মিতুনের বাবুসোনা।
মুসকান ডালিয়া। (জাহানারা)
---
বাবুসোনা আমায় কোলে নেবেনা?
বাবুসোনা- আজ আমি তোমার কাছে ঘুমাবো।
বাবুসোনা - তুমি আর বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছনা কেন? কেনই বা একা একা অন্য ঘরে আছ?সব পাঁচ বছরের মিতুনের কথা --তার বাবার উদ্দেশ্যে। হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল রেহানের। একটু পরেই আসবে সুহানি। কাঁচের দরজার ওপাশ দিয়ে জলে ভেজা বড় বড় ডাগর দুটো চোখ দিয়ে দেখবে। আজকাল সুহানির মুখখানা কত্ব শুকিয়ে গেছে। মৃদু হাসি মুখে মেখে রাখার বৃথাই চেষ্টা ওর। সর্বদা ভয় এই বুঝি কোভিড ১৯ কেড়ে নিল তার স্বামীর প্রান।
মিতুনের জন্ম হয়েছিল নয় মাসের আগে। রেহান নিজেই ডাক্তার। তবুও তার সামনে সুহানি প্রসবযন্ত্রনায় কষ্ট পাবে সেটা কি করে রেহান সহ্য করবে। তাই ডক্টর লগ্নজিতাকে বলে রেখেছিল সুহানির ডেলিভারি করানোর জন্য। কিন্তু তার কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আচমকা প্রসব বেদনা আর সময়ের আগেই সুহানি তার বেবির জন্ম দিয়েছিল বাড়িতেই। আর সেই শিশু পৃথিবীর মুখ দেখেছিল রেহানের হাত ধরেই। যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল রক্তাক্ত সুহানি। সদ্যোজাত মিতুনকে কোলে নিয়ে একসাথে সফল বাবা আর সফল ডাক্তার হবার সৌভাগ্য পেয়েছিল রেহান। তারপর কেটেছে চারটি বছর স্বপ্নের মতো। রেহান আর সুহানীর বেঁচে থাকার রসদ হল মিতুন। সারাদিন পর বাড়ি ফিরলে মিতুনের ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরা, মায়ের মতো করে বাবুসোনা বলে ডাক দেওয়া, মিতুনের গায়ে বেবি পাওডারের মিষ্টি মিষ্টি বেবি গন্ধ, রাতের অন্ধকার আকাশের নিচে মাদুর পেতে শুয়ে অরুন্ধতী নক্ষত্র, সপ্তর্ষিমণ্ডল চেনা, ঠাকুমার ঝুলি উজাড় করে রুপকথার গল্প শোনা সবই ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ করে পৃথিবীর বুকে নেমে এলো অভিশাপের কালো ছায়া। কোভিড ১৯ ছড়িয়ে দিলো আতঙ্ক, মৃত্যুভয়।
রেহান নিজে ডক্টর। তাই তাকে বাড়িতে বসে থাকলে চলবে কেন? কয়েক মাস ধরেই সে বাড়ির বাইরে। সারাদিন সারারাত অক্লান্ত পরিশ্রম। সারাক্ষণ রুগীর সাথেই সহবস্থান। এই প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমে সারা শরীরে ভাইরাসপ্রুফ জ্যাকেট। শরীরের ভিতরটা জ্বলে পুড়ে যায় যেন। চোখে মোটা চশমার আচ্ছাদনে চোখের দুপাশে গভীর দাগ। মুখে মাস্কের দাগ রগরগ করছে।
এবার দীর্ঘ পনেরো দিন পর বাড়ি ফিরেছে রেহান। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে। দুর থেকে দেখছে সুহানি। ছোট্ট মিতুনের বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়ে সে কি কান্না! " তবুও অসহায়ের মতো দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে রেহান। চোখ দিয়ে ঝরছে অকাল শ্রাবণ। কান্নাভেজা চোখে মেয়ে বুকে করে বুঝিয়ে চলছে সুহানি। -- "মিতুন সোনা, তোমার বাবুসোনা যে সুপারম্যান। তাকে অনেক এনিমির সাথে ফাইট করতে হয়। তাই এখন তার কোলে যাওয়া যাবেনা।" মেয়েকে গল্প বলার অছিলায় ঘরে নিয়ে যায় সুহানি।
