কানফাটানো আর্তনাদ শুনে বিছানায় উঠে বসল কল্যাণ আর সৌম্যদীপ।ঘরে হ্যারিকেনটা তখনও টিমটিম করে জ্বলছে।একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহুর্তেই স্থির করে ফেলে তারা নিজেদের কর্তব্য।হাতে টর্চ নিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এল ঘরের বাইরে।তারপরেই ছুটল নিলয়ের ঘরে।কিন্তু নাহ্!ঘরে কেউ নেই...বিছানা ফাঁকা...পাশের ঘরে গিয়ে দেখল অনিতা আর নবনীতা অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।মনে হয় ওরা কোনো শব্দ শুনতে পায়নি,তাই ওদেরকে জাগানো সমীচীন মনে করলনা দুজনেই।আস্তে আস্তে ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে সাবধানে নিচে নামতে লাগল ওরা।
ছুটতে ছুটতে ছাদে চলে এসেছে নিলয়।রীতিমত হাঁফাচ্ছে এখন সে।কিন্তু.....কিন্তু সেই আওয়াজটা কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না তার।সেই ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসা শব্দটা সিঁড়ি বেয়ে যেনো ছাদে উঠে আসছে।
নিলয় ছুটতে ছুটতে একেবারে ছাদের কিনারায় চলে এল।হঠাৎ করে ছাদ থেকে নীচের দিকে তাকালো নিলয়,আর মূহুর্তেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল ও...মাথা ঘুরতে লাগল রীতিমত।মনে পরে গেল ওর...উচ্চতায় যে ওর ভীষণ ভয়।দুইহাত দিয়ে চোখদুটো ঢেকে ফেলল ও।ঠিক সেই মুহুর্তেই পিঠে একটা হিমশীতল স্পর্শ পেল নিলয়।ঘাড়টা সামান্য বেঁকিয়ে নিলয় বুঝতে পারল সে এসে গেছে...আশেপাশের পরিবেশে কি বিভৎস বোঁটকা একটা গন্ধ।নিলয় বুঝতে পারে দুটো হাত তার গলা পেঁচিয়ে ধরছে।তারপর সবেগে ঘাড়টা সামনে থেকে পিছনের দিকে ঘুরে যায় তার।
আঃ.........আঃ নিলয়ের মারণ চিৎকারে থমকে যায় কল্যাণ আর সৌম্যদীপ।দুজনেই বুঝতে পারে আওয়াজটা আর কোথাও থেকে নয় আসছে ছাদ থেকে।দুজনেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকল ছাদের দিকে।ছাদে এসেই থমকে গেল দুজনে।কই কেউ তো কোথাও নেই।
"হ্যাঁ রে এতটাই ভুল শুনলাম?ছাদে তো কেউ নেই রে?"-অবাক হয়ে এদিক ওদিক টর্চের আলো ফেলে দেখতে থাকল কল্যাণ।
"আচ্ছা নিলয় কি আমাদের সাথে মজা করছে?ও কি আমাদের ভয় পাওয়াতে চাইছে?যদি এমনটা হয় না তাহলে কিন্তু ওকে আমি ছাড়ব না তুই দেখে নিস!"-গজগজ করতে করতে বলল সৌম্যদীপ।
"আচ্ছা তুই অল্পেতে এত রেগে যাস কেনো রে?জানিস তো নিলয় কিরকম ভীতু,বেচারার তো ফোবিয়াও আছে..ও খামোখা কেন মজা করতে যাবে বল?চল আমরা ভালো করে নিজেরা একটু খুঁজে দেখি,বেচারার কোনো বিপদ হলে ঘাপলা হয়ে যাবে কিন্তু"-সৌম্যদীপকে সাথে করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল কল্যাণ।
ঠক্...ঠক্....ঠকাং...ঠক্...ঠক্...ঠক্
দুজনেই থেমে গিয়ে কান খাড়া করে শুনছে আওয়াজটা.....
..ঠক্....ঠক্.....ঠক্....ঠকাং....ঠক্..ঠক্
"হ্যাঁ রে কল্যাণ আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছিস রে?নিলয়ের কিছু হল না তো রে?নীচ থেকে মনে হয় আওয়াজটা আসছে তাই না?চল চল নীচে চল!"সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকে সৌম্যদীপ।কল্যাণ বুঝতে পারে মুখে শত হম্বিতম্বি করলেও বন্ধুর বিপদে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন সৌম্য নিজেও।
অসহ্য আওয়াজটা আস্তে আস্তে বেরেই চলেছে।টর্চ জ্বালিয়ে আশেপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নেয় দুজনেই।মনে হল সামনে থেকে ৩নং ঘরের ভিতরেই আওয়াজটা হচ্ছে।সেদিকেই এগিয়ে গেল ওরা।
ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেল দুজনেই,সারা ঘর জুৃড়ে শুধু একটাই বড়ো সিন্দুক আছে আর তার ভিতর থেকেই আসছে কানফাটানো শব্দটা......ঠক্...ঠক্...ঠক্।
"আচ্ছা নিলয় কি ভিতরে কোনোভাবে আটকা পরে গেছে?"চিন্তাটা মাথাতে আসতেই সিন্দুকের দিকে ছুটল কল্যাণ।প্রাণপণে সিন্দুকের ডালাটা তোলার চেষ্টা করতে লাগল।কল্যাণের দেখাদেখি সৌম্যদীপও ওকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এল।
দুজনে মিলে একটু মেহনত করতেই খুলে গেল সিন্দুকটা,তাতে টর্চ ফেলে যা দেখল তাতে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল ওদের।সিন্দুকে গুটলি পাকিয়ে শুয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর প্রাণী,সারা মুখের মাঝবরাবর কেবল একটাই চোখ,তাও যেনো ভাঁটার মতো জ্বলছে,সারামুখটা মাঝবরাবর চেরা....সারা গায়ে কিরকম মাংস খোবলানো....দুজনেই সভয়ে পিছিয়ে এল একটু।
কি এটা?কোনো জন্তু?কোনো প্রাণী?কি এটা?তাদের বিজ্ঞানমনস্ক মন কোনো যুক্তি খাঁড়া করতে পারছেনা।তবে কি
..?না তা হতে পারে না...কিছুতেই হতে পারেনা...ওসব শুধু কল্পনা,কেবল গাঁজাখুরি গালগল্প।
...ঘষটে ঘষটে সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসছে প্রাণীটা....কিরকম সরীসৃপের মতো দেখতে লাগছে প্রাণীটাকে...
