সম্পাদক সমীপেষু
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখিকা : সান্ত্বনা চ্যাটার্জী
দেশ : India , শহর : কোলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৫ , নভেম্বর
প্রকাশিত ১৫ টি লেখনী ২৪ টি দেশ ব্যাপী ৭৪২২ জন পড়েছেন।
সম্পাদক সমীপেষু

আমি তো চাইনা 
তবু তুমি আস –
দরজায় কড়া নেড়ে ফিরে ফিরে যাও ।
মাটিতে কান পেতে রাখি ...।

এখানে ‘সারমেয়’ লিখব না ‘কুক্কুর’ লিখলে ভাল হয় , এ নিয়ে ভাবনায় পেনসিল চিবলাম কিছুক্ষণ । আমি কেন সারমেয়-র মতন মাটিতে 
কান পাতব, এর কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে পেলাম না । না: , নতুন করে শুরু করতে হবে লেখাটা । একটা লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিঠি 
লিখেছেন  হুগলী থেকে । চিঠি লিখেছেন বলাটা ভুল হবে, তিনি আমার আবেদনে সাড়া দিয়েছেন । মানে রীতিমত সাড়ম্বরে সাড়া দিয়েছেন। 
তাঁর পত্রিকার নাম ‘দ্বিব্রতী ‘ । বেশ নাম । কবিতার পত্রিকা বের করেন অনিয়মিত ভাবে , মানে যখন হাতে লেখা থাকে তখন বের হয়, 
এই আর কি । বেশ পত্রিকায় ঠিকানা পেয়ে আমি নিজেই একটি  চিঠি পাঠাই । আমার এখন সন্দেহ হয়, দেশ পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদক 
আমার মতন অর্বাচীনের প্রত্যহ একটি করে নেহাতই নিম্ন মানের কবিতার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যই এই লিটল ম্যাগাজিনের ঠিকানা প্রকাশ 
করে থাকবেন । তা সে কথা এখন থাক । এটি সেই চিঠির প্রত্যুত্তর । যাই হক সম্পাদকের চিঠি পেয়ে অত্যন্ত উৎসাহিত বোধ করছি । আমার 
পাঠান কবিতাটি তাঁর পছন্দ হয়েছে এবং আরও কিছু লেখার নিদর্শন নিয়ে দেখা করতে বলেছেন । তবে তাঁর দেখা করার জন্য নির্দিষ্ট স্থান এবং 
দেখা করার সর্ত আমাকে একই সংগে ভাবিত এবং সতর্ক করে তুলেছে । সম্পাদকের নাম ‘আলিঙ্গন চ... ‘।নামটা যেন কেমন কেমন, তা যাজ্ঞে, 
তবু তো আমার কবিতা পড়েছেন, আরও পড়তে চান, তা নামে আমার আপত্তি ছিলনা । কিন্তু তিনি আরও লিখেছেন যে তার বয়স উনত্রিশ, তিনি 
গৌরবর্ণ, এবং লম্বায় পাঁচ ফুট ন-য় ইঞ্চি । এবং তাঁর পরনে থাকবে হলুদ সার্ট, এবং নীল জিনস, এবং ডান হাতের কবজি তে বাঁধা থাকবে লাল 
রুমাল । তিনি কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউসের সম্মুখে বিকাল পাঁচটার সময় দাঁড়িয়ে  থাকবেন শনিবার, ৬ জানুয়ারি । চিনে নিয়ে ডেকে নিতে হবে । 
ডেকে নিয়ে তার পর কি হতে পারে সে বিষয়ে কিছু বলেননি অবশ্য । চিঠির প্রথমেই তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথেই লিখেছেন 
“আমার নাম আলিঙ্গন, আমার কাছে কেউ সান্ত্বনা চাইলে আমি কি না দিয়ে পারি!”। নিশ্চয় আমার কবিতার ভূয়সী প্রশংসা করবেন এমন একটা 
অমূলক ধারণ আমার মনের গভীরে উঁকি মারছিল ।

