• সংকলন

    নৈবেদ্য


নৈবেদ্য (দ্বিতীয় পর্ব)
সায়ন্তী সাহা
দেশ : India , শহর : সিঙ্গুর

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১৯ , ডিসেম্বর
প্রকাশিত ২৫ টি লেখনী ২৫ টি দেশ ব্যাপী ১৩৭৭৯ জন পড়েছেন।
   মধ্যরাতে হাইওয়ের বুক চিরে সামনের দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে গাড়িটি।রাতের নিস্তব্ধতাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে লাউডস্পিকারে বেজে চলেছে আইটেম সং আর গাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসছে পাঁচজন যুবক-যুবতীর হই-হট্টগোল।প্রত্যেকেই কলেজজীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং সারাবছরের একঘেয়েমিকে দূর করতে পুজোর কটাদিন তারা বেড়িয়েছে আউটিংয়ে।গ্রুপে রয়েছে তিনজন ছেলে এবং দুইজন মেয়ে যাদের প্রত্যেকেই আজ নিজ নিজ কর্মজীবনে বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত।এদের মধ্যে নিলয় আর অনিতা আবার একটু ভীতু টাইপের,এজন্য অবশ্য বাকি বন্ধুরা তাদের নিয়ে যথেষ্ট হাসাহাসি করে।কিন্তু বাকি তিনমূর্তি মানে সৌম্যদীপ,কল্যাণ আর নবনীতা যথারীতি সাহসী এবং ডাকাবুকো।নবনীতার তো আবার চোর পেটানোরও রেকর্ড আছে,প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মাথা ঠান্ডা রাখার এক অদ্ভুত দক্ষতা আছে ওর।
পাঁচজনে চলেছে ছত্তিসগড়ের এক প্রত্যন্ত গ্রামে,শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে একটু মানসিক প্রশান্তি লাভের আশায়।প্রত্যেকের বাড়িতে যদিও সকলে সেই কথাটা জানেনা,বাড়ির সবাইকে বলা আছে তারা যাচ্ছে সৌম্যর গ্রামের বাড়ি,সেখানেই তারা দুর্গাপুজোটা কাটিয়ে তারপর ফিরে আসবে।

যে স্পিডে কল্যাণ গাড়ি চালাচ্ছে তাতে ভোরের মধ্যে তারা গ্রামের মধ্যে পৌঁছে যাবে।গাড়ির মধ্যেও সকলে মিলে নিলয় আর অনিতাকে লেগপুল করতে ব্যস্ত।হাসি-ঠাট্টায় ভরপুর তরতাজা পাঁচটি প্রাণ নিজেরাও জানে না নিয়তির কোন নিষ্ঠুর পরিণতির স্বীকার হতে চলেছে তারা।

"মোড়লমশাই!! আজরাতেই কিন্তু সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সূচনা হবে।কি করব আমরা এবার?শতবর্ষ পর সে যে আবার জেগে উঠবে আজ রাতে,কি হবে এবার মোড়লমশাই"-ভয়ে ভয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করল জগা।
-"আগেরবারে এইসময় কিরম অঘটন ঘটেছিল তা তো লোকমুখে শুনেইছিস?সারা গ্রামে এক্ষুণি ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দে আজ বিকেলের পর থেকে কেউ যেনো ঘরের চৌকাঠও না ডিঙোয়।তাড়াতাড়ি যা জগা সময় বড়ো কম রে।"মোড়লমশাইয়ের কথা শুনে দ্রুতপদে ঘর থেকে প্রস্থান করলো জগা।জগা চলে যাওয়ার পরমূহুর্তেই ঘরে ঢুকল বছর বারোর রোগা ছিপছিপে একটি ছেলে,মোড়লমশাইকে ডেকে বলল,
-"বাবা ওনারা কখন আসবেন?ভোরে আসার কথা ছিল এখনও যে এল না,বেলা দশটা যে বাজতে যায়।"

