আন্দামানে ভ্রমণ
আনুমানিক পঠন সময় : ৬ মিনিট

লেখিকা : নূপুর গাঙ্গুলী
দেশ : India ,

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , মে
প্রকাশিত ৩৪ টি লেখনী ৩৩ টি দেশ ব্যাপী ১৬৪০৫ জন পড়েছেন।
Nupur Ganguli
বিয়ের পর টুকটাক এদিক ওদিক ঘুরতে গেলেও সবচেয়ে মনে দাগ টেনে গেছে আন্দামান ভ্রমণে।সেন্ট্রালে চাকরি করার দরুণ চার বছর অন্তর আমার স্বামি প্লেন ফেয়ার পেয়ে থাকে। তাই প্লেনে করেই আন্দামানে গিয়েছিলাম।

                ঐ প্রথম প্লেনে চড়া। বাড়ি থেকে গাড়ি করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ‍্যে রওনা হলাম। বুকে একরাশ প্রশ্ন ---এয়ারপোর্ট কেমন?প্লেনে উঠলে কেমন লাগে ইত‍্যাদি। অনেক অপেক্ষার পর এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। যেন মনেহল স্বপ্নের দেশে পৌঁছেগেলাম।তারপর সেখানে বন্ধুদের সঙগে      একসাথে মিলিত হয়ে প্লেনের কাছে গেলাম।উঃ- যেন স্বর্গ রাজ‍্যের ভিতর দিয়ে প্লেনে উঠলাম। সকলে বসলে সিট বেল্ট বাঁধার জন‍্য অনুরোধ করল। তারপর ধীরে ধীরে প্লেন মাটি ছেড়ে আকাশ পানে উঠতে লাগল। উঁচু উঁচু বাড়ি গুলো যেন নিমেষে খেলনা বাড়ির মতো দেখাতে লাগল। আস্তে আস্তে আমরা মেঘের মধ‍্যে প্রবেশ করলাম।  সকলে বলতো প্লেনে মাথা ঘোরায়------কিন্তু আমার দিব‍্যি লাগছিল। প্লেনে খাবার দিল। তারপর কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। হঠাৎ হৈ হৈ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।আরে আমাদের নামতে হবে।  প্লেনে বসে বুঝতেই পারিনি আমরা সমুদ্র পেরিয়ে এসেছি। প্রথমে   পোর্টব্লেয়ারে নেমে আমরা গাড়ি করে সোজা বেঙ্গল হোটেলে পৌঁছে স্নান -খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম।

           একটা কথা বলতেই হয়--আজকে আন্দামান একটা ভ্রমণের স্থান হলেও একসময় এটা ছিল জঙ্গলে পূর্ণ এটা ব-দ্বীপ। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজরা পরাজিত সিপাহীদের শাস্তি স্বরূপ এখানে পাঠিয়ে ছিল। তাদেরকে অনাহারে রেখে দিনের পর দিন এখানকার জঙ্গল পরিস্কার করানো হতো। এরপর অন‍্যান‍্য নানা রকম বিদ্রোহীদের সঙ্গে বিপ্লবীদেরও এই দীপান্তরে পাঠানো হতো। তাই আন্দামানকে আগে কালাপানি বলা হতো । এরপর    তাদের বন্দি রাখার জন‍্য ইংরেজ সরকার সেলুলার জেল তৈরী করেন। বিশ্ববিখ‍্যাত এই জেলে বিপ্লবীদের চরম কষ্টে রাখা হতো। তাই এই বিপ্লবীদের শ্রদ্ধা ঞ্জাপনের জন‍্য এখন ভারত সরকার ঐ জেলটিকে তাঁদের স্মৃতি হিসাবে জনগণকে প্রবেশ করার বা দেখার অনুমতি দিয়েছেন।

