প্রাসাদের বাইরেটা দেখে ভাঙাচোরা মনে হলেও ভিতরটা যথেষ্ঠ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন,দেখে মনে হয় কেউ যেনো প্রায়শই এখানটা পরিষ্কার করে,বসারঘরের দেওয়াল জুড়ে বড়ো বড়ো সোনালী ফ্রেমে রাজরানীদের তৈলচিত্র বাঁধানো,লাল গদিতে মোড়া সোফা...ফুলদানিতে তাজা ফুল...সিঁড়ি বেয়ে তারা যখন দোতলায় উঠল রীতিমত চমকে গেল প্রত্যেকে।
দোতলার প্রতিটি ঘরই ধবধবে চকচকে,কোথাও ধুলোর লেশমাত্র নেই।শোবার ঘরগুলোয় সাদা ধবধবে চাদর পাতা,কেউ যেন কিছুক্ষণ আগেই সব পরিষ্কার করে রেখে গেছে।কেউ যেনো জানত তারা আসবে...আসবেই।
চারিদিক খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে পাঁচজন খেয়ালও করল না যে ইতিমধ্যেই আকাশের রং রক্তিম বর্ণ হতে শুরু করেছে,আকাশে কতগুলো শকুন চক্রাকারে উড়ছে ডানা ঝাপটিয়ে।এদিকে ঝন্টুও রীতিমত অধৈর্য্য হয়ে পরছে,কয়েকবার তো "দাদাবাবু!ও দাদাবাবু তাড়াতাড়ি এস গো,আকাশ যে লাল হতে চলেছে"বলে হাঁক দিল,কিন্তু ভিতর থেকে কোনো উত্তর এলোনা।শেষে পূর্বের কথা অনু্যায়ী নিজেকে বাঁচাতে সে একাই বাধ্য হয়ে ভগবানকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।
এতোক্ষণ অবধি তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা ছবি দেখছিল।হঠাৎ একটা "ধড়াম"করে শব্দে সকলের যেনো সম্বিৎ ফিরে এল,এতোক্ষণ তারা সন্মোহিতের মতো সারা প্রাসাদে ঘুরে বেড়াচ্ছিল,বাইরে যেতে হবে সেই বোধটাই যেনো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তাদের।এবারে পাঁচজনেই ছুটল সদর দরজার দিকে,কিন্তু একি??দরজা কোথায় গেল?
প্রাসাদের বাইরে বেরোনোর কোনো দরজা তো নেই,কিন্তু তারা তো সেই দরজা দিয়েই প্রবেশ করেছিল!শুধু দরজা কেনো বাইরে যাবার কোনো জানালাও তো নেই।এতোক্ষণ যেখানে এতগুলো দরজা জানালা ছিল সেখানটা কোনো এক অদৃশ্য মন্ত্রবলে যেনো দেওয়ালে পরিণত হয়েছে।
তবে কি....তবে কি তারা এখানে বন্দী হল?সেটা কিকরে সম্ভব?বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের মন কিভাবে ব্যাখ্যা করবে এর?মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত প্রবাহিত হল প্রত্যেকের।এবার কি হবে??কি করে বেঁচে ফিরবে তারা?আদেও বাঁচবে তো নাকি গ্রামবাসীদের কথা মতো ওরাও শয়তানের খাবারে পরিণত হবে?এ ওর মুখের দিক চাইতে লাগল।তারপর কি মনে হতে নবনীতা ছুটল দোতলায়।যদি কোনো বাইরে বেরোনোর রাস্তা থাকে।কিন্তু না কোনো রাস্তা নেই....বাইরে বেরোনোর সব পথ উধাও।বাধ্য হয়েই নীচে নেমে এল সে।
নীচে নেমে এসে দেখে এদিকে আবার চারজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেছে।অনিতা আর নিলয়ের বক্তব্য সব কিছুর জন্য দায়ী সৌম্যদীপ,বেশি সাহস আর কৌতুহল দেখাতে গিয়ে আজ তাদের এই অবস্থা।তার পাকামির জন্যই সব হয়েছে।তাকে বারণ করা হলেও সে কারো কোনো বারণই গ্রাহ্য করেনি।
অন্যদিকে কল্যাণ সৌম্যদীপের পক্ষ নিয়ে নিলয়কেও দুকথা শোনাতে ছাড়েনি।ঝগড়া যখন একপ্রকার হাতাহাতির পর্যায়ে তখন নবনীতার মধ্যস্থতায় থামল দুপক্ষ।এরকম বিপরীত পরিবেশেও মাথা ঠান্ডা রাখা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
"কি করছিস তোরা নিজেদের মধ্যে?যা হয়েছে সবার সমর্থনেই হয়েছে,এখানে কেউ বাচ্চা নয় যে তাদের জোর করে টেনে আনা হয়েছে।এখন নিজেদের মধ্যে ঝামেলা না করে ভাব কি করে রাতটা কাটাবি,বাইরে বেরোনোর কোনো পথ নেই...আমরা এখানে ট্রাপড।শোন আমরা সবাই একসাথে থাকব আর রাত হবার আগেই চল খুঁজে দেখি হ্যারিকেনজাতীয় কিছু আছে কিনা,নাহলে অন্ধকারে বিশ্রী ব্যাপার হবে,আরেকটা কথা অযথা ভয় পাবিনা,জানবি এসব স্রেফ গালগল্প"-কথাটা নিজের কাছেই হাস্যকর লাগে নবনীতার,কারন ও জানে যা হচ্ছে তা নিছক কল্পনা নয়,কিছু তো অবশ্যই আছে,তাও বাকিদের সাহস দিয়ে বলল"কিছু হবে না আজ রাতে দেখিস,আজ রাতটা কাটাতে পারলেই ব্যাস কোনো চিম্তা নেই আর,একটাই তো রাত ও গল্প করে ঠিক কেটে যাবে।"
