আমার ভিতর বাহিরে
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখিকা : অস্মিতা ভাদুরী
দেশ : India , শহর : Konnagar

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ১৪ টি লেখনী ৩২ টি দেশ ব্যাপী ৮২৩৮ জন পড়েছেন।
"উফ এই গরমে আর পারিনা বাপু, গ্রামে এত গরম লাগত না, তোদের এই কলকাতায় এত গরম কেন যে কে জানে ?"
মৃন্ময়ীর কথা গুলো শুনে অমিত আড়চোখে তাকালেও আর মুচকি হাসিটা মৃন্ময়ীর চোখ এড়ালো না।

"হাসছিস কেন রে হতভাগা ? এই গরমে কেউ রাস্তায় বেরোয় ? কি এমন সারপ্রাইজ দিবি যে দুপুর বেলায় টেকো গরমে টেনে নিয়ে যাচ্ছিস ? রকম সকম বুঝিনা বাপু !"
মৃন্ময়ীর গলায় অসন্তোষ স্পষ্ট। কিন্তু , একমাত্র ছেলের সঙ্গে যেখানে যেতে হচ্ছে সেটার কথা ঘুণাক্ষরেও না জানা টা বেশি রাগের ওনার কাছে। ব্যাটা কিছুতেই মুখ খুলল না ! কি যে মনে মনে ঠিক করে সেই জানে !

একটু পরেই ক্যাবটা থামল সিগনালে। আলগোছে কানে ভেসে এল "যদি আরও কারে ভালোবাসো, যদি আর ফিরে নাহি আসো..." অমিত মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখল মা আনমনা হয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে , অমিত জানে এই গানটা মায়ের জীবনের কত বড় সম্পদ।

মৃন্ময়ীর তখন বছর পনেরো বয়স, মা মরা সুন্দরী মেয়ে বলে ঠাকুমা আর বাবা তাড়াতাড়ি বিয়ের তোড়জোড় করেছিলেন। তবে বাবার কাছে একটাই আবদার ছিল বাবার আদরের মিনুর, বিয়ের পর যেন এই গান তাকে না ছাড়তে হয়। বাবাও সায় দিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন ছোট বয়স এখন এরকম খেয়াল, বড় হলে ঠিক এসব ভুলে যাবে। সংসারের যাঁতাকলে এসব শখ কি মেয়েদের টেকে ?

কিন্তু, মিনু যে ওই প্রাণের গান ছাড়া দিন চলে না ! তালিম নিয়ে শেখেনি সে কোনওদিনই। সে তো তার মাও শেখেনি। কিন্তু মায়ের গলায় "তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও , আমি যত দুঃখ পাই গো !" শুনলে কেমন যেন বুকটা হু হু করত, কি যেন নেই বা হারিয়ে গেছে মনে হত। মাত্র দশটা বছর সে পেয়েছে মা কে। তাতেই মায়ের গানে মশগুল হত। মা রাঁধতে রাঁধতে , মিনুকে স্নান করাতে, নিজে পুকুরে নাইতে গিয়ে, বিকেলে চুল বাঁধতে বসে, সন্ধ্যেবেলা ছাদে বসে, রাতে মিনুকে ঘুম পাড়াতে সব কিছুতেই রবিঠাকুরের গান গুনগুন করতেন। মাঝে মাঝে "তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে, তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে" আবৃত্তি শুনে ভাবত, সকল শূন্য করে কাকে দিতে চায় মা ?

