অতি আধুনিকার কবলে কাল্লুজী
আনুমানিক পঠন সময় : ২৯ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫০ টি দেশ ব্যাপী ৪৩৩৮২ জন পড়েছেন।
অতি আধুনিকার কবলে কাল্লুজী
------------
জি০সি০ভট্টাচার্য্য,বারাণসী,উত্তরপ্রদেশ
================
সে’দিনটার কথা আমার অনেক দিন মনে থাকবে…. আমাদের কাল্লুজীর জন্যে। 
বিকেলবেলায় চারটে বাজতেই আমি যথারীতি স্কুটারে করে গিয়ে স্কুল থেকে আমার তেরো বছরের ভাইপো চঞ্চলকে সঙ্গে করে বাড়ী নিয়ে এসেছি আর সেই পরীর দেশের রাজকুমার ছেলে চঞ্চলকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ভালো করে হাত পা মুখ ধুইয়ে নিয়ে এসে তার সারাদিনের গরমে ধূলোয় আর ঘামে নোংরা হয়ে যাওয়া সমস্ত স্কুল ড্রেসগুলো এমনকি মোজা আর স্কুল টাই ও সব এক এক করে খুলে নিয়ে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে দিয়ে রোজকার মতন আমি চঞ্চলের জন্যে ঘরে পরবার ড্রেস এনে বসে চেঞ্জ করতে শুরু করেছি… অমনি ঝপ করে কারেন্ট গেলো চলে…
যাঃ …হয়ে গেলো…এই গরমে এখন এ কী দুর্ভোগ বলো তো… 
এমার্জেন্সী লাইট না হয় জ্বালিয়ে দেওয়া গেলো তবে এই দারুন গরমে পাখার হাওয়ার কি ব্যবস্থা হয়? মে মাস পড়ে গেছে আর এখন ও চঞ্চলের স্কুলে ছুটিই হয়নি…
আমাদের এ’খানে এখন পরীক্ষার পরে ও ছুটির বদলে নতুন ক্লাশের পড়া শুরু হয়ে যাবার এক নতুন নিয়ম হয়েছে উল্টে যাতে ছেলেদের একগাদা সামার হোমওয়ার্ক দেওয়া যায় আর কি… আর সে ও বেনারসের এই কাঠ ফাটা গরমে… 
আপদ আর বলে কাকে আর তার ওপরে দিন নেই রাত নেই সবসময় এই এক মহা ঝামেলা তো দেখি আমার পেছনে ঠিক ফেউয়ের মতন সমানে সব সময় লেগেই আছে… বলা নেই কওয়া নেই…পাওয়ার কাট…উঃ..উঃ… মনে হয় হাজার পঁচিশ টাকা গাঁট গচ্ছা দিয়ে কালকেই একটা ইনভার্টার কিনতে হবে আমাকে…তা নইলেই নয় …কি আর করা?...
নাঃ এখন আর এই গরমে ছেলেকে কোন ভারী পোষাক দেখছি পরানোই যাবে না তাই বাধ্য হয়ে আমি চকচকে ঝকঝকে পরী ছেলেটার গায়ে জড়ানো নীল তোয়ালেটা খুলে নিয়ে চেয়ারে রাখলুম আর তাকে ভেলভেটের ব্রাউন ফুলপ্যান্টটা পরানোর বদলে চট করে শুধুমাত্র একটা নরম ঘাম শুষে নেওয়া বিদেশী তোয়ালের মতন ড্রাইসোয়েট কাপড়ের তৈরী ছোট সবুজ শর্ট পরিয়ে দিলুম…
তারপরে সফ্ট আয়রণ করা দামী চকচকে গোলাপী রঙের সিল্কের যে ফুলশার্টটা চঞ্চলকে আজ পরিয়ে রাখবো বলে এনেছিলাম সেটা ও সরিয়ে রেখে ছেলেকে গাঢ় নীল রঙের ওপরে হলদে আর সবুজ রঙের ডিজনীল্যান্ডের ছবিওয়ালা একটা স্পোর্টস টি শার্ট পরিয়ে দিলুম… 
কিন্তু কি আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখো…সেই সামান্য পোষাকে ও দেখি যে চঞ্চল ছেলেটা যেন একটা ঝকঝকে পরী হয়ে ঝলসে উঠলো…সত্যিই রূপ থাকলে সে ছেলে সব পোষাকেই হয়ে ওঠে অপরূপ…
অবশ্য আমি চঞ্চলকে পরীছেলে বললেই সে বলে-‘ জানো তো কাকু… মা লক্ষীর প্যাঁচার চোখে ও কিন্তু নিজের বাচ্ছাটিই দুনিয়ার সবচেয়ে অনবদ্য আর অপরূপ সুন্দর বাচ্ছা বলে মনে হয়েছিলো… হিঃ…হিঃ…হিঃ…মানে আমি হ’লুম গিয়ে একটা…..
সে যাক গিয়ে… বাচ্ছা ছেলের কথায় অতো কান দেওয়াটা মোটেই ঠিক নয় তবে তখন যে  আমার বেশ খানিকক্ষণ ধরে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিলো মনের সুখে আমার এই ছেলে পরীটাকে … 
তবে সে আর তখন করা যায় কি করে?
আমি তখন আদর করা শুরু করলেই চঞ্চল যে খিল খিল করে ওর স্পেশাল জলতরঙ্গ সুরে খালি হাসবে আর আমার এই অসময়ের কাজের জন্যে সে যে অন্য সব ছেলেদের মতন আমার ওপরে একটু ও রাগ করবে না বা আমাকে একবার ও বারণ করবে না তা ঠিক তবে আমি তো আর ছেলেকে সত্যিই একটা ফেয়ারী ডল মানে পরী পুতুল মনে করে যা খুশী তাই করতে পারিনা…
কেননা চঞ্চল একটা ছেলে পরী হ’লে ও সে জ্যান্তো মানুষ পরী আর তাই তার ক্ষিদে তেষ্টা ও তো আছে…
 তাই আমি তাড়াতাড়ি করে তখনই চঞ্চলকে হাত ধরে বিকেলের জলখাবারের জন্য ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলুম…
তারপরে আমি কিচেন থেকে খানিক আগেই তৈরী করে রাখা নানা ধরণের  সব খাবার একে একে এনে টেবিলে সাজিয়ে ও দিলুম তবে চঞ্চল ছেলেটা যে খায় খুবই কম… 
সে সবকিছুই সাদা পোর্সিলেনের ফুডবাউল কভার তুলে তুলে দেখে নিয়ে মাত্র এক গেলাশ কমপ্ল্যান নিলো পানীয় হিসেবে আর নিজের প্লেটে তুলে নিলো চারটে পনীর পকৌড়া… সবুজ ও লাল সসের সাথে ও সঙ্গে কাজু পেস্তা কিশমিস আর বাদাম দেওয়া সুজির হালুয়া আধ প্লেট…ব্যস …
আমি তখন জোর করে ছেলেটাকে আর একটা প্লেটে চার চামচ ছোলার ঘুগনী একটা রাজ ভোগ আর ফ্রুট জ্যাম লাগিয়ে চারটে বিস্কুট ও তুলে দিলুম আর তাই দেখে চঞ্চল বললো-‘আরে ওঃ…ও কি কাকু? তুমি কি আমাকে শেষে ভীম ভবানী ভট্টাচার্য্য বানাতে চাও না কি?…যাঃ…’
আর তখনি বাজলো ঝিঁ ঝিঁ করে কলিং বেল …
ওরে বাবা … এখন আবার কে এলো? 
