গত বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে একদিন ভোরবেলা পাঁচটার সময় গাড়ী করে বেরিয়ে পড়লাম পূর্ব মেদিনীপুরের বন্দর শহর হলদিয়ার উদ্দেশ্যে। কলকাতা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে হুগলী নদীর মোহনায় অবস্থিত এটি একটি শিল্প শহরও বটে।
এই শিল্পাঞ্চল টি অত্যন্ত মনোরম ও স্বাস্থ্যকর।আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম।হলদি নদীর পাড়ে খুব সুন্দর একটা গেস্ট হাউসে আমরা উঠলাম। এই হলদি নদী আসলে গঙ্গার একটি অংশ।'হলদিয়া টাউনশিপ' সম্পূর্ণ ভাবে হলদি নদীর পাড়ে অবস্থিত।
প্রথম দর্শনেই হলদিয়া কেড়ে নিলো আমার মন। গেস্ট হাউসের পিছন দিকে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলেছে হলদি নদী।লাগেজ রেখে,তাড়াতাড়ি জলখাবারের পাট চুকিয়ে চললাম নদী দর্শনে।
অপূর্ব সাজানো হলদি নদীর পাড়। কি নেই সেখানে? নদী থেকে মাছ ধরে সরাসরি বিক্রি করছে নদীর পাড়ের বাজারে।টাটকা শাক-সব্জী, ফল -ফুল বিক্রি করছে গ্রামের লোকেরা।
হঠাৎ জাহাজের বাঁশি শুনে দেখি দেশ-বিদেশের কত বড় বড় পণ্যবাহী জাহাজ নদী থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে সাগরের দিকে। ছুটলাম পাগলের মতো।যা দেখছি অবাক লাগছে।মাঝিরা নৌকো করে মানুষ পারাপার করছে। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম ওই পাড়টা হোলো বিখ্যাত 'নন্দীগ্রাম'।
নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শব্দ টেনে নিয়ে গেলো নদীর দিকে। খানিক বসলাম। দেখলাম ডলফিন।
এখানকার মূল শিল্প 'হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালস'।
লাঞ্চ সেরে চললাম হলদিয়া পোর্ট দেখতে। এই হলদিয়া বন্দরের স্থান কলকাতা বন্দরের পরেই। 'প্রবেশানুমতি' আগেই ছিলো।চোখের সামনে ৮ থেকে ১০তলা বাড়ীর সমান দেশ-বিদেশের বহু পণ্যবাহী জাহাজ দেখে ঠিক করতে পারছিলাম না কি করবো। অনুমতি পত্র নিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখলাম, একটা বাড়ীর চেয়েও বেশি কিছু সেখানে আছে। ক্যাপ্টেন এর দূরবীন দিয়ে দূরের সমুদ্র দেখলাম। এ যেনো এক দারুণ অনুভূতি।
বিকেলে ফিরে,গেলাম নদীর পাড়ে।একদম দীঘার মতো ভিড়। হরেক খাবারের দোকান।দূরে গ্রামের আলোগুলো দেখতে ভালো লাগছিলো।সমুদ্রের মতো ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেলো। সন্ধ্যের সময় আলো জ্বালিয়ে এক এক করে জাহাজগুলো ফিরতে লাগলো। ভীষন সুন্দর লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো ওখানেই থাকি।খারাপ লাগছিল দু দিন পরে ফিরতে হবে বলে।
পরেরদিন সকালে জলখাবার খেয়ে গ্রামটা ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম গেওখালী জাহাজ তৈরীর কারখানা দেখতে। অপূর্ব গ্রামের দৃশ্য দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম।
উপকূল-রক্ষী(তট রক্ষক)বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি হোলো হলদিয়া। যেটা কম - বেশি ১৮ টির মতো 'উভচর যান'- হোভারক্র্যাফট) এর বন্দর। অর্থাৎ এরা দেখতে ছোটো জাহাজের মতো,সমানভাবে চলতে পারে জলে ও ডাঙায়।
দেখলাম প্রচুর খেজুর গাছ থেকে 'রসী'-রা রস নিয়ে নামছে।গ্রামের মেয়েরা উঠোনে বসে কাঠের উনুনে সেই রস জাল করে গুড় তৈরী করছে। হাওয়ায় ভাসছে মিষ্টি একটা কি সুন্দর গন্ধ! আহ :।
হলদিয়াতে রয়েছে 'ইন্ডিয়ান অয়েল'--এর একটি বৃহত্তম 'তৈল শোধনাগার'।
বিকেলের দিকে গেলাম অত্যন্ত প্রাচীন 'হলদিয়া রাজবাড়ী'--পরিদর্শন করতে।ফেরার সময় গেলাম 'সানসেট' পয়েন্ট এ।অপূর্ব সূর্য্যের অস্ত যাবার দৃশ্য সত্যিই মনোরম।
পরের দিন খুব ভোরে উঠে পড়লাম। আজ ফিরতে হবে যে।তাই গাড়ির ড্রাইভার বললো একটা দারুণ জায়গায় নিয়ে যাবে। সত্যিই অবাক করার মতো নিয়ে গেলো এক জায়গায়। 'মিতসুবিসি' কোম্পানী কে ঘিরে রয়েছে 'সাতাকু' নামে জাপানীদের একটি অতি সুন্দর ছোট্ট চমৎকার শহর।কেবল জাপানীরাই এখানে থাকে।এই শহরে জাপানীদের জন্যই রয়েছে রেস্টরেন্ট,সিনেমাহল।এটি ভারতের একমাত্র শহর 'জাপান টাউন'।
হলদিয়াতে আছে 'টাটা ফুটবল একাডেমী'। খেলাধূলার জগতে এটি একটি বিশেষ অবদান।
ফিরে এসে স্নান সেরে লাঞ্চ করে মনখারাপকে সাথী করে, হলদি নদীকে পিছনে রেখে কলকাতার দিকে রওনা দিলাম।
রচনাকাল : ১৫/৯/২০২০
© কিশলয় এবং অসীমা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।