• ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১২১)

    ২০২১ , জুন



মায়ের স্বপ্নাদেশ
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : Shyamsundar Dutta


কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২৫ , অক্টোবর
প্রকাশিত ০ টি লেখনী টি দেশ ব্যাপী জন পড়েছেন।
"সকালের চা জল খাবারের পর্ব সেরে সুমন মুখার্জি ও তার স্ত্রী কনিকা দেবী দুজনে পাশাপাশি বসে টিভিতে খবর দেখছেন। দুজনেই কলেজের অবসর প্রাপ্ত শিক্ষক ও শিক্ষিকা। কনিকা দেবী গত বছর অবসর নিয়েছেন। বাড়ির কাজের মেয়ে লিপি ঘরের মেঝেটা ঝাঁট দিতে শুরু করেছে। এমন সময় সদর দরজার বাইরে একটি বাচ্ছা ছেলে চিৎকার করে বলে “ মা, খুব খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দাও না? 'মা' খুব খিদে পেয়েছে--------""

বাইরে থেকে কনিকা দেবী বাচ্ছাটির চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বলে “ লিপি, দেখ তো, কে ডাকছে?"" 

কাজের মেয়ে লিপি দরজা খুলে দেখে একটা বাচ্ছা ছেলে উস্কখুস্ক চুলে তার ছোটো বোনকে কোলে নিয়ে বলছে — “মা! আমার বোনের খুব খিদে পেয়েছে কাল থেকে কিছু খাইনি কিছু খেতে দাও না, মা?""
লিপি বলে, "" যা অন্য বাড়ি যা এবাড়িতে এখনো রান্না হয়নি।""

বাচ্ছা ছেলেটা কান্নাকাটি করে বলে "" মা, সব বাড়িতে একই কথা বলে তাড়িয়ে দেয়। একটু জলও কেউ দেয় না।""
কনিকা দেবী হাঁক ছাড়ে, "লিপি, কে রে?"

- এই দেখো-না? দুটো বাচ্ছা এসে বলে দুদিন খাইনি কিছু খেতে দাও 'মা'?

- ওদের সঙ্গে বেশি কথা বলার দরকার নেই। দরজাটা বন্ধ করে দে।

দরজা বন্ধ করে দিতেই বাচ্ছা ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, "এই দেখো! আমার বোনটা কেমন করছে?"

বাচ্ছাটার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সুমন ও কনিকা দেবী ছুটে এসে দরজা খুলতেই দেখে শিশু কন্যাটি নেতিয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতর এনে চোখে জলের ঝাপটা দিতেই চোখ খুলে তাকালো। শিশু কন্যাটির বয়স বছর চারেক হবে। আর ওর দাদার বয়স বছর ছয়েক। তারপর দুই ভাই বোনকে ঘরে এনে সেবা শুশ্রূষা করে ওদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে, সুমন জিজ্ঞাসা করে- "তোমরা থাকো কোথায়? তোমাদের নাম কি?"

স্ত্রী কনিকা দেবী বলে, "আশে পাশের কোন বস্তি বাড়ির বাচ্ছা হবে। ওদেরকে ঘরে না তুলে কিছু খাবার দিয়ে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যেত।"

স্বামী সুমন- "ঐ ছোট্ট শিশু কন্যাটির করুন অসহায় অবস্থা দেখে কি থাকা যায়? দেখে তো মনে হচ্ছে এরা ভালো ঘর থেকে এসেছে।"

বাচ্চাটা এগিয়ে এসে বলে- "আমার নাম রবি, আমার বোনের নাম সীমা। জানো, কাকু, আমার বোন এখনো ওর নামটা ভালো করে বলতে পারেনা।"

- ও তাই-নাকি? বাঃ! তোমার বোনটাতো দেখতে বেশ মিষ্টি, তোমাদের বাবা-মা কোথায়?

- আমাদের মা-বাবা কেউ নেই, আমাদের বাড়ি অনেক দূর সেই আনন্দ পুর গ্ৰামে।

- তোমরা এত দূর থেকে এই শহরে এলে কি করে?"

