ছোটবেলা থেকে ইতিহাস এর এক আকর্ষণীয় অধ্যায় সিরাজ,বাংলা বিহার ওরিশার শেষ স্বাধীন নবাব ,পলাশীর প্রান্তে ১৯৫৭ সালে যার পরাজয়ে ভারতের স্বাধীনতা ও অস্তমিত হয়েছিল। এছাড়াও সুভাষচন্দ্র সিনেমা টা দেখার সময় ভাগীরথীর তীরে রজনীকান্তের গানে..
"তব চরণনিম্নে উৎসবময়ী শ্যাম ধরণী সরসা,
উর্দ্ধে চাহ অগনিত মনি,রঞ্জিত নভো নিলাঞ্চলা" গানটি শুনে ও হয়তো সেই দুর্মুখ আকর্ষণে মুর্শিদাবাদ এ কর্মক্ষেত্র হওয়ার সুবাদে প্রথম আমি যখন খোসবাগ কে ছুঁলাম মনে এক অপূর্ণ ইচ্ছা চরিতার্থ হলো_আজ ও তার আকর্ষণ একটুকুও কমেনি।তাই বলবো সবাই যখন মুর্শিদাবাদ এ হাজারদুয়ারি, কাটরা মসজিদ,ইমামবাড়া, রোশনী বাগ,মতিঝিল,মদিনা, কাঠ গোলাবাগান , নশীপুর রাজবাড়ি ,ফুটি মসজিদ দেখে ভাগীরথী পার না হয়ে ফিরে যান,... ইতিহাসের শেষ সাক্ষী কে যদি না দেখে যান তবে মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ অসম্পূর্ণ ।
খোসবাগ লালবাগ শহরের দক্ষিণ দিক এ ভাগিরথীর পশ্চিম তীরে সবুজ শ্যামলিমায় অবস্থিত নবাব আলিবর্দির প্রিয় খোসবাগ । বাংলা বিহার ওড়িশার নবাব তাঁর মায়ের সমাধিক্ষেত্র হিসেবে এটা তৈরি করেন।যেন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়,যার পায়ের কাছে ভাগীরথী তার কুলুকুলু শব্দে নিজের খেয়ালে বয়ে চলেছে নিজের ছন্দে।
সকালসন্ধে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে, কথিত আছে রাতে যদি কেউ সাহস করে খোসবাগে যান তো নারী কন্ঠের হৃদয় বিদারক কান্নার সুর শোনা যায়।
ভাগীরথীর দিকে মুখ করে যে প্রবেশদ্বার বা তোরণ টি আছে যে সেখান দিয়ে হাতি ও যেতে পরে।এখন অবশ্য ভাগীরথীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে সেটি অনেক দূরে সরে গেছে। আর ও সুন্দর ভাবে আস্তে চাইলে নিজামত কেল্লার চত্বরে চিল ঘাট থেকে নৌকা ছেড়ে বিহারী গ্রাম আমানিগঞ্জ এর ওপারে নেমে হেঁটে খোসবাগ আসলে এক অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়, যেনো শিল্পীর তুলির টানে নদী তটের নিসর্গ দৃশ্য মন মাতিয়ে দেয়।
প্রথম চত্বর ..সমাধিক্ষেত্র বাগান দিয়ে সাজানো।ঢুকেই দুটি ভাগ দেখা যায়।প্রথম ভাগে খোলা জায়গায় তিনটি কবর,যার উদ্দ্যেশ্যে আলীবর্দী এই স্থান টি তৈরি করেন_ একটি তাঁর মা এর। দ্বিতীয় ভাগে বর্গাকার সৌধের মধ্যে সাতটি সমাধি। আলীবর্দীর সমাধির ওপর পাথরে ফারসি ভাষায় নাম লেখা,ঠিক পাশে সিরাজ এর, আলীবর্দীর পায়ের দিকে তার মহিষী শরফউন্নিশার কবর,সিরাজের পায়ের তলায় লুৎফুন্নিসার সমাধি,পাশে তার ছোট ভাই মির্জা মেহেদীর কবর,তার পায়ের তলায় তার বেগম এর।বাকি টা উমৎ উন্নিশার,সিরাজের অন্য বেগম।
দ্বিতীয় চত্বর এর শেষে মসজিদ।
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়,১৯৫৭ সালে ইংরেজ দের কাছে যখন মির জাফর এর ষড়যন্ত্রে সিরাজ হেরে যেতে বসেন তখন ২৩ এ জুন,১৭৫৭ সালে বিকাল ৪ টে,সিরাজ উটে করে দেহরক্ষী দের নিয়ে মুর্শিদাবাদ পালালেন ,রাত ১২টায় সিরাজ হিরাঝিল এ মনসুর গঞ্জ প্রাসাদে ও পরের দিন সেনা জোগাড় করে লড়াই করে সম্পূর্ণ বিফল হন।রাত ১০ টায় সিরাজ রাজধানী ছেড়ে পালানোর সময় বিশ্বাসী খোজা,বেগম লুৎফুন্নিশা, কন্যা উম্মত জহুরা ও কিছু দাসদাসী সঙ্গে নেন ।১২ টায় মির জাফর পালানোর খবর পেতে গুপ্তচর লাগান।সিরাজ ভগবান গোলা থেকে পদ্মা দিয়ে রাজমহল যাত্রা করেন।২৯ শে জুন ক্লাইভ মিরজাফরকে ষড়যন্ত্রের পুরষ্কার হিসেবে মসনদে বসান ।
২ রা জুলাই সিরাজউদ্দৌলা ধরা পড়ার খবর ছড়াল,নৌকা ঘাটে বাঁধা অবস্থায় রান্না পর্ব সারার সময় রাজমহলের উল্টো দিকে গঙ্গার ধারের পোড়া বাগান এ ছদ্মবেশী নবাবের জুতো দেখে দানা ফকির মিরজাফর এর কাছে খবর দেন,সিরাজ বন্দী হন।এর পর সিরাজ কে মীরজাফরের কাছে আনলে মিরজাফর তাঁকে মিরণ এর হেফাজতে দিলে,মিরণের আদেশে মোহাম্মদী বেগ তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করেন ও দেহ খন্ড খন্ড করে পরের দিন 3 রা জুলাই,হাতির পিঠে তুলে শহর পরিক্রমা করেন ,তার মা আমিনা বেগম কোলাহল শুনে এই দৃশ্য দেখে পাগলপ্রায় হোয়ে যান।সেদিন ই ইতিহাসের হতভাগ্য নবাবের দেহ খোসবাগ এ দাদুর পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
এই ইতিহাস এর সাক্ষী খোসবাগ আজও সবাই এ কে বেদনার্ত করে।দেশপ্রেমের সাক্ষী এই খোসবাগ।স্বাধীনতার ইতিহাসের মর্মর ফলকে খোসবাগ এক অনন্য নাম।আজও ওখানে গেলে নিজে থেকেই মাথা মত হয়।তাই বাঙালি হৃদয় এ এক নাম নয় খোসবাগ। খোসবাগ এক রক্তাক্ত ইতিহাস।
রচনাকাল : ২২/৩/২০২১
© কিশলয় এবং নন্দিতা সরকার কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।