ছেলে ঝন্টুর দিকে মুখ ঘুরিয়ে মোড়লমশাই আদেশ করেন,
"শোন রে ঝন্টু ওনারা কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত চলে আসবে,ওনারা শহুরে লোক,ওনাদের দেখাশোনার দায়িত্ব তোর,সবসময় ওনাদের সাথে সাথে থাকবি আর ওনাদের চোখের আড়াল হতে দিবিনা।জানিস তো আজ বিকেলের পর বাইরে বেরোনো মানা,দেখিস ওনারা যেনো বাড়ির চৌকাঠও না মাড়ায়।কোনো বিপদ-আপদ যেনো না হয় বাপ।"এইবলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন মোড়লমশাই।তিনি নিজেও জানেন না আজ কি হবে।সারা গাঁয়ের মানুষ অমঙ্গলের ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে।ঝন্টু গম্ভীর গলায় বলল,
-"দেখো বাবা,আমি ওনাদের যত্নের কোনো ত্রুটি রাখব না,তুমি মিলিয়ে নিও,আর আজ দুপুরের পর ওনাদের ঘরের বাইরেও বেরোতে দেব না"।

গ্রামে ঢোকার মুখে যে বুড়ো বটগাছ সেখানেই জমায়েত হয়েছে গ্রামের ছেলে-বুড়ো-মেয়ে নির্বিশেষে সকল গ্রামবাসী।একজন জোরে জোরে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে সকলকে জানাচ্ছে মোড়লমশাইয়ের আদেশ,
"শোনো শোনো শোনো!!আজ সেই অভিশপ্ত দিন যখন একশো বছরের নিদ্রা ভেঙ্গে জেগে উঠবে শয়তান,আর তাই মোড়লমশাই বিকালের পর কাউকে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে যেতে নিষেধ করেছেন।একান্তই যদি কারো প্রয়োজন পরে বাইরে যাবার সে যেন ভুলেও রাজবাড়ির পথে পা না মাড়ায়।শোনো শোনো শোনো...."

যখন সতর্ক বার্তায় মুখরিত গ্রামের আকাশ-বাতাস ঠিক তখনই গ্রামের বুড়ো বটতলায় এসে থামল একটা চারচাকা গাড়ি,তা থেকে নেমে এল পাঁচজন অপরিচিত মানুষ।শহুরে মানুষদের দেখার জন্য রীতিমত তাদের ঘিরে সকলে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পরেছে,হা করে দেখছে সবাই শহরের বাবুদের,এমন সময় ভিড় ঠেলে সামনে এল ঝন্টু।

কোমড়ে হাত দিয়ে গম্ভীর গলায় পাকা গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করল,
"তোমরাই শহর থেকে এসেছ বুঝি?"
-"হ্যাঁ......"-অনিতাকে শেষ করতে না দিয়েই ঝন্টু বলতে থাকে,
-"এই তোমাদের আসার সময় হল?ভোরবেলা আসবে বলে বেলা এগারোটা বাজালে?জানো মা কখন থেকে জলখাবার সাজিয়ে বসে আছে?এবার কখন তোমরা জলখাবার খাবে আর কখনই না ভাত খাবে?"
"তুমি কে গো ছেলে?কিশোরীলাল তোমাকে পাঠিয়েছেন?"ছেলেটিকে চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করে কল্যাণ।
"আরে আমি ঝন্টু গো,আমার বাবাই হল কিশোরীলাল,বাবা তোমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন,চলো চলো বাড়ি চলো"-বলে কল্যাণকে একপ্রকার টানতে টানতে এগিয়ে চলে ঝন্টু।
-"কিন্তু গাড়িটার কি হবে সেটাতো বললে না?"জিজ্ঞাসা করে নবনীতা।
"ওটাকে তো আর সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না,এখানেই বরং থাক গাড়িটা,চলো এবার,যা করবে কাল করবে,আজ বাইরে থাকা বিপদ গো"-প্রায় অধৈর্য্য হয়ে বলে ঝন্টু।
"তাহলে একমিনিট দাঁড়াও,গাড়িটা লক করে আসি"বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে নিলয় লাগেজগুলো বের করে গাড়িটাকে লক করে ঝন্টুর সাথে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

রাস্তায় যেতে যেতে অনিতা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-"হ্যাঁ রে কোন বিপদের কথা বলছিলিস তুই তখন,গ্রামে কি কোনো বিপদ হয়েছে?

