আদিখ্যেতা
আনুমানিক পঠন সময় : ৩৫ মিনিট

লেখক : জি.সি.ভট্টাচার্য
দেশ : India , শহর : Varanasi,u.p.

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০১২ , নভেম্বর
প্রকাশিত ৪৪ টি লেখনী ৫১ টি দেশ ব্যাপী ৪৩৯৯২ জন পড়েছেন।
আদিখ্যেতা
জি০সি০ভট্টাচার্য্য, বারাণসী, উত্তরপ্রদেশ
আজ আমি বলছি একটা ছোট ছেলেকে গল্প শোনাবার ঝামেলার কথা…
এই ছেলেটাকে এখন অনেকেই চেনে কেননা সে আমার একমাত্র ভাইপো…নাম চঞ্চল। যে সময়ের কথা বলছি তখন তার বয়স সবে এগারো পেরিয়েছে মাত্র…
তবে ছেলেটা বেশ রোগা মতন দেখতে বলে ওজন ও কম ছিলো কিন্তু তার পরম বন্ধু কুশাগ্রবুদ্ধি ছেলে বাদল তার নাম দিয়েছিলো পরীর দেশের রাজকুমার…
দুধেরবরণ এই ছেলেটা তখনই ছিলো খুব ঝকঝকে চকচকে দেখতে আর তার মুখশ্রী অতিমাত্রায় সুন্দর একেবারে পরীর মতন বলে…
অতি বুদ্ধিমান এই ছেলেটার পরিচয় হয়তো বিশেষ না দিলে ও চলবে কেননা আমার লেখালেখির কল্যাণে এখন অনেকেই তো এই সব কথা জানে…তবে সেই ছোট্টবেলা থেকেই কচি ছেলেটাকে মানুষ মানে বড়ো করতে হয়েছে এই আমাকেই আর তাই অনেক এমন সব মুশ্কিলে ও পড়তে হয়েছে যে সে আর আমি কি বলবো? চঞ্চলের মায়ের ভাষায় সে সবই না কি আদিখ্যেতা….
অন্য সব ঝামেলার কথা এখন যদি ছেড়েই দিই তবে শুধু রাতে ছেলেটাকে সেই ছোট্টবেলা থেকেই ঘুম পাড়ানো নিয়ে যে সব ঝামেলা হতো শুধু সেইটুকু বলতে গেলেই দিব্যি করে একটা বই লেখা হয়ে যেতে পারে… 
আমার স্মার্ট কনভেন্টে পড়া অতি সুন্দরী মর্ডান বৌদি তো একেবারে অস্থির হয়ে গেছিলো সেই সদ্যোজাত ছেলেটাকে নিয়ে মাস কয়েক পরেই। 
যেমন হয় আর কি…সন্ধ্যার পরে মা ছোট বাচ্ছা ছেলেকে দুধ খাইয়ে দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে দোল দিয়ে ঘুম পাড়ালে তখন তো সব কচি বাচ্ছাই ঘুমিয়ে পড়ে …তাই তো স্বাভাবিক… 
কিন্তু এই ছেলেটার বেলায় দেখি যে সেটি হবার জো নেই… 
সে আর ঘুমোয় না উল্টে সে দিব্যি আরাম করে চোখ বুঁজে দোল খায় আর যখন তার মায়ের মনে হয় যে চুপচাপ যখন পড়ে আছে কোলে এতোক্ষণে তার ছেলে তবে ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছে আর এই মনে করে যেই না তাকে কোল থেকে নামিয়ে দোলনায় শুইয়ে দিতে গেছে অমনি সেই ছেলে তার বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ দুটোকে খুলে খিল খিল করে এক হাসি দিয়ে ওঠে আর তখন আবার মাকে করতে হয় ঘুম পাড়ানোর সেই ট্রায়াল… 
অন্য সব বাচ্ছা ছেলে তো ঘুম বা ক্ষিধে পেলে সে কেঁদে কেটে আর চেঁচিয়ে গোটা বাড়ী একেবারে মাথায় তুলে দেয় তবে এই ছেলের বেলায় দেখি যে সে সবের কোন বালাই নেই মানে কান্নাকাটি কিছু নেই…শুধু মুক্তো ঝরানো অপরূপ সুন্দর হাসি… উঃ.. আর তাইতেই বৌদি একেবারে কাহিল… 
এক রাতে তো চার পাঁচ বার এই ‘ট্রায়াল আর এরর’এর ঝামেলা করে বৌদি ছেলের কাছে শেষে হেরে গিয়ে অস্থির হয়ে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে সোজা আমার ঘরে এসে হাজির…
কথাবার্তা কিছু বলা কওয়া নেই হঠাৎ আমার কোলের ওপরে ঢিপ করে ছেলেটাকে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুটো হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বৌদি বলে ফেললো-‘ও ঠাকুরপো.. এই নাও তোমাদের পরী ছেলে…একে নিয়ে তোমরা আমাকে এখন একটু রেহাই দাও দয়া করে…রাত দশটা বাজছে…এইবার আমি ঠিক পাগল হয়ে যাবো…উঃ…এই ছেলেকে মানুষ করা আমার অসাধ্য…আমি শুধু না হয় বার কয়েক এসে দুধ খাইয়ে দিয়ে ছেলেকে তোমার কাছে ফেলে রেখে দিয়ে চলে যাবো আর সব ঝামেলা সামলাবে তুমি…নইলে আমাকে ঠিক বাড়ী ছেড়ে পালাতে হবে এই ভীষণ দুষ্টু ছেলের জন্যে…’
‘সে কি বৌদি? আমি যে এখন পড়তে বসেছি…তা আমার সব হোমওয়ার্কের আর স্কুলের টাস্কের কি হবে?’
‘সে সব আমি কিছু জানি না বাপু….’
‘আচ্ছা বেশ সে না হয় হলো বৌদি কিন্তু সকালে আমি যখন স্কুলে চলে যাবো তখন?’
