....নবনীতার চুলের মুঠিটা কে যেন পিছন থেকে টেনে ধরল।কিন্তু নবনীতা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ,কিছুতেই সে পিছু ফিরে তাকাবেনা,তাকে চৌবাচ্চা থেকে যে করেই হোক বাইরে বেরোতেই হবে...কল্যাণ আর অনিতা ওপরে একা আছে তাদের কাছে ওকে পৌঁছতেই হবে,পিছনের প্রাণীটাকে এক ঝটকা মেরে চৌবাচ্চার দেওয়ালটা ধরে উঠে বসে নবনীতা....সারা শরীর জলে চপচপ করছে,গা দিয়ে আঁশটে রক্তের গন্ধ ছাড়ছে।নীচে নেমে কোনোরকমে দাঁড়ালো নবনীতা..দুপা এগোতেই কিছুতে একটা হড়কে গেল ও...আর আছাড় খেয়ে পরল মেঝেতে..কিন্তু কোনো একটা কিছুর ওপর যে ও পরেছে সেটা ও ভালোই বুঝতে পারছে।চোখ খুলে দেখল যার ওপর পরেছে সেই প্রাণীটার কেবলমাত্র একটাই চোখ আর চোখটা যেন ভাঁটার মতো জ্বলছে...কি বিভৎস দেখতে প্রাণীটাকে...মুখ ভর্তি চুলগুলো সাপের ফণার মতো যেন তারদিকে তাকিয়ে আছে....সারাগাটা কিরকম ফ্যাকাশে...সাথে গা থেকে কিরকম বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ...থাকতে পারে না নবনীতা...প্রাণীটার ওপরেই বমি করে দেয় ও...শরীরটা এখন একটু হালকা লাগছে।হঠাৎ করেই ঘাড়ের কাছে একটা মরণ কামড় অনুভব করে ও।কেউ যেন ওর সমস্ত জীবনীশক্তিকে এক লহমায় শুষে নিচ্ছে।আস্তে আস্তে নেতিয়ে পরে নবনীতা।মেঝেতে এলিয়ে পরার আগের মুহুর্তে নিজের সমস্ত শক্তি একত্র করে প্রাণীটাকে জোরে ঠেলা মারে ও...তারপর ছোটে দরজার দিকে,কিন্তু দরজা থেকে বেরোতে পারেনা তার আগেই ওর একটা পা টেনে ধরে ফেলে জন্তুটা...তারপর আস্তে আস্তে ওকে টেনে নিয়ে যায় চৌবাচ্চার দিকে...নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ডান পাটা দিয়ে লাথি মারতে থাকে প্রাণীটাকে,কিন্তু প্রাণীটার কোনো হেলদোল নেই.....শেষ মূহুর্তের জলের তলায় ঢুবে যেতে যেতে নবনীতার মুখ দিয়ে শুধু একটা আওয়াজই বেরোল...আওয়াজ নয় ঠিক যেন মরণের আগে অন্তিম আর্তনাদ,
"অনিতা............প্লিস হেল্প মি.........."
নীচ থেকে নবনীতার চিৎকার পেয়ে হকচকিয়ে গেল অনিতা...