"হয়নি গো তবে আজ হবে,বিশাল বড়ো বিপদ,তোমরা তো আবার জানো না,শোনো তবে,"বলে শুরু করে ঝন্টু,
-"আজ এমন একদিন যেদিন সূর্য আর তার সব গ্রহ এক সরলরেখায় থাকে,আর রাজবাড়িতে আজকের তিথিতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে শয়তান।এইসময় জানো ওই রাজবাড়িতে যারা যারা উপস্থিত থাকে তাদের মধ্যে প্রতিটা মানুষই পরিণত হয় শয়তানের খাবারে,তাই তো বাবা আজ বাড়ির বাইরে পা রাখতে বারণ করেছে,তোমরাও বেরিয়ো না বুঝলে?"
-"হোয়াট রাবিশ!!এত কুসংস্কার এরা রাখে কোথায়?"রাগতস্বরেই কথাগুলো বলে ওঠে সৌম্যদীপ।
"আহ্ সৌম্য!!কি হচ্ছেটা কি,কারো বিশ্বাসে অাঘাত করিস না,আমরা এনাদের এলাকায় ঘুরতে এসেছি,এনাদের সংস্কৃতিকে মর্যাদা দেওয়া আমাদের কর্তব্য"মৃদুস্বরে প্রতিবাদ জানায় নিলয়।
"তুই যেমন ভীতুর ডিম একটা,এরকম আদেও শুনেছিস কোথাও?"বেশ ঝাঁঝের সাথেই কথাগুলো বলে সৌম্য,তারপর ব্যঙ্গাত্মক সুরে ঝন্টুকে জিজ্ঞাসা করে,
-"হ্যাঁ রে ঝন্টু তুই নিজের চোখে দেখেছিস এসব?"
"আমি দেখিনি গো দাদাবাবু সে তো একশো বছর আগের ঘটনা,তবে দাদুর মুখে শুনেছি,সে বারে নাকি রাজবাড়ির মধ্যে অনেকে ছিল,আসলে রাজামশাই তো ঘটনাখানা বিশ্বাস করতেন না,আর ওনার জেদের জন্যই অতোকটা মানুষ শয়তানের খাবার হয়ে গেল,পরদিন নাকি কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি।তাই তো এবার বাবা এতো কড়াকড়ি করেছে,যাতে কারো প্রাণ না যায়।"উত্তর দেয় ঝন্টু।
"আচ্ছা ঝন্টু এমন হওয়ার কারণ কি?মানে শয়তান এমন করে কেন?"এতক্ষণে মুখ খোলে কল্যাণ।
"তা তো বলতে পারব না দাদাবাবু,সে আমি জানিনা।"ঝন্টুর এহেন উক্তিতে মুখে হাসি ফোটে সৌম্যদীপের,তারমানে এটা স্রেফ গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই না।
"এই দেখ কথা বলতে বলতে আমরা কেমন বাড়ি চলে এসেছি,ওই যে সামনে কুঁয়ো,ওখানের জলে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে চল, আমি ততক্ষণে বাবাকে ডেকে আনছি"এই বলে কুঁয়োটা দেখিয়ে বাবাকে ডাকতে চলে যায় ঝন্টু।
 
দুপুরে সকলে মিলে একসাথে খেতে বসা হয়েছে,পাঁচ বন্ধু আর কিশোরীলাল একসাথে খাচ্ছেন,এমনসময় সকালে ঝন্টুকে করা প্রশ্নটাই কিশোরীলালকে আবার করল কল্যাণ।কিশোরীলাল প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও সকলের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে শুরু করলেন,