‘সে যখন তুমি স্কুলে যাবে তখন না হয়ে আমার মাসতুতো বোন এসে সারা দিন থাকবে বাড়িতে এই ছেলে নিয়ে কিন্তু তারপরে তোমাকেই এই ছেলেকে সামলাতে হবে তা বলে দিচ্ছি…আমি আর কোন কথাই তোমার শুনবো না…যতো জ্বালাতন হয়েছে সব আমার…এখন দেখছি যে আমাকে ও গিয়ে তোমার দাদার মতন একটা চাকরি যোগাড় যে করতে হবে তা ঠিক…এখন সাধে কি আর মেয়েরা সবাই লেখা পড়া শিখতে আর বড়ো বড়ো সব চাকরী করে ঘরে পয়সা আনতে চায়…হুঁ…সে সব অনেক সোজা কাজ এই সারাদিন ধরে সব ঘরকন্নার হাজারো কাজ করা আর রান্নাবান্না করা থেকে শুরু করে এইরকম দুষ্টু পাজী বজ্জাতের ধাড়ী সব বাচ্ছা সামলানোর চেয়ে…’
‘হুঁ…আমি ঠিক বলছি যে তখন আমার বদলে তোমাকেই মানুষ করতে হবে এই বজ্জাত ছেলেকে…আর বেশ বুঝতে পারবে যে কতো ধানে কতো চাল হয়…হ্যাঁ … নাও…এখন যে করে পারো এই পাজিটাকে তুমি ঘুম পাড়িয়ে দেখা ও তো তবে বুঝি তুমি বাহাদূর…উঃ…রাখবার মতন কেউ আর একটা নাম খুঁজে পেলো না চ দিয়ে…শেষে চঞ্চল…কেউ রাখে এই নাম? ছিঃ…’
‘আচ্ছা বৌদি…সবে তো তোমার মোটে একটা বাচ্ছা হয়েছে মাস তিনেক আগে আর এতেই তুমি এতো হয়রান হয়ে ভাবছো কেন বলো তো? পরে তো তোমার আরো ছেলে মেয়ে সব হবে..তখন? আর এই ছেলেটা তো দেখি যে খুবই ভালো কেননা তেমন ঘ্যান ঘ্যান ও করে না আর সবসময় কান্নাকাটি বা চিল চিৎকার ও করে না’ 
‘তা বেশ তো…থাকো না তুমি তোমার ওই ভালো ছেলে নিয়ে বাবা…আমাকে রক্ষে করো মা রক্ষাকালী…আর বলে কি না আবার? যাঃ…শোন ঠাকুরপো…ওই সব ঝুট ঝামেলায় আর আমি নেই…বাব্বা…এতেই বলে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে তার ওপরে বলে কি না আরো বাচ্ছা হবে আমার…ফের ওই সব বাজে কথা বললে আমি টেনে মারবো এক থাপ্পড় কষে তোমার গালে…..দুষ্টু পাজী ছেলে… …’
‘তবে আর দশটা বাচ্ছার মতন এই ছেলেটা ও সে সব মানে চিৎকার ও কান্নাকাটি করলে তো বাঁচাই যেতো…রাগ করে ছেলের পিঠে ঘা কতক লাগিয়ে দিতেই পারতুম আমি কিন্তু এই ছেলেটা যে শুধুই হাসে…উঃ…আর আমার গা জ্বলে যায় ওর ওই মিষ্টি মুখের দুষ্টু হাসি দেখলেই…আমি যাই…দুধের বোতল ও এনে দিয়ে যাচ্ছি না হয়…রাতে খাইয়ে দিও তোমার ছেলেকে… হ্যাঁ না তো…পরী ছেলে না পিলে হয়েছে আমার একটা…’ 
তখন কি আর করা? 
এ মনে হয় ঠিক মা ও ছেলের মধ্যে রাশির কোন ভয়ানক গরমিল হয়েছে কিন্তু আমি এখন করি কি? বেশ তো দেখি ফেঁসে গেলাম…নিজের সাত ক্লাশের পড়ার অঙ্ক বই আর খাতা মুড়ে রেখে বেশ নরম নরম দুধের মতন সাদা কচি চকচকে ছেলেটাকে দু’হাতে ধরে সাবধানে নিজের কোলে তুলে নিয়ে উঠতেই হলো আমাকে আর তাইতেই সে তখন আনন্দে বেশ সুন্দর করে ফোকলা মুখে একটা হাসি উপহার দিলো আমাকে যার মানে হলো….এই তো বেশ ভালো ব্যব্যস্থা হয়েছে এখন আর সেই আনন্দে সে তার একটা ছোট হাত মুখে পুরে দিলো যেন কতো ভালো মিষ্টি খাচ্ছে সে.. তবে খানিক পরে সেই হাতটাকে মুখ থেকে আবার বের করলো আর অন্য হাতটাকে মুখে ঢুকিয়ে নিলো..তবে সে ও তার বেশীক্ষণ ভালো লাগলো না হয়তো তাই সে তখন একসাথেই তার ছোট ছোট হাত দুটোকে মুঠি করে ধরে নিয়ে নিজের মুখে ঢোকাতে গিয়ে সে আর তখন কিছুতেই ঢুকছে না দেখে খিল খিল করে হেসে অস্থির হয়ে গেলো…উঃ…সত্যিই দেখছি যাচ্ছেতাই ছেলে হয়েছে একটা…
কি যে ছাই এখন করি আমি? 
তবে এই ছেলেটাকে যতো বেশী অপরূপ সুন্দর দেখতে ততোই বেশ মজার ও যা হোক..
বাচ্ছা ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে পায়চারী করতে করতে শেষে বুদ্ধি এলো একটা মাথায়..
আমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ারটা বাঁ হাতে খুলে আমার মাউথ অর্গ্যানটা বের করলুম আর ধীরে ধীরে বাজাতে শুরু করলুম…যে গানটার সুর আমি বাজাতে চেষ্টা করলুম সেটা অবশ্য হিন্দী গান…মেরে ঘর আয়ো…প্রীতম প্যারা…তুম বিন জগ অঁধিয়ারা…প্রীতম প্যারাআআআআ… 
তবে তার ফল হলো দারুণ… 
আমি যখন থামলুম পুরো ভজনটা একমনে বাজিয়ে তখন দেখি দুটো চমৎকার কান্ড হয়ে গেছে…এক..চঞ্চল ছেলেটা আমার কোলে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে আছে আর বৌদি দুধের বোতল হাতে নিয়ে দরজার বাইরে স্থানুর মতন দাঁড়িয়ে আছে… নির্বাক… আমার অতো স্মার্ট বৌদি চুপ একেবারে…দু’চোখ জলে ভিজে….আমি থামতে বললো-‘বাহবা ঠাকুরপো…এই না হলে কি ওই দুষ্টু ছেলের ঘুম আসে? আমি হার স্বীকার করছি আজ…ধন্য তুমি…’
আমি বললুম-‘আরে যাঃ…কি যে বলো না বৌদি…এটা কি আমার গান? এ তো মীরার ভজন ..’ 
