আমাকে বোধহয় তোর এখন আর ভালো লাগেনা। তাই না? বিশ্বাস কর, আমার এখনো সেই ইচ্ছে গুলো হয়। আগের মত । তোর হয়?
মনে হয়, কখন তুই এসে আমার বুকে ঘুমিয়ে পড়বি। কিংবা পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে এই বোধহয় জড়িয়ে ধরলি অতর্কিতে। এসব তো এখন অতীত । তাও, মনে পড়ে তোর ?
কে জানে । আমার তো খুব পড়ে।
আচ্ছা,তোর মনে আছে? বৃষ্টির দিনে ছাদে একসাথে নৌকা বানিয়ে ভাসিয়েছি কতদিন ।আমার সোনা, তোর কথাটাও ভাবতে হত তো আমায়। আমার ভীষণ বৃষ্টি ভিজতে ইচ্ছে করতো,জানিস? শুধু তোর কথা ভেবে নিজেকে আটকে রেখেছি কতবার। তোর যে ভীষণ ঠান্ডা লাগার ধাত। আমি চান করে এলে কি মিষ্টি করে এক একদিন আমার মাথা মুছিয়ে দিতি তুই।
তুই ছাড়া আমার আর কেই বা ছিল বল ?
তোর যখন জ্বর হত, ধুম জ্বর। মনে পড়ে? কষ্টে বুকটা ফেটে যেত আমার, সত্যি বলছি। তুই ঘ্যান ঘ্যান করতি আমায় উঠতেই দিতিস না। সারাদিন। বুকের মধ্যে মুখ গুজে পড়ে থাকতি। আমারও কাজকর্ম সব চুলোয়, অফিস কামাই করে সারাটা দিন তোর পাশে শুয়ে। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, চুমু খেয়ে দাও, কত্ত আবদার।
ছুটির দিনে কানে কানে ফিস ফিস- কাটলেট ,পকোড়া,বিরিয়ানি...বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি, বেগুনভাজা,উহ দাবির তো শেষ ছিল না তোর ।
তোকে পাতপেড়ে খাইয়েও যে কি ভীষণ রকম তৃপ্তি হতো আমার, সে শুধু আমি জানি।
নিজের থেকেও বেশি ভালবেসেছি তোকে। প্যারাসিটামল খেয়ে যখন ভোর রাতে ঘাম দিতো তোর, উফ্ শান্তি । হাঁফ ছেড়ে যেন জ্বর নামত আমার । এত্তগুলোদিন এত্তগুলো বছর একসাথে থাকার পর আজ এভাবে ভুলে যেতে পারলি?
আজকাল অফিস থেকে ফিরে একবারও আমার দিকে ফিরেও তাকাস না তুই। আমার সাথে কথা বলার সময় টুকুও নেই তোর? আমাকে ছুঁয়ে দেখিস নি কতদিন? বল্? দিন গুনিস?আমি গুনি।দিন গুনি রোজ রোজ।
তুই ছাড়া আমার কেইবা আছে বল? কেইবা ছিল? সেই তুই আজ....
তোর উপেক্ষা, অবজ্ঞা আমাকে বহুদিন ঘুমোতে দেয়নি। শুধু ভেবেছি আর নীরবে বালিশ ভিজিয়ে কেঁদেছি রাতে র পর রাত। কতদিন ঘুমোইনি ভালো করে। কিন্তু ভাবছি আজ পরম শান্তিতে ঘুম দেবো। অনেকটা ঘুম।
আমার এই আদর ভর্তি তোর প্রিয় (অতীতে)হাত দুটো ,ঘুমের ট্যাবলেটে ভর্তি। তুই - ই যখন পর করে দিয়েছিস, তখন পরের মেয়েকে আমি দোষ দিই না..খুব ভালো থাকিস।
আর কখ্খনো বিরক্ত করবো না তোকে। এই চিঠিটা তুই যখন পাবি, হয়তো ভাববি, কি সব হিজিবিজি লিখেছি। বয়সের দোষ বুঝলি। আমি যে এখন প্রাক্তন ।
- ইতি তোর মা
এই অব্দি লিখে ঘুমের বড়ি গুলো মুখে দিতে যাচ্ছিলেন সাবিত্রী দেবী ।
হঠাৎ ..