সেদিন সকাল থেকেই খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৈশাখ মাস শেষ হতে আর দিন পাঁচেক বাকি। এমন সময় এই বৃষ্টি বেশ স্বস্তি দিচ্চিল তবে মা আর বাবার ঝগড়া হচ্ছিল। ঝগড়া বলতে বাবা বারবার মা কে এত ওটা বলেই যাচ্ছিল আর মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। একবার কি একটা বলতে মুখ খুলতেই বাবা সপাটে এক থাপ্পড় মেরেছিল, মা খাট থেকে ছিটকে ড্রেসিং টেবিলে পড়েছিল। কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছিল হু হু করে। বাবা সাথে সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল ভিজে ভিজেই। আর ঠাকুমা মা কে কি সব বলে গালাগালি দিচ্ছিল। মা ঘরের দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে আবৃত্তি করেছিল,"অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তবে ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।"

এরপর মিনু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। দমদম করে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজে ঘুম ভাঙতে দেখেছিল বাবা মায়ের ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকেই বেরিয়ে এল। আলো আঁধারীতে মিনু দেখেছিল মা কড়ি বর্গা থেকে ঝুলে দোল খাচ্ছে।

তারপর সব কেমন ঘোরের মত লাগে মিনুর। আর মায়ের গান, আবৃত্তি শুনবেনা ভাবলেই বুকটা হালকা হয়ে যেত। নিজে নিজেই গুনগুনিয়ে উঠত,"মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে, সেদিন ভরা সাঁঝে, যেতে যেতে দুয়ার হতে....."

তারপর মিনুর বিয়ে হল গৌরাঙ্গ বাবুর সাথে। বৈশাখের শেষের দিকে। ডাকনাম গোরা। খুব ভালো মানুষ। মুখে না বললেও মিনুর মনের কথা বুঝে নিতেন। বয়স মিনুর প্রায় দ্বিগুণ হলে কি হবে তিনি মিনুকে তাঁর মত করেই থাকতে দিতেন। কিন্তু তাঁর মা নিরুপমা দেবী মোটেই সেসব সহ্য করতেন না। বাড়ির বউ দিন নেই রাত নেই গান গুন গুনিয়ে যায়, ছাদে, বারান্দায় কবিতা কপচায় নিজের মনে এসব তিনি মোটেই মেনে নিতে পারেননি। ফলে মিনুর গান আর আবৃত্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। সে ছটফট করত। কিন্তু কিচ্ছু করতে পারতনা। রতে দরজা লাগিয়ে গোরা মিনুকে খুব আস্তে আস্তে গান আর কবিতা শোনানোর আবদার করত। মিনুর ওই ছিল একমাত্র ভরসা।

বছর খানেক পরে সেবার মিনুর শরীরে আসন্ন মাতৃত্বের লক্ষণ স্পষ্ট। আবার বৈশাখের শেষ লগ্নে তুমুল ঝড় বৃষ্টি। গোরা গেছিল কলকাতায়। ব্যবসার মাল পত্তর আনতে। সেদিন ছিল মিনুদের বিয়ের তিথি। মিনু নিজের মনেই বিয়ের লাল বেনারসি পরে, বাগানে নিজের হাতে লাগানো গাছের জুঁই ফুল তুলে মালা গেঁথে খোঁপায় জড়িয়েছিল। অল্প সল্প গুনগুন ও করছিল "তোমা ছাড়া আর এ জগতে, মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো,আমার পরান যাহা চায়,তুমি তাই ,তুমি তাই গো"  শাশুড়ির কান বাঁচিয়ে।

কিন্তু , সন্ধ্যের মধ্যে যার ফেরার কথা রাত হয়ে গেলেও সে ফিরলনা। সারা রাত মিনু ওই একটাই গান গুনগুনিয়ে গেল। আর অঝোরে কেঁদে গেল। সকালে খবর এলো । নৌকাডুবি হয়েছে গঙ্গায়, গোরার নৌকা মাল ও মালিক সমেত ডুবে গেছে। মুর্ছা গেল মিনু। সেই ওর শেষ গাওয়া গান। আর কোনোদিন একটাও গানের কলি গায়নি সে। একটা কবিতাও আওড়ায়নি। পরের দিনই সন্তান প্রসব করে মিনু। কোলে আসে অমিত।