বৌদি বললো-‘তা তো বটেই তবে সুরের ওই দীর্ঘ টানগুলো তোলাই তো আসল কাজ…আমি তো নিজের চোখেই দাঁড়িয়ে থেকে সব দেখলুম যে ওই দীর্ঘলয়ের সুরে বাজনা বাজছে শুনেই তো ওই দুষ্টু ছেলেটা তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়লো…..সেই যে বলে না রতনে রতন চেনে…আজ তোমারই জয় ঠাকুরপো….’
‘আরে যাঃ…যতো সব বাজে কথা….তবে আমি তখন যাই বলি না কেন সেই হলো ঝামেলার শুরু… 
রূপকুমার চঞ্চল একটু একটু করে বড়ো হতে লাগলো আর আমাকে ও তাকে রোজ ঘুম পাড়ানোর সময় নিত্য নতুন সব পদ্ধতি খুঁজতে হলো যেমন গান বা বাঁশী শোনানো…রেকর্ডারে টেপ বাজিয়ে সেতার ও পদ্মবিভূষণ বিসমিল্লা খাঁয়ের শানাই বাজিয়ে তাকে শোনানো … 
এইভাবেই আমি হাইস্কুল পাশ করলুম তবে অতি কষ্টে আর তখন ছেলে সবে চার বছরের হয়েছে আর সে স্কুলে ও ভর্তি হয়েছে আর তখন দেখি যে ছেলেটা আমাকে আর ছাড়তেই চায় না এক মিনিট ও…..যতোই আমি ভাবি যে এইবার ঠিক রাগ করবো আর ভীষণ বকে দেব ছেলেটাকে কিন্তু কিছুই যে ছাই করে উঠতেই পারি না আমি কেননা চঞ্চলের অপরূপ সুন্দর মুখের মিষ্টি হাসি দেখলেই যে সবকিছুই ভূলে যাই আর ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরি…নাঃ…বেশী আদর করা তো ভালো নয় ছোট বাচ্ছাদের কিন্তু কি যে করি? আর সে তো দেখি নিজের মায়ের ধারে কাছে ও ঘেঁষতেই চায় না…..
বেশ মুশ্কিলই হলো তখন আমার…কি যে করি? শেষে কি বাথরুমে গিয়ে চান করবার সময়ে ও ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে না কি? উঃ..জ্বালাতন আর কাকে বলে বলো তো?…
যখন ছেলেটার বয়স ছয় বছর তখন আমি ইন্টার পাশ করলুম তবে সে ও কোনমতে সেকেন্ড ডিভিশনে… 
আমার দু দু’টো ফাইনাল পরীক্ষার দফা রফা হলো কেননা ছেলে ল্কুলে ভর্তি হতে তখন তাকে ঘরে পড়ানোর ঝামেলা ও বাড়লো আমার আর সেই সাথে শুরু হলো তার রাতে ঘুমোনোর আগে গল্প শোনার বায়না…
এখন তো সেই গল্প বলবারও শোনবার ব্যবস্থাও ইন্টারনেটের কল্যাণে গয়ং গচ্ছ হচ্ছে কেননা বাচ্ছারা এখন অনেক কিছুই জেনে শিখে পড়ে একেবারে সবজান্তা ফটিকচাঁদ হয়ে উঠেছে…আমি মধ্যে বেশ কিছুদিন ছেলেকে গোপাল ভাঁড়ের মজার গল্প শোনাতে শুরু করেছিলুম আর চঞ্চলের ও খুব পছন্দ হয়ে গেছিলো তবে ওই যে আধুনিক টেকনোলজির উৎপাত… 
ছেলেটা এক রবিবার সকালে বসে মোবাইলের ইয়ুটিউবে হাসির রাজা জ্ঞানের রাজা রসিক রাজা গোপাল ভাঁড়ের সব কার্টুন এপিসোডগুলো দেখে ফেললো আর আমি কোন গল্প বলতে গেলেই তখন বলে ওঠা শুরু করলো-‘ না…এই গল্পে তো হবেই না..ও কাকু … এটা তো আমি জানি … তুমি অন্য গল্প বলো …হিঃ হিঃ হিঃ…’
কি যে গেরো না আমার সে আর কি বলি আমি তাই বলো ।
আর আজকে তো আমি এই বারো বছরের চাঁদের টুকরো পরী ছেলেটার কাছে একদম জব্দ হয়ে গেলাম কেননা ছেলে বলে বসলো –‘কাকু … শুধু যে চার্চিল সাহেবই শব্দের খেলায় ও কথার মারপ্যাঁচে অর্থকে অনর্থ করে ছাড়তে পারতেন তাই তো নয়…আমাদের এই বাংলার গোপাল ভাঁড় ও তো তাই করতে পারতেন আর সেটা তিনি করতেন আজ থেকে সাড়ে তিনশো বছর আগে যখন গরিবদের জন্য তেমন শিক্ষাব্যবস্থা ও এই দেশে ছিলো না সেই মুসলমানের আমলে…নইলে কেউ অমাবস্যার চাঁদ ও দেখাতে পারে কি আর অমাবস্যার আকাশের চাঁদ দেখাবার সাথে তার প্রভেদ ও বলতে পারে কি? ও কাকু… আজ তুমি আমাকে এমন একটা গোপাল ভাঁড়ের গল্প বলো যাতে এইরকম কথার মারপ্যাঁচ আছে আর আমি সেই গল্পটা জানি না… যদি বলতে পারো তবে আমি তোমাকে ঠিক পুরস্কার দেবো কাকু..’
‘তা সেই পুরস্কারটা কি আগে শুনি আমি…একটা মিষ্টি হামি তো?…’
‘এই যাঃ কাকু…তুমি যেন কি…আমি এখন বড়ো হয়েছি কি না? তোমাকে আমি অন্য পুরষ্কার দেবো মানে কাল থেকে একমাস রোজ আমিই তোমাকে একটা করে মজার গল্প শোনাবো কাকু…চ্যালেঞ্জ…বলো পারবে?’ 
ওরে বাবা…সর্বনাশ…এইবার সেরেছে…আমি কই কম্ম কাবার.. 