হঠাৎ বাইরে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে ডাকলো-‘পন্ডিতজী…. আরে ও পডিতজী… বলি বাড়িতে আছো না কি? থাকলে এখনই একটা হলদে সবুজ রঙের মোটা কোলা ব্যাঙের মতন তড়াক করে এক পেল্লায় লাফ মেরে ঘর থেকে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এসে ধপাস করে আমার সামনে পড়ো দেখি…জরুরী কাজ আছে…’
শুনেই চঞ্চল একটু কেশে উঠলো বিষম খেয়ে… 
আমি তাড়াতাড়ি করে চঞ্চলের মাথায় হাত দিয়ে হাল্কা করে চাপড়ে দিয়ে বললুম-‘ষাট… ষাট…এই নাও আগে একটু জল খাও…’
চঞ্চল কয়েক ঢোঁক মিনারেল ওয়াটার খেলো…আমি চঞ্চলকে ওয়াটার পিউরিফায়ারের জল অবধি যে খাওয়াতে চাই না তাই…
আমি বললুম-‘ওরে বাবা…এ তো ঠিক কাল্লুজী বলে মনে হয়… চঞ্চল… তুমি খেয়ে নাও…আমার জলখাবার এখন শিকেয় থুড়ি…আধুনিক শিকে মানে ফ্রিজে তোলা থাক….মনে হয় এখন ভাগ্যে নেই… আমি গিয়ে দেখি যে কি ব্যাপার… তবে তুমি এখন গরমের জন্যে এই হালকা সামান্য ছোট ঘরোয়া পোষাক পরে আছো বলে কাল্লুজী যতোই আমার বন্ধুলোক হোক…তাকে এখনই ঘরের ভেতরে ডাকা যাবে না চঞ্চল…’ 
‘আমি আগে জানলে… সে যতো গরমই হোক… আমি তোমাকে যে অন্তর্বাস ও শার্ট প্যান্টটা পরাবো বলে এনেছিলাম সেইগুলোই পরিয়ে দিতুম আর নয়তো দামী মোটা অন্য ফুল ড্রেস মেটিরিয়াল মানে এই যেমন চকচকে ক্রিজলেস কাপড়ের লম্বা একটা শেরওয়ানী আর সাদা মখমলের চোস্ত পাজামা গোল টুপি ও কাবুলী স্যু পরিয়ে একেবারে কমপ্লিট পাঠান ছেলে বানিয়ে রাখতুম…উঃ… কি গেরো রে বাবা…’
‘ওঃ কাকু… তা অতো ভাবছো কেন? আমি পাশের ঘরে চলে যাচ্ছি না হয়…’
‘নাঃ… সেও হবে না চঞ্চল…কাল্লুজী এসেই ডাকবে তোমাকে আর দেখা মাত্রই একেবারে তোমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে ও ছাড়বে না পুরো পাঁচ মিনিট ধরে…’ 
‘একে বলে অবদমিত মনোভাবের বহিঃস্ফুরণ…’
‘তার মানে কাকু?’
চঞ্চলের ঠিক যেন তুলি দিয়ে আঁকা সরু কালো ভ্রুজোড়া ধনুকের মতন বেঁকে গেলো…
‘ও চঞ্চল……. এখন ব্যাখ্যা করবার মতো বেশী সময় তো নেই… শুধু সংকেত দিচ্ছি… তা তুমি কাল্লুপুত্র লাল্লুকে তো নিজেই দেখেছো …মা অতো সুন্দর মেয়ে কিন্তু…’
‘বুঝেছি… বুঝেছি সব আমি কাকু আর কিছু বলতে হবে না এখন আমাকে কাকু…তুমি নীচে যাও’
‘তাই আমি যাই … তুমি ভাই একটু ছানার তৈরী সীতা ভোগ অন্তত নিয়ে খেয়ে দেখো… আজই বর্দ্ধমান থেকে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে রেখেছি তোমার জন্যে…’
‘আচ্ছা কাকু… তবে তুমি না খেয়ে থাকবে… ইসসস…আমার যে খেতেই ইচ্ছে করছে না…’ 
‘সে কি আর করা যাবে ভাই? একেই বলে কপাল…আমি যাই…’
আমি গিয়ে দরজা খুলে বললুম-‘কি ব্যাপার কাল্লুজী? হঠাৎ তোমার উদয় হ’লো যে?...’
‘তা হবেই তো… সময়ে কি না হয়? সব কিছুই হয় রে ভাই …সময় বড়া বলবান… জানিস তো? তা চল এখন আমার সঙ্গে দেখি গুট গুট করে হেঁটে..’
‘আরেঃ… এই গরমে যাবোটা কোথায় সেটা বলবে তো আগে?’
‘কেন? না বললে কি তুই আর আমার সঙ্গে যাবি না বলে প্রতিজ্ঞা করে বসে আছিস না কি ভীষ্ম পিতামহের মতন? তা যদি হয় তো সাফ বলে ফেল দেখি আর থাক তুই এ’খানেই ল্যাম্পপোস্টের মতন কাঠ হ’য়ে দাঁড়িয়ে…আমি চললুম…’
‘আরে না না..তা নয় কাল্লুজী…যাচ্ছি রে বাবা যাচ্ছি তবে তুমি তিন মিনিট দাঁড়াও…আমি চেঞ্জ করে আসছি ড্রেসটা…’
আমি ড্রেস বদল করে তৈরী হয়ে নিয়ে ছেলেকে বললুম-‘চঞ্চল, আমি কাল্লুজির সাথে একটু বাইরে যাচ্ছি এখন…আজ আর তোমার সাথে ব্যাডমিন্টন খেলা ও আমার ভাগ্যে নেই তবে আমি দরজা লক করে যাচ্ছি আর একটা চাবি তোমার কাছে আছেই…কিন্তু খুব সাবধান… একলা কোথা ও বাইরে বা ছাদে ও যেও না যেন… আমি আসি…’
‘আচ্ছা কাকু…’
‘এইবার চলো কাল্লুজী…কোথায় যাবে…’
‘বলি যাবোটা আবার কোন চুলোয় শুনি? আমার কি আর কোথা ও যাবার জায়গা আছে না কি যে চলে যাবো? সে কপাল আমার নেই রে পন্ডিতজী….’
‘সে আবার কি? তুমি যে বললে…’
‘আমি বললুম আমার মাথা আর তোর ওই কুমড়োর মতন গোল মুন্ডু… হুঁ… সবই আমার কপালের ফের রে পডিতজী… নইলে কখনো তোর ভাবির বোনের মেয়ের বিয়ে লাগে আর আমাকে ছুটতে হয় নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে সেই চক বাজারে… এই মে মাসের গরমে আর তা ও কি না এই হাতটানাটানির সময়ে? বল তুই?..ছ্যাঃ…..ছ্যাঃ….’
‘তবে আমার সে’কষ্টের আর তুই কি ভাবে কি বুঝবি বল? বিয়ে শাদিতো তো আর কিছু তুই করলিনে রে পন্ডিতজী… এদিকে দেখতে দেখতে ২৬-২৭ বছর বয়স তো হয়ে গেলো গড়গড় করে… তোর সে’সব কিছু খেয়ালেই নেই… একটা যা ভাইপো নিয়ে মেতে আছিস আর পাগলের মতন যথাসর্বস্ব দু’হাতে ওড়াচ্ছিস সেই এক কচি ছেলের পেছনে … তবে ভাই যতোই যা কর না কেন রে পন্ডিতজী…. তুই ঠিক জানবি যে ভাইপো কখনোই ছেলে হ’তে পারে না রে ভাই…’
আমি নিজের মনেই বললুম-‘বিয়ের না নিকুচি করেছে… এই জন্যেই তো আমি এতো ভয় পাই চঞ্চলকে নিয়ে… সবাই যে দেখি যে অকারণে বেশ গায়ের জ্বালা আর ঈর্ষায় অস্থির….মনে হয় তার কারণ হচ্ছে দু’টো…এক.. ওই ছেলেটার পরীর মতন চোখ ধাঁধানো অসামান্য অপরূপ রূপ আর নম্র সুন্দর ব্যবহার আর দুই নম্বর… আমার সেই ছেলের জন্যে কেনা ও তাকে পরানো সব দামী দামী পোষাক পরিচ্ছদ ও তার ব্যবহারের জিনিষ…. 