তারপর ছেলে অমিতকে নিয়ে সে বাপের বাড়ি চলে আসে। নিজের মনের মত করব বড় করব তুলতে থাকে। আজ অমিতের একুশতম জন্মদিন। এই দিনটির গুরুত্ব মিনুর কাছে অনেক। এই দিনেই মা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, আর এই দিনেই তাঁর অমিতের জন্মদিন। ওইদিন আরও একজনের জন্মদিন। রবি ঠাকুরের। হ্যাঁ এই পঁচিশে বৈশাখ মিনুর জীবনে সুখ আর দুঃখ দুটোই বয়ে আনে প্রতি বছর। সেবার মা রবীন্দ্রজয়ন্তী করতে চেয়েছিলেন বলেই মাকে কুলটা ও আরও অনেক চরম আখ্যা পেয়ে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছিল। আর মৃন্ময়ীর কোলে অমিত এসে সেই আক্ষেপ একটু হলেও ভুলিয়েছিল।

তবে আজ অমিতের জন্মদিনে সে মাকে কোথায় নিয়ে আসছে তার কোনও ধারণাই নেই মৃন্ময়ীর। ক্যাব থেকে নেমে মা কে নিয়ে অমিত গেল সামনের বাঁধানো জায়গাটায়। কি সুন্দর বাগান করা। ঐদিকে কি সব হচ্ছে, ভীষন সুন্দর করে কেউ বাঁশি বাজাচ্ছে। অমিত মা কে সেদিকেই নিয়ে গেল। বলল ," ওখানেই বসবো মা আমরা, চলো।" মৃন্ময়ী অবাক হলেও অখুশি হলনা। ছেলের সাথে গুটি গুটি পায়ে এগোতে লাগল। কি সুন্দর জায়গাটা ! মন জুড়িয়ে গেল !

আরেকটু এগোতেই বুকটা ধক করে উঠল তাঁর। বিশাল বড় একটা রবি ঠাকুরের ছবি। তাতে রজনীগন্ধার বিশাল মালা পড়ানো। আর সামনে অসংখ্য ফুলের স্তবক ও ছোট মালা, ধুপ প্রদীপ জ্বলছে। আর সামনের বাঁধানো মঞ্চে একটি ছেলে চোখ বন্ধ করে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছে তখন"ও কোন বাঁকে কি ধন দেখাবে কোন খানে কি দায় ঠেকাবে, কোথায় গিয়ে শেষ মেলে যে, ভেবেই না কুলায় রে, আমার মন ভুলায় রে" একটু গুনগুনিয়ে উঠেও চুপ করে গেল। যে কোথায় আনল তাকএ অমিত ! গলায় আবার সুর দুলে উঠল যে !পাশে তাকিয়েই চমকে গেল। কোত্থাও অমিত নেই। চারপাশে তাকালো , কোত্থাও না। কি করবে ভাবতে ভাবতেই দেখল একটা মিষ্টি মেয়ে এগিয়ে এসে বলল,"মাসিমা আপনি আসুন ঐদিকে বসার জায়গা খালি আছে,আসুন আমার সাথে" বলে মৃন্ময়ীর হাত ধরে নিয়ে চলল। মৃন্ময়ী অমিতকে খুঁজেই চলল। মেয়েটিকে সে কথা বলতেই সে জানালো "কোনও চিন্তা নেই। অমিত আশেপাশেই আছে"

এই বলে তাকে বসিয়ে মেয়েটিও উধাও। মৃন্ময়ী কিছুক্ষন উসখুস করলেও একের পর এক রবিঠাকুরের গান ও আবৃত্তি শুনে সব ভুলে বিভোর হয়ে গেল। তবে চটক ভাঙল একটু পরেই। অমিত স্টেজে উঠেছে, গলায় গিটার ঝোলানো, পাশে সেই মিষ্টি মেয়েটা। অমিত স্টেজে উঠেই মায়ের দিকে তাকালো হাসি মুখে, মায়ের অবাক মুখটা দেখে হাসল তবে খুশি হল খুব। একটা পরেই অমিতের গান আর ওই মেয়ের আবৃত্তির দ্বৈত পরিবেশন জমে উঠল। দর্শকদের তুমুল হাততালি বুঝিয়ে দিচ্ছিল কেমন ভালো লাগছে এই পরিবেশন।

