টলোলিং এ যুদ্ধ স্মৃতি স্মারক এর সামনে কার্গিল দিবসে এসে কর্নেল জয়ন্ত র চোখ টা ঝাপসা হয়ে এলো, স্মৃতির স্মরণিকা বেয়ে খন্ড খন্ড চিত্র ভেসে উঠলো।
যে পাথর টা তার সামনে,তার ওপর জ্বলজ্বল করছে যে নাম টা , লেফটেন্যান্ট মনোজ, 47 রাইফেল বাহিনী , 4875 শৃঙ্গ জয় করতে সক্ষম হয়েছিল যখন, মনোজ এর ভূমিকা ছিল অপরিসীম।শেষ দিন ও মনোজ ওর সঙ্গে ছিল।সহকর্মী,সহমর্মী বলতে যা ওকে বলা যায় ও তাই ছিল। অকুতোভয় ,নির্ভীক ,দেশ মাতৃকার সেবায় নিবেদিত প্রাণ।প্রথম যখন ও কার্গিল সীমান্তে পোস্টিং পায় ,তখন পরিবেশ যে কি কঠিন - বুঝেছিল।লাদাঘ সীমান্তে এসে আর ও সেটা উপলব্ধি করেছিল এই ভয়ঙ্কর সুন্দর এর রূপ ।ভূগোল এ র ভাষায় শীতল মরুভূমি,ভারতের শীতলতম স্থান লাদাঘ।
মাইনাস ৬০ ডিগ্রী উষ্ণতা -য় ও দেখেছে সবাই সেটা কে তুচ্ছ করে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা য় তাদের কর্তব্য করেছে। কখনো রাস্তা করে,কখনো ধ্বস সরিয়ে...আর মুহূর্তে মুহুর্তে পাকিস্তান এর হুংকার শুনে কত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে যে ষষ্ট ইন্দ্রিয় খাড়া করে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তারাই জানে।
সেই রাতের কথা কর্ণেল এর মনে পড়লো তার একটা কাঠের পায়ের দিকে চোখ পড়তে ,রাতে সবাই খেয়ে ঘুমাতে গেছিল,সারাদিন অস্থিরতা ,সীমান্ত সমস্যা ,যুদ্ধ কালীন তৎপরতা সবই ছিল ,কিন্তু ১৯৯৯ সালের সেই রাত...অতন্দ্র প্রহরী ওরা ,জানতে পারলো কাশ্মীর এর বিচ্ছিন্নতাবাদী দের সহায়তায় পাকিস্থানি ফৌজ ,কাশ্মীরি জঙ্গি আশরাফ রশিদ এর নেতৃত্বে পাক ভারত সীমান্তের ডি ফ্যাক্টো নিয়ন্ত্রণ রেখা দিয়ে ঢুকে পড়েছে।সেনা বাহিনী তৈরি ছিল।দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় কামান ,ট্রাঙ্কার নিয়ে ভারতীয় বাহিনী তৈরি ছিল,লেফটেন্যান্ট মনোজ এর নির্দেশে যুদ্ধ শুরু ও হই।তিমির যে কত নিবিড়,তাকে সেনারাই জয় করতে পারে। জোজিলা পাস এর কাছে 4355 পয়েন্ট এ ভারতীয় কমান্ডার সোনাট গৌরভ এর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনীও বীর বিক্রমে পাকিস্থানি সেনাদের পাল্টা আক্রমণ করে।পাক আঘাতে চোখের সামনে চেনা ছেলে গুলো ভারত মায়ের ঋণ শোধ করে চলে গেলো। সমস্ত রাত এই ভাবে চললো।। বিমান বাহিনী ও আকাশ পথে আক্রমণ করে কিছুটা পাক বাহিনী কে পর্যুদস্ত করে। হঠাৎ একটা আগুনের বল তার উরু ভেদ করে চলে গেলো কারণ সেদিন সে সেনাদের লাইনম্যান এর ভূমিকায় ছিল সবার আগে।মনোজ তার হাত টা শক্ত করে ধরেছিল কিন্তু আর কিছু মনে নেই ।
পরের দিন হবে হয়তো,সেনাবাহিনীর মৃতের স্তুপে তার আঙ্গুল নড়ছে দেখে সেনা ডক্টর চন্দ্রাকর তার কাছে ছুটে আসে ,জল ও প্রয়োজনীয় কিছু দিলে অনেক কষ্ট এ চোখ মেলেছিল।কিন্তু পাশে সব ছাওনির ভাইদের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করেছিল,যাদের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে ,নিকট পরিজন ছেড়ে চব্বিশ ঘণ্টা কাটিয়েছে ,তাদের দিকে তাকাতে পারলনা ।কিন্তু একটা মুখ তার চেনা মনে হতে তাকিয়ে দেখলো তার পাশে মনোজ,যার হাত ধরে সে অজ্ঞান হয়ে গেছিল।আজ বুঝেছে তাকে আড়াল করে মনোজ সামনে এসে তাকে বাঁচিয়েছিল।মানতে পারছিলো না এটা।শুধু ডাক্টার কে জিজ্ঞেস করেছিল ভারতীয় বাহিনী কত দূর এগোলো।