মুখে সবাই চঞ্চলের প্রশংসা করলে কি হয় মনে মনে যে গায়ের জ্বালায় অস্থির সব সে আমি ভালো করেই জানি তবে চঞ্চলের জন্যে আমি যে সব দামী বিদেশী প্রসাধনের জিনিষ কিনি… তার সাজসজ্জা করি আর তাকে যে সব মহার্ঘ্য অলঙ্করণে একেবারে কৃষ্ণঠাকুর সাজিয়ে রাখি ছুটির দিনে সেই সব সাজের বাহার তো আর কেউ দেখতে ও পায় না এক তার মা ও বাপী ছাড়া নইলে সে’সব দেখলে হয়তো কাল্লুজির মতন অনেকেই ঠিক হার্টফেল ও করতো আর বাড়িতে ঠিক ডাকাত পড়তো……
আমরা গোধূলিয়া চৌমাথায় ততক্ষণে পৌঁছে উত্তরের সড়ক পথ ধরে চলেছি… অতি দ্রুতপদে আর কাল্লুজী তো তড় বড় করে এতো জোরে হাঁটছে যে তাল রাখতে আমার তো ঘাম ছুটছে তখনই… বলতে যাচ্ছি-‘আরে ও কাল্লুজী… এতো ভিড়ে একটু ধীরে গেলে হয় না? মানে … দোকান বন্ধ হ’তে এখন ও তো অনেক সময় আছে তো … তাই বলছি আর কি? আর গরম ও তো কম নয় কিছু…’
অবশ্য ভাষার এই স্টাইলটা ও আমার মোটেই নয়… চঞ্চলের নানা ধরণের ফিজিক্যাল ও ফেসিয়াল স্টাইলের মতন এটা তার একটা ল্যাংগোয়েজ স্টাইল… আমিই শিখিয়েছি অবশ্য চঞ্চলকে আর এর নাম দিয়েছি  আনডিউ সাবমিসিভ মাল্টিপল টেকনিক.......আমিই যে এইগুলোর স্রষ্টা সেটা তো বলাই বাহুল্য…তবে চঞ্চলের সুন্দরী মা বলে এ’গুলো নাকি তার ছেলের সবসময় হাস্যের মতন লাস্যের বাহার…
উঃ স্টাইল হ’লো গিয়ে লাস্য…বৌদি পারে ও বটে বাবা… হয়তো তো আবার কোনদিন বলে বসবে… নজাকত… 
সেই যে বলে না…খুদা যব হুস্ন দেতা হ্যায়… তো নজাকত আ হি যাতি হ্যায়… 
তবে আমার আর কিছু বলা হয়ে উঠলো না কেননা স্বয়ং ভগবান হস্তক্ষেপ করলেন… হয়তো বা আমার মত এক অসহায় ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত জীবের দুর্দশা দেখে দয়াবশতঃ…
হঠাৎ ঘটে গেলো এক বিভ্রাট… 
কাল্লুজির সাথে এক অগ্রবর্তিনী মহিলার বিষম জোর সংঘর্ষ হয়ে গেলো … 
তা তিনি দেখি যে এক জবর্দস্ত অতি উগ্র আধুনিকা ভদ্র মহিলা তবে এই যুগে ও তাঁর পরণে রয়েছে দামী শাড়ী … জিন্স টি শার্ট নয়… হয়তো বয়স একটু বেশী হয়ে গেছে বলেই এই ব্যবস্থা কিন্তু প্রসাধনে উগ্র আধুনিকার ছাপ আছে বলে মনে হ’লো আমার…
তবে তিনি একটু ও হেললেন দুললেন না বরং রোগা পাতলা কাল্লুজিই উল্টে পড়তে পড়তে তৎক্ষণাৎ হয়তো গুরুবলেই সামলে নিলো তবে পরক্ষণেই আর এক বিষম হুঙ্কার শুনে আবার ঠিকরে পড়তে পড়তে বাঁ হাতে আমাকে ধরে ফেলে টালটা খুব জোর সামলে নিয়ে কোনমতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো কিন্তু নিজের হাত দু’টো জোড় করে রইলো…ঠিক গরুড়ের মতন করে… 
আমার তো দেখেই হাসি পেয়ে গেলে ও চঞ্চলের মতন ঠোঁট টিপে সেটা আমি কোনক্রমে সামলে নিয়ে মনে মনে বললুম-‘হুঁ …গরুড়ই বটে আর আমি দেখছি সত্যিই একটা ল্যাম্পপোস্ট ও বটে …তাই আছাড়টা আর তোমাকে এখন খেতে হ’লো না কাল্লুজী তা ঠিক… তবে এখন ঠ্যালা সামলাও দেখি নিজে… বড় যে আমাকে খোঁটা দিচ্ছিলে বিয়ে করিনি বলে… হ্যাঁ না তো …
‘এই যে মিস্টার… তুমি কি চোখের মাথা খেয়ে বসে আছো? বলি দু’টো গোল গোল আলুর মতন চোখ জোড়া তো দেখি রয়েছে তোমার …তা দেখতে টেখতে কিছুই পাওনা না ইচ্ছে করেই দেখো না.. তাই বলো তো শুনি…’
‘না না মিসেস… মানে মিস… মানে ম্যাডাম… সে’সব কিছুই নয়… আমি ভদ্রলোকের ছেলে… ইচ্ছে করে আমি আপনার সাথে ধাক্কা লাগাইনি..…দৈবযোগে লেগে গেছে ম্যডাম…তবে…..
‘হুম… বুঝেছি…তবে  ভদ্রলোকের ছেলেরা যে আজকাল ভদ্রমহিলাদের এই ভাবে সম্মান জানায় তা তো জানা ছিলো না আমার…’
‘না  ..মানে… ওই লোকটা… ওই লোকটাই….’
‘কোন লোকটা?’
‘ওই যে একজন সিড়িঙ্গে মতন খুব সন্দেহ জনক কালো হতকুচ্ছিত দেখতে লোক যে ঠিক আমার আগে আগে বেশ খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো… … ম্যাডাম… ওকে দেখলেই মনে হয় যে হয় চোর আর নয়তো কোন জোচ্চোর হবে… ওকেই আমি একটু নজরে নজরে রাখছিলাম যে যদি কিছু অকাজ করে বসে আর তাই ঠিক আপনাকে আমি দেখতেই পাই নি …আমাকে আপনি ক্ষমা করবেন প্লীজ ম্যাডাম…ভেরী সরি…’
‘তা তোমার সেই খোঁড়া রাজপুত্রটি গেলো কোথায়? হাওয়াতে মিলিয়ে গেলো না কি? বলি তুমি ভেবেছোটা কি তাই শুনি একবার? তুমি বানিয়ে বানিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলে যাবে নিজের দোষ ঢাকতে আর আমি তোমার সেই সব গাল গল্প বিশ্বাস করে নেব? অ্যাঁ… বলি আমাকে দেখে কি তোমার একটা মুটকি গাধী বলে মনে হয় না কি? জানো আমি কে? ….আমি সর্বভারতীয় মহিলা মুক্তি আন্দোলন মোর্চার অধ্যক্ষা…. বুঝলে চাঁদ…’
‘বু…বুঝেছি…ম্যা…ম্যা…ম্যাডাম…’
‘থাক…আর ছাগলের মতন অতো করে ডাকতে হবে না…বোকা পাঁঠা কোথাকার… আজ তোমার কপাল খারাপ… তাই আমার পাল্লাতে পড়ে গেছো চাঁদ… ও’সব গুল গল্পো ঝেড়ে আমাকে ভাঁওতা দেওয়া যায় না… চলো দেখি বাছা এখন সুড়সুড় করে আমার সঙ্গে চকবাজার থানায়… থাকো হাজতে কিছুদিন তুমি… সব ভাঁওতা বাজী পিঠে দু’চার ঘা পুলিশের ডান্ডার বাড়ী পড়লেই তোমার সব স্মার্টনেসের সাথেই ঠিক বেরিয়ে যাবে আর পালাবার চেষ্টা করলেই ফোন করে আমি এখনি পুলিস ডাকবো গোধুলিয়া চৌমাথা থেকে…’
কাল্লুজী গোঁসা করে মুখটাকে বেশ বেগুন পোড়ার মতন ভার করে বললো-‘আমি কিন্তু সব সত্যি কথাই বলছি ম্যাডাম… আমার কোনই দোষ নেই… তা এই ঘোর কলিযুগে দেখছি যে সত্যিকথার কোন দামই আর নেই… তাই কেউ তো দেখি বিশ্বাস ও করতে চায় না …তবে আমি ও ছাড়বো না ওকে তা ঠিক  … প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি চোরটাকে ধরে আপনার সব টাকা উদ্ধার করে তবেই ছাড়বো…’
‘টাকা…? কার টাকা আপনি আবার উদ্ধার করবেন? আবার কি সব বকছেন আপনি পাগলের মতন?’
‘আরেঃ… সেইটাই তো আমি বলতে যাচ্ছিলাম তা আপনি আর শোনেন কই?’
‘বলেন…শুনছি…’
‘আর এখন শুনে কি হবে? এতোক্ষণে সে পগার পার হয়ে গেছে পার্সটা পকেটে পুরে…’
‘পার্স…কার পার্স?’
‘মনে হয় আপনারই হবে হয়তো… আমি কি ছাই চিনি নাকি আপনার পার্স? বলে আপনাকেই চিনি না…
‘কোথায় পার্স?’
