মা বাবার সাথে শিলিগুড়ি যাচ্ছিলাম। আমার দিদি আর জামাইবাবু কর্মসূত্রে ওখানেই থাকে। ডিসেম্বর মাস তাই বাঙালীর লাগেজ ও কিছু কম নয়।বাবার হাতে দুটো সুটকেস,মুখে টেনশনের প্রলেপ,মায়ের হাতে রাতের খাবারের প্যাকেট সাথে জলের বোতল আর একটা বড় ব্যাগ,আমি এখনো বাড়ির ছোট আদুরিণী তাই নিজের বোঝার দ্বায়িত্ব ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব ছিল না।এই চিত্র খুবই পরিচিত আমাদের।
বাবার আর আমার কেরামতিতে প্রথমবার অনলাইনে টিকেট কাটা হয়েছিল।কিন্তু এই কেরামতি যে কেলেঙ্কারিতে পরিণত হয়েছে তা বোঝা গেল টিটি আসার পর।আমাদের টিকেট কনফার্ম হয়নি এবং অনলাইনে আমাদের স্টাটাস হলো 'Without Ticket'।
ট্রেন নিজের গতিতে চলতে লাগলো।আমরা তিনজন যে আনন্দ নিয়ে রওনা হয়েছিলাম তা হয়ে গেল আমাদের আতঙ্ক। টিটির এই ঘোষণার পর ট্রেনের মানুষ গুলো আমাদের উদ্বৃত্ত ভাবতে শুরু করলো। যেই কাকিমা আমার হাতে টোকা দিয়ে আপনমনে গল্প করছিল দক্ষিণেশ্বর থেকে সে বর্ধমান আসার আগেই অচেনা হয়ে গেল।কারোর সিটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই বলতে শুরু করলো আর একজন আছে এখানে। আমরা তিনজন তিনটে অবাঞ্ছিত প্রাণীর মত ওই কপার্টমেন্টে ঘোরাফেরা করতে লাগলাম।
রাত তখন ১১.৩০টা হবে।ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে পেটের ক্ষুধাও বাড়তে থাকলো।এর মধ্যে মা বাবার এক পশলা ঝগড়া হয়ে গেল।বাবার বক্তব্য এতগুলো ব্যাগ হলো কেন আর মায়ের কটাক্ষ বাবাকে কারণ তিনি সবথেকে বেশি শীত কাতুরে,ওনার লটবহর সবচেয়ে বেশি।
শেষে আমাদের স্থান হলো বাথরুমের সামনে মাটিতে।খবরের কাগজ পেতে মাটিতে বসে রইলাম ওই ঠান্ডায়।মা বাবাকে দেখে এত অসহায় আমার আর কোনোদিন লাগেনি।তারমধ্যে সবাই আমাদের ডিঙিয়ে বাথরুম যাচ্ছে।নিতান্তই বসে থাকা দায়।কিন্তু টিকেট ছাড়া ক্ষুধায় ঠান্ডায় জর্জরিত তিনটে প্রাণী এর থেকে ভালো কিছু কি আশা করবে!
মাথা নিচু করে বসে ভাবছি সারারাত কি এইভাবে কাটবে!হঠাৎ একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম "আপা আপনারা এই খানে বইসা আসেন কেন"?এই স্বর আর ভাষা দুটোই অপরিচিত।চোখ তুলে দেখি এক যুবক আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে।মা উত্তর দিল তাকে।সেই যুবক মা আর বাবাকে সালাম করলেন।বাবাকে বললেন আব্বা আপনি আসেন তো আমার সাথে।কিছুক্ষন পরে বাবা দূর থেকে হাসিমুখে আমাকে আর মাকে ইশারা করে ডাকে।প্রচন্ড গরম রোদ্রে দাঁড়িয়ে থাকার পর এক গ্লাস ঠান্ডা জল যেভাবে শান্তি দেয় আমাদের বসার জায়গা পেয়ে ঠিক তাই অনুভুতি।
ছেলেটির নাম সোহাগ।বাড়ি বাংলাদেশের ঢাকা শহরে।সে আর তার তিন বন্ধুরা এসেছে ভারতে ঘুরতে।
প্রথমেই তারা আমাদের বসতে দিলেন।তারপর নিজেদের ব্যাগগুলো সরিয়ে আমাদের ব্যাগ রাখার ব্যবস্থা করলেন।মা আর আমি ইতস্ততবোধ করলেও এতক্ষন পরে শান্তির আস্তানা পেয়ে গিয়ে বসে পড়লাম।শুরু হলো গল্প।বাবা আর মা এর সাথে তারা তাদের দেশের বিভিন্ন গল্প করতে করতে চাদর পেতে বিছানা করে ফেললেন।এইবার খাওয়ার পালা।এমন নৈশভোজন ভাগ্যের ব্যাপার।দুই দেশের মিলনকেন্দ্র যে একটা ট্রেনের কামরা হতে পারে ভাবা যায় না। আমরা বাংলাদেশের মিষ্টি খেলাম আর তারা খেলো মায়ের হাতের রান্না।
রাত তখন ১ টা হবে।সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন।আমাদেরও এবার একটু জিরিয়ে নিতেই হবে কিন্তু বসে বসে আর কতক্ষন এইভাবে ঘুমাবো!হঠাৎ দেখি ৪ বন্ধু মিলে দুটো বার্থে উঠে আড়াআড়ি করে শুচ্ছে।আমরা অবাক হতেই সেই যুবক নরম গলায় বলে ওঠে আম্মা আপনারাও ঘুমিয়ে নেন একটু কষ্ট করে।তারা নিজেদের চাদর বিছিয়ে নিজেদের দুটো বার্থ আমাদের দিলো রাতে ঘুমাবার জন্য।
তাকিয়ে থাকলাম তাদের দিকে কিছুক্ষন।নাহ এইবার আর অবাক হয়ে না,তাকিয়ে দেখলাম প্রকৃত মানুষ কি এরকমই দেখতে হয়?
সকালে যখন স্টেশনে দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম একটাই কথা মনে হলো অতিথিদের আমরা কি আপ্যায়ন করবো? অতিথিরা তো আমাদেরই আপ্যায়ন করে গেল।
রচনাকাল : ৩১/৭/২০১৯
© কিশলয় এবং সঞ্চারী বোস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।