"টেঁপিইইইদি...ও টেঁপিদিইইই ..."লাফাতে লাফাতে ছুটে এসে আমি টেঁপিদিকে জড়িয়ে ধরলাম।
"ওই দেখো!!!যদিও বা হাফ তারকাটা ছিল,যমরাজের কেবিন থেকে ঘুরে আসার পর এখন দেখে তো মনে হচ্ছে ওর মাথার সবকটা তারই কেটে গেছে"-আমাকে আসতে দেখে ঠেস মেরে বলল পটলা।
আমি ওর ফালতু কথায় পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলুম না,আবার উত্তর না দিয়েও থাকতে পারলাম না,মুখ বেঁকিয়ে বললাম,
"দেখ কাকা,বেশি ফটর ফটর করো না,তুমি জানোনা আমি কি চিস আছি,বেশি ঘাঁটাতে এসোনা হ্যাঁ,নাহলে এমন দু-চারঅক্ষরের পাঁচালি শোনাব না,কানে অন্ধ হয়ে যাবে,হুম।"
"আরে ওর কথা বাদ দে না বোনু,বৌদির কাছে দিনরাত মুখঝামটা খেয়ে খেয়ে ও ওমনধারা খেঁকুড়ে হয়ে গেছে,জাস্ট ইগনোর কর ওকে,তুই বল ভাইভায় কি হল?"-চিন্তিতমুখে জিজ্ঞেস করল টেঁপিদি।
"দি আমি ভালোভাবে পাসও করেছি আর যমরাজ আমাকে বরও দিয়েছেন,উনি বলেছেন উনি আমাকে ছেলে খুঁজে দেবেন,কিন্তু দি এই প্রেতপ্রাশনটা কি জিনিস গো"-টেঁপিদিকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
"এই,এই,শোন না,বলছি তুই কি তোর মাথার নাটটা যমরাজের কেবিনেই ফেলে এসেছিস?যা তো,যা, একছুটে গিয়ে দেখে আয় তো একবার!!মেঝেতে পরে থাকতে দেখলে কুড়িয়ে নিয়ে আসিস"-ফ্যাকফ্যাক করে হাসতে হাসতে বলল পটলা।
"কেন,কেন?তোমার ওমন মনে হওয়ার কারণ কি?"-ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
"না মানে তুই কি আগের জন্মে অ্যাবনর্ম্যাল ছিলিস?জীবনে অন্নপ্রাশনের নাম শুনিসনি কোনোদিন?",আমাকে খেঁকিয়ে উঠল পটলা,
"তোদের মর্ত্যে অন্নপ্রাশনও যা আমাদের যমলোকে প্রেতপ্রাশনও ঠিক তাই,সিম্পল জিনিস একটা!!মর্ত্যে যাহা অন্ন প্রেতলোকে তাহাই প্রেত,তুই ট্যালা বলেই বুঝতে পারছিসনা,উফ্ কোথা থেকে যে চলে অাসে এরকম অাঁতেল পাব্লিকগুলো"-মুখ বেঁকিয়ে আমাকে বলল পটলা।
আমার মাথাটা আবার গরম হতে শুরু করেছে এমন সময় টেঁপিদি বলল,
"আরে মর্ত্যে অন্নপ্রাশনে যেমন মুখেভাত হয় না, আমাদের এই অনুষ্ঠানেও ঠিক তেমনিভাবেই মুখে ভাত হয়,এইদিন আমাদের এখানে পাঁচতরকারি ভাত,পায়েস খাওয়ানো হয় যমলোকে আসা নতুন অতিথিকে,তারপর তার নামকরণ হয় বুঝলি।এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তোর সাথে ওইলোকের সব সম্পর্ক পাকাপাকিভাবে ছিন্ন হবে,তুই স্থায়ীভাবে প্রেতলোকের মেম্বার হবি।"
"ওকে আর অতো ঝুড়ি কোদাল নিয়ে বোঝাতে হবে না,ও যা টিউবলাইট ও এমনিতেও এসব বুঝবেনা,তুই তাড়াতাড়ি চল বরং,ওকে নিয়ে সঞ্জুর কাছে যেতে হবে,ওখানে ওকে দিয়ে আমাকে আবার তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে,জানিস আমার না আবার আজ রাতে রান্না করার ডিউটি পরেছে,ঠিকঠাক সময়ে বাড়ি না পৌঁছালে বউ আমাকে বেলনি দিয়ে হেব্বি পেটাবে,এই টেঁপি তুই চল না বাপু"- হনহন করে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো পটলা,ওর পিছনে আমি আর টেঁপিদি ওকে নিয়ে হ্যা-হ্যা করে হাসতে এগোতে থাকলাম।
রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে এখানকার হরেকরকম নিয়মকানুন সম্পর্কে জানতে পারলাম।ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনে কেউ রিজেক্ট হয়ে গেলে সে সোজা চলে যায় নরকে,সেখানে ওদের কাউকে গরম তেলে ভাজা হয় তো কাউকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করা হয়,কাউকে আবার গরম কয়লার ওপর দিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়,অপরাধ একটাই তারা কাগজ থুড়ি ঠিকঠাক টোকেন দেখাতে পারেনি,এতোটা রাস্তা আসতে গিয়ে হয়ত পথেঘাটে কোথাও ফেলে দিয়েছে,কিন্তু যমরাজ্যে কোনোভাবেই অনিয়ম হয়না।নিয়ম এখানে নিয়মই,তার কোনো শিথিলতা নেই।
ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনের পর ভাইভাতে যারা ফেল করে তাদের অবস্থা হয় আরো শোচনীয়,তাদের পুনরায় পাঠানো হয় মর্ত্যে,সেখানে তাদের একশোটা ভালোকাজ করতে হবে,মানে ওই ধরুন কেউ মরতে গেলে তাকে বাঁচাতে হবে,অসহায় কোনো মানুষদের উপকার করতে হবে,কিন্তু এখানেও রয়েছে মস্ত বড়ো একটা গ্যাঁড়াকল।
যখন কোনো মানুষ মরে গিয়ে প্রেত হয়ে যায় তখন তার মনের মধ্যে থেকে যাবতীয় শুভবুদ্ধি দূর হয়ে অশুভ শক্তির উদয় হয়।সেই অবস্থায় কাউকে সাহায্য করা ভীষণ চাপের ব্যাপার।এমনও হয় ৯৯তম ভালোকাজ করার পর ওদের দ্বারা অজান্তেই কোনো ভুলকাজ হয়ে যায়।ব্যাস তার হিসেবের খাতা শূণ্য হয়ে যায় তখন,আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয় তাকে।
সঞ্জয় যমলোকের অলিখিত ডাক্তার,রীতিমতো ফিটনেস চেক করে তবে সে যমরাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেয়,আমরা পৌঁছালাম ওর অফিসে।
সঞ্জয়কে দেখতে কি হ্যান্ডসাম!!!উফ্ফ্!!উফ্ফ্!!!পোলাতো নয় এতো একেবারে আগুনের গোলা রে বাবা!!আমার "দিল মে লাড্ডু ফুটা"।মুখ খুলে হা করে চেয়ে আছি ওর দিকে,পটলা আমাকে একটা রামচিমটি কেটে বলল,
"মুখটা বন্ধ কর মা!!নাহলে মুখের মধ্যে নরকের কীট ঢুকে যাবে!!"বলেই বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল,ওর এই হাসিটা দেখলেই না আমার গা পিত্তি একেবারে জ্বলে যায়,অসহ্যকর!!
সঞ্জু থুড়ি সঞ্জয় হিরোসুলভ ভঙ্গিমায় এগিয়ে আসল আমাদের দিকে,ধবধবে সাদা দেখতে ওকে,একেবারে দুধসাদা,টুয়েলভ প্যাক বডি,ইয়ে মানে টুয়েলভ প্যাক বলতে বক্ষ পিঞ্জরের ওই বারোটা হাড়ের কথা বলছি আমি,হেঁ হেঁ,বুঝতে পারছি ওকে দেখে আমার হার্টবিট একলাফে দশগুণ বেড়ে গেছে,ওর ওপর আমি যে চরমভাবে ক্রাশ খেয়েছি সেকথা ওকে বলব কিনা ভাবছি,কানের কাছে তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছে,"তু নে মারি এন্ট্রি ইয়ার,দিল মে বাজি ঘন্টি ইয়ার...."এমন সময় চূড়ান্ত আনরোম্যান্টিকের মতো সুর-তাল কেটে সঞ্জু বলে উঠল,
"এই মেয়ে পরীক্ষা দিবি চল।"
"আবার পরীক্ষা!!শালা এটা যমরাজ্য না কলেজ!!এসে থেকে শুধু পরীক্ষাই দিয়ে চলেছি!!"-ব্যাজার মুখে বললাম,
"আবার পরীক্ষা!!বলছি ইয়ে মানে স্যার আর পরীক্ষা দিতে ভালো লাগছেনা,আপনি একটু ম্যানেজ করে নিন না!!আমার ওই জন্মের মেডিকেল হিস্ট্রি এক্কেবারে ফাইন!!হেঁ হেঁ বিশ্বাস করুন,মা ক্কালীর দিব্যি বলছি বেঁচে ছিলাম যতদিন একবারের জন্যও আমার সর্দিটা পর্যন্ত হয়নি,ওই বেসিসেই পাসটা করিয়ে দিন না স্যার।পিলিসসস..."