‘মনে হয় পার্স নিয়ে ওই কান্হাইয়া চিত্র মন্দির সিনেমা হলের ভেতর দিয়ে চোরটা সরে পড়েছে… একটুর জন্যে ফসকে গেলো চোরটা… কি আর করা? সবে সে আপনার হ্যান্ডব্যাগটার সোনালী চকচকে স্প্রিংলকের গোল মাথা দু’টো টিপে ধরে কুট করে খুলে ভেতর থেকে ছোট একটা কালোরঙের পেটমোটা পার্স দু’আঙুল দিয়ে টেনে বের করেছে…. আর আমি ও গেলাম বোকার মতন তার হাত থেকে খপ করে পার্সটা কেড়ে নিতে আর সে আমাকে এক জোর ধাক্কা মেরে সিনেমা হলের গেটের দিকে ছুটলো আর আমি গিয়ে পড়লাম আপনার ঘাড়ে…’
‘আরেঃ… সে কথাটা আগে বলবেন তো.. ?’
‘আরেঃ… আপনি বলতে দিলে তবে তো বলবো আমি… উঃ… কি জোর ধাক্কাটাই না আমাকে মেরেছে ব্যাটা… এখন ও ডান হাতটা আমার টন টন করছে… ওই সিড়িঙ্গে শরীরে যে এতো শক্তি থাকতে পারে তা আমি জানবো কেমন করে? মাঝখান থেকে আপনার পার্সটাই গেলো…’
ভদ্রমহিলা ততক্ষণে নিজের হাতে ঝোলানো বেশ বড়ো সড়ো ব্রাউন রঙের হ্যান্ডব্যাগটা তুলে তার মুখ খোলা দেখে আঁৎকে উঠে তার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে পার্স হাতড়াতে লেগে গেছেন…
পরক্ষণেই এক আর্ত চিৎকার…
‘আরেঃ…কি সর্বনাশ… আমার পার্স কোথায় গেলো? আমার ওই পার্সে যে দশ হাজার টাকা ছিলো একটা শাড়ি কেনবার জন্যে… হায়.. হায়… গেলো… গেলো… সব গেলো …আমার আজ সর্বনাশ হয়ে গেলো রে…এখন আমি কাল বিয়ে বাড়িতে কি ন্যাংটো হয়ে যাবো? ও হো হোঃ…’
‘আমার মাত্র একশো পঁচাত্তরখানা শাড়ির মধ্যে একটা ও তো নতুন শাড়ী নেই আর বিদিশা হারামজাদী দেখলেই তো মুখ বেঁকিয়ে বলবে …বাঃ বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে তোকে সুলেখা এই শাড়িটাতে… তবে… এটা তুই মাস ছয়েক আগে মিঃ ভাদুরিয়ার টি পার্টিতে মনে হয় পরে এসেছিলিস …তাই না? ঠিক… ঠিক… তা নতুন কোন শাড়ী তোর আর না থাকলে তুই আমার কাছ থেকে চেয়ে নিলেই তো পারতিস একটা… আমার গতমাসের কেনা দশখানা শাড়ির তো এখন ও প্যাকেট ও খোলাই হয়নি…পড়ে নষ্ট হচ্ছ সব যে…’
পরক্ষণেই তিনি রূঢ়স্বরে বললেন-‘তা আগে তো আপনাকেই একবার সার্চ না করে বিশ্বাস করাই যায় না আপনার কথা…’
‘তা বেশ তো …আরে ও পন্ডিতজী… তুই আমাকে সার্চ করে বল যে আমার পকেটে ওনার কোন পার্স আছে কি না…’
‘আমি খুব ভালো করে দেখে বললুম-‘না নেই তো ম্যাডাম…’
‘সর্বনাশ….আরে চোর… চোর… পাকড়ো… পাকড়ো…’
এই বলে তয়ানক এক চিৎকার করতে করতে তিনি তখন ছুটলেন সেই সিনেমা হাউসের দিকে …হয়তো ফোন করে পুলিশ ডাকতেই বা ছুটলেন আর এতোক্ষণ ধরে আমাদের ঘিরে ধরে বিনা পয়সায় যারা সিনেমা দেখছিলো তারা ও সব ছুটলো সেইদিকে….
এক সেকেন্ডে সব ফাঁকা আর তখনি কাল্লুজী একটা রিক্সাওয়ালাকে থামিয়ে নিজে তড়াক করে এক লাফ মেরে সীটে উঠে বসে বললো—‘আরে এই গঙ্গারাম পন্ডিতজী… এখনো তুই হুতোম প্যাঁচার মতন বিটকেল মুখ করে ওইখানে দাঁড়িয়ে কি আলুর চপ বিক্রী করছিস না কি? আরে জান বাঁচাতে হলে এসে উঠে পড় শীগ্গির করে …নইলে নারী মুক্তি বাহিনী এসে তোকে ঠিক তুলে নিয়ে চলে গেলে আমাকে কোন দোষ দিতে তখন পারবি না কিন্ত…. যত্তো সব উড়ো আপদ….’
আমি রিক্সাতে উঠে বসলুম ঠিকই তবে তখন আমার মাথা ঘুরছে বোঁ বোঁ করে চরকির মতন… বাহাদূর বটে কাল্লুজী… ঠিক সামলে নিয়েছে এতো বড়ো বিপদের ফাঁড়াটা ও তবে কি করে যে চোর এলো আর সে কখনই বা চুরী করলো আর সে পালালোই বা কোনদিকে সেটাই বুঝতে পারলুম না আমি তবে এটা যে নিশ্চয়ই কোনো ভূত প্রেতের কাজ নয় তা ঠিক কেননা তাদের আর টাকা পয়সার কি দরকার আর দিনের বেলায় ভূতের বড়ো বয়েই গেছে আসতে … 
তা হ’লে চোরই এসেছিল হবে হয়তো আর সেই চুরির ও অকাট্য প্রমাণ দিয়ে তবেই কাল্লুজী বিপদমুক্ত মানে হাজতবাস আর পুলিশের ডান্ডার ঘা থেকে মুক্ত হতে পেরেছে তা ঠিক… তবে চোরটা সঙ্গে সঙ্গে পালালো যে কি করে সেটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলুম না …কেননা কালুজী বর্ণিত তেমন কোন সিড়িঙ্গে খোঁড়া চোরকে আমি একবার ও দেখতেই পাইনি তবে চুরী যখন হয়েছে সত্যিই… তখন চোর ও ছিলোই সে’খানে … একে নাকি বলে কনসিকোয়েন্সিয়াল ও সারকমস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স…এটা আদালত গ্রাহ্য…
কাল্লুজী চক বাজার থেকে একটা এইচএম টির দামী হাত ঘড়ি একটা বড়ো সোনার চেন মানে সিকড়ী একটা লাল পাথর বসানো সোনার আংটি… আরো কি কি সব কিনে ফেললো টপাটপ করে …আমি সে’দিকে তখন আর মোটেই নজর দিতে পারলুম না কেননা ক্ষিদেতে আমার পেট তখন চুঁই চুঁই করছে আর চঞ্চল বাড়িতে এতোক্ষণ একলা আছে বলে তখন আমি বন্ধুকৃত্য সেরে কোনমতে বাড়ী ফিরতে পারলে বাঁচি……..
রিক্সা করে বাড়ী ফিরে এসে দেখি যে ছেলেটা বসে একলাই লুডো খেলছে …
আমি একেবারে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলুম কিন্তু চঞ্চল আমার পায়ের শব্দ না শুনে ও আর সে দরজার দিকে পেছন ফিরে বসেছিলো বলে আমাকে না দেখলে ও তৎক্ষণাৎ খেলা ছেড়ে উঠে পড়লো হঠাৎ আর আমার কাছে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বললো-‘কাকু, তুমি এসে গিয়েছো? যাক বাবা… তবে মনে হয় গরমে ক্ষিধে আর পথশ্রমে তুমি খুব বেশী ক্লান্ত হয়ে পড়েছো কাকু… তুমি বসো… আমি এখনি ম্যাংগো জুস নিয়ে আসছি…’
‘এই ছেলে…তার আগে তুমি বলো তো যে তুমি জানলে কি করে যে আমি এসেছি? তুমি তো দেখোনি…’
‘ওঃ কাকু… তোমাকে আমি না দেখে এমন কি কেউ আমার চোখ কান সব বেঁধে রাখলে ও ঠিক বলে দিতে পারি যে তুমিই এসেছো ঘরে না অন্য কেউ…’
‘সে আবার কি করে হয় চঞ্চল?’