অনেক চিন্তা করার পর আমি এক সিদ্ধান্তে এলাম । আমার বয়স আটত্রিশ  , এবং বিবাহিতা ; এবং নিন্দুকেও আমাকে কুরূপা বলবেন না ।তদুপরি 
আমার মনে কেমন একটা সন্দেহ হচ্ছিল – এটা ঠিক সম্পাদকীয় পত্রালাপ নয় ।এমত অবস্থায় সশরীরে উপস্থিত হতে আমার বিশেষ কুণ্ঠা এবং সাহসের 
অভাব হচ্ছিল কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমার লেখাটি গৃহীত হবার সম্ভাবনা অত্যন্ত কঠিন বলে আমার মনে হল । এমন মনে হবার কারণ হয়ত ছিল না, কিন্তু 
সম্পাদকের নিজ শারীরিক সৌন্দর্যের বর্ণনা আমাকে ভাবিত করল । কিন্তু চিঠি ফেলে দেবার মত মনের জোর আমার নেই। এত পত্রিকায় এত বছর 
ধরে কবিতা পাঠিয়ে পাঠিয়ে আমি হদ্দ হয়ে গেলাম, কোনও উত্তর আজ অবধি পাইনি। সবেধন নীলমণি এই ‘প্রেমিক-সম্পাদক’ ব্যতীত। অতএব আমি 
আমার লেখা বাছা বাছা কিছু প্রেমের কবিতা, কারণ সম্পাদকটিকে আমার  প্রেমিক টাইপের মনে হল, বেছে একটি খামে পুরে লেখকের হুগলীর ঠিকানায়
 পাঠাবার মনস্থ করলাম । কিন্তু মুশকিল হল, সেদিন শনিবার ৬ জানুয়ারি, এবং সেদিনই আমি চিঠি ডাকবাক্সে ফেলেছি । তাই সম্পাদক মশাই আজ খুবই 
 চটিতং হবেন বুঝেও আমি নিরুপায়, ঘরে বসে রইলাম । আমি আশা করেছিলাম মহাশয়ের ক্রোধ আমার প্রেরিত খামের ভিতর উপস্থিত প্রেমের কবিতা 
 গুলি প্রশমিত করতে সক্ষম হবে ।

একটি সপ্তাহ নিরুপদ্রপে বাহিত হল । আমি রোজই লেটার বাক্সটি আঁতি পাতি করে খুঁজি। যদি কোন অদৃশ্য কোনায় আমার নামে কোন চিঠি পরে থাকে , 
যদিও জানি সেরকম কোন কোনা চৌকো বাক্সটিতে নেই । সে দিন পেলাম চিঠি , বহু কাঙ্ক্ষিত সেই চিঠি । চট করে ঘরে এসে খাটে বসলাম । চিঠি 
খুলতে কিছু সময় লাগল , কারণ উত্তেজনায় আমার  অঙ্গুলি কম্পমান । চিঠি পড়ার পর আমার, একে একে, অপমান, রাগ, উত্তেজনা এবং ভয় হতে 
শুরু করল ।

