তিতি বললে, 'বাবা চলো না, ক'দিন বেড়িয়ে আসি। পুজোর ছুটি তো এসেই গেল।'
গরমের ছুটিতে কোথাও যাওয়া হয়নি ওর। তিনদিন মাসি আর দুদিন ছোটমামা, এগুলো তো কাছাকাছি, বাসে কোরেই যাওয়া যায়। দাদা'র তখন পরীক্ষা সামনে। বাবা বলেছিলেন দাদা'র পরীক্ষার পরে কোথাও নিয়ে যাবেন। মনে আছে নিশ্চয়ই বাবা'র। তবু বাবা কিছু বলছেন না ব'লেই কথাটা পাড়লো তিতি।
'ভালো কোরেছিস কথাটা তুলে। তোর দাদার পরীক্ষা তো শেষ হোয়েই এলো। আজকাল আগে থেকে সব ব্যবস্থা না কোরে কোত্থাও যাওয়া যায় না।'
বাবার মুখে কথাগুলো শুনে তিতি'র উৎসাহ উথলে ওঠে। একটু ঘনিষ্ঠ হ'য়ে বসে। 'জানো তো বাবা, আমি যখন মাসির বাড়ি গেছিলাম, তার আগেই ববদা'র পরীক্ষা শেষ। আনুদি ববদা, ওদের সকলের ইচ্ছে, ওরা আর আমরা একসাথে ক'দিন বেড়িয়ে আসি।'
বাবা বললেন, 'ভালো তো। সবাই মিলে চল, একটা অযাওয়া জায়গায় যাই এবার। একটা নতুন জায়গায় বেড়ানো হবে।'
প্রস্তাবটা তিতি'র বেশ পছন্দ হোলো। 'কিন্তু বাবা, মাসি বলছিলেন ওনার পুরী যেতে ভাল লাগে। পুরী ওঁদের সবার ঘোরা। আমরাও তো কতবার গেছি। তুমি জায়গা ঠিক করো। আমার মনে হয়, তুমি ঠিক কোরলে মাসিরাও খুশি মনে মেনে নেবেন।'
বাবা মনের ভাবটা চেপে রাখতে পারলেন না। বোললেন, 'তুই তো বেশ গুছিয়ে কথা বোলতে পারিস।'
তিতি'র বুকটা বেশ ফুলে উঠলেও মুখে বোললো, 'আঃ, জায়গাটা আগে ঠিক করো না।'
বেড়ানোর ব্যাপারে বাবারও খুব উৎসাহ। ইন্টারনেট ঘেঁটে বাবা এমন বলেন, যেন জায়গাটা বাবার খুব চেনা, কতবার গিয়েছেন। মোটামুটি প্রস্তুতি যে নিয়েই রেখেছিলেন, সেটা বাবার কথাতেই বোঝা গেল। বললেন, 'চল, এবার আরাকু ভ্যালি বেড়িয়ে আসি।'
'সেটা কোথায়, কেমন, একটু বলো।'
'তোর মাসির তো পুরী মানে সমুদ্র দেখার ইচ্ছে। আমরা প্রথমে যাব ভাইজাগ। সমুদ্রের গা'য়ে একটা বন্দর-শহর। শহরটা পাহাড়ের ঢালে ধাপে ধাপে বিস্তৃত। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সুন্দর একটা বীচ। রামকৃষ্ণ বীচ। সামনে সমুদ্র। তিনদিক ঘিরে পাহাড়। খুব উঁচু নয়।'
শুনতে শুনতে তিতি একসাইটেড। 'তুমি যেরকম বোলছো, এ তো একটা ছবির মতো ব্যাপার। ক্যালেন্ডারে যেমন থাকে।'
'ঠিক বোলেছিস।' তিতি'র নাকটা একটু টিপে দিয়ে বাবা বলেন, 'ভাইজাগে দুদিন কাটিয়ে আমরা যাবো আরাকু।'
বাবাকে থামিয়ে দিয়ে তিতি, 'আচ্ছা বাবা, রামকৃষ্ণ বীচে স্নান করা যায়?'
'তুই তো ব্যাটা রামভীতু, হঠাৎ সমুদ্রস্নানের কথা জিজ্ঞেস করছিস যে..'
'না না, আমার জন্যে নয়। আসলে মা মাসি দাদা ববদা, ওরা সবাই তো..'
'শোন, ভাইজাগ তো বন্দর-শহর। জলে খুব দূষণ। জাহাজগুলো বর্জ্য পদার্থ ফেলে জলে। তাছাড়া ছড়ানো ছেটানো পাথর। এতে সমুদ্রের শোভা বেড়েছে কিন্তু স্নানের পক্ষে নিরাপদ নয়। শহরের কাছে, বাস যায়, আর একটা বীচ, ঋষিকোন্ডা। যেমন সুন্দর তেমনই স্নানের অনুকুল। ওখানে সবাই মনের আনন্দে স্নান কোরতে পারবে।'
তিতি আশ্বস্ত। 'তবে তো খুব ভাল। ওরা সব্বাই স্নান কোরবে, আমি ব'সে সবার জিনিষপত্র সামলাবো। তারপর বলো, আরাকু কীভাবে যাব।'
'বাসে ক'রেই যাওয়া যায় তবে আমরা যাব ট্রেনে।'
'বুঝেছি, আমার কথা ভেবে তুমি ট্রেনের কথা ব'লছো। আজকাল কিন্তু বাসে আমি মোটেই বমি করি না।'
'ওরে না না, ট্রেন জার্ণিটা অতি মনোরম। ঘন্টা তিনেকের পথ। মনে হবে, ইস, এত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেল !'