‘কেন হবে না? আমি যে তোমার নিজের ছেলে…মা রাগ হলেই তো বলে শোননি…এই নাও তোমার গুণধর ছেলে সামলাও…. আর ছেলে হয়ে যদি কেউ তার বাবাকেই না চিনতে পারে……তবে কেমন হ’তো তুমি বলো তো…হিঃ…হিঃ…হিঃ…’
এই বলেই চঞ্চল কিচেনের দিকে ছুট দিলো আর ছেলেটার বুকে ঝোলানো সোনার চকচকে লকেটে পান্না বসানো দামী আসল মুক্তোর হারটা ঝকমক করে দুলে উঠলো…
এই রে …বড়োই ভূল হয়ে গেছে আজ দেখছি কেননা আমি রোজ চঞ্চলকে আগে একটা সুপার ফাইন গেঞ্জী পরিয়ে দিয়ে তবে এই হারটা পরাই যাতে তার ওপরে চঞ্চলকে টি শার্ট বা ফুলশার্ট যাই পরিয়ে দিই তখন আর এই দামী হারটা দেখাই যায় না …
তবে আজ আর সেই সব অন্তর্বাস তো চঞ্চলকে পরানোই হয় নি…তার আমি কি করবো? 
কিন্তু ভয় করে এইজন্যে যে শুধু এই দুষ্প্রাপ্য পান্নাটারই দাম দশ লাখ টাকা… আর এক একটা মুক্তোর দাম তিন লাখ করে…নাঃ…ছেলেটাকে আগে গেঞ্জী না পরিয়ে এই সব মহার্ঘ অলঙ্কার দেখছি আর পরানো যাবে না মোটেই…
চঞ্চল যা পাগল ছেলে… এইভাবে সে বারান্দায় বা ছাদে খেলতে চলে গেলেই বিপদ হবে তখন… আজ শুধু  টি শার্টের ওপরেই চঞ্চলকে হারটা পরিয়েছি মনে পড়লো … 
আঃ… ভাগ্যিস তখন কাল্লুজী ঘরে আসে নি তাই বাঁচোয়া… নইলেই হয়েছিলো আর কি…
সে যাক …আমি ততক্ষণে হাত পা মুখ চোখ ধুয়ে চেঞ্জ করে আসি এই মনে করে বাথরুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে গরমে একেবারে অস্থির হয়ে শাওয়ারের নীচেই বসে পড়লুম আমি…চঞ্চলের মতন… 
ওঃ… আজ যা কান্ড হ’লো না সারা বিকেল বেলাটাতে …
মনে হয় আমাতে আর আমি নেই …. 
আমি শাওয়ার খুলে স্নান সেরে গায়ে নাইসিল পাউডার লাগিয়ে পাজামা ও পাঞ্জাবী পরে যখন ঘরে এসে বসলুম তখন চঞ্চল দু’হাতে ট্রেতে করে দু’গ্লাস পাকা আমের দুধ আর বরফ মেশানো ঘরোয়া মিল্কশেক নিয়ে এসে হাজির হ’লো আর তার সাথে পনীর পকৌড়া এক প্লেট… 
আমি খেতে খেতে চঞ্চলকে সব ঘটনা বলতেই চঞ্চল বললো-‘কাকু এটা বেশ মজার কান্ড তো …একজন চোর চুরী করে পালালো আর অন্য কেউ এমনকি তুমি ও তাকে দেখতেই পেলে না এক কাল্লুচাচা ছাড়া… আর চুরী ও মিথ্যে নয় আর সাথে কাল্লুচাচার কাছে ও তেমন কোন পার্সের অস্তিত্ব ও টের পাওয়া যায় নি…তুমি নিজেই চেক করে সবাইকে দেখিয়েছো বললে তো… খুব অদ্ভূত ব্যাপার … নাঃ এ আমার বুদ্ধির বাইরে …কালই আমি বাদলকে জিজ্ঞাসা করবো যে এটা কি ম্যাজিক না কি অন্য কিছু?’
‘তাই করো না হয় চঞ্চল…’
‘আরেঃ…তাই বা কেন? আমি এখনই বাদলকে ফোন করছি …কাকু?’…
ছটফটে ছেলে চঞ্চল তখনই ছুটলো ফোন করতে আর ফিরলো মুখ গোমড়া করে দশ মিনিট পরে…
‘কি হলো চঞ্চল? বাদলের সঙ্গে সব কথা হ’লো?’
‘হুঁ….’
‘সব ভালো করে শুনে বাদল কি কিছু বললো?’
’হুঁ……..’
‘তা কি বললো বাদল?’
‘সব কিছু শোনবার পরে কিছু যেন বলতে গিয়ে ও হঠাৎ যেন মুখে ব্রেক কষে আটকে গেলো বাদল…
‘সে আবার কি? তুমি জানতে চাইলে না?’
‘সেইকথা জানতে চাইলে বাদল বললো –‘আমার কিছু বলা অন্যায় হয়ে যাবে চঞ্চল…… মনে কর এটা একটা ম্যাজিকই… চাচাজির ম্যাজিক…’. 
‘কি সব যা তা বলছিস তুই? এটা ম্যাজিক?’
 ‘হ্যাঁ… আমি নাম দিলুম চাচাম্যাজিক …আচ্ছা রাখছি চঞ্চল…’
‘ও রে বাবা ….আবার আমার মাথা ঘুরছে …চঞ্চল যেতে দাও ….বাদল কাল্লুজির চেয়ে ও একটা বড়ো পাগল ছেলে ছাড়া আর কিছু নয়… বাদ দাও তুমি… তবে আজ আর আমি এখন রান্না করতে মনে হয় পারবো না চঞ্চল… খুব ক্লান্ত লাগছে…’
‘ওঃ…তাইতে আর কি হয়েছে কাকু? তুমি শুধু কি খাবে তাই বলে দাও… আমি জোম্যাটোতে অর্ডার করে দিচ্ছি সব খাবারের…….’  
তারপরে ক্রমে মাসখানেকের ও বেশী সময় কেটে গেছে কিন্তু আমি যে তিমিরে সেই তিমিরেই রয়ে গেছি… জুন পেরিয়ে জুলাই আসতে চলেছে আর চঞ্চলের স্কুল ও গরমের একমাস সাত দিন টানা ছুটির পরে খুলবো খুলবো করছে আর আমি ঘরে শুধু ইনভার্টারই নয় ঝকঝকে রঙিন ছবি … এল ই ডি রঙিন বাল্বের ঝালর আর রোটেটিং নাইট বাল্বের আলোর ডিজাইনার প্রোজেকশান দিয়ে সাজানো চঞ্চলের বেডরুমে একটা এসী ও এনে লাগিয়ে দিয়েছি যাতে ছেলেটার গায়ে বেনারসের এই দারুণ গরমে ঘামাচি বা ফোঁড়া এইসব না হয়…
তবে এই সব কথা লোকে শুনলে মানে শুধু কাল্লুজী ও জানলেই চিত্তির…
তার পরে একদিন দেখি যে হঠাৎ মেঘ করে বেশ ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছে বিকেলে ….
তখনই দেখ তেমনই হঠাৎ কে কাল্লুজী এসে হাজির…
আর এসেই হাঁক-‘আরে ও পন্ডিতজী …আজ কি তুই বাড়িতেই ঢুকে চামচিকের মতন এখনো কড়িকাঠে ঝুলে আছিস না নেই …যদি থাকিস তো ফড় ফড় করে বেরিয়ে আয় দেখি চট পট করে….’ কলিংবেলের ধার কাল্লুজী ধারে না…
‘তা আছি কাল্লুজী… আসছি দাঁড়াও একটু …’ 
তখন চঞ্চল বাদলের সাথে ঘরে বসেই টেবিল টেনিস খেলছিলো বৃষ্টির জন্যে …
আমি গিয়ে নীল স্পোর্টস স্যুট আর ময়ুরের পালক বসানো একটা সোনার হেডব্যান্ড মাত্র পরে খেলায় ব্যস্ত চঞ্চলকে বললুম-‘ও চঞ্চল…আরে এই বাদল…একটু খেলা থামিয়ে তোমরা শোনই না… মনে হয় কাল্লুজী আগত দ্বারে আজ আবার …তাই আজ আমার কপালে বেশ কিছু দুর্ভোগ আবার ধিন তা ধিনা তা ধিনা ধেই…করে নাচছে …তা সে আর কি করা? তবে আমি যতোক্ষণ না ফিরি তুমি থাকো এখন বাড়িতেই বাদল….’