সম্পাদক ভয়ানক চটেছেন । তাঁর মতন একজন বড় মাপের কবি-সম্পাদককে এতখানি অবহেলা । তিনি আমাকে জানিয়েছেন যে তিনি অত্যন্ত বিচলিত 
আমার বিবেচনাহীন কর্মের ফলে, তাঁর অনেক মূল্যবান সময় বৃথা নষ্ট হয়েছে গত শনিবার কফি হাউসের সামনে । তিনি জানিয়েছেন আমি প্রথম দফায় 
যে লেখা পাঠিয়েছিলাম, (এবং যে গুলি সেবার তাঁর মতে অতি উত্তম ) অত্যন্ত কাঁচা হাতে লেখা । এর উপর অনেক ঘষা-মাজা করা দরকার, তবেই 
তারা দ্বীব্রতীর মাপের পত্রিকায় প্রকাশ পাবার যোগ্য হবে । তিনি আরও জানিয়েছেন যে আমার মতন বহু মহিলা তাঁর সান্নিধ্যে এসে ধন্য হয়েছেন এবং 
ফল স্বরূপ লেখার জগতে অনেক উপরেও উঠেছেন । তিনি এখনো, আমার এত অবিবেচনা মূলক কাজের পরেও, আমার সহিত বোঝাপড়া করতে যদি 
আমি  যে কোন শনিবার বিকাল পাঁচটার পরে কলেজ-স্ট্রীটের লাইব্রারী [কোন লাইব্রেরীর কথা লিখেছিলেন এতদিন পরে সে কথা আমার মনে পড়ছে না ]
 তে গিয়ে দেখা করি। অন্যথায় আমার বাড়িতে এসে আমাকে সাহায্য করতে রাজি আছেন, যদি আমার বাসায় আসার বাস রুট এবং নম্বর তাকে লিখে 
 পাঠাই । পাঠক নিশ্চয় মনে মনে ভাবছেন , এই ইন্টারনেট আর মোবাইলের যুগে, এমন চিঠি চালা-চালির সার্থকতা কোথায় । আসল কথাটাই তো 
 আপনাদের বলা হয়নি । এ ঘটনাটি প্রায় সাতাশ বছর আগেকার, এবং প্রথম এবং শেষ কোনও সম্পাদকের প্রতি আমার আবেদনের সত্য গল্প ।

এবার সম্পাদকের প্রস্তাবে তো আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হবার উপক্রম । কি করি, কি করি চিন্তা করতে করতে আর একটি  পত্রাঘাত । এবার খানিকটা 
চিন্তার সংগেই খাম খুললাম, কারণ আমি , বলা বাহুল্য, আমার বাড়ি আসার বাস রুট এবং নম্বর তাকে পাঠাই নি, জানতাম তিনি আবার ক্রুদ্ধ হয়েছেন । 
চিঠি পড়ে বুঝলাম তিনি আমার কবিতা প্রাপ্ত হয়েছেন । চিঠি পড়ে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা । চিঠিটি আমি আমার মেয়ের সঙ্গে যুক্তি করে সেদিনই টুকর।
 টুকর করে ছিঁড়ে গ্যাসের আগুনে নিক্ষেপ করেছিলাম । সেই চিঠির বক্তব্য আমি নিজের ভাষায় নিচে বর্ণনা করলাম ।

থুড়ি সে চিঠি বলা বাহুল্য আমার কবিতার উত্তরে লেখা । এখানে আমার কবিতাটি পেশ না করলে বোধ হয় সম্পাদকের উত্তর সাধারণের কাছে বোধগম্য  হবেনা-

(আমার পাঠান কবিতা-জীবনের প্রতি )
এখন-ও হয়নি শেষ আশা,
মৃত্যুর শীতল ছায়া এখন-ও রয়েছে দূরে,
জানি আমি, জানে সে ও,
যাবনা যাবনা ফিরে,
তবু উষ্ণ স্নায়ু, বলে মৃদু স্বরে-
এসো আরও একবার
মিলনের আয়ু এখনো হয়নি শেষ,
স্পর্শ করেছ বীণা
ঝঙ্কার তার
রেশ রেখে গেছে কিনা, দেখো একবার ফিরে ।
জানি আমি, জানে সে ও 
হয়ে গেছে শেষ- তবুও আবেশ
করে আছে বাসা।
পুঞ্জীভূত বেদনার মেঘ কখন হয়েছে ভাষা
নিয়ে যেও সাথে .
হয়েছে সময় ?
এখনি যে যেতে হয়-
তবু শান্তি তাতে,
বেদনার ভাষা যদি নিয়ে যাও সাথে ।।