...কি হল নবনীতার??এরকম করে চিৎকার করল কেন ও?কোনো বড়ো বিপদে পরল না তো ও।কিন্তু নবনীতার মতো এরকম ডাকাবুকো মেয়ের কিসে বিপদ হতে পারে?অনিতার কি নীচে যাওয়া উচিত হবে?কিন্তু কল্যাণকে একা ফেলে অনিতার একটুও যেতে ইচ্ছা করল না।সৌম্যদীপ বা নিলয়েরও কোনো পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
"নিলয়.....সৌম্য.....এই নিলয়....সৌম্যরে তোরা কি শুনতে পাচ্ছিস আমার আওয়াজ?তোরা কোথায় রে?এদিকে একটু আয় না...দেখ না..দেখ না কল্যাণ কিরকম জ্ঞান হারিয়ে পরে আছে রে...তোরা একটু আয় না রে...জানিসই তো আমি খুব ভীতু...আমাকে এভাবে তোরা কেনো ভয় দেখাচ্ছিস বলত?"-কথাগুলো বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে ফেলে অনিতা।
তারপর আস্তে আস্তে কোলের থেকে কল্যাণের মাথাটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায় অনিতা।হাতে হ্যারিকেনটা তুলে নিয়ে পা টিপে টিপে নীচে নামে অনিতা।
".....নবনীতা......অ্যাই নবনীতা!!শুনতে পাচ্ছিস তুই?কোথায় রে তুই?দ্যাখ আমি নীচে নেমে এসেছি।তোরা সব কোথায় রে?"-হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে ইতিউতি খুঁজতে থাকে ও।
হঠাৎই মাথার মধ্যে একটা সম্ভবনার কথা মনে হল ওর।
"আচ্ছা সবাই মিলে প্ল্যান করে কি ওকে ভয় দেখাচ্ছে??হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে পাশের ঘরটায় নবনীতাকে খুঁজতে যায় অনিতা....
চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল ঝরতে থাকে তার,সামান্য ভীতু বলে সকলে মিলে তাকে কিভাবে হেনস্থা করছে...তবুও চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে ও,
"নবনীতা...সৌম্য তোরা শুনতে পাচ্ছিস আমার গলার আওয়াজ?প্লিস বেরিয়ে আয় না তোরা...আমি জানি তোরা আমার সাথে মজা করে কোথাও লুকিয়ে আছিস।আমাকে তোরা ভয় খাওয়াতে চাইছিস তা আমি জানি...কিন্তু প্লিস এরকম করিস না....তোরা বেরিয়ে আয় এবার...আমি হাত জোড় করছি..প্লিস তোরা বেরিয়ে আয়...."আর বলতে পারে না অনিতা।হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে ও।সেই ঘরে না পেয়ে পাশের ঘরে আবার খুঁজতে যায় ও।
কিন্তু একি?ঘর থেকে বেড়িয়ে সিধে বাগানে চলে এল কি করে ও??প্রচন্ড ঘাবড়ে যায় অনিতা...কি হচ্ছে ওর সাথে??
এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখে স্নানের ঘাটে নবনীতার মতো কে যেন একটা বসে আছে..বুকে যেন এতক্ষণে একটু বল পায় ও কিন্তু বুঝতে পারে না নবনীতা এখন অসময়ে এখানে কেনো এসেছে?
সাহস করে এগিয়ে এসে নবনীতার পিঠে হাত দেয় ও....নবনীতাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই চকিতে পিছিয়ে যায় ও ...কি বিভৎস অবস্থা ওর,কি ভয়ঙ্কর রূপ...চুলগুলো সব এলোমেলোভাবে হাওয়ায় উড়ছে,কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পরছে....সারা মুখে কোনো চোখ নেই..এটা নবনীতা নয়...কোনোমতেই এটা নবনীতা হতে পারে না....কিছুতেই হতে পারে না...
কিন্তু পালাতে গিয়েও পালাতে পারে না ও.. নবনীতারূপী পিশাচটা ইতিমধ্যেই ওর হাত দুটো টেনে ওকে পুকুরে নামাতে শুরু করে দিয়েছে....