'ওঃ খুব মজা হবে। জায়গাটা কেমন, একটু বলো।' ন'ড়েচ'ড়ে বসে তিতি।
'ভ্যালী কাকে বলে, মনে আছে?'
'নিশ্চয়ই।' তিতি'র চোখেমুখে আস্থা।'উপত্যকা। দু'টো পাহাড়ের মাঝে নিম্ন সমতল।'
'ঠিক তাই। আরাকু হোলো সেরকমই শান্ত সুন্দর এক উপত্যকা। উদার হাতে প্রকৃতি ওকে সাজিয়েছেন। ঝুলিতে যত রং ছিল, সবটুকু যেন ঢেলে দিয়েছেন ওখানে।'
তিতি'র মুখটা হঠাৎ কেমন বিষণ্ণ লাগে বাবা'র। 'কিরে, কিছু বলছিস না যে...'
হতাশ সুরে তিতি বলে, 'ইস, আমি যে কেন এভাবে বলতে পারি না !'
'পারবি পারবি, বিষয়ের সাথে যখন একাত্ম হ'বি, মনের ভাব তখন আপনিই ভাষা খুঁজে নেবে। সেভাবেই তো সৃষ্টি হয় সাহিত্য।'
বাবার মুখটা তিতি খুঁটিয়ে দেখে, যেন নতুন কিছু। 'আমরা ওখানে থাকবো তো ?'
'অন্তত দুদিন তো থাকাই উচিত। কাছেই একটা অদ্ভুত দ্রষ্টব্য আছে। সেটা অবশ্য আরাকু'র পথেই, একটু আগে। বোরোগুহা। পাহাড় জঙ্গলের মাঝে বিশাল প্রাকৃতিক গুহা। হাজার হাজার বছর, চূণাপাথরে জল প'ড়ে প'ড়ে সৃষ্টি হ'য়েছে প্রাকৃতিক ভাষ্কর্য্য।'
'না না বাবা, তুমি আর বোলো না, আমার ভীষণ উত্তেজনা হচ্ছে, মনে হ'চ্ছে, একখুনি যাই। মাসির সাথে কথা ব'লে এটাই ফাইনাল করতে হবে।'
তিতি নিজেই মাসিকে ফোন ক'রলো। এমন জোরাজুরি ক'রলো, পরদিনই মাসি এলেন। মাসি একা। ববদা আনুদি, কেউ না। তিতি'র মুখ ভার। মাসি বুঝিয়ে বলেন, 'তোর দাদার একজ্যাম শেষ হোক, তারপর ওরা আসবে।' মন মানে না ওর। দু তিন ঘন্টার জন্যে ওরা এলে দাদার ও ভাল লাগতো, একঘেয়েমি কাটতো একটু। এত কথা তো আর বলা যায় না, মাসি যে বড়।
তর সয় না তিতি'র। বাবা কেন কথাটা পাড়ছেন না ! একটু পরে মাসিই কথাটা তুললেন। মাসি'র কথা একটু যেন অন্যরকম। এত জোর দিয়ে কেবল পুরী'র কথা বলছেন কেন ! তবে কি ভাইজ্যাগের প্ল্যানটা মাসি জানেন ! ওহো, কাল যখন মিস পড়াচ্ছিলেন তখন মা আর মাসি অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলেছেন। মা নিশ্চয়ই প্ল্যানটা তখন মাসিকে ব'লেছেন। ইস, বাবার মুখটা অমন গোমড়া কেন ! আমাকে যেমন ক'রে ব'ললেন, মাসিকে তেমন ক'রে আরাকু'টা বলছেন না কেন ! আচ্ছা, বাবা বড় না মাসি, নাকি দু'জন সমান ! নিশ্চয়ই সমান। তিতি ভাবে, হয়তো ওই সমান থেকেই সমান্তরাল কথাটার সৃষ্টি। কখনও মিলিত হয় না। সব কেমন গুলিয়ে যায় তিতি'র।
মাসি ফিরে গেছেন। বাবা কেমন যেন শান্ত। আধশোয়া। ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন। হঠাৎ তিতি'র দিকে নজর পরে বাবা'র।
'কি রে, কিছু বোলবি ?'
হ্যাঁ তো, অনেক কিছু বোলতে চায় তিতি কিন্তু...বলে, 'থাক বাবা, এবছর আমরা দূরে কোথাও নাইবা গেলাম।'
বাবার সেই দরাজ হাসি। বাবা হাসেন হোহোহোহোহো.....
তিতিকে জড়িয়ে ধরেন। 'মাম্মা, তুই কত্তো বড় হ'য়ে গেছিস।'
'মা'কে বল, রেডি হোতে, আজ আর রান্নাটান্না নয়, একটু ড্রাইভে যাই চল, ফেরার পথে প্যাক ডিনার।'
'মা, ওমা.....' নাচের তালে চ'লে যায় তিতি।
রচনাকাল : ৩০/৭/২০১৯
© কিশলয় এবং কবীন্দ্র চ্যাটার্জী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।