নিলব্জা নার্সিংহোম এর বিছানায় শুয়ে তার সন্তান এর দিকে তাকিয়ে দেখে কি সুন্দর হাসি মুখে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ও পৃথিবীর আলো দেখতো না যদি না ও ডাক্তার বিশ্বাস এর মতো মানুষ না থাকতো।
রোজকার জীবনে ঘরে বাইরে ছোটার সময় ছেলেদের সাথে পাল্লা দিয়ে,যে জীবন টায় মা হবে বলে এক্সট্রা কেয়ার সব মেয়ে রা পায়, নিলব্জা কারো কাছে সেটা আসা করেনি। খারাপ রাস্তা ,এমনকি বৃষ্টি তে এঁটেল মাটির রাস্তা তে তার কয়েকজন সহকর্মী র সাথে পড়ে যাবার ভয়ে লাঠি নিয়ে হেঁটেছে, শুধু পেটের সন্তান টা যেন ঠিক থাকে। দোতলা তিনতলা ভেঙ্গে ক্লাস নিতেও হয়েছে। কারণ মুখে আহা ওহ করার লোক থাকলেও পিছনে কিন্তু বলবে মাইনে তো কম নেয়না ,তাহলে এত সুযোগ বা কেনো নেবে।
মা হওয়া যে কি কষ্টের তাদের যারা ওই অবস্থায় রোদের মধ্যে জল আর খাবার নিয়ে আধপেটা খেয়ে, অজ পাড়াগাঁয়ে র পড়াতে ছোটে,যেখানে গাড়ি নেই, হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। মনের জোর ই সম্বল করে এগোয়, সুস্থ সন্তান কে পৃথিবীর আলো দেখাবে বলে।
সুস্থ সন্তান,কথাটা ডাক্তার অশোক বিশ্বাস এর থেকে শিখেছে , যখন ও আল্ট্রাসোনোগ্রাফির রিপোর্ট নিয়ে গিয়ে বলেছিল মেয়ে হলে খুশি হবো, উনি শুধু বলেছিলেন "সুস্থ সন্তান চাও"। ওনার কাছে দেখাতে গেলে অনেক্ষন গল্প করে বোঝাতেন অনেক ঘটনা নিয়ে,তাতে মনের জোর পেতো ও। তারপর কোনো অসুবিধা হলে ফোন করলেও সমস্যা সমাধান করে দিতেন। এর জন্য ডাক্তার বিশ্বাস কে ও ওর একজন ত্রাতা মনে করতো।
অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা সহ্য করে নিলব্জা বড়ো হোয়েছে, তাই এই জীবনে প্রচুর মানুষ এর সাথে তাকে মিশতে হয়েছে,তার বিশ্বাস এর সুযোগ নিয়ে অনেকে কাদা ছিটিয়েছে । তাই এখন সবার সাথে মিশলেও জীবনে সবাই কে সে মনের মধ্যে সম্মানের স্থানে এ রাখেনি।যে কয়েকজন মানুষ সেই জায়গায় ,তার মধ্যে ডাক্তার বাবু একজন,তাই একদিন দরকার এ ওনাকে ফোন করতে,কেমন আছেন ডাক্তারবাবু বলতে কলকাতার এক নার্সিং হোম এ শুয়ে ও বলেছিলেন .....ভালো নেই রে,আন্জিও হোয়েছে। শুনে নিলব্জা র পায়ের নিচের মাটি সরে গেছে মনে হয়,মাথার ওপর আকাশ টা নেই মনে হলো, ও ঈশ্বর কে ডেকেছিল। একটাই কথা বলেছিল ও...আপনি সুস্থ হয়ে যান তাড়াতাড়ি, আপনি না থাকলে আমাদের কি হবে। তখনও উনি বলেছিলেন ..এবার থেকে একটু সাবধানে থাকবো। তখনও কি দরকার জিজ্ঞেস করেছিলেন ও সমাধান করার জন্য নম্বর দিয়েছিলেন একজন ডাক্তার এর। এমন মানুষ কে মানুষের উর্ধ্বে না বসালে কাকে বসাবে।
আজ তার সন্তান ও বাঁচতো না। রীতিমতো গর্ভের সন্তান মুভ করছে না খেয়াল হতে, ও রাত ৯টা নাগাদ ফোন করে। উনি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করতে বলেন । বাড়িতে কেউ না থাকায় ও আর ওর মা বোন সব জায়গায় পাগলের মত ফোন করে কোনো সুরাহা করতে পারেনি,কারণ সরকারি ছুটি ছিল। ওই অবস্থায় সারা রাত ই উনি যোগাযোগ রাখার পর সকাল হতেই চলে আসতে বলেন । আর নার্সিং হোম এ যেতেই সঙ্গে সঙ্গে উনি এসে অপারেশন থিয়েটার এ নিয়ে যেতে বলেন । আর তৈরি হয়ে যখন অপারেশন করে,নিলব্জা অর্ধ অচৈতন্য অবস্থা য় শুনতে পান,কি রে মা,কষ্ট হচ্ছে, এনেস্থেটিস সেন বলেন আরে তোর বাচ্চা তো বামুনের পৈতে জড়িয়েছে।
ডাক্তার বিশ্বাস বলেন যে আর বেশিক্ষণ থাকলে অক্সিজেন এর অভাবে অন্য রকম হতো। তখন মনে মনে ও বলে সত্য যদি আপনি না থাকতেন তার সন্তান সুস্থ হয়ে জন্মাতো না। মনে মনে ঈশ্বর কে ডাকে ও ।
প্রথম পৃথিবী তে এসেছি জানান দিচ্ছে তার সন্তান তারস্বরে কেঁদে । একটু পরে আর একটা পরিচিত কণ্ঠ তার পাশে এসে বলেন যে আমার মতই হলো বুঝলে । গলা টা তার চেনা, ডাক্তার দে... নিলব্জা একটাই কথা বলেন ও সুস্থ তো? মা হিসেবে ওর আর কিছু চাওয়ার নেই। সারা রাত উৎকণ্ঠা ,ওকে বাঁচাতে পারবো তো, শুধু ডাক্তার বিশ্বাস এর ওপর ভরসা ছিল। তাই এই যাত্রায় ও সন্তান কে বাঁচাতে পারলো। ও দেখেছে ওর এক পরিচিত কে ডাক্তার এর গাফিলতিতে কিভাবে ন মাস গর্ভে ধারণ করার পর সন্তানের মুখ দেখতে পারেনি। এই কষ্ট মা ছাড়া কেউ বোঝেনা।
পরের দিন হাসি মুখে উনি যখন দেখতে আসেন তাকে, অন্তর থেকে ও ধন্যবাদ জানালো ওনাকে। একটাই কথা বললো ডাক্তার বাবু ওকে আশীর্বাদ করুন যেনো আপনার মত মানুষ হয়।
এমন ডাক্তার রুপী ভগবান রা আছেন বলেই হইতো মানুষ বাঁচে। যে সব আর্থলোলুপ ডাক্তার রা মানুষের জীবন নিয়ে যে ব্যবসা করে , গ্রামের সরল মানুষগুলো কে নরক হাসপাতাল গুলো তে কুকুর বিড়ালের মত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় , তাদের ডক্টরস ডে তে শুভ চেতনা হোক । আজও এমন ডাক্তার আছেন, যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের জন্য ছুটে চলেন সেই সব ডাক্তার দের কুর্নিশ।
রচনাকাল : ৩০/৬/২০২০
© কিশলয় এবং নন্দিতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।