আমি আর হিতৈষী দুজনা দুজনের দারুণ বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু এই বন্ধুত্ব সহজে হয়নি। আমরা মানে আমি, দ্যুতি,ধৃতি,প্রজ্ঞাপারমিতা,সৈরেন্ধ্রী,চিত্রাক্ষী,মৌলি,আরুষী,শ্রমণা-আমাদের একটা দারুন মাখো মাখো গ্রুপ ছিল। আমরা পড়াশুনোতে দারুণ রকমের ভাল ছিলাম না ঠিকই। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা সব ছিলাম মাথামোটার দল, বরং সকলেই আমরা বেশ বুদ্ধিমতি ছিলাম — ম্যাডামরা অনেকেই আমাদের একথা বলতেন।আমরা সেইসব ম্যাডামদের পড়া করে স্কুলে আসতাম যাঁরা পড়া না করলে শাস্তি দিতেন। রীতজা ম্যাডাম তো প্রায় রোজই বলতেন—"হ্যাঁ রে বেবুন-চামচিকের দল, তোরা কবে যে বুঝবি বুদ্ধিটাকে ভোঁতা করতে নেই, ভালো কাজে ব্যবহার করতে হয়? তোরা, মানে তোদের এই "নবরত্ন" এর দল একটু মন দিয়ে পড়লেই ভালো করতে পারিস, কিন্তু তোরা করবি না। মরগে! " রীতজা ম্যাডামের মতো চিত্রা, ঐশী, অরুন্ধতী, আলো ম্যাডামরাও একই মত পোষণ করতেন। তবে রীতজা ম্যাডামের "নবরত্ন" বলার কারণটা সহজবোধ্য, যেহেতু গ্রুপ টা আমাদের নয় জনের। কিন্তু ম্যাডাম বেবুন-চামচিকে কেন যে বলতেন তা আজও বুঝিনি। যাইহোক পড়ার ফিল্ডটার প্রতি আমরা সামান্য উদাসীনতা দেখালেও কাঁপিয়ে দিতাম খেলার মাঠ এবং অ্যানুয়াল কালচারাল প্রোগ্রামের মঞ্চকে। টি টি (টেবিল টেনিস) এবং ব্যাডমিন্টনে কোনোবার আমি তো কোনোবার আরুষী চ্যাম্পিয়ন। ওদিকে দ্যুতি দারুণ গিটার বাজায়, মৌলি মাউথঅর্গানে ওস্তাদ, ধৃতি ও শ্রমণা জীবনমুখী গানে ফাটাফাটি। কিন্ত আমাদের সুখের সংসারে আগুন লাগল, প্রজ্বলকের নাম ঐ হিতৈষী।
হিতৈষী খুব সৎ,সত্যবাদী,পরোপকারী,বন্ধুবৎসল,সাহসী এবং চৌখস, খেলাধুলো আর পড়াশুনোয় দারুণ রকমের ভালো। তবে ওর এসব পরিচয় আমরা একটু পরে পেলাম, ধীরে ধীরে পেলাম। শুরুটা কিন্তু বেশ ঝামেলার মধ্য দিয়েই হ'ল। হঠাৎ একদিন দেখলাম — লম্বা, ফর্সা, মাঝারি চেহারার একটা মেয়ে সেকেন্ড ব্রেঞ্চে (মাঝে) আমার বসার জায়গায় ব'সে। পিঠে দুটো টোকা দিয়ে বললাম —'ওটা আমার জায়গা, কাটো'।বিনা প্রতিবাদে ও জায়গা ছেড়ে লাস্ট ব্রেঞ্চে চলে গেল। পাশে বসা দ্যুতিকে জিজ্ঞেস করলাম —'মালটা কে রে? ' দ্যুতির MCQ ধাঁচের উত্তর —"নতুন"।তখন ক্লাস চলছিল জীবন বিজ্ঞানের চিত্রা ম্যাডামের। তিনি সেদিন প্রথমেই হিতৈষীকে জিজ্ঞেস করলেন—
