বসন্তের রঙ নীল
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখিকা : বৈশাখী রায়
দেশ : India , শহর : কোলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জানুয়ারী
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ২৬ টি দেশ ব্যাপী ৯৯৩৫ জন পড়েছেন।
"কাল সক্কাল সক্কাল চলে আসবি কিন্তু" নন্দ স্যার বলে দিয়েছিল।।এক পাল ছেলে মেয়ে।।ক্লাস ইলেভেন।। সব বাংলা পড়তে যেত ওরা।।
সেই মফস্বলের ধুলো ওড়া রাস্তা।। ঝিম ধরা শীতের বিকেল।। খালি পায়ে মাঠ পেরোনো দৌড়।। হলদে শাড়ি তে সরস্বতী পুজো।।আজকাল কার এত আড়ম্বর কোথায় তখন? কনকনে ঠান্ডা তেও ভোরবেলায় হলুদ মেখে ঝাপুস ঝুপুস করে স্নান করা।।তারপর কাঁপতে কাঁপতে এক পিঠ ভেজা চুলে শাড়ি পরে হাঁটা লাগানো।। ন পড়ার মাঠ পেরিয়ে মিত্রদের পুকুরের ডানদিক ধরে সোজা নন্দ স্যারের বাড়ি যাওয়া।।ততক্ষনে নব পণ্ডিত সাইকেল করে সরকার বাড়ির পথে।।জমিদার বাড়ির ধরা বাঁধা পুরুত।।সে এক অন্য জগৎ। ছেলে মেয়ে দের আলাদা আলাদা ইস্কুল তখন।। কাছাকাছি আসা বলতে ওই প্রাইভেট ক্লাস টুকু।। আর তাতেই টুপ টাপ এ ওর প্রেমে পড়ে যাওয়া।। কার সাধ্যি আটকায়?? এরই মধ্যে সেই শান্ত চুপ করে থাকা ছেলেটা।। মনে আছে কুহেলীর।। রণজয় সেন।। ভবনাথ বয়েজ এ সায়েন্স নিয়ে পড়ত।। কিছুই বলতো না।। শুধু তাকিয়ে থাকতো গাঢ় নিবিড় দুটো চোখ নিয়ে।। কুহেলীর চোখ পড়লেই চোখ নামিয়ে নিতো।। খাতা টা, পেন টা, জলের বোতল টা এগিয়ে দেওয়ার নাম করে যতটুকু কথা বলার ততটুকুই।। কুহেলী ও নিজে থেকে বলতো না কথা।। ওদের আলাদা একটা দল ছিল।। ছুটি হলেই ওরা সাইকেল নিয়ে চলে যেত।। কুহেলী আর চুমকি হেঁটেই একসাথে ফিরত।। বাকিরা যেত বকুল বাগানের দিকে।। ছেলে টাকে মাঝে মাঝে আড় চোখে দেখত কুহেলী ও।।একদিন দেখেছিল রঘু দার মুদিখানার দোকানে, আরেকদিন কমলা পিসির ফুলের দোকানে, বৃহস্পতিবার ফুল কিনছিল।। তাতে আর কি? ওই চোখা চোখি, এক চিলতে হাসি চালাচালি।। ব্যাস ওই টুকুই।। তাতেই বুকে হাতুড়ি পেটার শব্দ পেতো কুহেলী।।কোথাও অদৃশ্য এক জোড়া কোকিল ডেকে উঠতো।। কারোর সাথে শুধুমাত্র দেখা হলেই এতকিছু হয়?? এর আগে জানতো না।। সেবার মনে আছে, চুমকির জ্বর।। পড়তে যায়নি সরস্বতী পুজোর আগের দিন।। অগত্যা একাই হেঁটে ফিরছিল কুহেলী।। সন্ধ্যে সন্ধ্যে হবে।।। ন পাড়ার মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই দেখলো ল্যাম্প পোস্টের তলায় একটা সাইকেল দাঁড়িয়ে।। সামনে যে দাঁড়িয়ে তাকে দেখেই বুক টা ধড়াস করে উঠেছিল কুহেলীর।।এই তো পড়ে বেরিয়ে ওদিকে চলে গেলো? আবার এদিকে?
কিছুটা সংকোচ নিয়ে হলেও এই প্রথম বার রনজয় ওকে ডেকে বলেছিল, " এই নে এটা পড়িস।।" বলেই একটা চিরকুট হাতে গুঁজে দিয়েছিলো।।আর দাঁড়ায়নি।। সাইকেল নিয়ে চলে গেছিলো।। পাক্কা মিনিট খানেক ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায় কুহেলী।। পা চলছিল না।। হঠাৎ করে অজানা একটা আনন্দ পেয়ে বসেছিল।। শিরশিরে একটা অনুভূতি।। একটা কেমন যেন ভালোলাগার জ্বর।। কুহেলী কোনোদিন দার্জিলিং যায়নি।। শুধু ভাবতই যাবো।। আজ এই ছোট্ট শহর টাকেই ওর দার্জিলিং মনে হচ্ছিল।। যেন গুড়ো গুড়ো তুলোর মতো বরফে ঢেকে যাচ্ছে ইউক্যালিপটাসের পাতা গুলো।। 
তারপর বাড়ি এসে খুব সন্তর্পনে সবার থেকে লুকিয়ে চিরকুট টা খুলেছিল।। খুব সংক্ষেপে লেখা ছিল তাতে "কাল একটা নীল শাড়ি পরে আসবি??" 
