প্রতিদিন সন্ধ্যের আর বিকেলের এই মাঝামাঝি সময়টা রিক্তা এসে বসে এখানে . এই ঝিলের ধারের বেঞ্চিটাতে ..এদিকটায় ঝোপঝাড় খুব. বড় একটা কেউ আসেনা এদিকে . তাই হয়তো আরো বেশি ভালোলাগে ওর জায়গাটা . নিজের সাথে বেশ খানিকটা সময় কাটানো যায় .আর সূর্যটা যখন লালচে আভায় ঝিলটাকে রাঙিয়ে দেয় তখন আরো মায়াবি লাগে ঝিলটাকে ..মনে হয় লাল টুকটুকে বেনারসি পরে ..রিক্তা ভাবে সূর্যের সাথে বিয়ে দেবে ঝিলটার. ভেবে নিজেই মনে মনে হাসে..এখানটায় বসে কত কথা মনে পরে ওর …ছোটবেলা..ভোলাদাদের ছাদে ঘুড়ি ওড়ানো .. ঠাকুমার আচারের বয়াম থেকে আচার চুরি করে খাওয়া ..দুপুরে না ঘুমিয়ে ছাদে যাওয়ার জন্য মায়ের বকুনি ,, প্রথমবার সাইকেল শিখতে গিয়ে পরে যাওয়া। সরস্বতী পুজোয় প্রসাদ দিতে ঋভুদাদের বাড়ি যাওয়া, কাকিমার হাতের নাড়ু মোয়া আরো কতকি। এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যে নামে। রিক্তা ভাবে আর দেরি করা ঠিক হবেনা। সন্ধ্যের পর এদিকটায় আর না থাকাই ভালো। দিনের আলোতেই যেখানে কেউ আসেনা, তবুও ও জানে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জনকোলাহল থেকে দূরে থাকা জায়গা গুলোই তাকে শান্তি দেয়। ও মন খুলে শ্বাস নিতে পারে এখানে। ভাবতে ভাবতে রিক্তা এগিয়ে চলে মেঠো পথ বেয়ে। দূরে পাকুরগাছটার কাছে একটা ল্যাম্পপোস্ট ।শীতের সন্ধ্যে। গায়ের চাদরটা আরো একটু ভালো করে জড়িয়ে নেয় রিক্তা। সামনে পায়ে পায়ে চলতে চলতে চোখে পড়ে আবছা একটা অবয়ব। ল্যাম্প পোস্টটার কাছে আসতেই মুখটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বুকটা ধড়াস করে উঠলো রিক্তার। কাকে দেখছে ও? সবকিছু যেন থেমে গেল হঠাৎ করে। এক লহমায়। ভূমিকম্প চলছে। বুকে একশত হাতুড়ি পিটছে কেউ। চশমাটা ঝাপসা হয়ে আসছে। সেই ঋতব্রত সান্যাল না? আজ ১৪ টা বছর পর আবার কেন ? অতীত বুঝি আবার ঘর করতে এলো? যে স্মৃতিগুলো ওকে ধাওয়া করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় , এতদিন যেগুলো থেকে ও পালিয়ে বেরিয়েছে ,সেই ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত যেগুলোর চিরস্থায়ী ক্ষত রয়ে গেছে কেন তারা আবার এতদিন পর সামনে এসে হাজির? কেন? ভগবান আবার কি পরীক্ষা নিতে চলেছেন? মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড়। তবু এক আকাশ স্তব্ধতা। ভাঙলো সেই।
“রিম তুই?এখানে?”
খানিক্ষন থেমে নিজেকে সামলে নিলো রিক্তা, “চিনতে পারলে?” হয়তো অভিমান ঝরে পড়লো।
“আমার চোখ তোকে চিনবেনা রিম?” গলায় একরাশ ব্যাকুলতা।
রিক্তার বাঁকা হাসি “ না চেনার ই তো কথা”
“ এখনো অভিমান করে আছিস আমার ওপর?”
“১৪ টা বছর কেটে গেছে ঋভুদা। এসব মান অভিমান কিছুই নেই আর। ছিলও না হয়তো কোনোদিন। যাকগে বাদ দাও এসব। তুমি এখানে? বিয়ে করেছ নিশ্চয়। ছেলে না মেয়ে?”