ঠিক হল অনিতা আর নবনীতা একসাথে থাকবে,কল্যাণ আর সৌম্যদীপ একসাথে থাকবে,নিলয় থাকবে একা,একটু আগের ঝগড়ার জন্য কেউ তাকে আর দলে নিলনা,তিনটে হ্যারিকেন পাওয়া গেছে,আর দশ-বারোটা মোমবাতি।ঠিক হল যতটা সময় পারা যায় ওরা গল্প করে কাটিয়ে দেবে,ততক্ষণে বসার ঘরে মোমবাতি জ্বলবে,তারপর প্রত্যেকের ঘরে একটা করে হ্যারিকেন আর মোমবাতি থাকবে।দরকার হলে পাশের জনকে নিয়ে ঘরের বাইরে যাওয়া হবে,একা একা কেউ বাইরে বেরোবে না,একা থাকলে হ্যালুসিনেট করার সম্ভবনা থাকে প্রবল।চেষ্টা করেও রাত দশটার বেশি জাগতে পারল না তারা,যে যার ঘরে শুতে চলে গেল।
নিলয়ের আবার ভীষণ বাজে অভ্যাস,রাতে গায়ে চাদর চাপা না দিয়ে সে ঘুমাতে পারে না।শেষে বাধ্য হয়ে বিছানার চাদরটাকেই টেনে নেয় সে,মনটা তার আজ ভীষণই খারাপ,কল্যাণ আর সৌম্যদীপের ব্যবহারে মনটা ভারাক্রান্ত ,তবে সে আজ কিছুতেই ভয় পাবেনা যাই হয়ে যাক না কেন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল নিলয়।
কতক্ষণ অঘোরে ঘুমিয়েছে জানে না,হঠাৎ পায়ে একটা বরফ শীতল স্পর্শে ঘুম ভেঙে উঠে বসল নিলয়,মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই কল্যাণ বা সৌম্যদীপ তাকে ভয় দেখাতে এসেছে।চারিদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে দেখল কেউ নেই,বদমাইশগুলো নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়েছে,চাদরটাকে মাথা অবধি মুরি দিয়ে পাশ ফিরে শোয় ও।
....হঠাৎ মনে হল একটা চটচটে কিছু পা বেয়ে উপরে উঠছে নিলয়ের,সারা পাটা চটচট করছে কোনো কিছুতে,মোবাইলে টর্চটা জ্বেলে চাদরের ভিতর থেকেই জিনিসটাকে দেখার চেষ্টা করল ও,মূহুর্তের মধ্যেই একলাফে খাট থেকে নীচে নেমে এল নিলয়।তারপর চাদরটাকে টেনে সরিয়ে দিল খাট থেকে।
কিন্তু কোথায় গেল??কোথায় গেল সেই কাটা হাতটা যেটা তার পা বেয়ে ওপরে উঠে আসছিল......আচমকাই পায়ে একটা হ্যাঁচকা টান পরল আর মেঝেতে পরে গেল নিলয়,হাতের মোবাইলটায় ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলছিল,সেই আলোতে সে দেখল খাটের তলা থেকে ঘষটে ঘষটে বেড়িয়ে আসছে এক অদ্ভুত প্রাণী,গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে...চাইলেও উঠে যেতে পারছে না নিলয়,কে যেনো তাকে মাটিতে আটকে রেখেছে,সেই প্রাণীর হাতটা আস্তে আস্তে চেপে ধরেছে ওর গলা,শ্বাস নিতে পারছে না ও,কানের কাছে শোনা গেল এক রক্তজল করা আওয়াজ,
"আগেরবার খাটের নীচে এসে যে লুকিয়েছিল,আমার হাত থেকে সে কিন্তু পার পায়নি,তুইও পাবি না,খিদে পেয়েছে আমার খুব জোরে খিদে পেয়েছে...ক্কিক্....ক্কিক্...ক্কিক্......নিলয়ের কষ বেয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে,আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে নিলয়।কিন্তু না হাল ছাড়লে চলবেনা,চরম বিপদে খুব বড়ো ভীতুও সাহসী হয়ে যায়..নিলয়ও কোনোক্রমে সেই প্রাণীটার হাত ছাড়িয়ে ছুটল দরজা দিয়ে....বাইরে বেরিয়ে এসে দিগ্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হয়ে সে ছুটতে লাগল সি়ঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে....সাথে কানফাটানো গগণবিদারী আর্তনাদ........
রচনাকাল : ২৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।