সেদিনের সেই কচি বাচ্ছা ছেলেটা যে রোজ আমি তাকে কোলে নিলেই সে দিব্যি করে আমার সব জামা টামা ভিজিয়ে একসা করে দিতো সে আজ আমাকেই কি না চ্যালেঞ্জ করছে…ইসসস..নাঃ…এটা আমারই দেখছি ভূলে হয়েছে…..কি দরকার ছিলো চঞ্চলকে সে দিন চার্চিলের সেই বিশ্ববিখ্যাত উক্তির গল্প শোনাবার যাতে তিনি বলেছিলেন…‘this is not the end..it is not even the beginning of the end.. this is perhaps the end of the beginning…’
ছেলেটা তার সাথে দিব্যি করে গোপাল ভাঁড়ের অমাবস্যার চাঁদ দেখানোর গল্পকে জুড়ে দিয়ে আমাকে বেশ প্যাঁচে ফেলে দিয়েছে দেখছি…নাঃ…এই ছেলে ও মনে হয় যে মোটেই সাধারণ নয়…হয়তো বাদলের মতনই জিনিয়াস স্তরের আই কিউ নিয়ে এই ছেলে ও জন্মেছে… তাই এই ছেলেকে সামলানো কোন সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তির কারো পক্ষেই সম্ভব কাজ নয় তাই মুখে শুধুই বললুম… ‘হুঁ…’
‘বেশ তো কাকু…তবে বলো…’
‘তা আমি ইচ্ছে করলে তো বলতেই পারি…সে আর এমন কি কঠিন কাজ? তবে আমার কিন্তু একটা শর্ত আছে চঞ্চল…আজ তুমি রোজকার মতন এই সোফায় বসে সেই গল্প শুনতে পাবে না কেননা সারা দিন ইয়ুনিভার্সিটিতে ক্লাশকরে আর স্পোটর্সয়ের প্র্যাক্টিসের ঝামেলার পরে রাতে পেট ভরে খেয়ে উঠে এখনই যে আমার বেশ ঘুম পেয়ে যাচ্ছে…তার কি হয় শুনি? …’ 
‘যাঃ…তবে কি আমি গিয়ে বিছানায় শুয়ে তখন তোমার গল্প শুনবো?…ও কাকু… নাঃ.. সে হবে না কেননা আমি ও তো তখন ঘুমিয়েই পড়বো…’
‘বেশ..সে তবে আর এখন কি করা? থাক…বাদ দাও ও সব এখন…’ 
‘না না..সে হবেই না..এ তোমার কিন্তু ভারী দুষ্টুমী কাকু…’
‘তা হোক দুষ্টুমী….তবে একটা উপায় হয়তো আছে…’
‘কি? কি কাকু?’
‘নাঃ থাক…সে তুমি করতেই পারবে না…’
‘আমি ঠিক পারবো কাকু…তুমি একবার বলেই দেখো না কাকু…’
তুমি সত্যি বলছো তো চঞ্চল..?’
‘সত্যি…সত্যি…সত্যি..এই তিন সত্যি…’
‘তবে শোন…বেশী কিছুই করতে হবে না তোমাকে চঞ্চল…শুধু এখন তুমি যদি সেই ছোট্টবেলার মতন করে তোমার একটা পুরণো দুধের বোতল নিজে গিয়ে খুঁজে ধুয়ে টুয়ে আনতে পারো আর তাইতে দুধ ভরে এনে মুখে নিয়ে দুধ খেতে পারো তবে না হয় আমি তোমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পায়চারী করতে করতে গল্পটা আমি শোনাতে ও পারি চঞ্চল……’ 
‘ও মা…ছিঃ কাকু…এখন একটা এতো বড়ো ছেলে হয়ে আজ আমি একটা এক বছরের বাচ্ছা ছেলের মতন করে বোতল থেকে দুধ খাবো আর তোমার কাঁধে উঠবো?...যাঃ…আর তাও দুধের বোতল মুখে নিয়ে…ওঃ…কাকু ..তুমি না সত্যিই দেখছি যে ভয়ানক দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো দিন কে দিন…..নাঃ…একদম তুমি দুষ্টুমী করবে না বলছি…’ 
‘তবে আর কি? এইজন্যেই তো আগেই আমি বলেছিলাম যে তুমি পারবেই না…কি আর করা যাবে বলো? তাই আজ তোমার গল্প শোনা থাক না হয়…’
‘না…সেটি হবে না..কাকু…এখন তুমি যা চাইবে আমি তাই করবো কাকু…কেননা আমি তো গোপাল ভাঁড়ের সব গল্পই জানি আর তাই তুমি গো হারা হারতে বাধ্য কাকু আর তাই গল্পটা তো শুনতেই হবে আমাকে এখন নইলে তুমি না আমি কে যে জিতবে তাই তো বলা যাবে না … তা তুমি তৈরী তো কাকু?’ 
‘কি…কি বললে চঞ্চল তুমি? এখন আমি যা চাইবো তুমি তাই করবে? ওঃ… মার্ভেলাস ক্লু ইনডিড…মার দিয়া কেল্লা…আমার গল্প রেডী আর তার নাম ও দিলাম আপনি যা চাইবেন……’
চঞ্চল যেন বেশ হতাশ হয়েছে সেইভাব দেখাতে মুখের এক অপরূপ সুন্দর ভঙ্গিমা করলো আর নিজের দুটো দুধসাদা হাতের গোলাপী পাতা উল্টে ধরে বললো-‘ওরে বাবা… আমি আবার কখন কি ক্লু বলে ফেললুম?...নাঃ..কাকু ও দেখছি বাদলের সমগোত্র ছেলে একটা …কথা বোঝে কার সাধ্য…উঃ ….নইলে এই বয়সেই বাদল ভূগোল বইয়ে ছাপা ছবির ভূল ধরতে পারে আর বৃহৎ জোয়ারের ছবি দেখিয়ে বলে–‘স্যার, এই ছবিতে তো জোয়ার ভাঁটা দেখাবার জন্য জলমন্ডলকে বায়ুমন্ডল করে ভূগোলকের ওপরে আঁকা হয়েছে দেখছি…এখন আপনি আমাকে বুঝিয়ে দিন যে জোয়ার কি বায়ুমন্ডলেই হয়?...’
‘হুঁ…ক্লু তো দিয়েছোই আমাকে তুমি…’
‘বেশ কাকু…এখনই আমি আমার এই দামী শার্ট প্যান্টগুলো সব খুলে রেখে দিয়ে বোতলে করে দুধ নিয়ে চলে আসছি কেননা আমাকে তো রাতে তুমি এখন ও এক গ্লাশ দুধ খাইয়ে তবে ছাড়ো রোজ আর আজ সেটা না হয় আমি বোতলে করেই খাবো কেননা আমি তো এখনো তোমার কাছে সেই দুধের শিশুই আছি…যাঃ..কাকু সত্যি তুমি যেন কি?’