"সৌম্য পালা এক্ষুণি..."বলে দুজনেই ছুটল দরজার দিকে।কিন্তু দরজাটা আস্তে আস্তে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে না?পালাতে হবে যে করেই হোক পালাতে হবেই....
দরজাটা বন্ধ হবার আগেই কল্যাণ কোনোমতে বেরিয়ে আসে।কিন্তু সৌম্যদীপের কেবলমাত্র আর্দ্ধেক শরীরটাই বাইরে আসে আর বাকিটা থেকে যায় ভিতরে।কল্যাণ প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে সৌম্যদীপের হাত তারপর তাকে টানতে থাকে বাইরের দিকে।
ঠিক সেই মুহুর্তে সৌম্যদীপ বুঝতে পারে কিছু একটা তার পা দুটো জড়িয়ে ধরেছে..প্রবল আক্রোশে সে ভিতরে টানছে সৌম্যদীপকে..হাতের নখে ছিন্নভিন্ন হচ্ছে সৌম্যদীপের পা..বুঝতে পারে সৌম্যদীপ কোনো শরীরীর সাথে কল্যাণের লড়াইটা নয়...আর শতচেষ্টাতেও কল্যাণ যে জিততে পারবে না সেটাও ভালোভাবে বুঝে যায় সৌম্য।
শরীরি আর অশরীরির লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত হার মানে কল্যাণ।ওর হাত পিছলে ভিতরে ঢুকে যায় সৌম্যর শরীরটা।কল্যাণ দরজার সামান্য ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল সৌম্যর শরীরটাকে প্রাণীটা টেনে ঢুকিয়ে নিল সিন্দুকের ভিতর....তারপর সজোরে সিন্দুকের পাল্লাটা পরে গেল....
"সৌম্য........"কল্যাণের চিৎকারে ছুটে এল নবনীতা আর অনিতা।অনিতার কোলে এলিয়ে পরল কল্যাণ।
"কল্যাণের জ্ঞান ফেরানো দরকার অনি..কিন্তু সৌম্যটা আবার কই গেল?কল্যাণের সেন্স না এলে তো কিচ্ছু জানা যাবে না।তুই ওকে নিয়ে এখানে বোস...আমি নীচ থেকে এক্ষুণি জল নিয়ে আসছি...তুই কোথাও যাবিনা কল্যাণকে ছেড়ে.."ফোনের টর্চটা জ্বেলে নবনীতা ছুটল নীচে।
টপ্.......টপ্...টপ্....সমানে জল পরার শব্দ হয়ে চলেছে,নীচে নেমে অবাক হয় নবনীতা।আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে?বাথরুম থেকে??সৌম্য কি তবে বাথরুমে গেছে?তবে কল্যাণ চিৎকার করল কেন সৌম্যর নাম ধরে?সাত-পাঁচ ভেবে বাথরুমের দিকেই এগিয়ে গেল নবনীতা।
পুরানো বাথরুম....তার মাঝবরাবর আবার একটা চৌবাচ্চা...তাতে আবার টলমল করছে জল।কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে আসছে সেটা বোধগম্য হয়না ওর।
খুব ক্লান্ত লাগছে।চোখে মুখে জল দেওয়া দরকার।চোখে মুখে জল দেওয়ার জন্য চৌবাচ্চার দিকে এগিয়ে যায় নবনীতা .....
হঠাৎই....জল থেকে দুটো হাত বেরিয়ে এসে সাঁড়াশির মতো পেঁচিয়ে ধরে ওর গলা।তারপর....তারপর হ্যাঁচকা টানে ওকে চৌবাচ্চার মধ্যে টেনে নিল হাতটা....টাল সামলাতে না পেরে চৌবাচ্চাতে ডুবে যায় নবনীতা।একসাথে দশ-বারোটা মাথা ভেসে ওঠে ওর চারিদিকে....প্রত্যেকের মুখ থেকে রক্ত ঝরছে.....প্রত্যেকে মিলে চেষ্টা করছে ওকে ডুবিয়ে দেওয়ার..জলের রংটাও কেমন লালচে হয়ে উঠছে...আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পরছে নবনীতা...শুধু কানে আসছে পৈশাচিক হাসির শব্দ আর একটাই ঘ্যানঘ্যানানি......"খিদে পেয়েছে...খিদে পেয়েছে..."
নাহ্!!হার মানলে চলবে না...কল্যাণের জ্ঞান ফেরাতে হবে...সৌম্যকে খুঁজে বের করতে হবে...যে করেই হোক এখান থেকে বেরোতেই হবে তাদের..নিজের সর্বশক্তি দিয়ে চৌবাচ্চার ভিতর উঠে বসে নবনীতা..চেষ্টা করে বাইরে বেরোনোর...কিন্তু এমনসময়....
রচনাকাল : ২৬/১/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।