.. সেই চোখ, সেই চাহনি, সেই কথা বলার ভঙ্গি। এত মিল কিকরে হয় ! কিকরে ! এমনকি চোখের পাশে ওই তিলটাও !
এসবই ভাবছিলো একা তাঁবুতে বসে পারিজাত। অতীত এভাবেও কি ফিরে আসে ! কেন আসে ! কেন ওর সাথেই এরকম হয় ! নতুন করে সব শুরু করতে চেয়েই এই ট্রিপে এসেছিলো, ভাবতেও পারেনি সেখানেই আবার ফিরে আসবে যেখানে সবকিছু হারিয়ে গিয়েছিলো। নাহ ! আজ আর ঘুম আসবেনা, চোখদুটো বড্ড জ্বালা করছে ওর। পাশে রাখা গিটারটা তুলে নিয়ে তাঁবুর বাইরে জ্বলা আগুনের পাশটায় এসে বসে মৃদু স্বরে গাইতে শুরু করলো - 'তুমি কেন বোঝোনা তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়'.... জ্বলন্ত চোখ বেয়ে পড়তে থাকল গরম লবনাক্ত ধারা...রাতের নিশ্চুপ প্রকৃতি সাক্ষী থেকে গেলো সে হাহাকারের।
বিছানায় ক্রমাগত ছটফট করতে থাকে চারুলতা। কিছুতেই দু চোখের পাতা এক করতে পারছেনা সে। একসময় অস্বস্তি নিয়ে নেমে গেলো বিছানা ছেড়ে। কি যেন আছে ওই ছেলেটার চোখে। যেন অনেক অব্যক্ত কাহিনী বলে যায় নীরবে। জানতেই হবে চারুকে সবকিছু, যে করেই হোক। কেন ওকে দেখলেই পালিয়ে যায় ওভাবে ! পায়ে পায়ে জানলার ধারে এসে দাঁড়ায়, পর্দা সরিয়ে জানলায় চোখ রেখে থমকে যায় ও। - ' একি ! এই ঠান্ডায় তাঁবুর বাইরে বসে কি করছে টা কি ছেলেটা !' - তড়িৎ গতিতে নেমে যায় নীচে। নদীর ধারে পৌঁছে আরও একবার অবাক হয় , 'কোথায় গেলো এইটুকু সময়ের মধ্যে !'
- এদিক ওদিক ব্যস্ত পায়ে যেতে গিয়ে দুটো পাথরের মাঝে অন্ধকারে পা আটকে আচমকা পড়ে যেতে গেলে দুটো বলিষ্ঠ হাত ওকে ধরে নেয়। মোমের মত কোমল শরীর মুহূর্তের জন্য স্থান পায় সুঠাম বলিষ্ঠ দুটি হাতে। সামলে উঠেই দুজন দুজনের থেকে সরে যায় ছিটকে। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে চারু পারিজাতের চোখের দিকে- ' ওর গায়ের গন্ধটা কেনো এতো চেনা ! ' এই প্রথম পারিজাত ভালোকরে দেখলো চারুলতার দিকে- ' নাহ, হুবহু মিল না। ওর চোখে আগুন ছিলো, অবজ্ঞা ছিলো, এই চোখে তো মায়া, এই চোখে কি...প্রেম!'
দুজনেই চোখ সরিয়ে নেয় দুটো আলাদা আলাদা কারণে। অবশ হয়ে আসা শরীরটা এগোতে গিয়ে চারুলতা আবার হোঁচট খেলে পারিজাত ওর হাতটা ধরে ফেলে শক্ত করে। সাবধানে নিয়ে বসায় তাঁবুর বাইরে জ্বলা আগুনটার পাশে। তখনও কাঁপছিলো চারু, সেটা ঠান্ডায় না উত্তেজনায় ও জানেনা। তাঁবুর ভেতর থেকে একটা গরম জামা এনে চারুর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে ওর উল্টোদিকে বসে এক দৃষ্টে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে পারিজাত। বহুক্ষণ কোনো কথা বলেনা কেউই। কাটতে থাকে মুহূর্ত...