              একদম প্রথমে আমরা সেই বিখ‍্যাত সেলুলার জেল দেখতে যাই।উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মজবুত  বিশাল বড় এলাকা নিয়ে তৈরী তিনতলা বিশিষ্ট এই জেলে ছোট্ট ছোট্ট 698 টা গারদ ঘর বা সেল আছে।শোনা যায় সাত পাখনা বিশিষ্ট জেল টি বর্তমানে তিন পাখনাতে এসে ঠেকেছে। যাইহোক গারদ ঘর  এক একটা এতোটাই ছোট যে লম্বায় একটা মানুষ কোন রকম শুতে পারে আর চওড়াতে পা ছড়িয়ে বসতে পারে। ঘরে জানালা নেই কোনো,শুধু একটা ভেণ্টিলিটার। লোহার তৈরী মজবুত দরজা।প্রত‍্যেক ঘরে একজন করে বন্দি থাকত। আর এমনই ব‍্যবস্থ‍্যা ছিল কেউ কারো সাথে কথাও বলার সুযোগ ছিলনা।  খাবার দেওয়ার জন‍্য প্রত‍্যেক ঘরে একটা করে ড্রয়ার মতো আছে,সেটা ব‍্যবহার করা হতো। এই রকম নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে গিয়ে অনেকে উন্মাদ হয়ে যেতেন বলে শোনা যায়। সেখানকার ফাঁসি মঞ্চও এখনওবর্তমান। একসঙ্গে তিনজনের ফাঁসি দেওয়া হতো।   দেখতে দেখতে গা শিউরে ওঠে। সেখানে ওয়েলমিলও ছিল। বন্দিদের দিয়ে তেল তৈরী করানো হতো। আর যে কোন কেউ কাজে অসম্মত হলেই চাবুক মারা হতো-----"""এই সব কিছুর মূর্তির মাধ‍্যমে প্রদর্শিত করা হয়েছে। এছাড়া সন্ধ‍্যাবেলায়   "লাইট এন্ড সাউণ্ড" অনুষ্ঠানের মাধ‍্যমে কতৃপক্ষ চেষ্টা করেন দেখানোর যে সে কিভাবে বিপ্লবীদের উপর ইংরেজরা অত‍্যাচার করত।  

         পরের দিন  রাত থাকতে উঠে আমরা জারোয়া নামে এক আদিবাসিদের দেখার উদ্দেশ‍্যে বেরিয়ে পড়ি। তারা সভ‍্য সমাজে এখনো আসতে পারেনি। ওখান থেকে এসে, সমুদ্র থেকেই একটা খাঁড়ি মতো বেরিয়ে গেছে,সেখান থেকে বোট ভাড়া করে আমরা ম‍্যাণগ্রোভ অঞ্চল দেখতে বেরিয়ে পড়ি। এত সুন্দর গাছগুলো যেন মাথা নীচু করে জলে দোল খাচ্ছে। এরমধ‍্যে দিয়ে আমাদের বোট সো সো করে বেরিয়ে যায়। তারপর আর এক প্রাকৃতিক দৃশ‍্য  মন ছুঁয়ে যায়। আমরা এখানে একটা গুহা দেখতে পাই,যেটার মুখের আকৃতি প্রাকৃতিক ভাবেই সিংহের মুখের মতো। গুহাটার নামই 'লাইন কেভ'। ওখান থেকে ফিরে খাওয়া-দাওয়া সেরে   আবার    সেলুলার জেলে বেড়াতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল-------আমরা তো ট‍্যুরে এসেছি, সখ করে বেড়াতে এসেছি -"""""কিন্তু বিপ্লবীদের জোর করে এখানে ধরে এনে অত‍্যাচার করা হতো। ভাবলে কান্নায় বুকটা ফেটে যায়। জেলের বাইরে বহু বিপ্লবীর মূর্তি করেছে ভারত সরকার।  সেলুলার জেলে 1943সালে নেতাজি এসে তিনদিন থাকেন ও দখল করেন। জেল থেকে নেতাজির বেরিয়ে আসার মূর্তি দেখা যায়। আমরা অনেক ফটো তোলার সঙ্গে সঙ্গে জেলের কক্ষ গুলোর দরজায় প্রণাম করেছি সকল বীরদের উদ্দেশ‍্যে। আজ এটা আমাদের কাছে তীর্থভূমি।সেখানে যুদ্ধ বিমানও দেখেছি আমরা। পরের দিন আমরা এখানকার চিড়িয়াখানায় যাই। বিভিন্ন জন্ত-জানোয়ারের সঙ্গে আমরা সেখানে কুমির, নানা ধরনের সাপ দেখি। পাশে একটা খুব সুন্দর বাচ্চাদের পার্কও আছে। বাচ্চারা সেখানে দোলনা চড়ে।

            এরপর আমরা আসি রোজ আইল‍্যাণ্ডে। এটি পোর্টব্লেয়ারের রাজধানি। পুরোনো প্রাসাদ, গভরমেণ্ট হাউস,চার্চ,হাসপাতাল,প্রেস ইত‍্যাদি ব্রিটিশ আমলের ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে।  এরপর জলিবয়ে আসি। এখানে অবশ‍্য আমাদের সঙ্গের ছেলেরা সকলে গ্লাস বটম নৌকো গুলো দিয়ে জলের নীচে কোরল কলোনীতে সামুদ্রিক জীবের শ্বাসরুদ্ধ দৃশ‍্য দেখতে যায়। আর আমরা চলে যায় ফরেস্ট দেখতে।বহু প্রজাতির গাছ ----লবঙ্গ, এলাচ,দারচিনি, জায়ফল,গোলমরিচ,কর্পূর, আমলকি,তেতুল প্রভৃতি। আমরা সকলে পাকা তেতুল খেয়েওছিলাম।এছাড়া বিভিন্ন  ধরনের ফুল গাছ। এমন আরো অনেক গাছ দেখেছি, যার নামও জানিনা।এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ মন কেড়ে নেয়।