একটু পরেই ছেলে তৈরী হয়ে এসে বললো-‘হয়েছে কাকু…এই নাও কাকু তোমার ছেলে রেডী…’
শুধু একটা সরু নীল জাঙিয়া আর পাতলা স্লিভলেস গোলাপী গেঞ্জী পরা চঞ্চলকে জড়িয়ে ধরে তার নরম গালে পরপর দুটো চুমু খেয়ে নিলুম আমি আগে আর তারপরে তখনই তার গলায় নিজের গলা থেকে মোটা চকচকে সোনার চেনটা খুলে পরিয়ে দিলুম…
‘আরেঃ…এ আবার কি কাকু?’
আমি উত্তর  দিলুম না.. এগিয়ে গিয়ে গোদরেজের আলমারির লকারটা খুলে একটা আসল সোনার জরির কাজ করা বেনারসির লাল চেলির পাতলা উত্তরীয় দুটো সোনার চওড়া রিস্ট ব্যান্ড ও লকেটওয়ালা সোনার হেয়ার চেন আর একটা সোনার তৈরী হেয়ার বো…আমার রূপসী বৌদির এই সব দামী জিনিষ ও অলঙ্কারগুলো বের করে আনলুম…
তাই দেখে চঞ্চল বললো-‘আরে যাঃ…এসব আবার কি করছো কাকু? আমি কি একটা মেয়ে?’
‘হুঁ…তুমি আমার ছেলে ও আর মেয়ে ও মানে সবকিছুই জানোই তো আর সেটা মানতে হলে বালক কৃষ্ণঠাকুরকে যে ভাবে মা যশোদা সাজাতেন তা দেখলে তো তাকে ও মেয়ে বলে মানতেই হয়….তুমি আমার একটা শ্বেতকৃষ্ণ ঠাকুর…’
‘ওঃ কাকু…তুমি যে কি সব বলো আর করো না…তোমাকে নিয়ে আর তো পারাই যায় না দেখি…যাঃ…তুমি যেন কি? উঃ…আজ আমাকে শেষে একটা মেয়ে বানিয়ে দিয়ে তবে ছাড়লে? আমি কি চাইল্ড…না কিড…না টুইন..তাই বলো তো কাকু’
‘সে যাই হই আমি..তবে এখন আমার খুব আনন্দ হয়েছে তো তাই কোন কথাই শুনবো না তোমার…তবে তুমি ৫ বছর অবধি ছিলে চাইল্ড…এখন তুমি তা নেই …৮ বছর বয়স অবধি তুমি ছিলে কিড…এখন তো তুমি তা ও নও আর ১২ বছর অবধি তুমি ছিলে টুইন বা tween তবে এখন আর তুমি তা ও নেই..তাই এখন তুমি হচ্ছো একটি teen তবে লোকে টিন বলতে বোঝে tin বা ক্যানেস্তারা বা যেমন tween বা প্রিঅ্যাডোলেসেন্টকে ভাবে twin বা যমজ,,,এই আর কি…সে যাক তুমি এখন আমার কাছে চলে এসো…’
‘হুঁ…আমি তবে লোকের মতে হচ্ছি একটি ক্যানেস্তারা? যাঃ…সত্যি কাকু তুমি না পারো ও বটে কিন্তু কাকু..তোমার এতো আনন্দের কারণটা যে কি তাই তো আমি ছাই বুঝছি না তবে বাদল এখন এইখানে থাকলে সে ঠিক বুঝতেই পারতো…’
প্রথমে আমি দুধবরণ পরী ছেলেটাকে তার নরম চকচকে হাত ধরে কাছে টেনে এনে সোনার রিস্টব্যান্ড দুটো এক এক করে তার দুই কব্জির ওপরে পরিয়ে আটকে দিলুম আর মাথার চুলে পৌনে এক ইঞ্চি চওড়া সোনার বো টাকে পরালুম আর তার ভেতর দিয়ে টেনে এনে টিকলির মতন লকেটটা ছেলের কপালের ঠিক মাঝখানে রেখে তার চেনটাকে তার মাথার অল্প কুঞ্চিত রেশমের মতন নরম কালো চুলের সিঁথির ওপর দিয়ে টেনে এনে চঞ্চলের কপাল বেষ্টন করে মেখলার মতন পরিয়ে দিয়ে গায়ে লাল চেলির ঝকঝকে রেশমী উত্তরীয়টা জড়িয়ে দিলুম আর সেই সুসজ্জিত পরী ছেলেটার বগলে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে জোরে একটান দিয়ে তাকে একটা চার পাঁচ বছরের শিশুর মতন করে নিজের কোলে তূলে নিয়ে বললুম-‘এইবার একটু দুধ খাও তো আমার শ্বেতকৃষ্ণ ঠাকুর আর গল্পটা শুনে বলো যে কে জিতলো তোমার এই চ্যালেঞ্জ….’
চঞ্চল নিজের এই মেয়েদের মতন স্বর্ণিভ সাজসজ্জা দেখে খিল খিল করে ঠিক জলতরঙ্গের রিনরিণে সুরে হেসে উঠলো আর পরক্ষণেই এক অনবদ্য স্টাইলে নিজের চকচকে সোনার রিস্টব্যান্ড পরা হাত দুটোকে বেশ হতাশার ভঙ্গিতে ঘুরিয়ে এনে হাতের গোলাপী পাতা দু’টোকে উল্টে ধরলো আর নিজের হাল্কা করে মহার্ঘ মধ্যপ্রাচ্যের সুরমা পরানো কান অবধি টানা টানা কালো চোখ দুটোকে আরো বড়ো বড়ো করে তুললো আর চোখের কালো পাতাগুলোকে টপাটপ করে পাঁচ ছয় বার খুলতে আর বন্ধ করতে লাগলো ও শেষে নিজের ঠিক যেন তুলি দিয়ে আঁকা সরু ভ্রুদু’টো ধনুকের মতন করে বেঁকিয়ে নিয়ে পাতলা লাল ঠোঁট দুটোকে উল্টে মুখে শুধু গোপাল ভাঁড়ের নকল করে বললো-‘অগত্যা…’
আমি তার এই একটা মাত্র শব্দ আর হাবভাব দিয়ে অনেক কিছু কথা বলে ফেলবার কায়দা দেখে মনে মনে বুঝে নিলুম যে এই বাচ্ছা ছেলেটার বুদ্ধিবৃত্তি শুধু জিনিয়াস স্তরেরই নয় হাইলি ক্রিয়েটিভ ট্যালেন্টযু্ক্ত ও বটে আর সৎবুদ্ধি তো ইর্ষা করে না …অন্যকে স্বীকৃতি দিয়ে নিজেকে নগন্য করতে চায় যেমন ভালোবাসা কখনো কিছুই নিতে চায় নাা…নিজের সব কিছুই দিয়ে দিতে চায় তবে আজকের এই অতিআধুনিক আর স্বার্থ সর্বস্ব যুগে এই সব গুণ বা ট্যালেন্ট বা মানসিকতা দুর্লভ…এই যা..