সাথে সাথে চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেছিলো কুহেলীর।।হাত টা থর থর করে কাঁপছিলো।।সে রাতে ভালো ঘুম হয়নি ওর।। মায়ের থেকে চেয়ে একটা নীল হলুদ ফুল ছাপ শাড়ি পরে গেছিলো পরের দিন।। সেদিন আর আড়চোখে না।। ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়েছিল ঝাকরা চুলের ছেলেটা।। কুহেলী চোখ পড়তেও চোখ সরিয়ে নেয়নি।। পারেনি হয়ত।। আর তাতেই সেই অদৃশ্য হাতুড়ি পেটার গতি এক নিমেষে কয়েকশো গুণ বেড়ে গেছিলো।। কেউ অপলকে চেয়ে আছে।।সবসময় কারোর নজর বন্দী হয়ে থাকার এই অনুভূতি গুলো প্রথমবার কি সাংঘাতিক আকার নিয়েছিল।। মন বসতো না কিছুতেই।। মফস্বল বলেই কত গা বাঁচিয়ে চলা, পাওয়া না পাওয়ার সহাবস্থান। একবার হাত ধরতে পারার গগনচুম্বী আনন্দ।।এখন এসব কোথায়? তারপর যদিও কেটে গেছে তেইশ টা বছর।। উচ্চমাধ্যমিকের পর রনজয় কোলকাতা চলে গেছিলো পড়তে।। আর তারপর বছর দুয়েকের মাথায় কুহেলীরও বিয়ে হয় গেছিলো।। কেউ কারোর খোঁজ রাখেনি আর।।

আজ এত বছর পর আবার এক সরস্বতী পুজো।। তিতলি কে সকালে ডাকতে এসে দেখে মেয় টা কানে হেডফোন দিয়েই ঘুমোচ্ছে।।ফোনটা পাশেই পরে।। ফোনটা সরানোর সময়ই স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল একটা WhatsApp মেসেজ।।
"আজ একটা নীল শাড়ি পরে আসবি প্লিজ??" 
কি যেনো নাম টা দেখল!! ময়ূখ বোধ হয়।। ঝড়ের মত ধেয়ে এসছিলো এক ঝাঁক স্মৃতি।। মনে পড়েছিল এক জোড়া শান্ত নিবিড় চোখ।। এক মাথা ঝাকরা চুলের ছিপছিপে ছেলে টা কে।  
কেউ জানেনা কে কোথায় বাঁধা পরবে।। কুহেলী জানে, তবুও এই অনুভূতি গুলো চিরন্তন।। সেকাল আর একালের, চিরকুট আর হোয়াটসঅ্যাপ এর, মফস্বল আর খোদ কলকাতার প্রেমের কিছু তফাৎ থাকে অবশ্যই।। তবুও অস্বীকার করা যায় না।। অনুভূতি গুলো বড্ড এক।। কিছু স্মৃতি এভাবেই থাকুক না হয়।।
তিতলির এখন ফার্স্ট ইয়ার চলছে।। আজ আবার এস. ডি স্যারের বাড়ি পুজোয় যাবে।। এখনও উঠলো না মেয়ে টা।।
"কিরে তিতলি ওঠ।। যাবি না স্যারের বাড়ি??" আলমারিটা বন্ধ করতে করতেই কুহেলী বলল "এই দ্যাখ, নীল জামদানি টা বের করে রাখলাম।। এটা পরিস।।"
তিতলি উঠেছে।। মোবাইল টার দিকে তাকিয়ে হাসছে।। মুখ টা ঠিক সেই রকম লাল হয়ে গেছে।। মায়ের কথা শুনে মুখ খানা আরো লাল হয়ে গেলো যেন।।  আর কুহেলী তাকিয়ে আছে।। দেখছে।। প্রত্যক্ষ করছে তেইশ বছর পুরোনো সেই কুহেলী কে।।
রচনাকাল : ৩১/১/২০২০
© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 28  China : 33  France : 10  Germany : 6  India : 317  Ireland : 41  Netherlands : 1  Russian Federat : 11  Saudi Arabia : 3  
Sweden : 22  Ukraine : 20  United States : 408  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 28  China : 33  France : 10  
Germany : 6  India : 317  Ireland : 41  Netherlands : 1  
Russian Federat : 11  Saudi Arabia : 3  Sweden : 22  Ukraine : 20  
United States : 408  
© কিশলয় এবং বৈশাখী রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
বসন্তের রঙ নীল by Baishakhi Roy is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৭৬১৫