- ঝড় হচ্ছে, এখন বাইরে যাসনা বাবু।
- কোথায় ঝড় ? একটু জোড়ে হাওয়া দিচ্ছে। তুমি দরজা জানলা বন্ধ করে বসে থাকো।
- বাবা, তোমার এই বদভ্যাসটা ছাড়ো এবার। দাদা কি বাচ্চা যে ঝড়ে উড়ে যাবে? একটু ঝোড়ো হাওয়া দিলেই ঝড় আসছে বলে বাড়ি মাথায় তোলো। গাছের পাতা নড়লো কি না বাবার সাবধানবাণীর পাঁচালী শুরু।
- ঠিক বলেছিস বোন। বাবা এত ভীতু মানুষ , ঝড় নিয়ে অদ্ভুত ফোবিয়া। মা ,তুমিতো বাবাকে একটু বোঝাতে পারো।আমাদের নিয়ে যেন এত না ভাবে। যথেষ্ট বড়ো হয়েছি আমরা। নিজের ইনিংসটা তো খেলে নিয়েছ, আমাদের বেলায় খালি রেফারিগিরি। বাবা, তুমি কি এতকাল ঝড়ে বেরোতেনা? তোমার এখন সুখের জীবন। রিটায়ার্ড পারসন। আমি সারা সপ্তাহ অফিস করি। রবিবার বিকালটা একটু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেবোনা? ঝড় ঝড় করে ঘরে বসে থাকবো? আমি বেরোলাম রে বোন ।
ছেলে বেরিয়ে যেতেই মেয়েকে ওঘরে চা দিয়ে অপা দুজনের চা এর কাপ হাতে ঘরে ঢুকে স্বামীকে বলল, "ওরা তো জানেনা এই ঝড়েই তুমি কি হারিয়েছিলে। ওদের ভুল বুঝোনা।"
নির্বাক সুজন যেনো আবারো সেই অতীতে ফিরে গেলো। ঐ তো দেখতে পাচ্ছে তার প্রথম স্ত্রী জিনিয়াকে। জিনিয়ার হাসি, প্রাণোচ্ছলতা। ওদের প্রেম ছিলো স্কুলজীবন থেকেই। কচি বয়সেই বাড়ির অমতে স্বয়ংনির্ভর না হতেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েচিল ওরা। বড়ো ভালোবাসতো একে অপরকে। কষ্টের মধ্যে দিন কাটতো। সামান্য আয়, কোনোমতে দিন গুজরান । কটা টিউশনের টাকায় ভাড়া বাড়িতে ভরপেট ভালোমন্দ খাওয়ার সামর্থ্য ছিলনা। তবুও একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ছিল অফুরান। জিনিয়া অন্তঃসত্ত্বা। অভাবের ঘরে অল্পবয়সেই মা ষষ্ঠীর কৃপা সুজনের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল। জিনিয়া খুব খুশি। মা হবেই সে। সুজন গর্ভপাতের জন্য জিনিয়াকে অনেক বোঝালেও জিনিয়া শোনেনি। সুজন মন থেকে খুব অপছন্দ করেছিল জিনিয়ার এই অবুঝ সিদ্ধান্তকে। মনেপ্রানে চাইছিল যদি, হ্যাঁ যদি নিজে থেকেই অ্যাবরশন হয়ে যায়। একটু গুছিয়ে নিয়ে বছর দুয়েক পরে সন্তাধারনের জন্য ভাবাই যেত। মুখে কিছু না বললেও জিনিয়ার উপর তখন ভালোবাসার জায়গায় রাগটাই বেশি ছিল সুজনের।
সেদিন মনোজদের বাড়ি থেকে জিনিয়ার সাথে রাস্তা দিয়ে আসার সময় হঠাৎ ঝড় উঠলো। সাথে মুষলধারে বৃষ্টি। একটুতেই জল জমে গেলো। একটা দোকানের সেডে অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে ওরা দুজন। একটু ঝড় বৃষ্টির ঝাপটা কমতেই গুটি গুটি পায়ে দুজন বাড়ির পথে। প্রাকৃতিক বেগ আসায় সুজন অন্তঃসত্ত্বা জিনিয়ার হাত ছেড়ে একটু সরে গিয়ে ধূমপান করার জন্য দেশলাই জ্বাললো। জিনিয়া আস্তে আস্তে রাস্তার ধার দিয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলতে লাগলো। ঐ তো আর একটু গেলেই গন্তব্যস্থল, বাড়ি। ঝড় বৃষ্টিও কমে গেছে। জল জমে আছে। হঠাৎ জিনিয়ার তীব্র আর্তনাদে সুজন ছুটে এগিয়ে এলো।আলোআঁধারিতে জিনিয়ার বিদ্যুত্স্পৃষ্ট শরীরটা ছটফট করছে। বিদ্যুতের তার ছিড়ে পড়ে জিনিয়া নিহত। হতভম্ব সুজন কিছু করতে পারলোনা। হতভাগা পরম প্রিয় স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলল ঝড়ের রাতে। সুজন তো বাচ্চাটা এখন চায়নি, তাই বলে ঈশ্বর জিনিয়াকেও নিয়ে গেলো? ঝড় তার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল। ঝড়ের পর আবার সবাই যেমন নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে আবার জীবনছন্দে ফেরে। সুজনও তাই করেছে। দ্বিতীয় বিবাহ। তবুও ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো পাবেই। কিন্তু সব কথা আপন রক্তের মানুষ হলেও নিজের সন্তানদেরও বলা যায়না। আর কিছু কিছু অপরাধবোধ সারা জীবন ধরে ভিতরে ভিতরে পুড়িয়ে মারে।
"এখন ঝড় থেমে গেছে গো। জানলাগুলো খুলে দিই?" অপার প্রশ্নে এ জগতে ফিরে এলো সুজন।
- কমে গেছে?
পাশের বাড়ির টিভি থেকে গান ভেসে আসছে,
"সাতমহলা স্বপ্নপুরীর নিভলো হাজার বাতি,
ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস..."
রচনাকাল : ২৮/৬/২০২১
© কিশলয় এবং অর্পিতা চক্রবর্তী কণ্ঠ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।