তাই এই ছেলেটার সব জন্মজাত এক্সপেরিমেন্টাল বিহেভিয়ার বৌদিকে সেই কচি বয়সেই একেবারে নাচিয়েই শুধু নয় কাঁদিয়ে ও ছাড়তো কেননা এইসব ইন্টেলিজেন্টিক ক্রিয়েটিভ ট্যালেন্টেড বাচ্ছাদের দুনিয়াটাই হয় সাধারণের চেয়ে একেবারেই আলাদা মানে অন্যরকম আর তাই তাদের সব ক্রিয়াকলাপ কথাবার্তা হাবভাব ব্যবহার সব কিছু বুঝে নিয়ে তাকে সামলানো ও হয় সাধারণের পক্ষে এক দুঃসাধ্য ব্যাপার… এই আর কি…
তাই আমি একটু হেসে ফেলে ধীরে করে শুধু বললুম-‘ খুদা যব হুস্ন দেতা হ্যায়…তব নজাকত আ হি যাতি হ্যায়…’
‘তার মানে কাকু?’ 
‘মানে হলো…তারিফ করুঁ ক্যা উনকী…জিসনে তুম্হে বনায়া…’
‘ওঃ…কাকু…তুমি ও না একদম…যাঃ…তবে তোমার সংকেত আমি বেশ বুঝে গেছি তাই এখন আমার স্টাইল আর রূপের এই সব বাজে প্রসংশা করা ছাড়ো তো আর গল্পটা বলো…’
‘ছাড়া তো এখন তোমাকে আর যাবে না চঞ্চল..তাহলেই তুমি ধপাস…তবে এই কথা শুনলেই তোমার মা বলবে বাঁদর ছেলেকে নিয়ে এই সব যতো বাজে আদিখ্যেতা দেখে আর বাঁচি না… তাই ও সব কিছু না..তুমি আগে গল্পটা শোন…’
‘সে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগেকার কথা চঞ্চল…… তখন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে বাংলার স্বাধীন পাঠান নবাব আলি বর্দী খাঁয়ের আর করদ রাজ্য কৃষ্ণনগরে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের শাসন কাল চলছে যাঁর বিখ্যাত সভাসদ ছিলেন স্বনামধন্য গোপাল চন্দ্র পরামাণিক বা প্রামাণিক ওরফে গোপাল ভাঁড়…’ 
আমি গল্প শুরু করলুম আর পরী ছেলে চঞ্চল তার রূপোজ্জ্বল চাঁদের মতন মুখটা তুলে সাগ্রহে নিজের দুই মসৃণ নরম আর দুধবরণ মরাল বাহু দিয়ে আমার গলা আর দুই ঝকঝকে মসৃণ নরম ঊরু ও পা দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলো পড়ে যাবার ভয়ে কেননা আমি তখন শুধু বাঁ হাত দিয়ে অতো বড়ো ছেলেটার কোমরের নীচে পেছনটা শুধু ধরে রেখেছিলাম ও ডানহাত দিয়ে অবিভক্ত বাংলার একটা পুরণো ম্যাপের কাছে গিয়ে ছেলেকে বাংলা বিহার উড়িষ্যার বিশাল রাজ্যের মধ্যে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দুটো জায়গা দেখাচ্ছিলাম … 
‘একদিন নবাবের ভরা দরবারে এক নকাব পরা সদ্যবিধবা এক বড়ো শেঠানী এসে হাজির হলেন আর কুর্ণিস করে দাঁড়াতেই নবাব জানতে চাইলেন-‘মোহতরমা… তোমার কি কোন ফরিয়াদ আছে?’ 
‘জী জাঁহাপনা…’ 
‘বেশ বলো…’ 
‘আমার এই নোকরাণিকে বলতে ইজাজত দিন আলমপনাহ… আমি বড়োই অসুস্থ আর শোকাহত… তাই এই গোস্তাকি মাফ হয় হুজুর…’ 
‘বেশ…তবে না হয় তুমিই বলো…’
‘জী হুজুর… আমি নাসরিন… বহুত দিন আমি এই শেঠানিজীর খিদমত ও তদবির করছি … শেঠ সাহেব বড়ো ভালো ইন্সান ছিলেন … বহুত নেক ও রহমদিল খুদাপরস্ত বান্দা ছিলেন জাঁহাপনা… যে কোন গরীব অসহায় লোককে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন বিনা সুদে বা নামমাত্র সুদে … কখনো তো জমানত বা বন্ধক ও না রেখেই টাকা দিতেন … তা ভালো লোক তো আল্লাহের খুব প্রিয়পাত্র হয় তাই তারা বেশীদিন এই নফরত আর গুনাহের দুনিয়ায় থাকেন না আর তাই হঠাৎ মাস দুই আগে অপুত্রক শেঠজির ও এন্তেকাল হয়ে গেলো জাঁহাপনা আর আমাদের মাথায় আসমান ভেঙে পড়লো জাঁহাপনা… শেঠানিজী তো অতি শোকে পাথর হয়ে গেলেন একেবারেই…’
‘বহুত আফশোষ কি বাত তবে সবই আল্লাহ পাকের মর্জি…’
‘তা তো বটেই জাঁহাপনা… খোদার মর্জির ওপরে তো আর কারো কোন খোদকারী মানে কায়দা চলে না… তবে তখন শেঠজির বহুত টাকা বাজারে ছড়ানো রয়েছে …সব সুদে খাটছে … বহি খাতা সব ছিলো বটে টাকার হিসেবের কিন্তু তা থাকলে ও কে সে সব দেখে আর সময় মতন গিয়ে তাগাদা করে আদায়পত্র করে আনেই বা কে? এক শেঠানিজী নিজে পারেন আদায় করতে কেননা তখন তো তিনিই মালকিন আর নইলে ওনার একটা ছেলে থাকলে তো আর কোন কথাই ছিলো না …সেই সব করতে পারতো…’
এই বলে আমি একটু থামলুম আর চঞ্চলের অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলুম…
তাই দেখে চঞ্চল হেসে ফেললো খিল খিল করে আর বললো-‘ওঃ কাকু..আমি তোমার সব ইসারা বুঝতে পেরেছি তবে আমাকে ও সব ছেলে টেলে বলা এখন ছাড়ো তুমি আর বলো তখন কি হলো আর এর মধ্যে গোপাল ভাঁড়ই বা কোথায়? ও কাকু…’
‘সে আসবে ঠিক সময় হলেই…এখনো তাহার সময় আসেনি…’
‘তবে যেমন বলে চলেছো …তাই বলো তুমি… কাকু..’