জুলুজুলু চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল সঞ্জু,তারপর গম্ভীরস্বরে বলল,
"বটে!!তা মনে আছে নিশ্চয়ই তোমাকে দুমাসে পাঁচবার কুকুরে কামড়েছিল?প্রায়ই তুমি মাথা ঘুরে পরে যেতে এখান সেখান?কোনো খাবার তোমার হজম হতোনা?তা বাছা এগুলোকে তোমার কোনদিক থেকে ফিট অ্যান্ড ফাইনের সিম্পটম বলে মনে হয়?শোনো মেয়ে এ লাইনে অভিজ্ঞতাটা তো আর আমার কম দিনের হলো না,কালে কালে কত কি যে দেখলুম,দেখে দেখে গায়ের এই কালো রং সাদা হয়েছে আমার,আমাকে টুপি পরানোর চেষ্টা করোনা তুমি"
"এই তোকে কুকুরে কামড়ে ছিল?এ বাবা!!তাই বলি তুই এমন খেঁকুড়ে কেন!!দেখলি টেঁপি এইজন্যই ও সেই থেকে ঘ্যাঁক-ঘ্যাঁক করছে,যতই হোক বিষের একটা প্রভাব আছে তো নাকি!!হ্যাঁ রে সেই কুকুরগুলো তোকে কামড়ানোর পর বেঁচে ছিল তো?না মানে যা বিষমাল তুই,ছ ঘন্টাতেই আমাদের জ্বালিয়ে খেলি, বেচারা ওরা তো আবার তোকে কামড়েছিল, এতোদিনে সেগুলো মনে হয় পটল তুলেছে,বেচারাদের আত্মার শান্তি কামনা করি "-আমাকে প্যাঁক মেরে বলল পটলা।
"তোমায় আমি দেখে নেব কাকা,চুন চুন কে বদলা লুঙ্গা তুমসে,আপনা টাইম আয়েগা,এর শোধ যদি না আমি নিতে পেরেছি আমার নাম আমি বদলে দেব"-দাঁত খিঁচিয়ে কথাটা নিজের মনেই বললাম।
"তা মেয়ে চলো তো, এখান থেকে একছুটে দৌড়াতে দৌড়াতে যমরাজ্যটাকে একপাক ঘুরে এসো তো দেখি"-সঞ্জুর মুখে ছোটার কথা শুনেই আমার মানসপটে ভেসে উঠল কলেজ স্পোর্টসের ঘটনাটা।
একশো মিটার রেসে শেষ থেকে সেবার ফার্স্ট হয়েছিলাম আমি,জুনিয়রদের সামনে মানসম্মানে গ্যামাক্সিন পরে গিয়েছিল একেবারে।না না এবারে আর সেই ভুল করলে হবে না,মানুষ তো তার অতীত থেকেই শিক্ষা নেয় নাকি।এখানে আবার পটলা আছে,ও তো আরো একটা জিনিস!!ওর সামনে এরকম কিছু ঘটলে আমার এই প্রেতলোকে টেকাই দায় হয়ে যাবে,না তা হতে দেওয়া যায় না,আমতা আমতা করে তাই শেষমেষ বলেই ফেললাম,"আর কোনো অপশন নেই স্যার?"
"কেন বাছা?এটা কে কি তোমার মর্ত্যের এমসিকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পেয়েছ নাকি?যে তোমাকে আমি চারখানা করে অপশন দেব?মরণদশা,বলি মামাবাড়ির আবদার পেয়েছ?যা বলেছি তাই করো"-সঞ্জুর ধমক খেয়ে আমি ছুটতে শুরু করলাম,পিছন থেকে শুনতে পাচ্ছি টেঁপিদি চিৎকার করে চলেছে,
"ভাগ বোনু ভাগ!!কাম অন বোনু!তুই পারবি বোনু,ইউ ক্যান ডু ইট!!বোনু!!বোনু!!"
পটলার গলার স্বরও শুনতে পেলাম মনে হয়,বলছে,
"ছোট,ব্যাটা ছোট,না ছুটলে তুই কিন্তু পাস করতে পারবিনা,আর তেনাকেও কিন্তু পাবিনা,ছোট ছোট,নিজের জন্য না হলেও তেনার জন্য ছোট।"
আজ আমি সিঙ্গেল বলে পটলা সর্বসমক্ষে আমাকে নিয়ে খিল্লি করছে,রাগে গসগস করতে করতে বললাম,"তোর আজ হচ্ছে পটলা,তোকে আমি হাতে মারব না ভাতে মারব,তোকে আজ যদি আমি বৌদির বেলনির বাড়ি খাওয়াতে না পেরেছি তবে আমার নামও সায়ন্তী সাহা নয়,হ্যাঁ!!"
সেদিন কিন্তু আমি পরীক্ষায় পাস করেছিলাম,যমরাজ্যে এন্ট্রিও হলো,আর হ্যাঁ সেদিন টেঁপিদির সাথে ফন্দি এঁটে পটলাকে আমি বৌদির হাতে মারও খাইয়েছিলাম।
এখন অামি প্রেতলোকের স্থায়ী বাসিন্দা,প্রেতপ্রাশনটা আমার বেশ ধুমধাম করেই হয়েছিল,মেনুতে কি কি না ছিল সেদিন,শুনবেন আপনারা?শুনুন তবে,কিন্তু খবরদার!!একদম হ্যাংলার মতো লোভ দেবননা,এখন কিন্তু আমি পেত্নী, ঠিকাছে,রেগে গিয়ে আপনাদের কিন্তু ঘাড় মটকে দেব,
:: টিঙ্কুর প্রেতপ্রাশনে আজকের মেনু::
১)জেলিফিশের কাসুন্দী
২)শকুনের ডিমের ডেভিল
৩)ব্যাট বিরিয়ানী
৪)চিলি মাউস
৫)অক্টোপাশের পাতুরি
৬)ধুতরো ফলের চাটনি
৭)সাতদিনের বাসি পাঁপড়
৮)ঘিলু স্পেশাল মিস্টি
৯)পায়েস
১০) আইসক্রিম
ধন্যবাদান্তে,
চমকাদর ক্যাটারার
আহা!!সেদিন পেটভরে খেয়ে দিল বাগ বাগ হয়ে গিয়েছিল।নতুন নামও হয়েছে আমার একটা,টিঙ্কু পেত্নী,আসলে রোগা টিংটিংএ দেখতে বলে এই নামটাই ভালোবেসে দিয়েছে সকলে।
তবে আশার কথা,সেদিন থেকেই টেঁপিদি আমার বয়ফ্রেন্ড খোঁজার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছে, রোজদিন রাতে,ঠিক এক প্রহরে আমার মেকওভার চলে,চিতার ছাই দিয়ে প্রস্তুত ইম্পোর্টেড ফেসপাউডার,চিতার কাঠ কয়লা থেকে প্রস্তুত কাজল,হাড়গুড়োর সুগন্ধী পাউডার,রক্ত থেকে বিশেষ উপায়ে প্রস্তুত লিপস্টিক সহযোগে আমাকে সাজিয়ে দেয় দি,তারপর চোখে মুনগ্লাস এঁটে,এলোচুলে আমি বেরোই রাতের অভিসারে,সেদিন রাতে একটা অদ্ভুত মামদোর সাথে দেখা।ব্যাটা আমাকে দেখে নিজেই এগিয়ে এল,তারপর হাত বাড়িয়ে বলল,
"হাই ঘোস্টি!ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড,তুমি কি আমার সাথে একটা ঠকঠক ভিডিও করবে?আমি ওটা ভূতবুকে আপলোড করতাম তবে,তুমি কি জানো সুইটহার্ট,আমি কি বিশাআআল বড়ো একজন ঠকঠক স্টার?অসাআআআআধারণ সব ভিডিও আপলোড করি আর তাতে ভিউ হয় কয়েক মিলিয়ন, পেত্নীরা আমার ভিডিও দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকে।"
আমি তখন মনে মনে ভাবছি,"আ মলো যা মিনশে,সেসব শুনে আমি কি করব রে হতচ্ছাড়া,ও জন্মেও আমি এসব মোট্টে দুচক্ষে দেখতে পারতাম না,আর আমার ওসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই,তবু ছেলেটাকে কিন্তু দেখতে বেশ!বেশ কিউট কিউট"
তাই ঘাড় নেড়ে বললাম,"আচ্ছা বেশ।"
ঠকঠক ভালোয় ভালোয় মিটল,চরম বিরক্তি সত্বেও মুখে হাসি নিয়ে ভিডিওখান শেষ করলাম,তারপর খানিকক্ষণ ইতস্ততঃ করে আমি ওনাকে বলেই ফেললাম,
"প্রিয়ে,থুড়ি ইয়ে মানে বলছি কি আমার সাথে একটু ঘুরতে যাবেন গঙ্গারপাড়ে?দুজনে তবে মগডালে বসে নীরবে নিভৃতে একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ট করতাম,যাবেন আমার সাথে?"
হতচ্ছাড়া ছোটোলোক মামদোটা কেন জানিনা অদ্ভুতভাবে খচে গেলে,খানিকটা অ্যাটিটিউডের সাথেই বলল,
"এই,এই,কান খুলে শুনে রাখুন,এখানে না আমি ভিডিও করতে এসেছি,আপনার সাথে ঘুরতে না,ভিডিও করা হয়ে গেছে, এবার চলে যাচ্ছি"
এটা বলেই চলে যাচ্ছিল মামদোটা,কিন্তু যেতে পারল না,তার আগেই সপাটে একটা থাপ্পড় মারলাম ওর গাল লক্ষ্য করে,মারের চোটে মামদোটা বনবন করে দু পাক ঘুরে গিয়ে সপাটে ধাক্কা খেল একটা গাছের সাথে,সাদা গাল মারের চোটে লাল হয়ে গেছে,শালা হতচ্ছাড়া,ইয়ার্কি হচ্ছে আমার সাথে অ্যাঁ?শুঁটিয়ে লাল করে দেব না,নোংরামি বার করে দেব একেবারে।তারপরে আর ফিরে তাকালাম না আমি,গটগট করে হেঁটে চলে গেলাম,মটকা গরম হয়ে গেছে,ওটাকে খুলে ঠান্ডা করা দরকার।
বিরসবদনে গঙ্গার পাড়ে বেলগাছের মগডালে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছিলাম,মনে মনে ভাবছি প্রেতলোকে এসেও শান্তি নেই শালা,কোথায় ভাবলাম মরে গিয়ে চুটিয়ে প্রেম করব,অ বাবা!!এখানেও সেই ছেলের আকাল,কথায় অাছে না,"অভাগা যেদিকে চায়,সাগর শুকিয়ে যায়",হে যমরাজ কি হবে আমার!!
হঠাৎ করে দূর থেকে কানে একজনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ এলো,কৌতুহলী হয়ে নীচে নেমে এসে দেখি গঙ্গারঘাটে একজন বসে কাঁদছে,ব্যাপারটা কি দেখার জন্য এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলুম,সে পিছন ফিরে তাকাল আমার দিকে,ও বাবা এ যে দেখি আস্ত একখান ভূত।
বেশ গম্ভীরস্বরে জিজ্ঞেস করলাম,"কি হয়েছে টা কি আপনার অ্যাঁ?পুরুষ মানুষ হয়ে আপনার মেয়েদের মতো ওমন করে কাঁদতে লজ্জা করে না?"
সে ব্যাটা আমাকে দেখে চোখ মুছতে মুছতে বলল,"আমার কষ্ট আপনি আর বুঝবেন কি করে?বলতে পারেন আর কতো রাত একা ঘুরব?চল্লিশ বছর হয়ে গেল আমি মরে ভূত হয়েছি,না তো ওইজন্মে কেউ ছিল না তো এই প্রেতলোকে কাউকে পেলাম,আচ্ছা আমি কি গার্লফ্রেন্ড পাবোনা?গার্লফ্রেন্ড পাবোনা আমি?"
