আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। এরকম দিনে গঙ্গার ধারে বসে থাকতে ভীষণ ভালোলাগে চারুলতার। অন্তর্মুখী মেয়েটা বড্ড বেশিই আবেগপ্রবণ। এই নদীর অবিশ্রান্ত বহমান ধারা ওকে শক্তি যোগায় বাঁচার, বয়ে নিয়ে চলার। সব মলিনতা, সব দুঃখ, আবর্জনা, এমনকি শরীরের অবশিষ্টাংশ - অস্থি টুকুও কেমন বয়ে নিয়ে চলে যায় সে। কিন্তু, স্মৃতি বয়ে নিয়ে যেতে পারে কি ! যদি পারতো তাহলে এত বছরের জমে থাকা স্মৃতির ভার কেন হালকা হলোনা এই নদীর কাছে এসেও ! বড় যন্ত্রণা দেয় সেই স্মৃতি। মুছে ফেলতে চাইলে যেনো আরো বেশি মনে পড়ে। এই দিনটাতে সেই স্মৃতি যেন আরো বেশি সজীব হয়ে ওঠে।
ভাবতে ভাবতে চারুলতা ফিরে গেলো আজ থেকে ঠিক চার বছর আগের এই দিনটায়। কিভাবে যেন এই দিনটা এলেই আকাশ মেঘলা হয়। প্রকৃতিও কি ফিরে যায় ওই দিনটায় ! সেও কি আবেগপ্রবণ !
ধুর ! কি যে সব ভাবে !
সে বছর ছুটিতে পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলো ওরা কিছু বন্ধু মিলে একটা ট্যুরিজম কোম্পানির সাথে। পাহাড়ে গেলে শহরের রুক্ষতা মুছে যায় এক নিমেষে, গায়ে লেগে থাকা সব ক্লান্তি মুছে যায় মুহুর্তে। পাহাড়ের একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, চারু সেটা ভীষণ ভাবে অনুভব করে। আসলে প্রকৃতি অনেক কথা বলে, শুধু কান পেতে শুনে নেওয়ার ইচ্ছে থাকতে হয়।
পৌঁছনোর পরের দিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় চারু ঘর থেকে বেরিয়ে যায় পাহাড়ের সাথে কিছু মূহুর্ত কাটাতে, বাকিরা উঠলেই জলযোগ সেরে ওদের ঘুরতে বেরোনো। চারুর এসব ব্যস্ততা একদম ভালোলাগেনা পাহাড়ে এসে। নিরিবিলিতে সময় কাটাতে ও ভীষণ ভালোবাসে। ওদের হোটেলের ঘরটা থেকে পাহাড় দেখা যায় জানলা খুললেই, আর নীচে বয়ে চলা অবিশ্রান্ত পাহাড়ি নদী। রাস্তাটা পেড়িয়ে এসে সাবধানে এ পাথর সে পাথরে পা রেখে একটা পাথরের ওপরে এসে চুপ করে বসে পড়ে ও। কিভাবে পাহাড়ের মাথাটায় সূর্যের লালচে আভা লাগে সেটা ও চোখ ভোরে দেখতে চায়। প্রকৃতি আস্তে আস্তে ঘুম ভেঙে উঠবে আর ও আলতো করে তাকে বলবে 'শুভ সকাল'। ওর এই কাজকর্ম গুলো ওর বন্ধুদের কাছে পাগলামি। কিন্তু ও জানে প্রকৃতি শুনতে পায় ওর কথা।
চারদিকের অন্ধকার এখনো কাটেনি। আস্তে আস্তে ফর্সা হবে চারদিক। আবার একটা নতুন ভোর, নতুন শুরু, নতুন করে বাঁচার আশা, লক্ষ্যের দিকে আরও এক পা এগিয়ে যাওয়া। এসবই ভাবছিলো বসে বসে, হঠাৎ একটা পায়ের শব্দে চমকে উঠে পেছন ঘুরে তাকালো ও, আর তাকিয়েই বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে উঠলো ওর। সেই বাচাল ছেলেটা এখানে কি করছে ! চারুদের দলের সাথে এই ছেলেটার দলও ছিলো বাসে। একই কোম্পানির সাথে ওরাও এসেছে ঘুরতে। এদের এই দলটার জন্যই আর একটু হলে বাসটা খাদে ঢুকে যেতো। ড্রাইভারের শত বারণ সত্ত্বেও এই ছেলেগুলো নিজেদের গিটার, গান আর হুল্লোড় থামায়নি। পাহাড়ে গাড়ি চালাতে মনোসংযোগ খুব প্রয়োজন, ওদের হুল্লোড়ে বাস চালকের তাতে বারবার বিঘ্ন ঘটেছিলো, ফলে বাস অসাবধানতাবশত খাদে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো চালকেরই দক্ষতায়। শান্ত মুখচোরা চারু নিজের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ওদের দলের সামনে গিয়ে বলেছিলো ' অসভ্যতা একটু মাত্রা ছাড়াই হয়ে গেল না কি !'