বলছি-‘তা সে ছেলেও তো নেই আর তাই তখন একজন বিশ্বাসী লোক তো চাই তবে সে আর কে খুঁজছে বলুন জাঁহাপনা..শেঠানিজী তো শোকে তাপে অসুস্থ হয়ে পড়লেন … তবে ভাগ্য ভালো তাই একদিন শেঠজির একজন পুরনো নফর খবর পেয়ে নিজে থেকেই এসে হাজির হলো আর বললো শেঠানিজী… আপনি কোন চিন্তা করবেন না …আমি শেঠজির পাই পয়সাটি অবধি সব টাকা আদায় করে আনবো তিন মাসের মধ্যে তবে বহুত দৌড় ধুপ করতে হবে আর সে জন্য এক দু’মহিনা বেশী সময় ও লাগতেই পারে তবে যতো দিনই লাগে সে লাগবে আর যতো যা খরচা হবে সে সব ও আমার হবে … সে সব কিছুই আপনাকে ভাবতে হবে না.. আমি বহিখাতা দেখে হিসাব মিলিয়ে দেব আর সে আপনি তখন যাকে দিয়ে হয় দেখিয়ে বুঝে আর মিলিয়ে নেবেন শেঠানিজী তবে শুধু একটা কথা আপনাকে আজ এখনই সকলের সামনে বলতে হবে যে আদায়পত্রের থেকে আপনাকে কি দিতে হবে?’ 
তখন তো শেঠানিজির মাথার ঠিকই ছিলো না তাই কোনমতে বললেন-‘সে আপনি নিজে যা চাইবেন তাই আমাকে দেবেন…ব্যস…’
এই শুনেই চঞ্চল নিজের চোখ দুটোকে আরো বড়ো বড়ো করে বললো-‘ওঃ… এইবার আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি যে তোমার অতো আনন্দের কারণ কি? তবে তুমি না কাকু সত্যিই বাদলের চেয়ে ও জিনিয়াস ছেলে একটা আর তাই তুমি আমার একটা কথাতেই একটা গল্প তৈরী করে ফেললে কাকু? ওঃ…মনে হয় আজ আমি জিততে পারবো না…তবে তা না পারলে ও আমার কোনই দুঃখ থাকবে না…আমি হারলেই বা কি? তোমার কাছে আমি তো সবসময়  হারতেই পারি কাকু… তাতে আর আমার কিসের লজ্জা বলো?… আচ্ছা..তুমি গল্পটা বলো কাকু…’
‘তখন আর কি? সেই নফর মাণিকচাঁদ কাজে লেগে গেলো সেই দিন থেকেই আর চার মাসের মধ্যে সে সব টাকা ঠিক আদায় করে ও আনলো… তবে হুজুর… কি আর বলি বলুন? জাঁহাপনা… লোকটার নিয়ত ঠিক বদলে গেলো তখন… তাই সে সেই পাঁচ লাখ টাকা দেখে করলো কি যে শেঠানিজিকে সব দেখিয়ে হিসেব বুঝিয়ে দিলো আর তার হাতে মাত্র একলাখ টাকা দিলো আর চার লাখ টাকা নিজের জেবে পুরে নিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলো… শুধু এই বললো যে আমি আপনাকে এই টাকাই দিতে চাই শর্তমতন…’
‘এখন আমাদের ফরিয়াদ এই যে শেঠানিজিকে ঠকানো হয়েছে সুযোগ বুঝে হুজুর… তাই আমরা হুজুরের কাছে ইন্সাফ চাই কেননা শতকরা আশী ভাগ টাকা কখনো কারো মেহনতানা তো হতেই পারে না হুজুর…আপনিই ইন্সাফ করুন দীন দুনিয়ার মালিক…’
‘তা তোমরা কাজির কাছে আগে তো যাবে… তা সে যাও নি কেন? ‘ 
‘হুজুর…গেছিলাম তো হুজুর… তবে তিনি সবকিছু শুনে … হো.. হো.. করে হাসলেন আর বললেন যে নফর তো শর্তমতনই কাজ করেছে আর তাই এতে আমি তার কোনোই গলতী বা নাইন্সাফী তো দেখতেই পাচ্ছি না তাই তোমার আর্জি খারিজ করা হলো …’
‘তাই শেষে বাধ্য হয়ে হুজুরের দরবারে আসতে হলো…এই গোস্তাকি মাফ হয় হুজুর..’
‘হুম…তা উজির সাহেব… সব তো তুমি ও শুনলে…এখন তুমিই বলো এই ব্যাপারের কি ফয়সলা করা যায় …’
উজির চুপ…..মাথা নীচু…
তাই দেখে নবাব বললেন-‘কোতোয়াল…তুমি বলো …’
কোতোয়ালের মুখে ও আর কথা নেই দেখে বেশ বিরক্ত হয়ে নবাব বললেন-‘আচ্ছা নাজির…তুমি?’ 
সে ও নির্বাক দেখে নবাব বিষম বিরক্ত হয়ে বললেন-‘তা বেশ মোহতরমা…তোমরা কাল সকালে একবার আমার দরবারে চলে আসতে পারো…আজ আমরা একটু ভেবে দেখতে চাই যে তোমাকে কোন উপায়ে ইন্সাফ দেওয়াতে পারা সম্ভব…’
‘যো হুকুম জাঁহাপনা…’
তারা পিছনে হেঁটে কুর্ণিস করতে করতে চলে গেলো আর নবাব বললেন-‘এই দরবারে কারো কি কিছু এই বিষয়ে পেশকষ করবার মানে বলবার আছে?’
সবাই তখন ঢকঢক করে দু’পাশে মাথা নাড়লো আর তাই দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে নবাব বললেন-‘আজ দরবার এখানেই বরখাস্ত করা হলো…’
এই বলে তিনি উঠে চলে গেলেন… 
‘তা এইবার চঞ্চল… তুমিই বলো তো বাপু…নবাবের উজির কোতোয়াল নাজির … কেউ তো পারলেন না ইন্সাফ করতে…..তুমি পারবে?’
