“এস ঋভুদা, এই আমার বাড়ি।ওপরে বাড়িওয়ালারা থাকে আর একতলাটাতে এই আমরা। পেছনের দিকটা বাগান।“
ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই এক দস্যি মেয়ে ছুটে এলো। “মা আমার চকোলেট?”
“এই যাহ! মামমাম আজ এক্কেবারে ভুলে গেছি সোনা। কাল প্রমিস দুটো এনে দেবো। তুমি পড়তে বসেছিলে?”
মেয়েটা হা করে তাকিয়ে আছে ঋভুর দিকে অবাক দৃষ্টিতে। ঋভু ওকে আদর করে কাছে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো , “ কি নাম তোমার?”
“রিতশ্রী সান্যাল”
সাথে সাথে একঝাঁক ঝিঁঝিঁপোকা ডেকে উঠলো যেন। ঋভুর মাথা টা ঝিমঝিম করতে থাকলো। ও তাহলে রিক্তার শ্বশুরবাড়িও সান্যাল।রিক্তা আর ঋভুর প্রেমের কথা জানতোনা এমন মানুষ হয়তো ওদের গোটা অঞ্চলটায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল। ওদের প্রেম টা লুকিয়ে চুরিয়ে কোনোদিনই হয়নি। বরং বাবা মায়েদের সান্নিধ্য পেয়েছিল বলেই হয়তো ওরা দুজনেই দুজনের বাড়িতে সমান অধিকার পেয়েছিল। ঋভুদের বাড়ির কালীপুজোর জোগাড় কাকিমার সাথে রিক্তার দায়িত্বে থাকতো। ওদিকে রিক্তাদের বাড়ির রং কি হবে তা কাকু আর ঋভু মিলে ঠিক করতো। ছোট থেকে বড় হওয়া প্রেম গুলো হয়তো এইজন্যই এত সুখী। নিজের হাতে লালন পালন করে বড় করে তোলার মতোই প্রাসঙ্গিক। সেবার রিক্তাদের ছাদে বসে ওরা ঠিক করেছিল,
ঋভু বলেছিল “দেখিস আমাদের মেয়েই হবে!”
“ইসস কি শখ ছেলের! বিয়েই হলোনা তায় আবার মেয়ে”
“বিয়ে হল নাতো কি? হবেতো একদিন”
“সে যখন হবে দেখা যাবে”
“হাঁ আর তারপর তোর মতো পুচকি একটা মেয়ে হবে আমাদের”
“তুমি কিকরে জানলে?আর যদি মেয়ে না হয়?”
“আমি জানি হবে। মেয়েই হবে। দেখে নিস। নাম দেব রিতশ্রী।“
হঠাৎ ঋভুর মনে হলো তবে কি ঋভুদা কোনোদিনই ওর রিম এর মন থেকে মুছে যায়নি? যতই রিক্তার বর্তমান জীবনে ঢুকছে ততই এক ধাঁধায় ধেঁধে যাচ্ছে ঋভু।
সম্বিৎ ফিরলো রিক্তার ডাকে ,“ ঋভুদা তুমি একটু বস।আমি লুচিটা করে নিয়েই আসছি এক্ষুনি। আর হ্যা শ্যামলী দি তোমার ময়দা মাখা হলো?…….আর মাম আঙ্কল কে জালিও না যেন। তোমার ড্রইং গুলো দেখাও তো।“
রিক্তা চলে গেল রান্নাঘরে।মাম আঁকার খাতা আনতে আর ঋভুর চোখ গিয়ে আটকে গেল দেওয়ালে টাঙানো একটা পুরোনো ফটোফ্রেম এ।কত স্মৃতি যে ধেয়ে আস্তে লাগলো ফের। স্মৃতির সুনামি। ঋভুর তখন ইলেভেন। রিক্তার এইট। দুই পরিবারের সকলে মিলে শ্যামবাজার মোড়ের সেই স্টুডিও তে গিয়ে তুলেছিল ফটোটা। দুজনের বাড়িতেই বাঁধানো ছিল। রিক্তা এই ছবিটা শশুরবাড়ি ও নিয়ে এসেছে? বড়ই অবাক লাগে ঋভুর। এখনো পর্যন্ত রিক্তার হাসব্যান্ড কে দেখেনি ও।রিক্তার শাঁখা সিঁদুর কিছুই তো দেখলনা। তবে কি? ভাবতেই ঋভুর ভীষণ কষ্ট হলো। এটুকু বয়সেই মেয়েটা।।।।
মাম এদিকে ওর ড্রইং দেখিয়ে চলেছে। আর ঋভু ভেবে চলেছে । মাম এর বাবার কথা কি ওকে জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে? কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। আর থাকতে না পেরে করেই ফেললো প্রশ্নটা,
“মাম তোমার বাবা কে দেখছিনা। অফিসে বুঝি”
মেয়েটা নিষ্পাপ দৃষ্টি নিযে ঋভুর দিকে খানিক্ষন তাকিয়ে, “ বাবা? নাতো। বাবা তো আসেনা এখানে। জানো আঙ্কল আমি মাকে জিজ্ঞেস করলেই মা বলে বাবা একদিন হঠাৎ করে এসে আমায় সারপ্রাইজ দেবে”
আরো অবাক হয়ে যায় ঋভু। সব কেমন পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
“তাই? তুমি দেখেছো তোমার বাবাকে?”