টিং টং। টিং টং ।
বেজে উঠল ডোরবেলটা।
টিং টং। টিং টং।
আবার।
অগত্যা ট্যাবলেটগুলো আর চিঠিটা টেবিলে রেখে দরজাটা খুলতে গেলেন সাবিত্রী। কোমরেও আজকাল ভীষণ ব্যথা।সারা গায়ে বাত। নড়তে চড়তে খুব কষ্ট হয়।
কি একটা ঘোর থেকে যেন আচমকা সম্বিৎ ফিরল তার..
দরজা খুলতেই...
পাশের পাড়ার তাতান। একে তো চেনেন সাবিত্রী। মিষ্টি গুবলু গাবলু বছর সাতেকের বাচ্চা ছেলেটা । দাঁড়িয়ে। হাতে লাটাই ।
- ও ঠাম্মা, ঠাম্মা তোমাদের ছাদে একটা ঘুড়ি কেটে পড়েছে গো? এইমাত্র দেখলাম ওটা উড়তে উড়তে ভোকাট্টা..তোমাদের ছাদে....আমায় দেবে ও ঠাম্মা? প্লিজ ....
ওই কচি গলার স্বর আর মিষ্টি শব্দগুলো কি যেন এক অদৃশ্য আদর করে গেল বাহাত্তরের বৃদ্ধাকে। চোখ দুটো হঠাৎই চিকচিক করে উঠলো তার।
নরম করে বললেন -আচ্ছা দেখি..চ।চ দেকি ছাতে।
তাতান কি খুশি।লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি তে উঠতে উঠতে বলল- ওটা পেটকাটি ঘুড়ি । জানো ঠাম্মা । আস্তে আস্তে এসো। হাতটা ধরবো?
ভালোবাসার লোভটা সামলাতে পারলেন না সাবিত্রী দেবী । কাঁপাকাঁপা কুঁচকানো হাতটা বাড়িয়ে দিলেন । অনেকদিন এরকম কেউ ছোঁয়না।বহুদিন ধরে তিনি হাতড়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন এমন একটা ভালোবাসা র হাত। পাগলের মত।
-ঠাম্মা। ও ঠাম্মা। তাতান টা বকবক করছে। কি মিষ্টি।
উফ আজ যেন ভুল করেই অনেকটা ভালোবাসা ঢুকে পড়েছে সাবিত্রী দেবীর ঘর -বাড়িতে ।
ইস কি ভীষণ ঘুড়ি ওড়াতে ইচ্ছে করছে সাবিত্রী র। ঘুড়ি হতে ইচ্ছে করছে। ঘুড়ি কাটতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে-অ্যাই তাতান,দে না, দে না লাটাই টা, দিবি?ধার দিবি?
একটু ঘুড়ি হয়ে ঘুরে বেড়াবো।
প্রাক্তন -প্রাক্তনীরা বড় কষ্ট পায় অবহেলায়।
এমন কেন হয় না হঠাৎ করে....ধরুন হঠাৎ করেই ভীষণ হাওয়া দিচ্ছে এখন । ভাবুন না ,ঘুমের বড়ি গুলো ইতস্তত ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। সাবিত্রী দেবীর সুইসাইড নোট টা হঠাৎ করে উড়ে পালিয়ে যাচ্ছে জানলা দিয়ে । তারপর হারিয়ে যাচ্ছে ,মিলিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত রাস্তায়।
আচ্ছা,ঠিক কতটা? ঠিক কতটা পুরনো হলে তাকে প্রাক্তন বলা যায়?
রচনাকাল : ৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।