স্কুল জীবন থেকেই আমরা জেনে এসেছি ,Travelling is a part of education অর্থাৎ ভ্রমন বা পর্যটন হল শিক্ষার একটি অংশ। বাস্তবিকই শিক্ষা এবং ভ্রমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু, বর্তমানকালের সংগঠিত পর্যটনের মূল ভাবনা,সূচনা, প্রচার , প্রসার ও জনপ্রিয়তার নেপথ্যে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বের ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নের প্রচেষ্টা।।
২য় বিশ্ব যুদ্ধের পরে সারা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক অবস্থা মুখ থুবড়ে পড়ে তখন বিশ্বময় অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রসারের জন্য বিভিন্ন দেশে এই পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠে। বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই শিল্পের সূচনা হয়। ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে এই সকল পর্যটন সংস্থার সেতুবন্ধন তৈরি হয়। কালক্রমে ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘের বিশ্বপর্যটন সংস্থা (United Nations World Tourism Organisation)এর তত্বাবধানে ২৭শে সেপ্টেম্বর দিনটিকে প্রতিবছর সারা বিশ্বে বিশ্বপর্যটন দিবস হিসাবে পালন করা হয়। বিশ্বপর্যটন সংস্থার প্রধান কার্যালয় স্পেনের মাদ্রিদে। এই পর্যটন দিবসের অন্যতম লক্ষ্য হল জনসচেতনতা বৃদ্ধি অর্থাৎ পর্যটনের শিক্ষামূলক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে ছড়িয়ে দেওয়া।
আমরা শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে কত ঐতিহাসিক জায়গার কথা,কত সুন্দর স্থাপত্য,মিনার, সেতু এবং প্রকৃতির নানা অপরূপ শোভার কথা জানতে পারি। কিন্তু, স্মরণে তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ভ্রমণেই আমাদের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা এবং সুস্পষ্ট জ্ঞান অর্জন হয় যেটা স্থায়ীভাবে আমাদের মনে গেঁথে থাকে।অজানাকে জানা,অদেখাকে দেখার আনন্দটাই আলাদা।তাই ভ্রমণ পিপাসু মানুষ যার যার সাধ্যমত বেরিয়ে পড়ে অজানার উদ্দেশ্যে।দেশ বিদেশের নানান বর্ণের, নানা ধর্মের অনেক মানুষের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, তাদের জীবন শৈলী, আচার আচরন, খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আমরা জানতে পারি।
পর্যটনের একটি উদ্দেশ্য হলো
বিনোদন ও অবসর সময় কাটানো। একঘেয়েমির কর্মজীবনে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে ।তাই মাঝে মাঝে কর্মজীবন থেকে কয়েকটা দিন ছুটি নিয়ে ছন্নছাড়ার মতো বিভিন্ন প্রান্তে পরিবারসহ বা বন্ধুবান্ধব সহ সদলবলে তারা বেরিয়ে পড়ে। গৃহ সংসার কিছুদিনের জন্য তালা বন্ধ রেখে বাইরে একটু হাওয়া বদল করা এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আনন্দগুলো নিংড়ে বের করে নিয়ে উপভোগ করাই উদ্দেশ্য যাতে ফিরে এসে নতুন উদ্দীপনা প্রাণশক্তিতে ভরপুর হয়ে নিজ নিজ কর্মে মনোনিবেশ করে আরো বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারে।কেউ কেউ আবার ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো কাজের সূত্রে দেশ বিদেশ ভ্রমন করেন। কাজের ফাঁকে একটু সুযোগ করে সেইসব জায়গার দর্শনীয়স্থানগুলো ঘুরে দেখে আসেন।কেউ কেউ আবার কাজ শেষ করে একটু সময় বের করে জায়গাটা ঘুরে নেন নিজের জীবনীশক্তির রসদ জোগানোর জন্য।
