ভ্রমণের নেশা মানুষের চিরন্তন। স্হানু হয়ে বসে থাকতে কারও ভালো লাগে না। শৈশব থেকেই মানুষের মন কল্পনায় ভর করে চলে যায় দূরে বহু দূরে। শৈশবে যেটা থাকে শুধুই কল্পনা, বড় হওয়ার সংগে সংগে তাকে বাস্তব করে তুলতে চায় সে। ভ্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য হল গতানুগতিক জীবনের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি করা। মানুষ শুধু প্রকৃতি নয়, ভ্রমণের সংগে সংগে সে অঞ্চলের মানুষের সাথে মনের লেনদেন করে। সে এক বৃহৎ জীবনের আস্বাদন লাভ করে। ভ্রমণ শুধু প্রমোদের উপকরণ নয়, ভ্রমণ শিক্ষার ও অঙ্গ।
আগামী ২৭শে সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবস। বর্তমানে কোভিড ১৯ এর জন্য আমরা সবাই গৃহবন্দী। তাই এই পরিস্থিতিতে সকলের মন ভারাক্রান্ত। আমার জীবনের ছোট্ট ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সকলের সাথে আমি ভাগ করে নিলাম। আশা করি সকলের ভালো লাগবে। আমার মা, বাবার খুব বেড়ানোর সখ। অল্প বয়সে আমিও তাদের সাথে ভ্রমণের সংগী হই। অনেক জায়গায় ঘুরেছি। গত বছর আমি গিয়েছিলাম সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এখনও পর্যন্ত আমার জীবনে সব থেকে স্মরণীয় ঘটনা। এক বেসরকারী পর্যটন সংস্থা এই ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সুন্দরবনের অজস্র নদীনালা খাঁড়ি ঘুরে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে আমরা যাব সমুদ্রের কাছাকাছি বাংলাদেশ সীমান্তে। তারপর সে পথ ঘুরে আবার ফিরে আসব।
অবশেষে সেই দিন এল। শীতের সময়। গরম জামাকাপড় শরীর মুড়ে বেশ সকালেই বেরুতে হল এসপ্ল্যানেডে ভ্রমণ সংস্থার বাস ধরতে। বাইপাস, বানতলা পেরিয়ে চলেছি সুন্দরবনের দিকে। মা, বাবা, আমি, বোন আর মাসতুতো ভাই মিলে পঁচিশজন দলের সাথে আমরা চললাম আনন্দ করতে করতে। অপরূপ দৃশ্য চারিদিকে, সবুজের সমাহার। আমি কোনদিন সুন্দরী, গেঁওয়া, গরাণ গাছ দেখিনি। এগুলো সব শ্বাসমূল জাতীয় গাছ। একমাত্র সুন্দরবনের নোনা জমিতে এই গাছ জন্মায়। ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা পৌঁছলাম বাসন্তী, সুন্দরবনে ঢুকবার মুখে একটা বড় গঞ্জ। অসংখ্য জেলে নৌকা ও লঞ্চের ভীড়, নদী বেশ চওড়া। শীতের বাতাসে একটা নোনা গন্ধ। আমাদের সংগে ভ্রমণ সংস্থায় গাইড ছিলেন। লঞ্চে উঠে মনটা ভালো লাগলো। বেশ প্রশস্ত লঞ্চ। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। আমরা যেন চলেছি সমুদ্রের বুক চিরে। লঞ্চে আমাদের তিনদিন কাটল। লঞ্চে রান্নাঘর ছিল। এখানেই খাওয়া হল।এখানেই আমরা মিলেমিশে থাকলাম। গাইড কিছু নির্দেশ দিলেন। প্রাণভরা সুন্দবনকে প্রত্যক্ষ করলাম। সন্ধ্যেবেলায় কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল।
গাইড আরও জানালেন বোনের ভেতরে যেসব জায়গায় যাব সেখানে যেন আমরা নিজের মত করে চলাফেরা না করি। গাইডের সংগ ছাড়া না হই। বনের ভিতর কোথায় যে বিপদ ওৎ পেতে আছে আমরা কেউ জানি না।আমাদের দলে পঁচিশজন মানুষ ছাড়া দুজন গাইড ছিল। রান্নার লোকজন ও লঞ্চের লোকজন নিয়ে জনা চল্লিশ। আধুনিক জীবন ছেড়ে চললাম নদীপথে বনের গভীরে। এ এক অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
লঞ্চ চলেছে মাতলা নদী পার হয়ে নেতা ধোপানির ঘাটের দিকে। চারদিক নিঃশব্দ, শুনশান। শুধু মাঝে মাঝে ভটভটি লাগানো জেলেদের নৌকো ভেসে আসছে। দুপারে ঘন জঙ্গল। নদীর ওপর দিয়ে শঙখ চিল উড়ে যাচ্ছে। শুনলাম এটা নাকি বিধবাদের গ্রাম। কাঠ, মধু আনতে গিয়ে এ গ্রামে প্রায় সব পুরুষ ই বাঘের পেটে গেছে। গা কেমন ছমছম করে উঠল ভয়ে। নদীতে এখানে কেউ নামে না। ভয়ংকর হিংস্র কুমিরও এখানে আছে। দূরে একটা চর জেগে উঠেছে। দেখলাম সেখানে কুমির রোদ পোহাচ্ছে। আমরা খাবারের ডাক পেলাম। এতক্ষণ ভুলে গিয়েছিলাম যে খিদে পেয়েছে। গরম ভাত ও মুরগির মাংসের ঝোল খুব ভালো লাগলো। আবার নদীর দিকে, রহস্য ভরা জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শীতের বেলা ছোট। কুয়াশায় অস্পষ্ট হল চারিদিকে। সজনেখালির দিকে এসে লঞ্চ থামল। অজস্র পাখির কলরব। এখানে একটা পাখিরালয় আছে। সজনেখালিতে আমরা রাতে নামলাম না। পরের দিন সেখানে গেলাম। দেখানো হবে বাঘের যাতায়াতের পথ।প্রায় মাঝনদীতে লঞ্চ থেমে রইল। সজনেখালির টুরিস্ট বাংলো ছাড়া চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিঃশব্দ, নিঝুম। কান পাতলে বাঘের ডাক শোনা যায়। রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল। পরস্পর পরস্পরের সাথে আলাপ পরিচয় হল। তারপর লঞ্চে কম্বল মুড়ি দিয়ে নদীর উপর ঘুম। চারিদিকে পর্দা নামিয়ে দেওয়া হল। তার ই ফাঁক দিয়ে দেখলাম আকাশের তারা।
পরের দিন সকালে সজনেখালিতে নরম মাটির উপর টাটকা বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম। গাছে গাছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। আর বাঁদর। এখানে অনেক হরিণ ও আছে। শিকারের জন্য বাঘ এদিকটায় আসে। পরদিন গোসাবা, সাতজেলিয়া গেলাম।বাংলাদেশের সীমান্ত পৌঁছলাম। কীভাবে তিনদিন দুই রাত্রি কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। সুন্দরবনের রোমাঞ্চ বহুদিন মনে থাকবে।।
রচনাকাল : ১৫/৯/২০২০
© কিশলয় এবং মোনালিসা রায় কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।