"বলতো, ফটোসিন্থেসিস্ কাকে বলে? " হিতৈষীও ফট করে উত্তর দিয়ে দিল,আমাদের অনেকের চোখ একটু খানি ট্যারা হয়ে গেল, কিন্তু সেদিন ওর পেছনে আমরা লাগলাম না কারণ ওইদিন আমাদের অন্য প্ল্যান ছিল। ঐশী ম্যাডামকে আমরা দু'চোখে দেখতে পারতাম না। তাছাড়া ক্লাস এইটের প্র্যাকটিকাল খাতায় সই করেননি বলে চিত্রাক্ষী ওনার সই নকল করেছিল। বাপরে , চিত্রাক্ষীকে সে কি কামলা। আমরা বাইরে (বাথরুম নামক ছোট বাইরে) যেতে চাইলে আমাদের "নবরত্ন" কে কোনোদিন ছাড়তেন না অথচ অন্যরা সেই সুযোগ পেত। প্ল্যানটা ছিল সোজাসাপটা —'ম্যাডাম ভালো পড়া বোঝান না' –এই অজুহাতে আমরা সবাই মিলে ক্লাস বয়কট করব; আর ম্যাডাম ওদিকে হেডম্যাডাম এর কাছে ধাতানি খাবেন এবং আমরা তা উপভোগ করব।কাউকে অনুরোধ করে,কাউকে শাসানি দিয়ে রাজি করলাম কিন্তু চিত্রাক্ষী সই নকল করে একবার কানমলা খেয়ে আর ম্যাডামকে ঘাঁটাতে চায় না, তাই চিত্রাক্ষী বয়কটে যোগ দিল না আর হিতৈষীকে অনুরোধ করতেই ও সরাসরি বলে দিল – 'এই কাজে আমি নেই'। পরে 'দেখে' নেবার অঙ্গীকার করে তখনকার মতো ওকে ছেড়ে দিলাম। দূর থেকে মজা দেখছি — কী হয় কী হয়! ঐশী ম্যাডাম একবার এসে ফিরে গেলেন, দূরে আমাদের হলে জটলার মধ্যে থেকে আরুষী হঠাৎ বলে উঠল – 'চোরের ওপর বাটপাড়ি, নে এবার দ্যাখ কেমন লাগে। ' ধৃতির মুখ দিয়ে 'শা' এর পর 'লা' টা বেরোনোর আগেই আমি ওর মুখটা চেপে ধরেছিলাম আর বললাম মুখটা একটু সামলা । বড্ড বেয়াদপ, বলল– ' ও. কে '। ও অন্যের দোষ ধরে আর ওর 'শা'_কারী কথাটা এত বাজে যে বড্ড কানে লাগে। ওদিকে হেডম্যাডাম,অরুন্ধতী ম্যাডাম, ঐশী ম্যাডাম, চিত্রা ম্যাডাম, চন্দ্রিমা ম্যাডাম চিত্রাক্ষী আর হিতৈষীকে কী যেন জিজ্ঞেস করছে। ওইদিন দেখলাম চতুর্থ পিরিয়ডে স্কুল ছুটি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরে দেখলাম বাবা-মা কেউ ভালো করে কথাই বলছে না ।তাহলে কি স্কুলে গার্জিয়ান কল হয়েছে? আশঙ্কা সত্যি হল। মূলত নবরত্নের প্ল্যানের কথা সব জানিয়ে দিয়েছে। গার্জিয়ানরা মুচলেকা দিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন, টিফিনের সময় আমাদের নবম শ্রেণীর আটজনের ডাক এল।হেডম্যাডামের ঘরের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। উপরন্তু বাড়িতে ফিরে আর এক প্রস্থ ধাতানি ।এরপর নবরত্নের প্ল্যান –টিফিনের সময় গেট খোলা হয়, বাইরে সবাই টিফিন খেতে বেরোয় – ওই সময় 'হিতৈষী প্যাঁদানী' অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার স্কুল যাব না, সিভিল ড্রেসে কাজটা সারব। কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হল।
কিন্তু কোনো রিপারকেশন হল না বলে আমরা খুব অবাক হলাম।