’একটু রহস্যময় ভাবে মুচকি হেসে বাদল বললো –‘ঠিক আছে কাকু… তোমার এই কৃষ্ণঠাকুর ছেলেটাকে একলা রেখে দিয়ে আমি বাড়ী চলে যেতেই পারি না কাকু… তুমি বেড়িয়ে এসো তবে হয়তো হাঁটতে হবে…মানে আকাশের যা অবস্থা আর কি… তাই বলছিলাম ছাতাটা নিয়ে যেও…’
আমি দরজা খুলতেই কাল্লুজী বলে উঠলো-‘হুঁ… এই বিকেল বেলায় যখন এটা তোর ভূত হ’তে পারে না তখন তো তুই হবি নির্ঘাৎ …আরে পন্ডিতজী… চল চল শীগ্গির … অনেকটা পথ রুটমার্চ মানে …কদম কদম বঢ়ায়ে যা… খুশীকে গীত গায়ে যা… করতে হ’বে তো.. তাই বলছি আর কি…’ 
‘তার মানে কাল্লুজী? আরে যাবোটা কোথায় তা আগে বলবে তো… ‘ 
‘কেন রে পন্ডিতজী… আমার সঙ্গে যেতে তোর এতো ভয়টা কিসের শুনি? আরে আমি কি তোকে জেলখানাতে নিয়ে যাবো না কি?’
‘তবু ও…’
‘আরে প্রসিদ্ধ সেতার শিল্পী পন্ডিত শংকরজির বাড়িতে যেতে হবে রে …সেই কবীরচৌরাতে … ওই রুটে আবার ছাতা এই গোধূলিয়া থেকে সোজা কোন অটো ও যায়না শেয়ারে …আর নয়তো সেই গির্জাঘর অবধি হেঁটে গিয়ে অটো ধরে যাও লহুরাবীর আর আবার সে’খান থেকে মৈদাগিনের অটো ধরে অনেকটা ঘুরে তবেই যাওয়া যায় আর অটো রিজার্ভ করতে হ’লে তো কোন কথাই নেই রে ভাই… সব লাভের গুড় পিঁপড়েতেই খেয়ে যাবে… তার চেয়ে চল আমরা শর্টকাটে চট করে বেনিয়াবাগ হ’য়ে পায়দলই মেরে দেব না হয়… চল চল…
‘আরে সে না হয় যাবো কেননা যখন পড়েছি মোগলের হাতে তখন খানা খেতে হবে একসাথে… সে তো আমি জানি কিন্তু আমরা তাঁর বাড়িতে হঠাৎ যাবোই বা কেন কাল্লুজী?’
‘কেন যাবো না? এই তো তুই নিজেই বললি যে খানা খেতে…’
‘তার মানে? কিসের খানা?’
‘কেন? বিয়ের আবার কিসের?’
‘তা সেই বিয়েটা করলো কে কাল্লুজী?’
‘পন্ডিতজী… আবার কে?…’
‘আরে গেলো যা… আমি আবার কখন আর কাকেই বা বিয়ে করলুম… আমি নিজেই তো জানি না …কি গেরো… আমার দাদা বা বৌদি শুনলেই আমি তো গেছি কাল্লুজী…’
‘এই খেলে এখন গরম গরম কচুপোড়া এই ওঁচা কথাশিল্পির বাচ্ছা… আরে ছাতা সে তুই পন্ডিতজী নয় …পন্ডিত শংকরজী…’
‘তাই বলো কাল্লুজী… তা পুরো কথাটা বলবে তো না কি?’
‘অতো বলাবলি করতে গেলে এ’খানেই তো রাত হয়ে যাবে আর তখন গিয়ে কি পাতা চাটবি? তার ওপরে আজ আবার আকাশের এই যা তা অবস্থা…’
‘শোন কাল্লুজী… শংকরজী না হয় তোমাকে নিমন্ত্রন করেছেন তাই তুমি যাচ্ছো… তা সে তুমি তো যেতেই পারো কিন্তু ভাই তুমিই বলো যে একটা বিয়েবাড়িতে বিনা নিমন্ত্রনে আমি যাই কোন সুবাদে…আমার তো আর নিমন্ত্রন নেই কাল্লুজী…’
‘কে বললো যে তোর নিমন্ত্রন নেই… আলবৎ আছে… একশোবার আছে… আমি যখন আছি তখন নিমন্ত্রন ও থাকতে বাধ্য …. থাকবে না মানে? তার ঘাড়ে কটা মাথা?’
‘তা আমি বাপু জানি না… খান দশেক মাথা আছে হয়তো তবে অনাহূত বা রবাহূত হয়ে আমি যেতে পারবো না … সরি কাল্লুজী…’
‘তা এই কি তোর শেষ কথা রে পন্ডিতজী?’
‘মনে করো তাই কাল্লুজী…’
‘তা বেশ এই যখন তোর শেষ কথা তখন তুই বোঁ করে আধ পাক ঘুরে যা দেখি পন্ডিতজী…’
‘এই মরেছে? সে আবার কি?’
‘কেন? যাবিই না যখন তুই একেবারেই কাঠ কবুল তখন বাড়িতেই তো ফিরে যাবি না কি? আর সেইজন্যে ও তো তোকে পেছনে ঘুরতেই হবে…’
‘তা বেশ কাল্লুজী … এই না হয় আমি পেছন দিকে ঘুরলুম আর আমি চললুম…বাই …বাই…’
‘আরে থাঁড়া…. মানে থাম আর দাঁড়া…. আমি তোকে শুধু ঘুরতেই বলেছি বটে চলে যেতে তো আর বলিনি ….নে সামনে ঝুঁকে পড় দেখি… মানে তোর ওই কুমড়োর মতন মুন্ডুটাকে নীচু করে ঝুঁকে দাঁড়া বলছি…’
‘দাঁড়িয়েছি কাল্লুজী…’
‘এখন তোর এই পিঠটা হ’লো আমার টেবিল আর তার ওপরে রেখে আমার ঝোলা থেকে এই বেরলো কার্ড আর এই লিখলুম তোর নাম … নে ধর… তোর নিমন্ত্রন পত্র …এইবার তো যাবি না কি আরো কোন বাহানা আছে তোর? উঃ বাবারে বাবা…’
‘এ’সব আবার কি কান্ড? আর আমি কি করে জানবোই বা কাল্লুজী যে তুমিই নিমন্ত্রন ও করে বেড়াচ্ছো..’
‘আরে শংকর আমার পুরণো বন্ধু যে রে…সেই ছোটবেলাকার…’
‘সে না হয় হ’লো…তবে বিয়ে বাড়িতে যাবো …আর কোন উপহার না নিয়ে এমনই খালি হাতে? সেটা কি ভালো দেখাবে কাল্লুজী?’
‘আরে দমাস করে মার এক গুলী তোর উপহারকে … সে’সব তোকে কিছু ভাবতেও হবে না আর দিতে ও হ’বে না… সে ভার আমার…. আমি যা একখানা উপহার দেবো না… সকলের মাথা না ঘুরিয়ে দিয়েছি বন বন করে লাট্টুর মতন তবে আমার নাম কাল্লু রাম রামই নয় …তা এখন তুই যাবি না এখনো একঠেঙে বকের মতন রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকবি?’
‘’চলো কাল্লুজী…’
‘শুধু  চলো বললে এখন আর চলবে না বাপু…বলতে হবে অটোতে চলো আর সেই অটোর ভাড়াও দিতে হবে তোকেই… উঃ…দিলে আমাকে একঘন্টা দেরী করিয়ে বকের মতন বাজে বক বক করে…বিয়ে থা কিছু না করলে সে ছেলের এইরকমই স্বভাব দাঁড়ায়…হুঁ..’