বাড়ি ফিরেই ওয়াশরুমে আসে রেহান। সেখানে বড় আয়নার সামনে দাঁড়ায়। খুলে ফেলে ভাইরাসপ্রুফ জ্যাকেট। মুখের মাস্ক, চোখভরা বড় চশমা। দেওয়ালে লাগানো বড় আয়নায় দেখতে পায়- তার ফর্সা মুখখানি গরমের তাপে লাল হয়ে গেছে। দানা বেঁধে উঠেছে গালময়। চোখের কোলে রাতের পর রাত জেগে থাকার ক্লান্তি। কন্ঠার হাড় উঁচু হয়ে আছে৷ চোখ যায় নাকের পাশের তিলটায়। ভীষণ পছন্দ এটা সুহানির। কত অগুনতি চুমুর বৃষ্টিতে সিক্ত হয়েছে এই তিল। কিন্তু আজ চাইলেও আর ছোঁয়া যাবেনা সুহানিকে। হাজার ইচ্ছা হলেও আর সুহানিকে বুকে জড়িয়ে মিশে যেতে পারবেনা তার মাখনরঙা শরীরের কোমল গভীর উপত্যকায়। আজ চাইলেও পারবে না তারই অংশ তার মিতুনকে বুকে নিয়ে ঠাকুমার ঝুলি থেকে ভুত পেত্নী দত্যি দানো বার করে আনতে। মিতুন এখনো চুপ করেনি। চার বছরের ছোট্ট শিশুটির কান্নার আওয়াজ এখানেও ভেসে আসছে। সে বলে চলছে- "মাম্মাম, ছাড়ো আমায়। আমি বাবুসোনার কাছে যাবো। আমি বাবুসোনার কাছে ঘুমাবো।" বুকের ভিতরটা বড় হাহাকার করে ওঠে রেহানের। আদরের পুতুলটাকে সে চাইলেও আজ আর বুকে জড়িয়ে নিতে পারবেনা। হাঁটুতে মুখ গুঁজে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে রেহান।
কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে গেছে ছোট্ট মিতুন। দরজা খুলে দাঁড়ায় সুহানি। রেহানের রুমের দিকে চোখ পড়ে। সে তার দরকারী জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে। এবার বেরিয়ে যাবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। কতদিন ওই চওড়া বুকে মাথা রেখে ঘুমায়নি সুহানি। কতদিন নিজের পাশে বসিয়ে খেতে দেয়নি রেহানকে। কতদিন আর কতদিন!!! ওগো স্রষ্টা - এবার সব স্বাভাবিক করে দাও। কান্নায় ভেঙেচুরে যায় সুহানির বুকের ভিতরটা।
আজ কাঁচের দেওয়ালের ওপাশে রেহান শুয়ে। কোভিডের বিষ ছড়িয়েছে তারও শরীরে। মিতুন আর সুহানিও কোয়ারেন্টাইনে ছিল ১৪ দিন যাবত। আজ আবার তারা এসেছে রেহানের কাছে। রেহানের অবস্থার আরো অবনতি হয়েছে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট। কোভিড গ্রাস করে নিয়েছে আরও এক ঝকঝকে যুবকের প্রান। একটা সময় স্থির হয়ে যায় রেহান। দরজার পাশে কান্নায় আছাড়ে পড়ে সুহানি। চার বছরের মিতুন শুধু অবাক হয়ে দেখছে- সাদা চাদরে আচ্ছাদিত তার বাবুসোনা স্থির শুয়ে আছে কাঁচের ওপাশে।
এমন সময়ই নড়ে উঠলো রেহানের একটা হাত। ছুটে সেদিকে গেলেন ডক্টর সৌম্য। রেহানের বাল্যবন্ধু। না, এখনো প্রান আছে রেহানের। কোভিড পরাজিত হয়েছে চার বছরের এক মিষ্টি শিশুর মায়ের আকুল কান্নায়। আবার শুরু হয় চিকিৎসা। সুস্থ হয় রেহান। প্লাজমা ডোনেট করে বহুদিন পর বাড়ি ফেরে। মিতুন এসে বুকে জড়িয়ে ধরে তার বাবুসোনাকে। পরম স্নেহের আদরে রেহানের বুকে আজ পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যায় মিতুন।
দীর্ঘ চুয়াত্তর দিনের ব্যাগ্র প্রতীক্ষার পর রাতের গভীরে স্বামীর বুকে ডুবে যায় সুহানি। দীর্ঘ আদরে সিক্ত করে বলে-" তুমি আর যেওনা কাজে। তোমার কিছু হলে কি নিয়ে বাঁচবে তোমার মিতুন আর সুহানি?
সুহানির মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেয় রেহান। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলে- যেতেই হবে সুহানি। আমি যে ডাক্তার।"
বিঃদ্রঃ --
(অভিনেতা অভিনেত্রী দের আমরা হিরো, হিরোইন হিসাবে জানি। কিন্তু আমাদের সুপারহিরো তারাই যারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে। গল্পটা থেমে যেতে পারতো রেহানের মৃত্যু দিয়ে। কিন্তু মৃত্যু নয়, যারা আমাদের জন্য এত বলিদান দিচ্ছেন। (ডাক্তার, নার্স, ফৌজি) সেই সুপারহিরোগন বেঁচে থাকুন। সুস্থ থাকুন। স্যালুট জানাই তাদের।)
রচনাকাল : ৩০/৬/২০২০
© কিশলয় এবং মুসকান ডালিয়া কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।