“হ্যাঁ ঐতো বাবার ছবি দেখ। ওখানে টাঙানো।“ মাম ওর ছোট্ট আঙুল দিয়ে দূর থেকে ইশারা করে দেখাতে থাকলো,,”ওই যে ঐটা মা, ওই নীল জামা টা বাবা, ওটা দাদু দিদা আর এইদিকে ঠাকুরদা আর ঠাম্মা।“
জীবনটা হঠাৎ কোথাও থেমে গেলে হয়তো এমন হয়। অতীতের এক ঝোড়ো হাওয়া হঠাৎ করে কাঁপন ধরিয়ে গেলে এমন হয়। অনেকদিনের পরে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে গেলে এমন হয়। অপূর্ণ স্বপ্নগুলো হঠাৎ একযুগ পর এভাবে অবাক করে দিলে হয়তো এমন ই হয়। ঠিক এখন ঋভুর যেমনটা হচ্ছে।কি হচ্ছে কেন হচ্ছে কিছুই বুঝছেনা ও। অথচ এটাই সে চেয়ে এসছে বরাবর। খালি মাঝের একটা ঘটনা না ঘটলে হয়তো…..
সেবার ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ঋভুর প্লেসমেন্ট হলো।ব্যাঙ্গালোরে। নতুন চাকরি নতুন জায়গা, নতুন বন্ধুবান্ধব।জীবনের গতি এক ধাক্কায় বেড়ে গেল অনেক খানি। পরিচয় হলো ঝা চকচকে সিমোনের সাথে। স্মার্ট সুন্দরী কনভেন্ট এডুকেটেড মেয়েটির সাথে উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের নিতান্তই সাধারণ ঘরোয়া রিক্তার বিস্তর তফাৎ।সেই বুঝি দূরত্ব শুরু হলো ঋভুর ওর শিকড়ের সাথে। দিনের দশবার এর ফোন এসে ঠেকলো তিনবার,,দুবার আর তারপর একবারে।। শুরু হলো এক চাপানউতোর। ঋভু কিছুই বলেনা। রিক্তার চাপা টেনশন এদিকে বেড়ে চলে। পারবেনা ও ধরে রাখতে জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে? ঋভু মাস ছয়েক পর ফিরলো দিন দশেকের জন্য। সবই চললো ঠিকঠাক।রিক্তা চেয়েছিল কথা তুলতে। ঋভু তোলেনি।
“সবই তো ঠিক আছে, কেন এরকম বিহেভ করছিস? কিছুতো হয়নি!”
“তাহলে কেন এরম ইগনোর করছো আমায়?”
“রিম যথেষ্ট বয়স হয়েছে তোর।ইউ আর এনাফ ম্যাচিউরড নাও।বোঝার চেষ্টা করবি এটুকু এক্সপেক্ট তো করতে পারি? আরে বিজি থাকি। ইয়ার। আর আমার কোম্পানি তোকে ফোন করার জন্য আমাকে বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দেয়না?”
রিক্তা থ মেরে গেছিলো। বুকের ভেতর কেউ একশ মন পাথর চাপিয়ে দিয়েছে মনে হলো।একটা কথাও আর বলতে পারেনি ও। শুধু ভেসেছিল ওর চোখ।
ঋভুও আর দাঁড়ায়নি। বেরিয়ে গেছিলো ঘর থেকে।
পরেরদিন আবার সব ঠিকঠাক।আসলে রিক্তা প্রতিটাবার ঋভুর দোষ ত্রুটি গুলো সব ভুলে যায়। বাবা মা ঋভু ছাড়া ওর আর আছে কে? নিজের পৃথিবী টাকে ওর খুব ছোট মনে হয়। এই কটা মানুষকে নিয়েই তো মানিয়ে গুছিয়ে চলা।পারবেনা ও? ঠিক পারবে।খুব পারবে।
সেদিন সকালে রিক্তার বাবা মা গেছিলো দক্ষিনেশ্বর। ঋভু চলে যাবে পরের দিন। দেখা করতে এসছিল রিক্তাদের বাড়ি। ফাঁকা বাড়ি।হঠাৎ ভালোবাসার আঁচে কিজানি কিভাবে কি হলো? পুড়ে গেল দুজনেই। দুটো মন দেহ একাকার হয়ে গেল। এর কি কোনো ই প্রভাব পড়বেনা ঋভুর ওপর? ওর মনে জীবনে? রিক্তা ভেবেছিল..হয়তো এভাবেই ওকে পাকাপাকি ভাবে বাঁধতে পারবে, সব উজাড় করে দিয়ে। …..পেরেছিল কি? পরেরদিন ঋভু ফিরে গেছিলো ব্যাঙ্গালোরে। আর আবার একবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেরি হয়নি।
রচনাকাল : ৪/১/২০২০
© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।