এক কোমড় জলে নেমে যাওয়া সত্বেও কোনোমতে নিজের হাতটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টোদিকে প্রাণ হাতে করে দৌড় দিল অনিতা...ঝরে পরা পাতার মধ্যে দিয়ে দিগ্ব-বিদিগ্ব জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে থাকল ও,হঠাৎই ঝরাপাতার মধ্যে থেকে একটা হাত খপ্ করে টেনে ধরল অনিতার পা,
"ও বাবা গো......."বলে আঁতকে ওঠে অনিতা।
পাটা দিয়ে আঁকড়ে ধরা হাতটাকে সজোরে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে আবার ছুটতে লাগল ও।
...কিছুক্ষণ ছোটার পর অনিতার মনে হল এবারে দুটো হাত যেন তার দুটো পাকে আঁকড়ে ধরেছে।তারপর তাকে টেনে নামাতে লাগল ঝরা পাতার স্তূপের নীচে।
ঝরাপাতার মধ্যেই পুঁতে যেতে থাকল অনিতার দুটো পা....যেন চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে ও...তারপর আস্তে আস্তে কোমড়...তারপর পুরো শরীরটাই....একজন জীবন্ত মানুষ সমাধিস্থ হল ঝরে পরা পাতার নীচে।পাতার স্তূপের ভিতর থেকে যেন লক্ষ লক্ষ হাত পাতালে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে ওকে।
আচমকাই যেন ঘুমটা ভেঙে গেল কল্যাণের...কিছু ঘসটে চলার শব্দ কানে আসছে ...পাশে সৌম্যও তো নেই,তারপরেই আস্তে আস্তে ওর মনে পরল সেই বিভৎস ঘটনাটার কথা।কিন্তু বাকিরা কই?নবনীতা,অনিতা ওরা কোথায় গেল?কল্যাণের মনে আছে জ্ঞান হারানোর আগেও ও দুজনকে ওর কাছেই ছুটে এসে বসতে দেখেছে।ওর এখনও মনে আছে ও অনিতার কোলে ঢলে পরেছিল; আর নিলয়....ও কি ফিরেছে?
না এভাবে এখানে বসে থাকলে হবে না...সবাইকে খুঁজে বের করতেই হবে,সৌম্যর ব্যাপারে সব সত্যিকথা সবাইকে জানাতে হবে,সৌম্যর মতো পরিণতি ও বাকিদের সাথে হতে দেবেনা।হাতে ফোনের টর্চটা জ্বেলে টলতে টলতে উঠে গিয়ে পাশের দুটো ঘরে উঁকি দেয় কল্যাণ...কই ঘরের মধ্যে কেউ নেই তো..তবে কি??তবে কি...সব শেষ হয়ে গেছে?
সম্ভবনাটা মাথায় আসতেই কেঁপে উঠল কল্যাণ...ঘসটানোর শব্দটা এখন আরো তীব্র শোনাচ্ছে...একছুটে নীচে নেমে এল ও....পাগলের মতো দৌড়তে শুরু করল প্রাসাদের এদিক থেকে ওইদিক পর্যন্ত আর তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল সকলের নাম ধরে ধরে,
"অনিতাআআ........নবনীতাআআআ....নিলয়....তোরা কেউ শুনতে পাচ্ছিস আমায়....শুনতে পেলে সাড়া দে একবার...আমাদের সবার খুব বিপদ রে...আমাদের এইমূহুর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে...নাহলে মৃত্যু আমাদের অনিবার্য।তোরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?অনিতা......নিলয়.....নবনীতা...শুনছিস কেউ?"
একটা ঘটনা হঠাৎ মনে হতেই থেমে গেল কল্যাণ।ও প্রাসাদের এদিক-ওদিক এতো ছোটাছুটি করছে কিন্তু সেই ঘষটে আসার আওয়াজটা তো কই একটুও কমছেনা?যেনো তার ছায়ার সাথে মিশে আছে কিছু একটা।প্রতি পদক্ষেপেই যেনো সেটা অনুসরণ করছে কল্যাণকে।পালাতে হবে,এখান থেকে যে করেই হোক পালাতে হবে কল্যাণকে।
কিন্তু কিভাবে?কিভাবে বেরোবে সে?বাকিরাই বা কোথায় গেল?....বেরোনোর কোনো পথই তো নেই এখানে...কি করবে কল্যাণ এবার?মাথায় হাত দিয়ে ধপ্ করে মেঝেতে বসে পরে কল্যাণ।
হঠাৎই প্রাসাদের এককোণে দেখতে পেল একটা কালো দরজা...মনের মধ্যে একটু হলেও আশার আলো জাগল কল্যাণের...তবে কি....তবে কি...তবে কি সে এযাত্রায় বেঁচে গেল?