"আজ থেকে ২০০ বছর আগে এখানকার মহারাজ ছিলেন প্রতাপাদিত্য।সুখ-সমৃদ্ধি-ঐশ্বর্য-বৈভব সব থাকলেও ছিল না তার সন্তান।পরপর তিনজনকে বিবাহ করলেও সন্তানের জন্ম কোনো রানিই দিতে পারছিলেন না।রাজামশাইও কম চেষ্টা করেননি,এমন কোনো ঠাকুর-দেবতা নেই যার তিনি পূজো করেননি,এমন কোনো যজ্ঞ নেই যা তিনি করাননি,কিন্তু প্রাপ্তির খাতা সেই শূন্য।সেইসময় রাজাবাবু খবর পেলেন শ্মশানে এসেছেন একজন প্রেতসিদ্ধ শয়তানের উপাসক,তিনি নাকি এতটাই ক্ষমতাশালী যে মরা মানুষকেও এক লহমায় বাঁচিয়ে তুলতে পারেন,এমতাবস্থায় রাজামশাই ছুটলেন তার কাছে,একটাই আর্জি সন্তানলাভের জন্য তিনি যা খুশি করতে পারেন কিন্তু তার সন্তান চাই।তান্ত্রিক রাজী তো হলেন কিন্তু শর্ত একটাই যা বলা হবে তাই রাজামশাইকে পালন করতে হবে।পুত্রমোহে রাজামশাই একবাক্যে সব মেনে নিলেন।তারপর এল সেই কালো রাত.....বলেই আঁতকে উঠলেন তিনি।

   নিজের রাণীর কোল ভরাতে রাজামশাই বলি দিলেন নজন নিষ্পাপ ব্রাহ্মণ বালককে,সন্তানহারা করলেন নয়জন ম‍াতাকে আর এগ্রামে যেচে ডেকে নিয়ে এলেন শয়তানকে।সন্তান লাভ করলেন পরেরবছরই কিন্তু সে বংশই বা টিকলো কোথায়?গতবারে রাজার বংশধর এইঘটনাকে তেমন আমল দেননি আর তারই জেদের বশে মৃত্যু হল সারা মহলের মধ্যে থাকা প্রত্যেকটা মানুষের,পুরো রাজবংশ বিলুপ্ত হয়ে গেল এক লহমায়।"বলতে বলতেই যেন শিহরিত হয়ে উঠলেন কিশোরীলাল।

"আচ্ছা ঠিক কি হয় বলুন তো ওই প্রাসাদে?"-প্রশ্ন করে নবনীতা,"মানে আমি বলতে চাইছি ওইসময় কিকরে  এতজনের মৃত্যু হয়েছিল?তাদের কি করে মারা হয়েছিল সেটা কি বলতে পারবেন?"

-"না গো দিদিমণি তা তো আমরা বলতে পারব না কারণ কোনো মৃতদেহই আমাদের বাপ-ঠাকুরদা নিজের চোখে দেখতে পাননি!তবে আপনারা আজ খবরদার কোথাও বেড়োবেন না যদি নিজের ভালো চান তো।"এই বলে উঠে পরলেন তিনি।

-"স্রেফ ভাঁওতা এসব,যত্তসব বোগাস জিনিসপত্র!নিজেদের খালি মনগড়া গালগল্প।আমি আজই যাব দেখতে ওই প্রাসাদ,দেখি শালা কে কি করে আমাকে"গর্জে উঠে ঘোষণা করল সৌম্যদীপ।
রচনাকাল : ২৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 13  Germany : 1  India : 119  Ireland : 9  Saudi Arabia : 3  Sweden : 9  Ukraine : 7  United States : 116  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  China : 13  Germany : 1  India : 119  
Ireland : 9  Saudi Arabia : 3  Sweden : 9  Ukraine : 7  
United States : 116  


© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
নৈবেদ্য (দ্বিতীয় পর্ব) by Sayanti Saha is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৭৫৮৯