যাদের কাছে আমি অপরিচিত তারা জানেনা আমি একটা চোর ।
আর যাদের পকেট ব্লেড দিয়ে কাটতে গিয়ে ধরা পরি, তারা জানতে পারে ।
কিন্তু যারা আমাদের মতই তারা জানে "আমি কেন চোর" । সবাই জানে
এটা ভুল, আমরাও জানি ও এটা ভুল । অনেক সময় ভুল আর ঠিক এর
বিচার করার যোগ্য শুধু ঈশ্বর । তিনি বিচার করেন ও । আজ আমি যার
মরা পোড়াতে এসেছি,তার প্রতি একটা দারুন বিচার করেছেন তিনি । কানাই
আমার বন্ধু । হাঁ ,ও ও একটা চোর । আজ সকালে বিনয়হাটির ঘুটেপোড়া
গ্রামে গনপিতুনিতে মরা ওর লাশটা নিয়ে ফিরেছে পুলিশ । আমি এখন ও
একটু ও কাদিনি , আমার একটু ও ভয় পাচ্ছেনা । আমার খুব রাগ হচ্ছে ,
প্রতিদিন ই হয় ।
সন্ধ্যে সাতটা বাজলো । কানু যদি ফিরতে দেরি করে আজ বত-তলা পর্যন্ত
যে ওর সাথে যাবার কথা আছে সেটা আর হবেনা । ও হসপিটাল এ ওর
মায়ের সাথে দেখা করতে গেছে আর বলে গেছে সাতটা বেজে গেলে আর
অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যেতে । আমি নিউসিটি-র দিকে যাবো কোন নতুন
তৈরি ফ্লাট এ রাখা ওয়িরিং তার চুরি করতে । সবাই জানে আমি ওখানে
নাইট ডিউটির চাকরি করি, আজ সকাল পর্যন্ত কানাই ও তাই-ই জানতো ।
আর ও ঘুটেপোড়া গ্রামে মুখুজ্জে বাড়িতে চুরি করার প্লান করেছে । আজ
ওর প্রথম চুরি । যাদের সামান্য বৃষ্টিতে ভিজলে সর্দি করে তারা কানুর কষ্টটা
কোনোদিন বুঝবেনা । চুরি করলে ওর মা বেঁচে থাকবে ।
ফুটবল টায় হাওয়া কম আছে , বিশু ওটা নিয়ে গেছে । তাই মাঠে বসে ,
রাস্তার দিকে চোখ যেতেই কানুকে দেখতে পেলাম । ওর তারাতাড়ি ফেরার কথা
জিজ্ঞেস করবো তার আগেই " রিয়াজ তুই আমায় কত টাকা ধার দিতে পারবি
এই মুহূর্তে ?" ও প্রশ্ন করে বসলো । "আমার কাছে নয়শো আছে কুড়িয়ে
কাড়িয়ে । কেন বলবি ?" আমার কথাটার পরে পরেই ও অন্যমনস্ক হয়ে গেল ।
তারপর বলল "চল" , হনহনিয়ে ওর বাড়ি এলাম । রাস্তায় যা বলল তার
সারমর্ম কানাই এর মা এখন হসপিটালে, আর ওখান থেকে ফোন এসেছে , তিরিশ
হাজার টাকা নিয়ে শিগগির পৌছতে । কানাই একচালা ছোট্ট ঘরের সমস্ত কোনা
থেকে ঘেঁটে ঘুঁটে ও মোট দেড় হাজার টাকা বের করল । তারপর পাড়ার সবচেয়ে
ধনী মহিতবাবু থেকে শুরু করে ওপাড়ার মুদির দোকানের বিকাশ , সবার ই নাকি
সময় খুব খারাপ । কানাই বলল আর কোন উপায় নেই হসপিটাল থেকে একদিনের
সময় চেয়ে নিই , আজ রাতে আমি চুরি করবো । হসপিটাল এ গিয়ে আর
একবার মুখ থুবড়ি খেতে হল, ‘টাকা কাল দিলে , অপারেশান ও কাল ই হবে
যদি কাল পর্যন্ত বেঁচে থাকে ’ রিশিপ্সানিস্ট টা হয়তো সত্যি কথাই বলল । এটাই
হয়ত পৃথিবীর সবচেয়ে সত্যি কথা । পৃথিবীটায় মানুষ নামক পোশাকে ঢাকা
নোংরা জন্তুদের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ বোঝা গেলো জন্তুদের মাঝে
মানুষ হয়ে থাকাটা অসম্ভব । কানাই এর দিকে তাকালাম , এক মুহূর্তের জন্য
মনে হল আমার বুকের মধ্যে কোন যন্ত্রপাতি নেই , শূন্যের হাহাকার । আমি
ওকে আজ রাতে যতটা সম্ভব টাকা যোগার করে দেবার আশ্বাস দিলাম, তবু
পুরোটা পারবো বলে কালকের অপারেশান টার অনিশ্চয়তা বাড়ালাম না । ওকে
আমার সত্যি টা বললাম , আমি কোন অফিসে কাজ করিনা আমি চুরি করি।
ওর মুখের রেখাটার একটুও পরিবর্তন হলনা , বলল "একটা টর্চ জোগাড় করে
দিবি?"
আকাশের দিকে তাকালাম , শ্মশানের বিকালটা মাঠের বিকাল থেকে
কতটা যে আলাদা তা বুঝতে পেরেই দমটা বন্ধ হয়ে এল । আর এক ঘণ্টার
মধ্যে একটা চোরের দেহ নিঃশেষ করা হবে আগুনে , আর তারপর থেকে
সবাই শুধু চোর হিসাবে তাকে "মনে" রাখবে । একটা ঘৃণ্য চোর । কোথায়
ঝেন শুনেছি "মাছেরা জলে থাকে আর ভাবে জলটাই তাদের বিশ্ব – তার থেকে
বাইরের জগত কিছু হয়না " মাছেরা কথা টা মানুষ কে এসে বলেনি ;
মানুষ নিজে এটা ভেবে নিয়েছে । বিরোধ করতে মাছেরা আসেনি তাই মানুষ
জিতে গেছে । কিন্তু মানুষ জানেনা মাছেরা ওইটুকু জলে সাঁতার কাততে যত
আনন্দ পায় , হিংসুটে , স্বার্থপর , লোভী মানুষ প্রজাতি এত বড় পৃথিবীর
সব সম্পত্তি নিজের নামে করেও তার এক চিলতে সুখ পেয়ে ওঠেনা ।
তারা জানেনা তারা হেরে যায় ।
রচনাকাল : ৮/৭/২০১১
© কিশলয় এবং সাগীরুদ্দিন মণ্ডল কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।