বৃদ্ধ হরিপদবাবুর পেনশনটা এখনো চালু হয়নি, নিঃসন্তান মানুষ, আর বাড়িতে রোগে ভুগে রুগ্ন এক স্ত্রী। রিটায়ার্ড হবার পর থেকে ট্রেজারি অফিসের চক্কর কাটতে কাটতে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে গেল হরিপদবাবুর। এমনিতেই তার হাঁপানির ব্যামো, তায় হার্টের অসুখ। ভালো করে যে চিকিৎসা করবেন অত পয়সা কই? তাও লাঠিতে ভর দিয়ে বুড়ো মানুষটাকে প্রায় দিন আসতে দেখা যায়, পরনে সাদা ফতুয়া, সাদা ধুতি, সিঁড়ি বেয়ে দোতলা উঠতে উঠতেই ভয়ঙ্কর রকম হাঁপান।
পেনশনটা কোনোভাবেই চালু হচ্ছে না তার, এইতো আগের সপ্তাহেই অফিসার তাকে খেদিয়ে দিয়ে বললেন- "একি মশাই আপনি আজকে আবার এসছেন? আপনাকে বললাম না সামনের মঙ্গলবার আসুন!! আর আগেই তো বলেছি আপনার ফাইল তাড়াতাড়ি উপরে আনতে গেলে কিছু মালকড়ি ছাড়তে হবে, ফেলো কড়ি মাখো তেল.... কি বুঝলেন হেঁ হেঁ হেঁ"।
ঘুষ কথা টা কানে আসতেই ক্ষোভে, দুঃখে, অভিমানে মাথা নীচু করে বাড়ি চলে যান হরিপদবাবু। সারা জীবন সৎপথে চলার এই পুরস্কার? তাকে কেউ ঘুষের কথা বলবে তিনি ভাবতেও পারেন না। নাহ ঘুষ দিয়ে নয় তিনি তার পরিশ্রমের প্রাপ্য সৎপথেই আদায় করবেন, যত দেরী হোক না কেন।
আজ মঙ্গলবার। আবার এসছেন হরিপদবাবু। লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠেছেন দোতলায়। বড় গরম পড়েছে আজ। দরদর করে ঘামছেন তিনি। এক ভদ্রলোকের মায়া হতে তিনি বেঞ্চ থেকে উঠে বললেন- "এখানে বসুন"। হরিপদ বাবু হাসিমুখে না বলতে যাবেন এমন সময় অফিসারের ডাক পড়ল। হরিপদবাবু আস্তে আস্তে অফিসারের রুমে ঢুকলেন। অফিসার মাথা নীচু করে কাজ করছেন। হঠাৎ দুজনের চোখে চোখ পড়তেই এ কি হল? অফিসার নিজেই তড়াং করে চেয়ার থেকে উঠে ছুটে এল তার কাছে। তারপর একগাল হাসি নিয়ে তার পায়ে প্রণাম করে বলল- "মাষ্টার মশাই আপনি? এখানে? কেমন আছেন?"
অর্ধ ছানি পড়া ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলেন হরিপদবাবু। ব্যাক ব্রাশ করা চুল, সাদা শার্ট পড়া যুবকটি প্রাণোচ্ছল মুখে বলল- "চিনতে পারছেন না মাষ্টার মশাই? আমি বিল্টু আপনার ছাত্র বিল্টু.. অঙ্ক পারতাম না বলে একসময় কত বেতের বাড়ি খেয়েছি আপনার হাতে... সেই যে দুষ্টুমি করেছিলাম বলে একবার...."
মনে পড়ে গেছে হরিপদ বাবুর। আহা সে সব কবেকার কথা, বড় দস্যি ছেলে ছিল বিল্টু ওরফে সুপ্রতীক। অঙ্ক পারত না, আর দস্যিপনা করত বলে কি মারটাই খেত তার কাছে। হরিপদবাবু সস্নেহে বিল্টু কে জড়িয়ে ধরলেন- "সুপ্রতীক,ভালো আছিস বাবা?"