দরজার দেখা পাওয়া মানেই তো অশুভ সময়ের সমাপ্তি...শয়তানকে কি তবে ঘুমিয়ে পরল এবার?তারমানে এবার তো মুক্তি....অপার শান্তি লাগছে কল্যাণের...মুক্তির নেশায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে ওর।সব কিছু কেড়ে নিয়েছে এই প্রাসাদ কল্যাণের থেকে...তার বন্ধু-বান্ধবী সবাইকে।আর একমূহুর্তও এখানে থাকবে না ও।
একছুটে চলে যায় কল্যাণ দরজার দিকে।একটানে দরজাটা খুলেই ভিতরে ঢুকে যায় ও...অবশেষে মুক্ত সে...এবার সে মুক্ত।
কিন্তু এ কি?সারাঘরের মধ্যে এমন অন্ধকার কেনো?দরজার দিকে ফিরে দাঁড়ায় কল্যাণ....এক্ষুণি বেরোতে হবে ওকে এখান থেকে।
কিন্তু এ কি?ঘরের দরজাটা কোথায় গেল?দরজাটা কোথায় হারিয়ে গেল?ঘসটে আসার শব্দটা আবার শুনতে পায় কল্যাণ।কিছু একটা চটচটে জিনিস ওর পা বেয়ে গায়ের ওপর উঠতে থাকে..অন্ধকারে অনুভব করে সেটা তার বুকের কাছে উঠে এসেছে,জিনিসটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘরের অপরপ্রান্ত ছোটে কল্যাণ।কিছু একটায় ধাক্কা লাগে ওর।টর্চের আলোয় দেখে মেঝেতে সারি দিয়ে শুয়ে অাছে নিলয়,সৌম্যদীপ,নবনীতা আর অনিতা।প্রত্যেকের কেউই আর জীবিত নেই.....প্রত্যেককেই বিকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
চোখ ফেটে জল আসে কল্যাণের।সৌম্যর পরিণতি জানলেও বাকিদের এ অবস্থায় দেখে কান্না থামাতে পারে না কিছুতেই।ঠিক সেই সময়ই ফোনটাও চার্চের অভাবে সুইচ অফ হয়ে গেল।সাথে ফ্ল্যাশ লাইটটাও বন্ধ হয়ে গেল।নিকষ অন্ধকারে ডুবে গেল সারা ঘরটা।সবুজ চোখটাকে জ্বলতে দেখছে ও নিজের আশেপাশে,সাথে দমবন্ধ করা বোঁটকা একটা গন্ধ।
আবার সেই স্পর্শটা নিজের শরীরে অনুভব করল কল্যাণ।এবার আর উঠতে পারে না ও।কেউ যেন ওকে মেঝের সাথে গেঁথে দিয়েছে।হাতটা পা বেয়ে ওপরে উঠে আসছে।ধীরে ধীরে সেটা স্পর্শ করছে কল্যাণের বুক। তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে ও..প্রবল আক্রোশে জিনিসটা তার শরীরের ভিতর থেকে হৃৎপিন্ডটা যেন টেনে বের করে আনতে চাইছে।
"মাআআ গো.........."-তীব্র আর্তনাদ করে তখনই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কল্যাণ।
ভোরের আলো ফোটার আগেই আকাশের রং আবার নীলবর্ণ ধারণ করতে শুরু করল।প্রাসাদের ঠিক মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে এক বিভৎস প্রাণী,সারা মুখে কেবল একটাই চোখ,মুখটা একেবারে মাঝবরাবর কাটা...হাড়কাঁপানো গলায় হিসহিসিয়ে সে বলতে লাগল,
"এবারের মতো আমার নৈবেদ্য গৃহীত হল..আগামী একশোবছরের জন্য চিরতরে খুলে যাবে আবার প্রাসাদের দরজা...একশোবছর পর আবার ফিরব আমি...আমার নৈবেদ্যর জন্য প্রস্তুত থেকো সবাই.......ফিরে আমি আসবই আমার গ্রাসের জন্য"।
একরাশ কালো ধোঁয়া মূহুর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল চারিদিকে...বিলুপ্ত হওয়া প্রাসাদের দরজা ফুটে উঠল আস্তে আস্তে,হাট হয়ে খুলে গেল প্রাসাদ আগামী একশত বছরের জন্য॥
রচনাকাল : ২৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।