‘অগত্যা…তখন আর কি? ডাকো রিক্সা আর দাও গাঁটগচ্ছা …তা সেই রিক্সাটি ও জুটলো তথৈবচ… নাঃ… রিক্সা পুরণো বা নড়বড়ে নয়… তবে তার চালকটি পুরণো মানে বুড়ো… ধীরে ধীরে চলে যখন আমরা আমাদের গন্তব্যে গিয়ে হাজির হ’তে পারলুম তখন বেশ রাত হ’য়ে গেছে… তবে বিয়ে থুড়ি মানে পার্টিবাড়ী দেখি আলোয় আলোয় ঝকমক করছে… শানাই ও বাজছে আর নিমন্ত্রিতেরা অনেকেই দলে দলে এসে আগে রিসেপশান হ’য়ে মন্ডপে ঢুকছে আর সে’খান থেকে বেরিয়ে এসে ডিনার লাউঞ্জে হাজির হ’চ্ছে … সে’খানে মৃদু সেতার বাজছে মাইক্রোফোনে… মনে হয় শংকরজিরই কোন বাজনার রেকর্ডিং হবে হয়তো তবে সে  এক এলাহী ব্যবস্থা… সব দেখে শুনে সে’খানে আমি তো বেশ সংকুচিত হ’য়ে পড়লুম কেননা সবাই যে অজানা অচেনা লোক তবে কাল্লুজী অকুতোভয়…
গট গট করে গিয়ে মন্ডপে ঢুকে পড়লো আর রিসেপশানের মেয়েগুলো তাকে দেখামাত্রই সব যে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো গুড ইভনিং স্যার বলে …আর গার্ড তিনজন যে লম্বা স্যালুট ঠুকলো… সে’সব কিছু যেন দেখে ও দেখলো না কাল্লুজী আর সোজা বর বধুর লাল ভেলভেটের কাপড়ে মোড়া চকচকে সিংহাসন দু’টোর সামনে গিয়ে থামলো… তখন স্যুট বুট পরা বর নিজেই উঠে দাঁড়ালো… 
’আরেঃ…এসো…এসো…কাল্লুজী…তা এতো দেরী করলে কেন? ব্ষ্টির জন্যে বুঝি?’
‘নাঃ …এই পন্ডিতটার জন্যে… আরে আয় না… পরিচয় করিয়ে দিই আগে …এই হ’লো ওস্তাদ সেতার বাদক শংকরজী …আমার বাল্যবন্ধু আর ইনি তার নবপরিণীতা ম্যাডাম সুলেখা শংকর…  আর ইনি হলেন বিখ্যাত কবি লেখক ও নাট্যকার সিদ্ধার্থ শেখরজী…এখন অবধি দুই শতাধিক প্রিন্ট ও অনলাইন পত্র পত্রিকাতে এর লেখা ছাপা হয়েছে আর এক খানা গল্পসংগহ ও ছাপা হয়েছে… এমন কি ওয়াশিংটন বাংলা রেডিওর প্রিন্ট ভার্সানের সাহিত্য সেক্সানে আর বাংলাদেশের গল্প কবিতা ই-পত্রিকাতে ও অনেক গল্প কবিতা ছাপা মানে পাবলিশ হয়েছে… আমার ঘনিষ্ট বন্ধু…. তবে এখন ও ব্যাচেলার আর তাই ম্যাডামের করুণাণ্রার্থী…’
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠলেন শংকরজী আর লজ্জায় মুখ নীচু করলেন ম্যাডাম তবে তাঁকে যেন আমি আগে কোথা ও দেখেছি বলে মনে হ’লো…
‘তা পরিচয় তো না হয় হ’লো… তা এ’বার কিছু উপহার টুপহার দিবি না সবটাই ফোকটে সারবি রে কালুয়া?’
‘তোকে আমার উপহার দিতে বড়ো বয়েই গিয়েছে কেননা তুই আমাকে সকলের সামনে ঘুরিয়ে কঞ্জুস বললি তো … অপমান ও করলি তাই তুই কিছুই পাবি না তবে নবপরিণীতা ম্যাডামকে দেবো বইকি…এই নিন ম্যাডাম এক ক্ষুদ্র মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপহার…’
‘আরেঃ… কি ওটা শুনি… দেখি দেখি… বেশ রঙচঙে দেখতে তো ওপরে তবে ওর ভেতরে ও কি কিছু আছে না সব ফক্কা.. দেখি তো…’ 
বিউটি পার্লার থেকে কনে সাজা আর উগ্র প্রসাধনে সুসজ্জিতা নবপরিণীতা শংকরজির হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলেন আর সব দামী দামী উপহার ফেলে শংকরজী নিজেই সেই ছোট সাধারণ প্যাকেটটা খুলতে লেগে গেলেন…’
‘আ গেলো যা… এ’তো দেখি যে একটা লেডিজ পার্স… দূর দূর… নিশ্চয়ই ভেতরে সব ফক্কা… আমি তো আগেই বলেছিলাম যে কালুয়ার উপহার তো… এইরকমই হবে কিছু …তা মেয়েদের পার্স যখন …নাও তুমিই খুলে দেখো কি আছে…’
‘আরে এতে তো রয়েছে এক হাজার টাকা আর পার্সটা ও যেন আমার খুব চেনা চেনা ঠেকছে…’
‘তা কেমন চেনা ম্যাডাম? শংকরজীর মতন চেনা?’
ম্যাডাম চুপ …মুখ নীচু…
হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে কাল্লুজী বললো –‘ম্যাডাম এখন যেমন এই শংকরজী আপনার জিনিষ হয়ে গেছে ঠিক তেমনই ওই পার্সটা ও আপনারই জিনিষ… তবে চোরে চুরি করে নিয়েছিলো একদিন বিকেলবেলায় এক সিনেমা হলের সামনে… ঠিক এখন যেমন আপনি শংকজীর মনটাকে চুরী করে নিয়েছেন অন্যসবাইকে সরিয়ে থুড়ি হারিয়ে দিয়ে তবে সেই দিন আমি ও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এই চোরকে আমি ধরে ছাড়বো আর আপনার টাকাও আমি উদ্ধার করে ছাড়বো …জানেন তো ভদ্রলোকের হয় এক কথা আর আমি তো বলেই ছিলাম আপনাকে যে আমি ভদ্রঘরের ছেলে …. এইবার কি কিছু বোঝা গেলো ম্যাডাম না আরো কিছু বলতে হবে?’
তিনি সিংহাসনের ওপরে ধপ করে বসে পড়ে বললেন…’না না তার আর দরকার নেই ভাই…’
‘তবে আমি এই সব কথা বার্তার কিছুই তো ছাই একবর্ণ ও বুঝতে পারছি না…’
‘সে তোর ঘটে কিছু থাকলে তবে তো বুঝবি… তা রাতে সবটা শুনে নিস না হয় ভাবীর কাছ থেকে তবে এখন তো অন্ততপক্ষে কিছু মিষ্টি ও তো খাওয়াবি না কি ..’
‘ওঃ হ্যাঁ…সরি… তোর সব কান্ডকারখানা দেখে তো আমি এমন হতভম্ব হ’য়ে পড়েছি যে কি বলবো… তা চল আমি নিজেই নিয়ে যাই লাউঞ্জে …আর আপনি ও আসুন স্যার…’
জম্পেস করে ভালো মন্দ খ্যাঁটনের পরে কাল্লুজী বললো-‘কি যে ছাই বাদলের দিনে তুই জন্মেছিলিস না …দেখ এখনো সমানে ঝুপঝাপ করে জল পড়েই যাচ্ছে …থামবার কোন লক্ষণই নেই… তা দয়া করে একট রিক্সাকে যদি ডেকে দিতে পারিস তো দেখ ভাই… নইলে…’
‘তার দরকার নেই কোন… আমার গাড়ী তোদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসছে… এই…কোই জাকর ড্রাইভারকো বুলাও জল্দী…’
গাড়িতে উঠে আমি বললুম-‘তা এটা কি রকম ব্যাপার হলো বলো তো কাল্লুজী… ? ‘ 
‘আরে হবে আবার কি রে পডিতজী? তবে শুনেছি লোকে নাকি একে বলে…গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজো …তাই আর কি…’
‘তা সেই গঙ্গাজলটা তুমি জোটালে কোথা থেকে সেটা তো বলবে ? চোর ধরে?’
‘আরে দূর দূর… আমি কি জাসুস যে চোর ধরবো?’
‘তবে?’
‘তবে আবার কি রে পন্ডিতজী?’ 
‘জাসুস লাগিয়েছিলে অন্য?’ 
‘হ্যাঁ…বড়ো পয়সা হয়েছে কিনা আমার? আরে বাবা কোন চোর থাকলে তবে না তাকে ধরা?’
‘তা হ’লে?’
‘যত্তো সব অখাদ্যে আধুনিকার দল … রাস্তা জুড়ে হাঁটছিলেন যেন মহারাণী এলিজাবেথ… আর আমি ঘড়ির দোকান দেখতে দেখতে তাড়াতাড়ি করে হাঁটছিলুম … জোর ধাক্কা লেগে গেলো…
না মৈনে সিগনল দেখা না উসনে সিগনল দেখি…অ্যাকসিডেন্ট হো গয়া… রব্বা রব্বা…’
‘আর…’
‘আর ওনার অসাবধানে খুলেই রাখা বা সেই জোর ধাক্কা লেগে ক্লিপলকের মুখ খুলে যাওয়া হ্যান্ডব্যাগের ভেতর থেকে কি একটা ছিটকে এসে আমার হাতে পড়লো…আর আমি ও হাতটাই মুঠো করে ধরলুম যদি আছাড়টা আটকাতে পারি সেই চেষ্টায়….  আরে সেই যে বলে না…ডুবতে কো তিনকে কা সহারা… ঠিক তাই রে পন্ডিতজী আর ওদিকে ততক্ষণে ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুদ্গার শুরু হয়ে গেছে….’