ভিন্ন ভিন্ন দেশে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যেগুলো কালক্রমে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হয়েছে ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে,যেমন আগ্ৰার তাজমহল, দিল্লির লালকেল্লা,লোটাস টেম্পল, ইন্ডিয়া গেট ইত্যাদি।গোয়ায়
রয়েছে অনেক দেখার মত চার্চ এবং মনমোহিনি সমুদ্র সৈকত, আবার কাজুগাছের সারিতে প্রকৃতি কত সবুজ, সুন্দর। জলপথে ভ্রমন করলে সেই সবুজের হাতছানি উপভোগ করা যায়। হরিদ্বারের মনোরম পবিত্র গঙ্গার ঘাট,লছমনঝোলা, রামঝোলা ও উল্লেখ্য। তাজমহলের কথা আমরা ইতিহাসে পড়েছি। কিন্তু, চাক্ষুষ দেখার অভিজ্ঞতাটাই আলাদা । শাহজাহান তাঁর বুকভরা প্রেম উজাড় করে তাজমহলের প্রতিটি কোনায় কোনায় ঢেলে সাজিয়েছেন। সেদিকে তাকালে দুচোখ যেন স্থির, পলকহীন হয়ে যায়। যমুনার তীরে শুভ্র, সমুজ্জ্বল প্রেমের প্রতীক মুমতাজ মহলের এই স্মৃতিসৌধ চোখে না দেখলে জীবনটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হিসেবে এটি সমগ্ৰ বিশ্বে পরিচিত। দেশে, বিদেশে আরো এমন অনেক আশ্চর্য স্মৃতিসৌধ, স্থাপত্য আছে যেগুলো অতুলনীয়। এইসকল আশ্চর্য দৃশ্য সকলের দেখার সুযোগ হয় না। তার পিছনে আর্থিক সামর্থ্যটাই কারণ। তবে আমাদের বাসস্থানের আশেপাশে, কাছাকাছি এমন অনেক দর্শনীয় স্থান আছে যেগুলো আমাদের হয়ত অজানা। এইসব স্থানেও বাইরে থেকে অনেক পর্যটক আসেন এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। এছাড়াও প্রকৃতির নিপুণ হাতে গড়া কত সমুদ্র, পাহাড়,জঙ্গল, জলপ্রপাত ইত্যাদি রয়েছে, যেগুলো পর্যটন স্থান হিসেবে বিখ্যাত। মানুষ তার নিত্য কর্মজীবন থেকে একটু সময় বার করে নিয়ে বারে বারে সেদিকে ছুটে যায়।জনকোলাহলপূর্ণ জীবন থেকে কয়েকটা দিন সরে গিয়ে নিরালায় প্রকৃতির মাঝে মানুষ মুক্তির স্বাদ পায়।
পর্যটন শিল্প এখন ব্যবসার একটি বিশেষ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ছোট বড় অনেক পর্যটন সংস্থা বাস, ট্রেন ইত্যাদি পরিবহনের সুবন্দোবস্ত করে ও নিজস্ব গাইড রেখে এই ব্যবসা চালান।তারা তাদের পর্যটকদের থাকা, খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা ইত্যাদি খুঁটিনাটি দেখেন এবং নানা জায়গায় ঘুরিয়ে দর্শনীয় স্থান দেখানোর সুযোগ করে দেন।পর্যটন স্থানকে কেন্দ্র করে অনেক ব্যবসায়ী তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন।
দিন যত এগোচ্ছে পর্যটন ব্যবসা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ হচ্ছে। মানুষ আরও উন্নত ও আধুনিক, আরও শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি ভ্রমনকে সঙ্গত কারণেই জীবনের অঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছে, কারণ মানুষ অনুধাবন করতে শিখেছে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাই শিক্ষাকে সম্পূর্ণতা দেয়।
২৭ শে সেপ্টেম্বর দিনটিকে বিশ্ববাসী নানা অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শোভাযাত্রা, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে সাড়ম্বরে পালন করে। মানবজাতির জীবনে ভ্রমন বা পর্যটনের অপরিসীম শিক্ষাগত, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অবদান ও অপরিহার্যতা অনাগত সব প্রজন্মের মানুষের মনে সদাজাগ্রত রাখার উদ্দেশ্যেই বোধকরি জাতিসংঘের বিশ্বপর্যটন সংস্থা এই ব্যবস্থা করেছে।
রচনাকাল : ১৫/৯/২০২০
© কিশলয় এবং যুথিকা দেবনাথ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।