সেনা হাসপাতালে তার পা গ্যাংগ্রিন হওয়ায় বাদ দিতে হবে শুনে যত কষ্ট হয়েছিলো ,সেনা বাহিনী র এগোনোর খবরে সে আনন্দ বেশি পেয়েছিল।সেনা রা জানে পাকিস্তান সব সময় ভারতে র অংশ লে,লদাঘ,শ্রীনগর কে পাকিস্তানের অংশ করতে চায়।প্রাণের বিনিময় এ তারা পারবে না ভারত মাকে খণ্ডিত করতে।কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের মধ্যেই পাক জঙ্গিরা সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকে।কখন যে কোথা থেকে বিপদ আসবে তার অজানা।
মনোজ এর তৎপরতা -য় এমনি এক পাক জঙ্গি সংগঠন এর নেতা সহ সাগরেদ রা ধরা পড়ে।যখন তাকে পুরস্কৃত করা হবে বলে বলা হয়, ও বলেছিল ---এই পুরস্কার আমি চাইনা।আমি নিজেকে সেদিন ই পুরস্কার এর যোগ্য মনে করবো , যেদিন পরমবীর চক্র পাবো।
পেয়েছিলো," পরমবীর চক্র" মৃত্যুর পর।সেটা নিতে ওর মা এসে ছিল।সঙ্গে ওর নব বিবাহিতা স্ত্রী,যে পরে মহিলা বাহিনীতে নিজে থেকে এগিয়ে এসে যোগ দিয়েছিল। এবং বলেছিল মনোজ এর মৃত্যুর যোগ্য জবাব সে দেবে।মাথা আপনা থেকে এই মায়েদের জন্য নত হয়ে যায়।মনোজ এর মা কে প্রণাম করতে গেলে তিনি মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন আমার এক ছেলে শহীদ হলে ও আর এক ছেলে আছে। জয়ন্ত এর মা ছিল না।মনোজ তাই বাড়ি থেকে এলে বলতো ,মা জয়ন্তর জন্য নারকেল নাড়ু পাঠিয়েছে ও নাড়ু ভালোবাসতো বলে।শুধু সে নয়, দ্রাস সেক্টর এর সবার জন্য তিনি পাঠাতেন। হম মনোজ এর সাথে সখ্যতা ছিল কারণ বাটালিক সেক্টর থেকে দ্রাস ,সব জায়গায় তাদের একসাথে পোস্টিং ছিল।একদিন ধুম জ্বরে সারা রাত মনোজ নিজে পাশে জেগে তার সেবা করেছিল।তাকে সে কোনদিন ভুলতে পারবে না।
বিজয় দিবস এ তাই সে প্রতি বছর টলোলিং এ আসে মনোজ শুধু নয়,তাদের হাজার সহকর্মী কে খুঁজে পেতে,যাদের নাম গুলো কার্গিল যুদ্ধ স্মরণ স্মারক এ জ্বলজ্বল করছে।প্রাণ থেকে তাদের কুর্নিশ করতে আসে কাঠের পা নিয়ে।
হঠাৎ কেউ তার জামা ধরে টানতে তাকায়,দেখে গোলাপ নিয়ে ছোট ছেলে
দাঁড়িয়ে আছে।হেসে তার হাতে দিতে মুখ তুলে দেখে চৌকিদার রহমত আলী র স্ত্রী সুকিনা ভাবী,বুঝতে অসুবিধা হয় না ছোট ছেলেটা কে,যে বাবা কে দেখার আগে ই তার বাবা শহীদ হোয়েছিলো ।দ্রাসে প্রথম শহীদ রহমত ।গোলাপ টা নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করেছিল ,বেটা বড়ো হলে কি হবে?উত্তর টা শুনে স্তম্ভিত হয়েছিল..."বাবার মত সেনা"... তাকিয়ে আদাব করেছিল সুকিনা ভাবী কে,সব যার চলে গেছে দেশ মায়ের সেবায় ,সে কিন্তু সেই কাজে নিজের ছেলে কেও কাজে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে,এমন মা কে কুর্নিশ না করে পারে না।ভারত মায়ের এই সব বীরাঙ্গনা মায়েরাই, এমন বীর সেনা দের জন্ম
দেয়।
এত বছর এসেছে,এই বিজয় দিবস টা এক অন্য বার্তা নিয়ে তার জীবনী শক্তি কে দীর্ঘায়িত করলো। হম্ সে এখনও সেনা বাহিনী র কাজে নিয়োজিত। উপদেষ্টা কমিটি তে নিজেকে বহাল রেখেছে কারণ তার ও অনেক দেওয়ার আছে দেশ কে।দেশ মা কে যে প্রাণের বিনিময় এ রক্ষা করতে হবে।
##কার্গিল যোদ্ধা লাইন ম্যান দেবব্রত দাস এর দ্রাস সেক্টর এ নিজের যুদ্ধজীবনের কাহিনী ও কিছুটা কল্পনা মিশ্রিত গল্প,নাম পরিবর্তিত।##
রচনাকাল : ১৬/৭/২০২০
© কিশলয় এবং নন্দিতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।