‘ বাপরে বাপ… কি আপদ বল তো তবে আমি ও প্রতিজ্ঞা করে ছিলুম যে এই অযথা অপমানের শোধ যদি না নিয়েছি তো আমার নাম কাল্লুরামই নয়…’
‘তা তো বুঝলাম কিন্তু আজকের তোমার কথার চোটটায় উনি এতো ঘাবড়ে গেলেন কেন বলো তো কাল্লুজী?’
‘আরে যার মনে পাপ থাকে সেই ঘাবড়ে যায় সত্য সামনে এলেই… পরের দিনই আমি ওনার মোর্চার অফিস খুঁজে গিয়েছিলাম তো পার্সটা ফেরৎ দেবো বলে …তা সেইখানে গিয়ে ভিজিটার্স রুমে বসে শুনতে পেলুম যে উনি পাশের ঘরে মিটিংয়ে বসে সব অবিবাহিতা সবস্যদের বলছেন…
’সমস্ত পুরুষ হ’লো জন্মগত পাজী…ওদের কোন বিশ্বাস করতে নেই… ওরা যা বলে তা মিথ্যাই বলে মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই বলে না… ওরা দল বেঁধে সব বিয়ের ছুতোয় মেয়ে দেখতে যায় আর গান্ডে পিন্ডে চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয় সব গেলে বসে আর শেষে নানা ছুতোয় মেয়ে পছন্দ হ’লো না বলে চলে যায় …তখন আবার অন্য একদল আসে… মেয়েদের ফতুর করতে… আর যদি বা মেয়ে পছন্দ হ’লো তখন পণের হিসেব নিয়ে বসে লাখ লাখ টাকার… দান সামগ্রী তো বোঝার ওপরে শাকের আঁটি থাকবেই….সব শেষে যদি বা বিয়েটা হয়েই গেলো তখনই বা ছাড় আছে কি? মিস পান্ডেকে মিসেস উপাধ্যায় বা ত্রিবেদী বানিয়ে দাসী করে ছাড়ে…কেন? নিজে মিঃ পান্ডে হয়ে গেলেই তো পারে….হুঁ…চলবে না… চলবে না…এই সব নারী শোষণ চলবে না…’ 
‘শোন কমলা? আমি কালকেই কাগজে অ্যাড দেবো …যে রেসপন্স করবে তাকে দেখতে তুই বিমলার সাথে নিজেই যাবি… তারা আসতে পারবে না… তোরা সে’খানে জম্পেস করে সাঁটাবি… ছেলের দু’শো দোষ বের করবি আর হয় রিজেক্ট করে চলে আসবি আর নয় তো পঞ্চাশ লাখ টাকার পণের আর দান সামগ্রির লিস্ট ফেলে দিয়ে চলে আসবি…তারপরে আমি নিজে যাবো কন্যাকর্তৃ হয়ে ফাইনাল কথা বলতে..’
‘ওরে বাবারে খেয়েছে রে…গেছিরে… এ কি সাংঘাতিক ভয়ংকর মহিলারে…’
‘হুঁ… তবেই বোঝ…সে’দিনের আমার বিপদটা কতো ভারী ছিলো..’
‘তা সে অ্যাড বেরলো?’
‘আলবৎ… তবে ওনার অফিসের চাপরাসিকে চায় সমোসা খাইয়ে জেনে নিলুম যে ওই অ্যাড দেওয়াই সার….উত্তর নৈব নৈব চ…; 
‘তখন কাল্লুজী?’ 
‘আরে তখন আবার কি? আমি রেসপন্স দেওয়াতে ও জানি রে পডিতজী…নেহাৎ আমার ঘরে এক জব্রদস্ত পত্নী আর ছেলে ও আছে তাই কি করি…উপায় নেই… নইলে নিজেই ঠুকে দিতুম ধাঁ করে আর তোকে না পুছ করে তো আর তোর নামে আমি কিছু করতে পারি না ..তাই গিয়ে ধরলুম শংকরজিকে যে তাঁর ভাইপোর জন্যে ওই অ্যাডের ঠিকানায় রেসপন্স দিতে হবে…’
‘উনি দিলেন?’
‘দেবে না মানে? ওর ঘাড় দেবে…আর দেবে নাই বা কেন? মেয়ে পছন্দ না হ’লে বিয়ে থোড়েই না হ’বে…’
‘কমলা এলো আর জমিয়ে সাঁটালো?’
‘দারুণ…সেই রাজকীয় আপ্যায়ন আর ভোজনে দু’জনেই কাৎ…ছেলেকে ও পছন্দ করে ফেললে পট টক তার গাড়ী বাড়ী দেখে তখনই… আর তাই তো গিয়ে খুব ভালো রিপোর্ট ও দিলো…’
‘কি রিপোর্ট দিলো তা তুমি জানলে কি করে?’
‘তা আমি ঠিক জানি না বটে তবে জানিস তো পন্ডিতজী যে… ফলেন পরিচিয়তে.. বলে একটা কথা আছে..’
‘সেটা আবার কি?’
‘কেন? পরিণাম…….পরদিনই খোদ ম্যাডামের ছূটে আসা মানে আগমন দেখেই বোঝা গেলো …রিপোর্টে খুব বেশী প্রশংসা না করা হ’লে কি আর তখনি গায়ে অতো জ্বালা ধরে কোন মেয়ের? না অতো অস্থির হয়ে পরের দিনই সে ছুটে আসে যাচাই করতে রে পন্ডিতজী…..’
‘আর তারপরে…?’
‘তারপরে আবার কি পড়ে থাকবে শুনি? সে’দিন তো আর রবি বার নয় যে শংকরজির ভাইপো বাড়িতে বসে থাকবে? সে ছিলো ও না… ছিলো শংকরজী শুধু…তা সে তো এমনিতেই তো খুব অতিথিপরায়ণ আর সজ্জন মানুষ….বড়ো ম্যাডামকে দেখে আরো বেশী খাতির যত্ন করলে …লাঞ্চ খাওয়ালো …সেতার শোনালো… একটা নিজের কালেকশানের সি ডি উপহার দিলো আর নিজে গাড়ী চালিয়ে বাড়িতে ও পৌঁছে দিয়ে এলো… ব্যস… কমলার কপাল পুড়লো… সে জানতে ও পারলো না… আবার পরের দিন ইন্টারভিউেয়ের ডেট পড়লো…আর তারপরে আবার… আবার ও…. তবে কে যে কার ইন্টারভিউ নিলো তা খোদা মালুম তবে পরিণাম যা হ’লো তা তো তুই দেখতেই পেলি আজ রে পন্ডিতজী…’ 
আমি বললুম-‘হুঁ…মিঃ শংকরজী তো কই সুলেখা শংকর হ’লেন না তবে মিস সুলেখা থেকে মিসেস সুলেখা শংকর দিব্যি করে তিনি হয়ে গেলেন দেখছি…এই কার্ডটাই তার প্রমাণ…. হায় রে পুরুষ বিদ্বেষী নারী মুক্তি…’
‘তবে ধন্য তুমি কাল্লুজী .... মাই হ্যাটস অফ টু ইউ… আরে আরে…রোকো ভাই..আমি এইখাইনেই নামবো যে…বাই বাই কাল্লুজী…গুড নাইট…’

======================
০৯৪৫২০০৩২৯০
bhattacharyagc@rediffmail.com








’
‘











‘



’









রচনাকাল : ১৪/৬/২০২১
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bulgaria : 1  Canada : 1  China : 77  Europe : 1  Germany : 2  India : 120  Romania : 1  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 5  Ukraine : 2  
United Kingdom : 4  United States : 170  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bulgaria : 1  Canada : 1  China : 77  Europe : 1  
Germany : 2  India : 120  Romania : 1  Russian Federat : 6  
Saudi Arabia : 5  Ukraine : 2  United Kingdom : 4  United States : 170  
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
অতি আধুনিকার কবলে কাল্লুজী by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৬৪৩৫৯
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী