এ বড় ধন্দ। অনেক কসরত কোরেও চিন্তাটা হঠাতে পারেনা অনির্বাণ। কে ? কে ওই লোকটা ! কী ওর মতলব। বাড়ি ঘরসংসার ছেড়ে কেন, কী উদ্দেশে এই জঙ্গলে পাকাবাড়ি বানিয়ে পড়ে আছে ! হয়তো অনাবশ্যক, তবুও কৌতুহলটা এড়াতে পারে না সে।
প্রথম যেদিন দেখেছিল, খেটো পায়জামা, রঙীন ফতুয়া, কাঁধঝোলা, কাঁচাপাকা খোঁচা দাড়ি, অবিন্যস্ত খসখসে চুল। সুজাত বললো, চল, ওনার বাড়ি যাবি ? একা থাকেন। প্রশ্ন করেনি অনির্বাণ।
দুটো বাইকে ওরা চারজন।
মাঝারি একটা ঘর। সংলগ্ন ছোট কিচেন। বাথরুমে কমোড। পরিপাটি সাজানো। চারদিকে চারটে জানালা। পর্দা নেই। আসবাব একটা আলনা আর একজনের শোওয়ার উপযোগী একটা ডিভান। সিলিং ফ্যান, সরাসরি বিছানাটার ওপরে। অনির্বাণের কৌতুহল, লোকটা শৌখিন না স্বার্থপর !
শুকনো খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করেছিল। ধরণ দেখে অনির্বাণের মনে হয়েছিল, লোকটা নয়, বলা উচিত মানুষটা।
কয়েকবার গিয়েছে। বন্ধুদের নিয়ে। একাও। কার্পেট বিছিয়ে বসতে দিতো। কী একটা আকর্ষণ ছিল মানুষটার। মিতবাক। আন্তরিক। নিজেকে জড়িয়ে কোনো কথা নয়। কিছু না কিছু খাবার দিয়ে আপ্যায়ন। চলে আসার সময়, আবার আসিস কিন্তু। ওই 'কিন্তু' শব্দটা না বোললে তফাত কিছু হোতো না। শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ ক'রতো... আবারও যেতেই হোতো। মাঝেসাঝেই।
ওদিকে ধন্দটা কাটে না। সরাসরি জিগ্যেস কোরবে, পারেনি। কোনো আভাস, পায়নি। খচখচ করে মন। সেটা কাটাবার জন্যে নিজেকে বোঝায়, মানুষটাতো কারো বিষয়ে নাক গলায় না। স্বপছন্দে যেমন খুশি যেখানে ইচ্ছে থাকার অধিকার তো সবার আছে। অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ না কোরে কেউ যদি নিজের মতো থাকে, তাতে তো কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। বরং অন্য কারো কৌতুহল, সেটাই তো..... না, এই অনাকাঙ্ক্ষিত ধন্দটাকে আশকারা দেবে না অনির্বাণ।
ঝ'রে পড়ার আগে বুড়ো পাতা যখন রং বদলায়, সোনা হলুদ, সেই দিনগুলোয় একা একা বেড়িয়ে বেড়াতে বেশ লাগে অনির্বাণের। পড়তি বিকেল, তেরচা নরম রোদ্দুর, মন চায় ভেসে বেড়াতে উদাসী হাওয়ায়। শুকনো পাতার আলপনা। বাতাস বয়। প্রতিনিয়ত আলপনা পাল্টে যায়। নানা ছবি।
তেমনই এক ফুরিয়ে আসা বিকেল। পাশ দিয়ে একটা শবমিছিল। প্রাপ্তবয়স্ক দেহ। মুখটা দেখতে চেষ্টা করে অনির্বাণ। কে, কার শবদেহ ! সাদা চাদর ঢাকা। সাদা ফুলের মাঝ থেকে একটু উঁকি দিয়ে আকাশ দেখছে। একটু কাছ থেকে দেখতে চায় অনির্বাণ। মুখটা। পারে না। বুক কে যেন চেপে ধরেছে। পা অসাড়। ভয়ানক অস্বস্তি। একটু যদি বসা যেত। তেষ্টা, কেমন একটা আচ্ছন্ন শরীর।
দূর থেকে মিছিলের মিলিয়ে যাওয়া দেখে। শবটার মুখ দেখতে না পাওয়ার হতাশা ওকে অস্থির করে। আকাশটাও একটু একটু রং পাল্টাচ্ছে। একটা উজ্জ্বল তারা। আশপাশ আঁধার হয়ে আসে। এবার চলতেই হবে। মন তাকে জানান দিয়েছে। হাঁটতে থাকে। ক্রমে বল ফিরে আসে। বড় বড় পা। মুখটা দেখতে না পাওয়ার ব্যথাটা ওকে তাড়া দেয়। ভাবে, ওইভাবে 'কিন্তু', কেউ বলতে পারে না। জোরে পা চালায় সে।
বাড়িটায় আলো জ্বলছে না। ধীর পা'য়ে অনির্বাণ। টগর গাছটায় থিকথিক সাদা গুটি। গাঁদাগুলো নিজেদের ভারে নুইয়ে। ভেসে আসে উদাত্ত কন্ঠ। যে কন্ঠ ওইভাবে 'কিন্তু' বলে। চেনা গান। রবিঠাকুর। "আমি একেলা চলেছি এ ভবে, আমায় পথের সন্ধান........."। অপার আনন্দে ভরে মন। সে ভাবে, ভদ্রলোকের জন্যে কিছু একটা উপহার আনলে হ'তো বেশ। নিজের নামটা যদি দিতে পারতো ওনাকে ! তখন আকাশে চতুর্থী চাঁদ, অগনন তারা।
উঠোনে চুপটি ক'রে দাঁড়িয়ে গান শোনে অনির্বাণ। গান থেমে গেছে। ধীর পা'য়ে দরজায় যায়। একটু ইতস্তত। উনি এগিয়ে এসে বলেন, ভেতরে এসো, লাল চা চলবে ?
সেদিন ও অনেকক্ষণ ছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল, সকলেই তবে খুঁজেফেরে পথ। সেদিনও চলে আসার সময় উনি সেই একইসুরে বলেন, আবার এসো কিন্তু। ধন্দের কথাটা মনে পড়ে। খুব একচোট হাসতে ইচ্ছে হয় অনির্বাণের।
রচনাকাল : ৩১/১২/২০১৮
© কিশলয় এবং কবীন্দ্র চ্যাটার্জী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।