তারপর দেখি আমাদের খেলার চন্দ্রিমা ম্যাডাম, আমরা যাকে ' কুঁচুটে - বুড়ি ' বলে গোপনে ডাকতাম, উনি বাস্কেট বলে আরুষীর জায়গায় হিতৈষীকে খেলাচ্ছেন।মেনে নিতে পারলাম না, তাছাড়া দু'দিন আগেই হিতষী আমাকে টি. টি (টেবিল টেনিস) র সেটে সটে হারিয়েছে। আমাদের গ্রুপের সবাইকে বলে দিলাম ওকে কেউ ভালো সাপ্লাই যেন না দেয়, ও যেন বাস্কেট করতে না পারে। শনিদেবী গার্লস হাইস্কুলের সাথে ম্যাচ।প্রথম রাউন্ডে কোনো বাস্কেট হল না, ম্যাচ ড্র হল। পরবর্তী ম্যাচ নিউটাউন বালিকা বিদ্যালয়ের সাথে। হাফটাইমের পর হিতৈষীর পরিবর্তে আরুষী নামতেই এক মিনিটের মধ্যে গোল। কিন্ত একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, অপনেন্ট টিমের একজন বল ছোঁড়ার সময় আমার নাকে কুনুই চালাল আর আমি পরে যাবার সময় একজন আমার বাঁ-হাঁটু তে এমন ল্যাঙ মারল যে আমি জ্ঞান হারালাম ।
পরদিন সকালে 'কেয়ার ফ্রি ' নাসিংহোমের ১০ নম্বর কেবিনে শুয়ে। ভোররাতে জ্ঞান ফিরেছে আমার। মা ডেকে তুলে বলল—"কে এসেছে দ্যাখ"।দেখি ক্যাডবেরী ডেয়ারী মিল্কের সেলিব্রেশন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে হিতৈষী। ছোট্ট কথা— 'ভালো, হয়ে ওঠ'। পরে শুনলাম আমার প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় রক্ত দেবার প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু আমার বিরল গ্রুপ, 'o' আর হিতৈষী নাকি আমায় রক্ত দিয়েছে। আগামী দিনগুলোতে আমরা ঠিক করলাম যে আমাদের গ্রুপের নাম পাল্টাবো, এবার থেকে আমরা 'দশাবতার'।হিতৈষীও খুব এপ্রিসিয়েট করল।
আমাদের বন্ধুত্ব বেশিদিন রইল না। হঠাৎ একদিন হিতৈষী বলল—'বাবা বদলি হয়ে যাচ্ছে, আমাদেরও যেতে হবে '। আমাকে কাঁদতে দেখে হিতৈষী বলল—'দ্যাখ পৃথিবীটা গোল, আমাদের আবার দেখা হবে। বন্ধুত্ব তো থাকবেই। আর আজই তো চলে যাচ্ছি না।' প্রজ্ঞাপারমিতা ফস্ করে বলে বসল—'পৃথিবীর দু'ধার একটু চ্যাপ্টা।' অন্যদিন হলে রাগ করতাম, কিন্তু সেই মুহূর্তে সবাই হেসে ফেললাম।
হিতৈষী একদিন সত্যি সত্যিই চলে গেল, আমরা আমাদের এক দারুণ বন্ধুকে আর সেভাবে কাছে পাব না। দেখতে দেখতে আমরা ইলেভেনে উঠে গেলাম। মাধ্যমিকে ৮০ শতাংশ নম্বর পেয়ে নিজের স্কুলেই কলা বিভাগে ভর্তি হলাম। বছরখানেক হল, হিতৈষী কাছে নেই। মাধ্যমিকের ফলাফলে চোখ বুলিয়ে দেখেছি সারা বাংলায় হিতৈষী পঞ্চম হয়েছে। নিজের কথা ভুলে সেদিন গর্বে আমাদের বুক ভরে গিয়েছিল।আনন্দে চোখের জলে চোখ ঝাপসা হয়েছিল।এমনি করেই চলছিল দিনগত পাপক্ষয়। একদিন খবরের কাগজের পাঁচের পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে দেখি— "এক পথ দুর্ঘটনায় এক পরিবারের সকলেই মৃত। পরিবারের কর্তা হিরন্ময় সেনগুপ্ত (৫২), আগমনী সেনগুপ্ত (৪৪),তাঁদের কন্যা হিতৈষী সেনগুপ্ত (১৭) এবং গাড়ির ড্রাইভার দীপক দাস(৩৫) মৃত। আমি কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। অস্ফুটে বললাম, 'হিতৈষী, তুই..........'।।
রচনাকাল : ৩০/১২/২০১৮
© কিশলয় এবং স্বাগতা লক্ষ্মী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।