দলের একটা ছেলে এগিয়ে এসে ওকে কিছু বলতে গেলে এই ছেলেটাই আটকেছিলো ওকে। অপরাধী মুখে ক্ষমা চেয়েছিল সে দলের হয়ে সকলের কাছে।
ভুল স্বীকার করে নিলে ক্ষমা করাই উচিৎ, চারুও কথা বাড়ায়নি তাই। কিন্তু ভোলেওনি ঘটনাটা। কাজেই এই সময় এভাবে ছেলেটাকে এখানে দেখে ওর ওই ঘটনাই মনে পড়লো আবার। মুখ ঘুরিয়ে নিলো কোনো কথা না বলেই। ছেলেটাও বোধহয় ওর মনের ভাষা বুঝে আর কথা বলার চেষ্টা করেনি। তড়িৎ পায়ে লাফাতে লাফাতে ঠিক মাঝ নদীতে পৌঁছে একটা বড়সড় পাথরের ওপর গিয়ে বসে পড়ল সে। মনে মনে চারু ভাবলো - ' খরগোশ নাকি ! '
ধীরে ধীরে লালের ছোঁয়া লাগতে শুরু করলো চারদিকে। পাহাড়ের খাঁজ থেকে সূর্যটা মাথা তুললো নিজের ঘুম ভাঙার পরবর্তী স্নিগ্ধতা নিয়ে, নতুন আশা নিয়ে। হাসি ফুটলো এতক্ষনে চারুলতার মুখে। প্রকৃতির এই শান্ত রূপ ওর খুব প্রিয়। পাহাড় এমনিও শহরের কলরব থেকে ঊর্ধ্বে তবু এই ভোরের স্নিগ্ধতা ওর খুবই প্রিয়। সবাই লেপের তলায় কাঁপলেও ও এই ঠান্ডাটা খুব উপভোগ করে।
সূর্যদয় দেখতে গিয়ে ছেলেটার কথা ভুলেই গিয়েছিলো ও। উঠে হোটেলের দিকে ফিরতে গিয়ে মনে পড়লো ছেলেটার কথা। দেখলো একই ভাবে ওর দিকে পিছন ঘুরে বসে আছে। ওঠার কোনো লক্ষণই নেই। আর এক ঘন্টার মধ্যেই ওদের বাস ছাড়বে, ছেলেটা যাবেনা নাকি ! একবার ভাবলো - ডাকবে কি ! তারপর ভাবলো - 'থাক ! আমার কি ! নিজে বেড়িয়েছে ঘুরতে নিজের হুঁশ নেই !'
কিন্তু তবু মনে একটা দোলাচল নিয়ে হোটেলের দিকে ফিরে চললো চারু। ঘরে ঢুকে দেখলো বেড টি নেওয়ার পরে সকলের মধ্যে একটু গতি সঞ্চার হলেও রুহী এখনও গুটিসুটি পাকিয়ে লেপের তলায় কাঁপছে। ওর দিকে এগিয়ে ওকে ডাকতে ও দাঁতের ঠকঠকানি সহযোগে যা বললো তার মর্মার্থ এই যে - ' তোরা চলে যা, যাওয়ার আগে সবার লেপ গুলো একটু আমায় দিয়ে যা। লেপ থেকে বেরোলে আমি স্নো-ওম্যান হয়ে যেতে পারি ।' - এই শীতকাতুড়ে প্রাণীকে নিয়ে কি করা যায় সেটাই ভাবছিলো সবাই, তখনই হোটেলের একজন কর্মী এসে জানালো বাস এসে গেছে, তাড়াতাড়ি জলখাবার সেরে সবাই যেনো বাসে ওঠে। আর আধ ঘন্টার মধ্যে রওনা না হলে সব জায়গায় ঘোরা হবেনা। এই ঘোষণার পর আর আলসেমি চলেনা তাই সকলেই তাড়াহুড়ো করে তৈরি হয়ে নীচে নেমে খাবার টেবিলে এসে বসলো। হ্যাঁ , রুহীও। চারু যখন বললো হোটেলের সকলে ঘুরতে বেরোলে ওকে একা থাকতে হবে এই পুরো হোটেলে। আর তারপর যদি এই ঘরে ভৌতিক কোনো ঘটনা ঘটে তাহলে যেন ও ভুতের নাকে সুড়সুড়ি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়, কারণ আর কেউ তো ওকে বাঁচানোর জন্য থাকবেনা । ভুতের গল্পের পোকা হলেও রুহী ভীষণ ভীতু, তাই ভুতের ভয়ের কাছে হার মেনে সেও তৈরি হয়ে নেমে গিয়েছিলো চারুর পেছন পেছন গোমড়া মুখে। ওদের দলটা তৈরি হয়ে গাড়িতে ওঠার কিছুক্ষন পরে ওই ছেলেগুলো উঠলো । তবে আজ আর গিটারের বাড়াবাড়ি নেই। কালকের বাচাল ছেলেগুলো যেনো কোন এক মন্ত্রবলে একদম শান্ত হয়ে গেছে। অবাক হলো চারু, কিন্তু প্রকাশ করলোনা। একটু পর খেয়াল করলো ওই ছেলেটা নেই, হয়তো তৈরি হয়নি। এর মধ্যেই ড্রাইভার নিজের সিটে এসে বসলেন। স্টার্ট করার আগে একবার জিঙ্গেস করে নিলেন সকলে উঠেছেন কিনা। সকলে 'হ্যাঁ' বলায় বাস এগোনো শুরু হলো। সেই ছেলেটা আর এলোনা। একটু খারাপ লাগলো চারুর-' সকালে অমন না করলেই বোধহয় ভালো হতো, হয়তো খারাপ লেগেছে।' ভোরে ওর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আড় চোখে দেখেছিলো চারু, ছেলেটার মুখটা যেনো কেমন বিষণ্ণতা মাখা। সকলের মাঝে থেকেও কিছুতেই যেন ভালোলাগছিলোনা। ভাবছিলো কখন ফিরবে হোটেলে। আবার মুখোমুখি হলে সকালের ভুলটা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
রচনাকাল : ১২/৫/২০২১
© কিশলয় এবং দেবারতি নন্দী ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।