"বাবা জানো আজ দারুন একটা বই এর খোঁজ পেয়েছি।। টুসি বললো।"
ছেলে রিত এর কথায় চমক ভাঙলো দিগন্তের।। জানলার দিকে তাকিয়ে খানিক টা আনমনা হয়ে গেছিলো।। এই জানলার কাছটায় কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে এসে দাঁড়ায় ও। এখানের এমন হাই রাইস এর মাঝে আকাশ খুঁজে পাওয়া বড় দুষ্কর।। এই জানলা টা দিয়ে ধরা যায়।। এক টুকরো নীলচে আকাশ।।
" তাই? কবে অনবি তাহলে?"
"দেখি অর্ডার তো দিয়েছি।। মাস্ট বি দে ইয়ার উইথিন আ উইক।।
রিতের এই অভ্যাসটা বরাবরের।।যখন যেমন যে বাংলা বই পাবে সব কিনবে। পিডিএফ কিন্ডল এর যুগেও বই কিনে পড়ার নেশা।। তাও আবার এই বিদেশ বিভূঁইয়ে।। প্রতিবার নিয়ম করে শারদ সংখ্যা কেনা চাইই চাই।। দেশ, আনন্দমেলা, শুকতারা, বর্তমান, কি নেই তাতে? অথচ বাংলা কেনো গোটা ভারতবর্ষের সাথে সেই সখ্যতা টা গড়ে ওঠা খুব একটা সহজ ছিলনা ওর পক্ষে।। ওর বয়স যখন ৪ কি ৫ তখন ভিটে মাটি ছেড়ে সুদূর স্টেটস এ পাড়ি দেওয়া। দিগন্তের বিদেশের কলেজে পড়ানোর সুযোগ হাতছাড়া করার মত ছিল না।। তারপর থেকেই ইংরিজি নিয়ে করবার।। বাংলার নাম গন্ধও থাকার কথা নয়। অথচ রিতের সব ঠোটস্থ।। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, শরৎচন্দ্র, মানিক বাঁড়ুজ্যে অবলীলায় শেষ করেছে।। শুধু শেষ নয় মনে গেঁথে আছে ওর।। যখন যে পরিস্থিতিতে যে উক্তি, যে বর্ণনা, যে পংক্তি প্রযোজ্য অনায়াসে বাতলে দিতে পারে ছেলেটা।। তবে সব কৃতিত্ব টাই দিগন্তের।। বাবা র জন্যই রিতের এত ঘনিষ্ঠতা বাংলা সাহিত্যের সাথে।। ছোট থেকে তিল তিল করে বেড়ে তোলার মাঝে গেঁথে দিয়েছে বাংলার বীজ। দিগন্তের মাঝে মাঝে সত্যিই গর্ব হয়।। ছেলের জন্য বরাবর মাথা উচুঁ হয়ে এসেছে।।নিজের ছোটবেলাটা ই দেখতে পায় দিগন্ত রিতের মধ্যে। সেই বইপ্রেম, সেই একাগ্রতা, এক অদম্য ইচ্ছেশক্তি।।
কাবেরী খানিকটা অন্য ধাঁচের।। বাংলা শিকড় ভিত নিয়ে অত মাতামাতি নেই।। বরং এখানকার জীবন বেশ উপভোগ করে।।ভীষণ কেরিয়ারিস্টিক।।এখানে সেটেল্ড হওয়ার পরই কাবেরী ও চাকরিজীবনে শুরু করে।। তবে বাবার মত কাছের মানুষ রিতের মা হতে পারেনি।। ছেলেদের যদিও মায়ের প্রতি বেশি টান হয়।। রিতের ক্ষেত্রে খানিক আলাদা ব্যাপার টা।
রিতের বরাবরের অভ্যেস।। যে কোনো ভালো বই এর সন্ধান পেলে বাবা কে জানানো চাই। ক্লাসিক তো বটেই, আজকাল উঠতি লেখক দের বই ও তার মুখস্ত।। বাংলায় বসে থাকা সমবয়সী অনেক ছেলে মেয়ের থেকে রিতের বাংলা সম্পর্কে জ্ঞান অনেক বেশি।। তার সাহিত্য চর্চার একমাত্র সঙ্গী এই বাবা ই।। যখন যে লেখক, যে চরিত্র ভালো লাগে, বাবার সাথেই আলোচনা চলে তাই নিয়ে।। আজকাল কার এই কংক্রিট রোবটের যুগে রিত খানিকটা দিগন্ত বিস্তৃত এক সবুজ মাঠের মতো।। বড় আবেগ ওর মনে।।
আজকাল সেই সদ্য খোঁজ পাওয়া বইটা নিয়েই মেতে আছে।। মাঝে মধ্যে বাবার সাথে ভাগ করে নেয় ওর অনুভূতি গুলো।। মাঝে মধ্যেই এসে বলে "জানো বাবা কি অসাধরন লেখেন এই ভদ্রমহিলা।"
দিগন্ত শোনে।।
খুব একটা বেশি সুযোগ এখনও অব্দি হয়নি এই বিষয়ে কথা বলার।। আজকাল ওর নিজেরই বাংলা বই পড়া টা কমে গেছে।সময়ই বা কই। দিগন্ত ও ব্যস্ত থাকে কলেজের কাজে।। সারাদিন জার্নাল, রিসার্চ পেপার, থিসিস আর ছাত্র।। যতটুকু সময় মেলে রোজ কার জীবনের বাকি কাজ গুলো মেটাতেই কেটে যায়।।
আজ সন্ধ্যে তে একটু সময় পেয়েছিলো।। ঘরের আলো টা নিভিয়ে ইজি চেয়ারে গা টা এলিয়ে বসেছিল।। কাবেরী এখনও ফেরেনি।। হঠাৎ রিতের গলা।। পাশে এসে বসলো।।
"একি শরীর খারাপ নাকি তোমার??"
"নানা। কই?"
"তবে আলো নিভিয়ে?"
"এমনিই, এই একটু স্মৃতিচারণ করছিলাম।।"
"কি ভাবছিলে বাবা।।?"
"কত কি? ছার বাদ দে।। তোর বই টা পরা হলো বুঝি?" এসব দিগন্তের জানা। এ ঘটনা প্রায়শই ঘটে। রিত এর একটা বই শেষ হলেই এসে বাবার সাথে আলোচনা টা দরকার হয় পরে। চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ।।
"সেইজন্যেই তো এলাম।। জানো বাবা ওনার ছোট গল্প আমি আগেও পড়েছি দেশ এ।। কি অসাধরন লেখেন।। মাঝে মধ্যে মনে হয় একবার যদি দেখা পেতাম।।"
দিগন্ত হাসে মনে মনে।।
"তা লেখিকা কি একেবারেই অল্প বয়সী?? প্রেমে টেমে পড়লি নাকি??"
"একদম।। নিঃসন্দেহে।।তবে বলতে পারো ওনার লেখার।।তবে কম বয়সী উঠতি লেখিকা নন।। এত গভীরতা খুব একটা কম বয়সে আসার কথাও নয়।। জীবনে নিশ্চয়ই প্রচুর ঘাত প্রতিঘাত দেখেছেন মৃন্ময়ী দেবী।।"
নাম টা শুনে খানিকটা ধাক্কা খেল দিগন্ত।। কি নাম বললি??
"মৃন্ময়ী।। মৃন্ময়ী সেন।। দ্য অথর অব দ্যা বেস্ট সেলার, অপেক্ষার এক জীবন"
এক ধাক্কায় বছর পঁচিশেক পিছিয়ে গেলো যেনো দিগন্ত।। নাম টা শুনে মাথা টা ভো ভো করছে।। মৃন্ময়ী?? মৃন্ময়ী সেন? এই কি সেই মৃন্ময়ী?? এক জোড়া শান্ত, গভীর , মায়াবী চোখ মনে পড়ে গেলো দিগন্তের।। এক পৃথিবী আবেগ ছিল তার বুকে, এক আকাশ মায়া জড়ানো মুখ।। কি অসামান্য ক্ষমতা ছিল ওর দিগন্ত কে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসার।। যখন যেভাবে চেয়েছে পাশে পেয়েছে মৃন্ময়ী কে।। আর ছিল তার লেখনীর ধার।। দিগন্ত কতবার বলত।। মিঠি লেখা গুলো দেশ এ পাঠাও।। সেও দিচ্ছি দেবো করে আর পাঠাতো না।। মৃন্ময়ীর জীবন জুড়ে শুধুই দিগন্ত তখন।। আর কিছু চাইতো না বছর চব্বিশের মেয়েটা।। একটা সাদামাটা চাকরি করতো।। আর শুধুই লিখত।। পাতার পর পাতা।। দিগন্তের জন্য।। ওর একমাত্র পাঠক, লেখার একমাত্র অনুপ্রেরণা।। এমন চাহিদা হীন কোনো মানুষ হতে পারে? দিগন্ত যত দেখতো মৃন্ময়ী কে অবাক হয়ে যেত।। প্রতিবার।।
"জানো বাবা?", রিত বলে চলেছে।।
"এই বইটা বেস্ট সেলার হওয়ার পর ওনার একটা ছোটো সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল।। ভদ্রমহিলা বিয়ে করেননি।। বয়স প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি।। জীবনে একটা দুঃখ আছে জানো? আমার মন বলছে।। এই গল্প টাও খানিক টা ওনার জীবনের মোড়কে গড়া।।একজনের জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করা যায় বাবা??"
দিগন্তে র বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠছে।। সবটাই কেন মিলে যাচ্ছে? নাকি পুরোটাই কাকতালীয়।।?? একটাই ফারাক ছিল দিগন্ত আর মৃন্ময়ীর।। দিগন্ত উত্তর কলকাতার এক বনেদি, ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে।। স্টেটাস মেলেনি।। মৃন্ময়ী সামান্য এক সরকারি কেরানীর মেয়ে।। মেনে নেননি দিগন্তের মা।। বড়ো পরিবারের বাধ্য ছেলে।। মায়ের ইচ্ছের অমতে প্রেম টা হতে পেরেছিল।। কিন্তু বিয়েটা হয়নি।। দেখাশোনা করে বিয়ে হয় কাবেরীর সাথে।।
শেষ অব্দি একটা লালচে রঙা পড়ন্ত বিকেল এসছিলো।। গঙ্গার ধারে দেখা করে বলেছিল সবটা মৃন্ময়ী কে।। সামনে দাঁড়ানোর বুকের পাটা যদিও ওর ছিলনা।। তবুও শেষ বারের মত।। মৃন্ময়ী সেদিনও স্থির।। গঙ্গার মতনই ।। উপর থেকে বোঝার উপায় নেই ভেতরে স্রোতের কি টান।।কথা বলেনি একটাও।। সেদিন শুধু ওর চোখ গুলো বলেছিল কথা।। দিগন্তের কিছু বলা সাজে না এই পরিস্থিতিতে।। মৃন্ময়ী একবার ও প্রশ্ন করেনি কেনো।। কেমন যেনো চুপ মেরে গেছিল।। দিগন্ত খালি আসার সময় হাত টা ধরে বলেছিল।। লেখাটা ছেরোনা মিঠি।। মৃন্ময়ী এক জোড়া জল টলমল দীঘল চোখ নিয়ে একটু হেসেছিল কেবল।। তারপর চলে গেছিলো বহুদূর।। কয়েক ক্রোশ, কয়েক যোজন, কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে।।আর ছুঁতে পারেনি দিগন্ত।। তারপর এতগুলো বছরে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয় এসেছে অস্তিত্ব টা।। আর রিত আজ এক ঝটকায় সেই ধুলো গুলো ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে।। অদৃষ্টের মার।। মৃন্ময়ীর ফিরে আসা এভাবেই লেখা ছিল তবে।। মধ্যেও, একটাই ভালো লাগা, মৃন্ময়ী কথা রেখেছে।। লেখা টা ছাড়েনি।। আজও দিগন্তেই বেঁচে আছে একটা মানুষ।। ভাবতেও অবাক লাগে।। কষ্ট হচ্ছে খুব দিগন্তের।। খুব ইচ্ছে করছে মৃন্ময়ীর কাছে ছুটে যেতে।। একটা বার ক্ষমা চাইতে।। একটা মানুষের জীবনের গতিপথ টাই আটকে দিয়েছে দিগন্ত।। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে দিগন্ত র।।আমি কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি মিঠি, তুমি না দিয়েও রেখে গেছ।। আজীবন।।
এই পাপবোধ এ জর্জরিত হয়ে বেঁচে থাকা টা কি যন্ত্রণার টা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল দিগন্ত।। সময়ের ভারে খানিকটা কমে এসেছিল জ্বালা টা।। আজ না জেনেই রিত আবার খুঁচিয়ে ঘা করে দিয়েছে।।দঘদঘে লালচে।।
রিত স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে চলেছে।।
"জানো বাবা, এইটাই যদি ওনার জীবন হয়, আমি হলফ করে বলতে পারি যে মানুষ টা ওনাকে ছেড়ে গেছে, তার ধারণাই নেই কি হারিয়েছে।। জীবনে কি শুধু মাত্র স্টেটাস টাই ম্যাটার করে? এত বোকা কেনো মানুষ?? নাকি স্বার্থপর?? নাকি আদ্যপান্ত কাপুরুষ??" একটু থেমে আবার বলে রিত, "আমি হলে তো সারা জীবন আগলে রাখতাম।।"
কথা গুলো তীরের মতো বিঁধছে দিগন্তের কানে।।ছেলে কি জেনে শুনে এসব বলছে?? নানা সেটা কি করে সম্ভব? ওই বা জানবে কি করে। আজ অব্দি কাবেরী পর্যন্ত জানেনি কিছু।। মৃন্ময়ী চাইলেই সংসার টা ছারখার করে দিতে পারতো।। কিন্তু সেসব তো ওর ধাতে ছিলনা।। অকপটে, নির্দ্বিধায় সরে গেছে, হারিয়ে গেছে।। । কিসব ভাবছে এসব দিগন্ত।। নিজেই বুঝতে পারেনা।। আঁতে ঘা লাগছে?? ভেতর টা পুরে যাচ্ছে দিগন্তের।। এতদিন ছেলের জন্য গর্ব হত।। আজ ও হচ্ছে।। শুধু কারণ টা আলাদা।।এতদিন ছেলের প্রতি টা প্রাপ্তি তে এ দিগন্তের গর্বে বুক ফুলে গেছে।। মনে হয়েছে ছেলে কে ঠিক যেভাবে গড়তে চেয়েছিলো ঠিক সেরকম টাই হয়েছে রিত।। সবাই বলে অবিকল বাবার ধারা।। প্রত্যেকবার নিজে জিতে দিগন্ত কে জিতিয়ে দিয়েছে রিত।। আজ এই প্রথম বার রিত জিতে গেছে।। দিগন্ত কে হারিয়ে।। তবুও গর্ব হচ্ছে দিগন্তের।। মনে হচ্ছে দিগন্ত যেটা পারেনি, রিত ঠিক পারবে।। ঠিক। ওর মতো ভীতু, কাপুরুষ হয়নি ছেলেটা।।গলার কাছটায় দলা পকিয়ে আসছে কেমন।।। চোখ বোজা।। কোন বেয়ে জল গড়াচ্ছে।। ভাগ্যিস আলো টা নেভানো।। নাহলে বাবার এই নকল ভালোমানুষির মুখোশ টা খুলে যেত রিতের সামনে। একটা ভীরু কাপুরুষ এর অবয়ব বেরিয়ে পরতো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে।।যে কিনা লোকলজ্জার ভয়ে নিজের প্রেম কে স্বীকৃতি দিতে পারেনি, পরিবারের মান সম্মান বাঁচানোর মিথ্যে অছিলায় অবলীলায় ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে, একটা সরল নিষ্পাপ মেয়েকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।।
চারদিক টা কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠেছে।।
"বাবা শরীর টা কি বেশি খারাপ লাগছে? কিছুই বলছো না।।?"
নিজেকে খানিকটা সামলে নিলো দিগন্ত।।" নারে একটু মাথা টা ধরেছে খালি।।"
"ওষুধ এনে দেবো?"
"না থাক।। একটু শুয়ে থাকি।।"
"বেশ তবে রেস্ট নাও তুমি।। আমি যাই।।"
রিত উঠে দাঁড়ায়।। দরজার দিকে পা বাড়ায়।।
"রিত??"
"হ্যা বাবা?"
"আমায় একটু বই টা দিয়ে যাবি বাবা? পড়ব।।"
"হ্যাঁ, এইতো, আমি এখুনি দিয়ে যাচ্ছি।।"
একটা ঝড় বইছে দিগন্তে।। একটু মাটির কাছাকাছি যেতে হবে।। বইটা জড়িয়ে খানিক টা অন্ধকারে থাকতে মন চাইছে।। মৃন্ময়ীর কাছাকাছি।। এভাবেই।।। এখানেই।। সব দিগন্তই তো শেষ পর্যন্ত মাটিতে গিয়েই মেশে।।
রচনাকাল : ১৫/৪/২০২০
© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।