একে একে মিনুর সব প্রিয় গান আর কবিতা পরিবেশন করে অমিত বলল,"আমার মা এর জন্যই আমি এই গানের সুর গলায় পেয়েছি, আর এই লাবণ্য আমার মায়ের সবকটি প্রিয় কবিতা আবৃত্তি করেছে নিজের ইচ্ছেয় ! আর একটি গান এবার আপনারা শুনবেন সেটা আমার মায়ের সবথেকে প্রিয় ও বিশেষ আবেগের গান। কিন্তু আমার মা মৃন্ময়ী ব্যানার্জী এখানেই আছেন, ওনাকে মঞ্চে আস্তে অনুরোধ করছি ওই গান ওনার গলাতেই শুনুন আপনারা .…"

কোনও ওজর আপত্তি ধোপে টিকলনা, লাবণ্য মঞ্চ থেকে নেমে মৃন্ময়ীকে হাত ধরে নিয়ে গেল মঞ্চে। ছেলে বলল,"মা আজ তুমি আর আমি ডুয়েট গাইব, আমার পরান যাহা চায়!"

চোখ বন্ধ করে, গোরার সদাহাসি মাখা মুখটা মনে করল মৃন্ময়ী। শুরু করল "আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস, দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরস মাস !"

অমিত গলা মেলাল। উদ্বেল হয়ে গাইল দুজনে। শেষের কবিতার কয়েকটা লাইন আবৃত্তি করল এরপর মৃন্ময়ী," আমি আগন্তুক, জনগণেশের প্রচন্ড কৌতুক। খোল দ্বার, বার্তা আনিয়াছি বিধাতার, পাঠায়েছে দুর্লখ্য অক্ষর...."

তারপর অনুষ্ঠানের সমাপ্তি সঙ্গীত গাইল সকলে মিলে। প্রত্যেকের গলায় গমগম করে উঠল রবি ঠাকুরকে তাঁর জন্মদিনে তাঁরই লেখা গান দিয়ে অভিবাদন জ্ঞাপন।

"চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ ,
 হে নুতন, দেখা দিক আরবার, জন্মের প্রথম শুভক্ষণ....."
রচনাকাল : ১৫/৫/২০২১
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bulgaria : 1  Canada : 3  China : 79  Europe : 2  France : 1  Germany : 3  Hungary : 2  Iceland : 1  India : 188  Ireland : 3  
Romania : 2  Russian Federat : 6  Saudi Arabia : 5  Ukraine : 2  United Kingdom : 2  United States : 194  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bulgaria : 1  Canada : 3  China : 79  Europe : 2  
France : 1  Germany : 3  Hungary : 2  Iceland : 1  
India : 188  Ireland : 3  Romania : 2  Russian Federat : 6  
Saudi Arabia : 5  Ukraine : 2  United Kingdom : 2  United States : 194  
লেখিকা পরিচিতি -
                          ১৯৯১ সালের ১১ই জানুয়ারি হাওড়া জেলার অখ্যাত গ্রাম হিরাপুরে জন্মগ্রহণ করেন অস্মিতা। বর্তমানে কোন্নগরবাসী এই লেখিকার, ছোট থেকেই লেখা লিখির প্রতি ঝোঁক ছিল। মূলত মা কে দেখেই অনুপ্রেরণা পান লেখিকা। পেশায় শিক্ষিকা হলেও শখ বলতে নিজের ছোট্ট বাগানের ও পোষ্যদের পরিচর্যার পাশাপাশি গান শুনতে ভীষন ভালোবাসেন। বেড়ানো, ছবিতোলা, নাচের কোরিওগ্রাফ করা শখের মধ্যেই পড়ে। কলম যেহেতু তলোয়ারের চেয়েও  শক্তিশালী, তাই নিজের বলতে না পারা সব কিছুর প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করেন। 

ভালো থাকায় ও ভালো রাখায় বিশ্বাসী হয়ে, পরিচিত অক্ষর ও শব্দ দিয়েই , নতুন গল্পমালার সৃষ্টি করেন ! 
                          
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
আমার ভিতর বাহিরে by Asmita Bhadury is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৬৪৩৬০