ঘাটে ওনার পাশেই বসে পরলাম আমি,করুন স্বরে বললাম,"আমারও সেম কেস, কেউ দেয় না,ইয়ে মানে কেউ খুঁজে দেয় না একটা বয়ফ্রেন্ড,শালা যমরাজটাও একটা পাক্কা চিটিংবাজ,কথা দিয়ে কথা রাখেনা,ধরে আচ্ছাসে দু ঘা দিতে পারলে ওনাকে,তবে আমার গায়ের জ্বালা মেটে।"
"এই আপনি সিঙ্গেল?"আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল ভূতের মুখ।
"দুঃখের কথা কি আর কমু,হ্যাঁ আমিও সিঙ্গেল"-একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম আমি।
"এই আপনি আমার গার্লফ্রেন্ড হবেন?জানেন আমার না কেউ নেই, কেউ না"-ভূতের কথায় মনটা আমার ভিজে গেল,যতই হোক দয়ার শরীর আমার,তারওপর বিশাল বড়ো মন।লাজুক হেসে বললাম,
"আপনার গার্লফ্রেন্ড না হওয়ার আমি তো কোনো বিশেষ কারণ দেখিনে,চলুন একটু ঘোরা যাক"-একে অন্যের হাত ধরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এলাম আমার পছন্দের চন্দননগর স্ট্রান্ড রোডে।জীবদ্দশায় ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার, প্রেমিকের সাথে এই স্ট্রান্ডে বসে প্রেম করব।বেঁচে থাকতে হয়নি তো কি হয়েছে? মরে গিয়ে হোক,কথায় তো আছেই,'দের আয় পার দুরস্ত আয়ে।"
গঙ্গারপাড়ে হাতধরাধরি করে দুজনে একটা গাছের মগডালে বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছি,উনি গান গাইছেন,
"এই রাত যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলতো"
আমি বলছি,"তুমি বলো"
উনি বলছেন,"না তুমি বলো"
এমন সময় হুট করে গাছের ডালটা মট করে গেল ভেঙে,আর আমি হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পরলাম গঙ্গার জলে। হঠাৎ করে মনে পড়ল আরে আমি তো সাঁতার জানি না!!এ বাবা, তাহলে যে ডুবে যাবো আমি!! প্রাণপণে চিৎকার করতে লাগলাম,"বাঁচাও!!বাঁচাও"
কিন্তু না ডুবে যাচ্ছি আমি,অতল জলে তলিয়ে যাচ্ছি আমি।
"ও ম্যাডাম শুনছেন?বলি ও ম্যাডাম বেঁচে আছেন কি আপনি?"-চোখেমুখে ঠান্ডা জলের ঝাপটায় উঠে বসলাম আমি।ও বাবা আমি যে স্ট্রান্ডেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম এতোক্ষণ। আমার সামনে একটা ছেলে বসে আছে,সেই আমাকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়েছে।
তাকে দেখে আবার মনে হলো,দিল মে লাড্ডু ফুটা,মনে মনে ভাবলাম,"যাক্ বাবা এতোদিনে ঠাকুর আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন!!জয় রগুবীর, তোমাকে আমি দশ টাকার হরিনোট দেবো ঠাকুর"তারপর একটু ফিল্মি কায়দায় ঢং করে বল্লুম,"আমার হাতটা একটু ধরবেন প্লিস? আমি না একা একা উঠতে পারছিনা।"
কোথা থেকে দেখি একটা মেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল,
"নিজে নিজে উঠতে পারছেনা যেন!! ন্যাকাষষ্ঠী একেবারে,এই তুমি আমার সাথে যাবে কি এবার?"
পিছন ফিরে দেখি একটা মেয়ে কোমরে হাত দিয়ে কটমট করে আমার দিকে চেয়ে আছে, বুঝতে পারলাম ইনিই হচ্ছেন ওই ছেলেটার শ্রীমতী ভয়ঙ্করী।মনে মনে ভাবলাম,"তোর বয়ফ্রেন্ডের দিকে তাকাতে আমার বয়েই গেছে রে পেত্নী, হুম!!"
আমাকে পাশ কাটিয়ে ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে এগিয়ে চলল, আমিও গা থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ালাম, ব্যাগ থেকে অবশিষ্ট দুটো ঢিল বের টিপ করে ছুঁড়ে মারলাম ওদের দিকে, তারপর পিছন ফিরেই দিলাম দৌড়, তখনও মনে মনে গুনগুন করছি "আর কতো দিন একা ঘুরব!"
।।সমাপ্ত।।
ক্রমশঃ
বিঃদ্রঃ::গল্পে উল্লিখিত সমস্ত কাহিনী এবং কথা সবটাই কল্পনা, কাউকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলা নয়, লেখার মাধ্যমে পাঠক মনে আনন্দ দেওয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য,কারো মনে আঘাত লেগে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
রচনাকাল : ১৬/৪/২০২০
© কিশলয় এবং সায়ন্তী সাহা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।