- আমি বোনকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। আমি আমার বোনকে খুব ভালোবাসি। বোনকে ছাড়া থাকতে পারি না। তাই আমার বোনকে সবসময় কাছে রাখি। আমার কাকা-কাকিমা খুব মারে কিছু খেতে দেয় না। বলে বাবা-মাকে খেয়েছিস
এবার আমাদেরকেও খাবি। এখান থেকে আগে দূর হ, চোখের সামনে থেকে। আমাদের গ্ৰামে পটল কাকুর চায়ের দোকান আছে, ঐ দোকানে সকাল সন্ধ্যাতে গ্ৰামের লোকেদের আড্ডা বসে, ওরা চা খেতে খেতে অনেক গল্প করে। আমাদের ডেকে ওরা বিস্কুট খেতে দেয়। কাকুরা নিজেদের মধ্যে গল্প করে বলে, দেখ, নিবারণ চক্কতীর এত বিষয় সম্পত্তি থাকতেও তার ছেলে মেয়েকে দুমুঠো খাওয়ার জন্য পরের কাছে হাত পাততে হয়। ভগবানের একি পরিহাস? নিবারণ চক্কত্তী ও তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর পুরো সম্পত্তি ভোগ করছে নিবারণের ভাই উমেশ চক্কতী। আর নিবারণের ছোট্টো বাচ্চা ছেলে ও শিশু কন্যাটি এখন রাস্তায় রাস্তায় খাবারের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্ৰামের এক কাকু পটল কাকুকে চা খেতে খেতে বলছে যত বড় লোক সব শহরে,আর গ্ৰামে সব গরীব চাষী আর দিন মজুর। শহরে ভাতের অভাব নেই। তাই শুনে রেল গাড়ীতে বসে বোনকে নিয়ে চলে এলাম এই শহরে। পেট ভরে খেতে পাব বলে। কিন্তু এখানেও-------!

- পটলকাকুর দোকানে গেলেই কাকিমা মারতে শুরু করে দেয়। বলে, পটলের দোকানে গেলেই ঠ্যাং ভেঙ্গে দেব। এত খিদে আসে কোথা থেকে শুনি? লোকে ভাবে আমরা কিছুই খেতে দিই না। কাঁড়ি কাঁড়ি গিলেই পটলের দোকানে। কেন? পটলের দোকানে গিয়ে হাত পাতিস বল? আবার ফের কোনো দিন যদি পটলের দোকানে দেখি------!
তারপরের দিনই বোনকে নিয়ে রেলগাড়িতে বসে-------।

পরের দিন সুমন আর কনিকা দেবী বাচ্ছাদুটোকে সঙ্গে করে থানায় হাজির। ঘটনার সমস্থ লিখিত বিবরন দিয়ে থানায় জানানো হয়। থানার বড়বাবু বলেন, “এদের বাবা-মা নেই , তার মানে এরা অনাথ শিশু, এদেরকে কোন অনাথ আশ্রমে পাঠানো যেতে পারে।"

সুমন- "ওদের বাড়ির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে না? যদি যোগাযোগ করা যায়, তাহলে ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়।"

সুমনের কথোপকথন শুনে ছেলেটি বলে, "বাড়িতে গেলেই কাকু-কাকিমা খুব মারবে, বাড়িতে আর যাব না। আমার বোন আর আমি তোমাদের কাছেই থাকবো।"

থানার বড়বাবু- "তাহলে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিন। দেখুন, আপনি কি করবেন? সেটা আপনার ব্যাপার। আমারা একটা মিসিং ডায়েরি নিয়ে নিচ্ছি। খবরের কাগজে এদের ছবি দিয়ে বিঞ্জাপন দেওয়া হবে। আর ওদের আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি দিন পনেরো-কুড়ির মধ্যে একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে।"

সুমন বাচ্ছা দুটোকে অনাথ আশ্রমে না দিয়ে থানা থেকে বাড়িতে নিয়ে চলে আসে। খবর চলে যায় সুমন ও কনিকা দেবীর মেয়ে রিয়ার কাছে। রিয়া গত দশ বছর হলো আমেরিকাতে আছে। রিয়া কয়েক বছর আগে বিয়ে করে নুতন সংসারও পেতেছে। কর্ম ও সংসারের কাজের ব্যস্ততায়, বাবা-মায়ের কাছে যাওয়া আসা খুব কমই হয়।

খবরটা শুনে রিয়া বলে, "তোমাদের যদি অসুবিধা না থাকে বাচ্ছা দুটোকে কাছে রেখে দিতে পার। বাচ্ছাদের সঙ্গে থাকলে মন ভালো থাকবে, তোমাদের ভালো লাগবে, সময়ও কাটবে।"

বাবা সুমন- "আমাদের কি আর বাচ্ছা মানুষ করার বয়স আছে? আজকাল বাচ্ছা মানুষ করা খুবই সমস্যা। তাছাড়া ছোটাছুটি করার বয়স আর নেই। ওদের জন্য অনাথ আশ্রমেও যোগযোগ করেছি। এখন ওদের আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের অপেক্ষায়------। "

বাচ্ছা দুটো আসার পর সুমন-কনিকার বাড়িটা যেন সবসময় বেশ জমজমাট হয়ে থাকে। শিশু কন্যাটির সঙ্গে সুমনের রোজ লুকোচুরি খেলা হয়। বাচ্ছা দুটির প্রতি আদর যত্নের ত্রুটি রাখে না মুখার্জি দম্পতি। অবশেষে মায়ার জালে জড়িয়ে পড়ে মুখার্জি দম্পতি। এভাবে আনন্দে খুশিতে দিন যায় মুখার্জি পরিবারের।

