চারুলতা কে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো পারিজাত লনের দোলনার দিকে।
- অদ্ভুত ! সারারাত এই ঠান্ডায় এখানেই ঘুমিয়েছে নাকি মেয়েটা !
মনে মনে ভাবে পারিজাত। এগিয়ে এসে ওকে ডাকার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে থমকে যায় বুঝি এক মুহুর্ত। কাল রাতের ব্যবহার মনে করে নিজের ওপর রাগ হয় ওর।
কি দরকার ছিলো মেয়েটাকে অভাবে বলার ! ওর দোষ তো কিছু ছিলোনা !
আলতো করে হাত রাখে চারুর কাঁধে।
কোনো সাড়া নেই। ওর নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখটা দেখে খুব মায়া হয় পারিজাতের। ওই তিলটা খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে একবার।
মনের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে একবার ওর নাম ধরে ডাকে।
সাড়া নেই।
- নাহ গভীর ঘুমোচ্ছে মেয়েটা।
দোলনার পাশেই ওর মুখোমুখি মাটিতে বসে এক দৃষ্টে চারুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পারিজাত। নাহ মিল নেই, মিল নেই। এই মায়া ভরা মুখের সাথে তিতাসের অহংকার মাখা মুখের কোনো মিল নেই। তবে কেন ওকে অভাবে অপমান করলো কাল রাতে ! এক বিশ্বাসঘাতিকার ওপর জন্মানো তীব্র আক্রোশের আগুনে নির্দোষ চারুকে কেন জ্বালিয়ে দিলো ও !
হঠাৎ ভোরের একটা স্নিগ্ধ হাওয়ায় চারুর আলগা হয়ে আসা কিছু চুল এসে ওর চোখের নিচের তিলটাকে ঢেকে দিলো। যেনো চাঁদকে ঢেকে দিলো কোনো কালো মেঘ। আলতো করে আঙ্গুলে করে চুলগুলো তিলের ওপর থেকে সরাতে গিয়ে চমকে উঠলো পারিজাত। চারুর গা থেকে যেন আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেরই রাগ হলো এবারে। এতক্ষন মেয়েটকে ঘরে না নিয়ে গিয়ে এই ঠান্ডায় ওকে এভাবেই রেখে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি ওকে কোলে তুলে নিল পারিজাত। ওর শরীরের উত্তাপে, বুকের ওমে চারু যেন একটু ঘন হয়ে এলো। ওর মুখের দিকে আর একবার চাইলো পারিজাত। কালকের সেই কলকল করে কথা বলা মেয়েটা আজ ওর দুহাতের মধ্যে, জীর্ণ তরুলতার মতো নিস্তেজ..বিড়বিড় করে কি যেনো বলছে।
নাহ, সময় নষ্ট করা যাবেনা। সব ঘর ভেতর থেকে বন্ধ। আসলে চারু পাহাড়ে এলে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে উজাড় করে দেয়। ওকে তখন চেনাই যায়না। ওকে বাঁধা দিলেই বিরক্ত হয় ও। তাই ওর বন্ধুরাও কেউ খোঁজ করেনি আর কাল রাতে। তাছাড়া এই জায়গাটাও যথেষ্ট নিরাপদ । তাই কারোর চিন্তারও কোনো কারণ ছিলোনা। ঠান্ডার প্রকোপ বাড়তেই যে যার খাওয়া সেরে লেপের ভেতর সেঁধিয়ে গিয়েছিল তাই।
সব দরজা বন্ধ দেখে পারিজাত নিজের ঘরেই ওকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় যত্ন করে শুইয়ে দিয়ে ভালো করে ব্ল্যাংকেট ঢেকে দেয় গায়ে। তখনও ওর জ্যাকেটটা আঁকড়ে ধরে আছে চারু। কোনো রকমে নিজের রুমাল ভিজিয়ে জলপট্টি দিতে দিতে ভাবে কেনো কাল রাতে মেয়েটাকে অমন করে অপমান করলো ও ! নিজের কৃতকর্মের গ্লানি যেন ওকে কুড়ে কুড়ে খেতে লাগলো ক্রমাগত। মেয়েটা প্রায় অজ্ঞান, শুধু মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কি সব বলে চলেছে। এই অবস্থার জন্য ও নিজেই দায়ী, আজকে ওর জন্যই একটা মেয়ে এভাবে কষ্ট পাচ্ছে বেড়াতে এসে। কাল ভোরেও যে মেয়েটা সূর্যদয় দেখছিলো আজ সে নির্জীব হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। প্রকৃতিও যেন বিষণ্ন আজকে। কেন চারুকে দেখলেই তিতাসের কথা মনে পড়ে ওর ! কেন মনে পড়ে যায় সেই দিনের কথা যেদিন ও তিতাসকে নিজেরই প্রিয় বন্ধুর সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় দেখেছিলো ! না না, ভাববেনা আর এসব, কিছুতেই না।
দৌড়ে চলে এসেছিলো সেদিন ওখান থেকে পারিজাত। ফোনের সিম ভেঙে ছুঁড়ে ফেলেদিয়েছিলো ও। সারারাত ধরে তিতাসের সব স্মৃতি নষ্ট করে ফেলেছে নিজে হাতে, বিশ্বাসঘাতকের কোনো ছোঁয়া ও রাখবেনা নিজের সাথে। কিন্তু সফল হলো কি ! নিজেকে কঠিন আবরণে ঢেকে রাখলেও মনের কোণে তিতাসের ছবি রয়েই গিয়েছিলো, আর সেই স্মৃতিই আবার উস্কে দিলো চারু। ওকে দেখেই সেই পুরোনো ক্ষত যেন আবার দগদগে হয়ে উঠেছিলো ওর। তাই কাল চারুকে ওভাবে গলা তুলে কথা বলতে শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। উগরে দিয়েছিল সেদিনের ক্ষোভ, রাগ, ঘৃণার বিষগুলো। রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে লক্ষ্যও করেনি চারুর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায় অভিমান।
আসলে রাগ জিনিসটাই এমন। উল্টোদিকের মানুষটাকে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে নিমেষে। সে ক্ষত রয়েই যায়, সময়ের সাথে সাথে তাতে কিছুটা প্রলেপ পড়লেও একবারের নির্মূল হয়তো হয়না।
জ্বর না কমা পর্যন্ত চারুর কপালে জলপট্টি দিয়েছে পারিজাত। ওর এলোমেলো চুল গুলোতে আলতো আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে দিয়েছে। সত্যি বড় বড় কবিরা নারীকে যে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি কেন বলেছেন সেটা আজকে উপলব্ধি করতে পারলো পারিজাত। -অসুস্থতায়ও কত সুন্দর চারু । স্বার্থক নাম বটে।
ভাবে পারিজাত।
- একবার চোখ খোলো প্লিজ, আর কোনোদিনও তোমায় আঘাত করবোনা ওভাবে। বলে ওঠে নিজের অজান্তেই।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যায়। জ্বর কমলেও চোখ খোলেনা চারু। পারিজাতের মনে হয় ওর ওপর অভিমানেই বুঝি ও চোখ বুজে আছে, দেখতে চায়না ওকে আর।
আরও কিছুটা সময় পরে আসতে আসতে চোখ খোলে চারু। ওদিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পারিজাত।
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবারতি নন্দী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।