              এরপর আমরা হ‍্যাভলকে আসি। এক দ্বীপ থেকে অন‍্য দ্বীপে যাই আমরা জাহাজে করে। একটা এত বড়ো জাহাজেও উঠেছি,যাতে করে বাস,ক্রেন ইত‍্যাদি বড় বড় জিনিস পার হয় -----ভিতরে মানুষ বসার জায়গা আছে। তবে আন্দামানে খুব গরম---প্রচণ্ড রোদের তাপ। আমরা সকলে মাথায় টুপি পড়ে ঘুরতাম আর বারে বারে ডাবের জল খেতাম। অনেক নারকেল ও সুপারি গাছ আছে এখানে। রাধানগর বিচে স্নান করি সকলে। সমুদ্র সৈকতে প্রাণ ভরে যায়।
  অনেকক্ষণ সময় আমরা এখানে কাটাই। বিকেলের দিকে আমরা যখন সমুদ্রেল পারে ঘুরছি, তখন ভাঁটা  ছিল। জোয়ারের সময় বহু সামুদ্রিক প্রাণি পারে চলে এসেছে। কত ঝিনুক, শঙ্খ, রঙিন কচ্ছপ ইত‍্যাদি। কত ঝিনুক কুড়িয়েছি, শঙ্খও এনেছি।অপূর্ব রূপ প্রকৃতির। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে অস্তায়মান। যেন রঙ-তুলিতে আঁকা।তারপর হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নিই। আন্দামানের খাওয়া-দাওয়ার মধ‍্যে সামুদ্রিক মাছটাই বেশি পাওয়া যায়।তবে আমরা ডিমের মামলেট টাই বেশি খেয়েছি।আর খুব গরম বলে গুরুপাক খাবার সহ‍্য না হওয়ায়   অনেকে অসুস্থ হয়ে যায়।    

        তারপর আবার জাহাজে চড়ে বসি। জাহাজে উঠলে আমার খুব মাথা ঘোরাতো---"তাই আমি চুপ করে বসে থাকথাম। জাহাজে করে এবার আমরা নীলদ্বীপে চলে আসি। সেখানে জাহাজ যখন ঘাটে দাঁড়াবে, তখন এক বিস্ময়কর জিনিস চোখে পড়ল। সমুদ্রের জলের রঙ সে এক অন‍্য রকম। গাঢ় নীল; উঃ সত‍্যিই আশ্চর্যজনক; সমুদ্র পারে আমরা সারাদিন ছিলাম। সেখান  থেকে আমরা একটা হোটেলে গিয়েউঠি। হোটেলটা এতো সুন্দর যে কি বলব; নানা রকমের ফল-ফুলের গাছে ভরা। সন্ধ‍্যে বেলা টিফিন করে আমরা হোটেলে বসে আড্ডা দিই। পরের দিন সেখানকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারি তারাও সেখানে ভালোই আছে। আমরা সকলে কেউ মুক্তের হার, চুরি কেউ শাঁখা, শঙ্খ ইত‍্যাদি কেউবা ঝিনুক-শঙ্খ দিয়ে তৈরী ঘর সাজানোর সামগ্রী কেনে। এই ভাবে  সারাদিন আনন্দ করি।

            এরপর আমরা জাহাজে করে আবার পোর্টব্লেয়ারে ফিরে এসে একটা রেষ্টুরেন্টে কিছু টিফিন করে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ‍্যা বেলা এসে পরের দিন রওনার জন‍্য গুছিয়ে নিলাম। পরের দিন সকাল ছটার সময় আমরা এয়ারপোর্টে এসে পৌঁছলাম এবং যাত্রা করলাম। সেদিনই রাত্রে এসে দমদমে নেমে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

        এই ট‍্যুরটি আমার জীবনের এখনো পর্যন্ত বিখ‍্যাত ট‍্যুর।।
রচনাকাল : ১৫/৯/২০২০
© কিশলয় এবং নূপুর গাঙ্গুলী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 5  China : 18  France : 11  Germany : 1  India : 153  Ireland : 9  Macedonia : 1  Romania : 1  Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 4  
Sweden : 69  Ukraine : 5  United States : 184  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 5  China : 18  France : 11  Germany : 1  
India : 153  Ireland : 9  Macedonia : 1  Romania : 1  
Russian Federat : 10  Saudi Arabia : 4  Sweden : 69  Ukraine : 5  
United States : 184  
© কিশলয় এবং নূপুর গাঙ্গুলী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
আন্দামানে ভ্রমণ by Nupur Ganguli is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.