বাচ্ছা দুটো গ্ৰাম থেকে হারিয়ে যাওয়ার পর গ্ৰামের জনসাধারণ উত্তেজিত হয়ে কাকা উমেশ চক্রবর্তীর বাড়িতে চড়াও হয়।
“কৈফিয়ৎ চাই, কোথায় গেল বাচ্চা দুটো? কেউ বলে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। পাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা বলে ঐ শিশু দুটিকে রোজ ওর কাকিমা মারধোর করত। রোজই বাচ্ছা দুটোর কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। আজ পনেরো দিন হতে চলল বাচ্ছা দুটোর কোন খবরই নেই। কাকা উমেশের ভিতর কোনো দুঃখ অনুতাপ দেখা যাচ্ছে না। মৃত দাদার সম্পত্তি গুলো লুটপাট করে, জবর দখল করে খাচ্ছে। নিবারণ চক্রবর্তীর সম্পত্তির লোভে গ্ৰামের অনেকেই বাচ্ছা দুটোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে। বাচ্ছা দুটি এখন কোথায়?".….. খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে যায়।

এর প্রায় দু- মাস বাদে হঠাৎ সুমন মুখার্জির বাড়িতে আনন্দপুর গ্ৰাম থেকে দুজন লোক এসে হাজির। বলে খবরের কাগজে এই নিখোঁজ বিজ্ঞাপন দেখে আমরা বাচ্ছা দুটোকে নিতে এসেছি। উমেশ নিজের পরিচয় দিয়ে বলে “ওরা আমার ভাইপো-ভাইঝি হয়।"

রবি- উমেশ কাকুকে দেখে অন্য ঘরে লুকিয়ে পড়ে। শিশু কন্যাটিকে উমেশ কোলে নিতে গেলে অনিতা দেবীর কাছ থেকে যেতে চাই না। কাঁদতে শুরু করে দেয়। সুমন আবেগ জড়ানো গলায় বলে- “চলুন, থানায় চলুন, নিয়ম কানুন মেনে থানার বড়বাবুর নির্দেশ অনুযায়ী বাচ্ছা দুটিকে আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। আর আপনাদেরকে লিখিত আকারে দিতে হবে যে বাচ্ছাদের গায়ে কোনো দিন হাত তুলবেন না। এটা আইনত অপরাধ।"

রবি বুঝতে পেরে কাঁদতে শুরু করে। বোন সীমার কিছু বোঝার ক্ষমতা হয়নি, শুধু মায়া জড়ানো মুখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

থানায় যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সুমন হঠাৎ করে বলে বুকে যন্ত্রনা হচ্ছে। বুকটা হাত দিয়ে চেপে ধরে বসে পড়ে। ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে আসা হয়। ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তারবাবু দেখে জানান- “চিন্তার কোন কারন নেই। ব্লাড প্রেসারটা হঠাৎ করে খুব বেড়ে গেছে।"

কনিকা দেবী - “নিয়মিত প্রেসারের ওষুধ খাওয়ার পরও কেন রক্ত চাপ এত বেড়ে গেল?"

ডাক্তার বাবু বললেন- “উনার বয়েস হয়েছে, সঙ্গে মানসিক চাপও আছে। চিন্তার কোনো কারণ নেই, ওষুধ গুলো নিয়মিত খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।"

কাকুর কি হয়েছে বাচ্ছা দুটো কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। এরপর বিছানায় শুয়ে আবেগ জড়িত গলায় সুমন ছোট্টো শিশু কন্যাটিকে ডাকে, "আয় মা আয়, সীমা আমার কাছে আয়।"

অশ্রুভরা চোখে সুমন বলে “ আমি যে তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না-মা, আয় মা কাছে------। আমি যে মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়েছি। মা' স্বপ্নাদেশ দিয়ে বলেছেন আমি অনেক কষ্ট পেয়ে ঘুরে ঘুরে তোর কাছে আশ্রয় পেয়েছি। আমাকে তাড়িয়ে দিস না। আমার মা, আমার কাছে আবার ফিরে এসেছে। এই ছোট্ট মাকে বাড়ি ছাড়া করলে আমাদের সংসারে অমঙ্গল হবে।"

অবশেষে কাকা উমেশ চক্রবর্তী খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসে।
রচনাকাল : ২৮/৬/২০২১
© কিশলয় এবং Shyamsundar Dutta কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Canada : 4  China : 1  Europe : 4  France : 1  Germany : 1  India : 101  Ireland : 3  Japan : 3  Latvia : 1  
Romania : 3  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 11  Ukraine : 5  United Kingdom : 8  United States : 223  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Australia : 2  Canada : 4  China : 1  Europe : 4  
France : 1  Germany : 1  India : 101  Ireland : 3  
Japan : 3  Latvia : 1  Romania : 3  Russian Federat : 5  
Saudi Arabia : 11  Ukraine : 5  United Kingdom : 8  United States : 223  
  • ১১তম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১২১)

    ২০২১ , জুন


© কিশলয় এবং Shyamsundar Dutta কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
মায়ের স্বপ্নাদেশ by Shyamsundar Dutta is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১১০০৯৫০৭
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী
fingerprintLogin account_circleSignup