নিস্তব্ধতা বাইরে হলেও দুজনেরই মনেই সাংঘাতিক ঝড় চলতে থাকে। দুজনেরই ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
মৌনতা ভেঙে পারিজাতই প্রথম কথা বলে, - ' আপনি এতো রাতে, এই ঠান্ডায় এখানে কেনো এলেন চারু ?'
ভাবনার অতল থেকে এক ঝটকায় যেন বাস্তবে ফিরে আসে চারুলতা পারিজাতের মুখে নিজের নাম শুনে। এক মুহুর্ত কোনো উত্তর দিতে পারেনা। নিজেকে একটু ধাতস্থ করে বলে ওঠে - ' আপনার জন্যই তো ! ' - বলেই মুখ নামিয়ে নেয় চারু।
পারিজাত চমকে ওঠে ওর উত্তরে - ' আমার জন্য ! মানে ! '
ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে চারুর। খানিকটা উঁচু স্বরেই বলে ওঠে- আপনিই বাধ্য করেছেন এখানে এভাবে আসতে। কেনো ওভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন বারবার আমায় দেখে ? এখানে এভাবে ঠান্ডার মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে কেনো থাকতে হচ্ছে আপনাকে ? কি করতে কি চাইছেন বলুন তো ! সকাল থেকে আপনার সাথে কথা বলবার চেষ্টা করে চলেছি আর আপনি এভাবে এখানে গীটার হাতে স্যাড সং গাইছেন ! নিজেকে কি দেবদাস মনে করেন আপনি ?
এক নাগাড়ে এতগুলো কথা বলে হাপাচ্ছিলো চারু। আর উল্টো দিকে ওর বলা শেষ কথা গুলো শুনে পারিজাতের বুকের ছাই চাপা আগুন যেন মুহুর্তে জ্বলে উঠলো। কেটে কেটে শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে ও বললো
- আমি আমার জন্য আর কারোর চোখে ঘৃণা দেখতে চাইনা। আপনি চলে যান এখন এখান থেকে। আমার ভদ্রতার মুখোশ পড়ার অভ্যাস অনেকদিন আগে চলে গেছে, আর বেশিক্ষন আপনি এখানে থাকলে হয়ত অপমানজনক কিছু বলে বসব।
কথাগুলো এক একটা যেন তীরের মতো বিঁধেছিলো চারুর বুকে, চোখে জল এসে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিকে পারিজাতের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার ভেতরে তখন আগুন জ্বলছে, যে আগুন বিধ্বংসী। তবু শেষ বারের মতো চারু অনুরোধ করেছিলো হোটেলে ফিরে যেতে। কিন্তু একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলো ওকে ফিরে যেতে।
ধীর পায়ে চোখে জল নিয়েই ফেরার পথে পা বাড়ায় চারু। বুকের ওপর যেন পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে কেউ। সেই অদৃশ্য চাপ বুক থেকে আস্তে আস্তে দলা পাকিয়ে গলার কাছে উঠছে। যন্ত্রণা হচ্ছে গলার কাছটা। হোটেলে না ঢুকে লনের দোলনাতেই বসে পড়লো সে। কেউ যেন সব শক্তি কেড়ে নিয়েছে ওর থেকে। আর এক পা চলার ক্ষমতা নেই ওর। কাঁদতে কাঁদতেই এক সময় দোলনাতেই ঘুমিয়ে পড়লো ও পারিজাতের জ্যাকেটটা আরো শক্ত জড়িয়ে নিয়ে।
ওদিকে অসম্ভব আক্রোশে ফুঁসতে থাকে পারিজাত। - ' এতো সাহস মেয়েটা পেলো কিকরে ওকে প্রশ্ন করার ! কাল আসুক আবার সামনে, সব উত্তর এমনভাবে দেব যাতে কোনোদিন কোনো অচেনা ছেলেকে উঁচু গলায় প্রশ্ন করার আগে দুবার ভাবে। ' হোটেলের চারতলায় চারুর ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে তাঁবুর মধ্যে ঢুকে যায় সে। দু প্রান্তে দুজন ঘুমিয়ে পড়ে একজন যন্ত্রণা আর একজন আক্রোশ নিয়ে। দর্শক এবং একমাত্র সাক্ষী হয়ে থেকে যায় এই রাতের রহস্যময় প্রকৃতি।
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবারতি নন্দী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।