পৃথিবীটা গোল বলেই বোধহয় এত গোলমেলে, চেয়ে চেয়ে না পাওয়ার দলে আজ এত ভিড় । প্রত্যেকটা মানুষজনকেই বলতে শুনি, জীবনে যা চেয়েছিলাম তার কিছুই পেলাম না । চাওয়া পাওয়ার মাঝে এত ফারাক কেন? তবে কি মানুষের চাওয়ার পরিধি বেশি? নাকি পাওয়ার নেশাই মানুষের চাহিদা কে আরো বাড়িয়ে দেয় ?এর উত্তর খুঁজে পাই না। আজ পরিচিতির জগতে পরিপূর্ণ মানুষের নাম খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেলাম, প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনো ক্ষোভ লুকিয়ে আছে, ছোট্ট মানুষ ছোট্ট জীবনে তাদের নিজের মতন করে ঘর বর নিয়ে সুখী থাকতে চায়। আর সুখের দোর গোড়ায় অ-পাওয়ার নানা বেদনা তাদেরকে দৈনন্দিন জীবনে বড় হতাশায় পর্যবসিত করে। আজ লিখতে গিয়ে দেখতে পেলাম ভাগ্য মানুষকে অনেকখানি নিরাশায় পর্যবসিত করে।
চেয়ে পাওয়া মানুষের সংখ্যা কম। কম নয়, প্রায় নেই বললেই চলে।
গ্রামের মেয়ে লক্ষ্মী, ছোট থেকে অভাব-অনটনের মধ্যেই বড় হয়েছে। লোকের বাড়ি কাজ করে সাময়িক অভাব মিটিয়েছে। বড় হয়ে এটাই মনে মনে চেয়েছি সে, ছোটবেলাটা নানা কষ্ট দুঃখের মধ্যে দিয়ে কেটেছে, ভালো ঘরের সাধারণ ছেলে দেখে বিয়ে ঠিক হয়েছে ,এবার তার জীবনে চাওয়ার স্বপ্নগুলো বোঝার পূরণ হবে !
হাড়ভাঙ্গা খাটুনির মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ক্ষনিকের বিশ্রাম তার জীবনে বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল । এক জীবনের থেকে আরেক জীবনে প্রবেশের সাথে সাথে তার একটি স্বচ্ছলতার সাথে জীবন শুরু করার স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল পরের ঘরের জন্য আর নয়, এবার নিজের ঘর গুছোবে , নিজের ঘর পরিষ্কার করবে, নিজের সংসারে রান্নাবান্না করে সংসারকে সুখের করে তুলবে। প্রকৃতির সাথে বেড়ে ওঠা লক্ষ্মী জীবনে পূর্ণতা পাবে ,সোহাগ-আদর দিয়ে ভরা থাকবে তার জীবন।
কিন্তু পৃথিবীর আকৃতি গোল বলেই যত গোলমাল! ছোটবেলা থেকে সারা জীবন ধরে সাজিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো লক্ষ্মীর জীবনে স্বপ্নই রয়ে গেল ।
বৌভাতের রাতে সাপে কেটে মারা গেল তার বর প্রদীপ ।সেই প্রদীপের আলোয় লক্ষ্মীর আর আলোকিত হওয়া হলো না ।অলক্ষী বলে সংসার থেকে চিরকালের জন্য বিতাড়িত হলো। লক্ষ্মীর নামের সঙ্গে অলক্ষী কথাটা বেশ মানিয়ে গেল । না, লক্ষ্মী তার নামের পাশে কোন উপমা চায়নি, লক্ষ্মী চেয়েছিল ঘর-বর। প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়তি তাকে স্বপ্ন দিয়েছে, চাইবার অধিকার দিয়েছে, পাওয়ার দাবিদার করেনি ! তাই তার জীবনে পূর্ণতা পাওয়া আর হলনা।
বাপের সংসারের ঠাঁই হলো আবার । পরের ঘর গোছানোর কাজই তার ভাগ্যে আবার ফিরে এলো। নিজের ঘর আর গোছানো হয়ে উঠলো না ! এইভাবে এবাড়ি-ওবাড়ি কাজ করতে করতে সমাজের দাদাদের চোখে পড়ে গেল সে। বাইরে কাজ দেবে বলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি হয়ে গেল লক্ষ্মী ! পাঁচ হাতে ঘুরতে ঘুরতে তার দাম ও উঠল ভালোই ! যে লক্ষ্মী জীবনের কোন দাম পেল না, সেই লক্ষ্মী সমাজে ভালো দামে বিকিয়ে গেল !
আজ লক্ষ্মীর পরনে দামি দামি শাড়ি ! চুলে, গায়ে, মুখে প্রলেপ দেওয়ার নানা দামি দামি প্রসাধনী ! চোখেমুখে চকচকে সোনালী আভা ! গ্রামের "লক্ষ্মী" শহুরে "ঝিলমিল" হয়ে উঠেছে । লক্ষ্মী চেয়েছিল ভালো ভালো পোশাক পরতে, বড়লোকদের মত সেজেগুজে থাকতে, অনেক সোহাগ ভালবাসার বাঁধনে বাঁধা পড়তে, অভাব-অনটন কাটিয়ে সচ্ছলতার সঙ্গে বাঁচতে ।
আজ হয়তো লক্ষ্মীর সবই আছে, কিন্তু সত্যি কি লক্ষীর সব চাওয়া পাওয়ায় পরিণত হয়েছে ?সে যা চেয়েছিল তাই কি পেয়েছে? নাকি পাওয়ার মাঝে শুধুই হতাশা রয়ে গেছে?
লক্ষ্মী যা চেয়েছিল তা সে পায়নি কারণ লক্ষ্মী, লক্ষ্মী হয়েই থাকতে চেয়েছিল সে অলক্ষী হয়ে, "ঝিলমিল" হতে চায়নি।
রচনাকাল : ২৮/৬/২০২১
© কিশলয় এবং বাণী দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।