......
(সম্পাদকের চিঠি)
সব টুকু মনে না থাকায় প্রধান বক্তব্য পেশ করলাম
এখন গভীর রাত, আমি রাত জেগে বসে এই চিঠি লিখছি, এবং আমি নিশ্চিত আপনিও
ঘুমাতে পারছেন না ,জেগে রয়েছেন । কিন্তু এমন কষ্ট পাবার কি দরকার,  এই দূরত্ব রাখবার ই বা কি প্রয়োজন , যখন আমরা দু-জনাই ইচ্ছুক 
( ইচ্ছার বিষয় ব্যক্ত করেন নি )। আমি আপনার উদ্দেশ্যে এই কবিতাটি লিখছি, আপনি অবশ্য-ই আমার  এ  কবিতাটি গ্রহণ করুন । 
কারণ আমার লেখা কোনও কবিতাই অধিক দিন পরে থাকেনা । কেউ না কেউ সেটি নিয়ে চলে যায় ।

কবিতাটি কিছুটা এরকম_

ঠোটে সিগারেটের আগুনের মতন
ছুঁয়ে গেল তোমার ঠোঁট ।
আমার হাত খেলে গেল তোমার
নরম ঢেউ নিয়ে । 
বেদানার দানার মিষ্টি স্বাদ আমায়
করে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি যখন হাঁদার মতন চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে, মেয়ে ফিরল স্কুল থেকে । কি হয়েছে মা ?
চিঠি পড়ে  ভয়ে মেয়ের অবস্থা মায়ের মতন । শিগগির ছেঁড়, ফেল ফেল , দাঁড়াও গ্যাস জ্বালাই দাঁড়াও, ফেল ফেল আগুনে ফেল...লেখে গুল 
পুড়ছে আর আমি আর আমার মেয়ে সুস্থির নিশ্বাস ফেলছি । কিন্তু কেন ছিঁড়ছে, কেন পোড়াচ্ছি, দু-জনার কেউ বুঝিনি । মেয়ে আমার কিশোরী , 
তার প্রতিক্রিয়া বোঝা যায়, কিন্তু কিশোরীর মা, কেন এমন উজবুকের মতন কাজ করল আজও আমার মাথায় ঢোকেনি ।।

[আমি সম্পাদকের পাঠান প্রথম দুটি চিঠি ‘বেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের কাছে পাঠিয়েছিলাম, এই অনুরোধ করে যে ভবিষ্যতে এমন ছ্যাবলা প্রকৃতির 
সম্পাদকের ঠিকানা যেন সেখানে দেওয়া না হয়- উজবুকের মতন কাজটা না করলে শেষ চিঠিটা পাঠাতে পারলে আমার অনুরোধ আরও জোরদার হত]	
রচনাকাল : ৩১/১/২০১৬
© কিশলয় এবং সান্ত্বনা চ্যাটার্জী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger
সমাপ্ত



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Belarus : 1  Canada : 3  China : 20  France : 1  Germany : 3  India : 208  Ireland : 3  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 7  Taiwan : 1  
Ukraine : 35  United Kingdom : 2  United States : 170  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Belarus : 1  Canada : 3  China : 20  France : 1  
Germany : 3  India : 208  Ireland : 3  Russian Federat : 6  
Saudi Arabia : 7  Taiwan : 1  Ukraine : 35  United Kingdom : 2  
United States : 170  
লেখিকা পরিচিতি -
                          সান্তনা চ্যাটার্জী ১৯৪৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি খড়দা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। 
বর্তমানে তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মী এবং পুণে তে থাকেন। তিনি সাহিত্য চর্চাতেও সমান আগ্রহী। 
১৯৭৮সালে কোলকাতায় ইন্সটিটিউট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট অফ ইন্ডিয়াতে কাজ করা কালীন তাঁর সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। বর্তমানে নানান অনলাইন পত্র-পত্রিকাতেও লেখেন। 
                          


© কিশলয় এবং সান্ত্বনা চ্যাটার্জী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সম্পাদক সমীপেষু by Santwana Chatterjee is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৩৮৭২৫
fingerprintLogin account_circleSignup