“বিয়ে? ছেলেমেয়ে?..” ঋভু নিজেই মনে মনে হেসে ফেললো। “ এখানে আমাদের কোম্পানি এর একটা প্লান্ট বসছে। তার দায়িত্ব নিয়েই এসছি। থাকতে হবে কদিন। তা তোর শ্বশুরবাড়ি বুঝি এখানে?”
কথা শেষ হতে না হতেই রিক্তার ফোন টা বেজে উঠলো।
“ হ্যা শ্যামলী দি বল। কি? আবার এক বায়না? কৈ সে ফোনটা দাও ওকে। কি মামমাম আবার শুরু করেছিস? এখুনি গিয়ে বই খাতা নিয়ে বস।আমি আসছি এক্ষুনি। আচ্ছা শ্যামলী মাসি কে একটু ফোনটা দেতো। ও শ্যামলী দি শোনো তুমি এক কাজ কর তো। কিছুটা ময়দা মাখো আর পাঁচটা মতো আলু দমের মতো করে কেটে রাখো। আমি আসছি।“
ঋভু হা করে তাকিয়ে, “ তোর মেয়ে বুঝি? খুব দুষটু তোর মতো? বললি নাতো বর কিকরে?”
“ সব কি এখানেই জিজ্ঞেস করবে? বাড়ি চলো আগে”
“এই নানা আজ না। আজ থাক। আমিতো আছি এখানে সপ্তাহখানেক মতো। অন্যদিন যাবো নাহয়।“
রিক্তার ধমকানির কাছে কোনোদিনই ঋভু পাত্তা পায়নি।
“শুনলেনা শ্যামলী দিকে কি বললাম? লুচিতে আমার গা গুলোয় তুমি জানোনা? ওগুলো কি আমি নিজে খাওয়ার জন্য বানাতে বললাম?”
ঋভু মনে মনে ভাবলো রিক্তার ঝাঁঝ এখনো কমেনি। সেই দস্যি দামাল খিলখিলিয়ে হেসে ওঠা , অযথা রাগ দেখানো মেয়েটা এখনো কোথাও লুকিয়ে বেঁচে আছে। মরে যায়নি।খালি পাতলা গাম্ভীর্যের আস্তরণে ঢেকে গেছে একটা মানুষ। একটু খুঁড়লেই হয়তো একটা সবুজ পাতাভরা গাছ বেরিয়ে আসবে।
একসাথে প্রায় একযুগ পর হাঁটা পাশাপাশি। অনেক কিছুই বদলে গেছে। যায় ও। সময় বয়স অভিজ্ঞতা অনেকটাই পরিণত করে তুলেছে পরিস্থিতি আর মানুষ দুটোকে। ঋভুর মনে পড়ে রিক্তার মায়ের হাতের লুচি আলুর দম। উফফ!! সলিড বানাতো কাকিমা। আর রিক্তা তো দুটোর বেশি খেতেই পারতোনা। ঋভুর তখন কলেজ।ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, ফোর্থ ইয়ার। রিক্তা সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। সেবার লক্ষীপূজোয় প্রথম নিজে হাতে লুচি আলুর দম রেঁধে খাইয়েছিল ঋভু কে।ছাদের ঘরে ঋভু কে লুচি দিতে গিয়েছিল রিক্তা। গুনে গুনে এগারোটা লুচি আর একবাটি আলুর দম এক নিমেষে সাবড়ে দিয়ে বলেছিল মিষ্টি লাগবে। মিষ্টি আনতে নিচেই পা বাড়াচ্ছিলো রিক্তা আর ঋভু ওর হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিয়ে নিয়েছিল ওর পছন্দের মিষ্টিটা। সেই প্রথম। রিক্তার হাত পা অবশ হয়ে গেছিলো। দম বন্ধ হয়ে গেছিলো এক অদ্ভুত ভালো লাগায়। ফর্সা গাল দুটো ডালিম ফলের মতো রাঙা টকটকে হয়ে গেছিলো। আর ঋভু হেসে চলেছিল হো হো করে ওর ভয় পাওয়া লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ টা দেখে।
রচনাকাল : ৪/১/২০২০
© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।