বিল্টু বলল- "হ্যাঁ মাস্টারমশাই, আসুন চেয়ারে বসুন।"
আগের অফিসারের বদলে বিল্টু এখানে বদলি হয়ে এসেছে, ও এখন এখানকার নতুন অফিসার। এতদিন পর মাস্টারমশাই আর ছাত্রের দেখা, পুরোনো দিনের গল্প বেশ জমে উঠেছে ওদের। বিল্টু বুঝতে পারল মাষ্টারমশায়ের পেনশনটা খুব তাড়াতাড়ি দরকার, কিন্তু হচ্ছে না, কিন্তু তিনি তাঁকে মুখেও সেভাবে বলতে পারছেন না। বিল্টু হরিপদ বাবুর হাত ধরে বললেন- "মাষ্টারমশাই, আমি এসে গেছি, আপনার আর কিচ্ছু চিন্তা করতে হবে না, কষ্ট করে রোজ রোজ আসতেও হবে না এই গরমের মধ্যে, আমি দেখছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে দেব স্যার।"
হরিপদবাবু কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। বিল্টু বলল- "আপনার বকুনি, মার, কেশব নাগের বই থেকে অঙ্ক কষতে দেওয়া, না পারলে কান ধরে একপায়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া এসব এখন খুব খুব মিস করি স্যার। কি সুন্দর ছিল, ওসব দিন না?"
হরিপদবাবু সলজ্জ চোখে বললেন- "তুমি তো আর সেই ছোট্টটি নেই বাবা, এখন কত্ত বড় অফিসার হয়েছ, আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছো, এসব বলে আর লজ্জা দিও না আমায়। তোমার সাফল্যে আমি খুব খুশি হয়েছি বাবা, বুকটা আমার গর্বে ভরে গেছে।"
"ঠিক আছে ,দেখো বাবা, আমি আসি আজ হ্যাঁ। আমার স্ত্রী আসলে একটু রুগ্ন, অসুস্থ, বাড়িতে একা আছে তো...."
"আর একটা কথা বাবা, ফাইল এগিয়ে আনার জন্য ঘুষ দিতে পারবো না বাবা, তার চেয়ে দু-দিন না খেয়ে থাকাও ভালো। তুমি তো জানো সারা জীবন আদর্শের পথে চলেছি, সততা ছাড়া আর কিছু জানি না, আগের অফিসার ঘুষ চেয়েছিলেন, কিন্তু ঘুষ দেবার কোনো প্রবৃত্তি বা ক্ষমতা আমার নেই বাবা। তুমি আমার ছাত্র বলেও আলাদা কোনো সুবিধা চাইছি না বাবা। তাতে যত দেরী হয় হোক...."
হরিপদবাবুর ছাত্র অধুনা অফিসার হাঁ করে তাকিয়ে আছে মাষ্টারমশাই এর দিকে। চোখ ভিজে আসছে তার। সংসার চলবেনা তবু সত্য আর সততার পথ থেকে একচুল নড়বেননা অঙ্কের মাষ্টারমশাই।
হরিপদ বাবু বললেন- "আজ তাহলে উঠি বাবা বিল্টু.."
বিল্টু বলল- "এক মিনিট মাষ্টার মশাই.. এক মিনিট.."
হরিপদ বাবু বললেন- "বলো বাবা.."
বিল্টু বলল- "আমিও ঘুষ নেব মাষ্টারমশাই। দুঃখিত, আপনাকে ছাড় দিতে পারবো না আমি। আমার ও ঘুষ চাই।"
হরিপদ বাবু হতবাক। - "কি বলছ বাবা?"
বিল্টু একটা নোটপ্যাড আর পেন এনে বলল- "ঠিকই বলছি মাষ্টারমশাই। যে মানুষটার জন্যই আজকে আমি এখানে, এই অফিসারের চেয়ারে, তাকে পেয়ে এভাবে ছেড়ে দেবার বান্দা আমি নই। আপনার ফোন নাম্বার, ঠিকানাটা এতে একটু লিখে দেবেন প্লিজ? আপনার বৌমার কাছে আপনার অনেক গল্প করেছি, সে আবার খুব আস্তিক, পুজো আচ্ছা করতে ভালোবাসে। একদিন তাকে নিয়ে আপনাদের কাছে যাবার খুব ইচ্ছে, খুব ইচ্ছে তাকে দেখাবো সত্যিকারের ভগবান কেমন দেখতে হয়?"
"দয়া করুন মাষ্টারমশাই, এটুকুই ঘুষ চাইছি কেবল... দেবেন আমাকে?"
মুক্তোর মত স্বর্ণাক্ষরে ঠিকানা লিখছেন হরিপদবাবু, চোখের কোণ দুটো চিকচিক করছে জলে। ঘুষ দিতেও যে এত আনন্দ হতে পারে, সত্যি জানা ছিল না তাঁর।
শুভ শিক্ষক দিবস
রচনাকাল : ৫/৯/২০২০
© কিশলয় এবং স্বাগতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।