‘ওঃ…কাকু..তুমি কি আমাকে বাদল ভেবেছো যে এই জটিল সমস্যার সমাধান আমাকে করতে বলছো? আমি তো একটা গাধা ছেলে কাকু… বাপী তো সবসময় আমাকে তাই বলে তুমি শোননি? আমি কোন ছার কাকু…স্বয়ং সুপ্রীম কোর্টের বিচারকের পক্ষে ও এর কোনোই ইন্সাফ করা সম্ভব নয় কেননা সাক্ষী শর্ত সবই যে বিপক্ষে আর তার ব্যবস্থা ও…’
বিরক্ত হয়ে আমি বললুম-‘আরে.গেলো যা…যতো সব বাজে কথা রাতদুপুরে…’
‘আচ্ছা বেশ কাকু … তুমি আমাকে যতোটা বুদ্ধিমান ছেলে বলে মনে করো না কেন কাকু আসলে আমি যে কি সেটা তো এখন নিজেই দেখতে পেলে…আর তাই আমি তো এখন ডাহা ফেল তবে তখন কি হলো সেটা তো বলো… ও কাকু..’
‘সে আর আমি কি বলবো আবার? তবে শুধু তুমি কেন…কাজীসাহেবের সাথে তামাম বাংলার নবাব আর তাঁর সব সভাসদ ও তো ফেল হয়েছিলেন… তা নবাব তো তখনি সেই দরবারের সব কথাই ভূলে গেলেন আর শাহী খানাপিনা নাচগান আর মজলিসে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তবে পরদিন যেই দরবার শুরু হলো আর তখনই সেই শেঠানী ও এসে আভূমি নত হয়ে কুর্ণিস করতে লাগলেন আর তখন তাই দেখে নবাবের চক্ষু চড়ক গাছে উঠে গেলো সাঁৎ করে… এখন কি উপায় হয়? রাতের শরাবের নেশার ঘোর ছুটে গেলো নবাবের আর তাই বেশ খানিকক্ষণ নিজের দাড়ী ধরে বিষম টানাটানি করতে শুরু করলেন সেই বিশাল বাংলার দন্ডমুন্ডের কর্তা নবাব আর শেষে গোটা দশেক দাড়িই উপড়ে ফেললেন আর উঃ… উঃ… গেলো.. গেলো রে গেলো…করে উঠলেন..
‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…হিঃ…হিঃ…..’
শেষে ব্যাজার মুখে বললেন-‘তা শোন মোহতরমা, আজ আমি…এই কি যে বলে ছাই…ওঃ…হ্যাঁ…এই…মানে আমার রাজকীয় শাসনকার্যে যে.. ভীষণ ব্যস্ত হয়ে আছি আর তাই তোমাকে সময় দিতেই পারছি না…কি যে করি?,,,তবে কোই বাত নেহী…তোমাদের আমি একশো আশর্ফি আর পালকিও খোলা ঘোড়ার জুড়ি গাড়ী সব দিচ্ছি …তোমরা এখনি গিয়ে সেই পালকিতে উঠে বসবে আর সেই পালকিটা তোলা হবে আমার বেগবান জুড়িগাড়িতে…এখনই তোমরা সেই গাড়িতে করে কৃষ্ণনগরে চলে যাও দেখি…আমি আমার আদেশনামা ও ঘোড়ার পিঠের সওয়ার একজন দূতকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি ..মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তোমাকে ঠিক ইন্সাফ পাইয়ে দিতে পারবে…যাও…আর উজির..তুমি এখনি আমার হুকুমনামা পাঠাও…জল্দী…লেখো এই মোহতরমা যদি ফিরে এসে আমাকে বলে যে সে সত্যিই ইন্সাফ পেয়েছে তবে আমি বিচারককে নগদ দশ হাজার আশর্ফি ইনাম দেবো আর নইলে কিন্তু তাকে কোতল করবো…’
‘হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ…ও কাকু…এ আবার কি রকমের বিচার?’
‘একে বাংলায় বলা হয় যাক শত্তুর পরে পরে…’
‘হিঃ…হিঃ…হিঃ…হিঃ…তারপরে..কাকু?’
‘তা শোন… তখন আর কি? কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেই দুই মহিলা কৃষ্ণনগরে পৌঁছে গেলেন আর নিজেদের আর্জি ও পেশ করলেন…ততক্ষণে নবাবের হুকুমনামা ও এসে গেছে…সপারিষদ সব কথা শুনে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বললেন-‘হুঁ…তা মন্ত্রী, তুমি বলো তো কি ফয়সলা হতে পারে?’
মন্ত্রী ঘাড়টাড় বেশ করে খানিক চুলকে নিয়ে বললেন-‘আজ্ঞে..মহারাজ… এর আর ফয়সলা কি হবে? মহারাজ… এ তো যেমন কর্ম তেমনই ফল হয়েছে…এর পরে আর কিছু করা সম্ভব নয় …’
‘বেশ…এই যদি তোমার বিচার হয় তবে আমি তোমার এই রায় আর তোমার নাম দুটোই না হয় লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছি আর তখন নবাব তোমার গর্দানটাই নিয়ে নেবেন না হয় কচাৎ করে…যেমন তোমার বিচার…তেমন ফল…কেননা বিচার আর বিচারকের নাম দুই তো আমাকে হুকুম মতন লিখে পাঠাতেই হবে…..তাই…যত্তো সব অপদার্থ আর মাথামোটার দল…’
‘ওরে বাবা…না..না…মহারাজ…রক্ষা করুন…দয়া করে আমার নামটা আর পাঠাবেন না…’
‘তা আর পাঠাবো কেন? তবে আমার নিজের নামটাই না হয় পাঠিয়ে দেবো…তা আচ্ছা সেনাপতি…তুমি কি বলছো বলো তো…’
‘আজ্ঞে মহারাজ…আমি আর ওই সব বিচার টিচারের কি বুঝি যে বলবো? বরং সভাপন্ডিতই এর বিচার করতে পারবেন ঠিক…’
‘ওঃ…তাই বুঝি? তা সভাপন্ডিত…তুমিই তবে করো বিচার…’
‘আজ্ঞে মহারাজ…আমার মতে ও এই মহিলা নিজেরই দেওয়া শর্ত মতন ঠিক টাকাই পেয়েছেন আর এখন মিছেই বেচারা চাকরকে দোষ দিচ্ছেন …’
‘ওঃ…কি জ্বালাতন রে বাবা এই সব অপোগন্ড সভাসদদের নিয়ে হয়েছে আমার …..এরাই নাকি আমার সভার নবরত্ন…ওঃ…আমি সবকটার নাম এখনই লিখে নবাব বাহাদূরকে পাঠিয়ে দিই তবে …’
‘ওরে বাবারে…বাঁচান মহারাজ…না না…না…না…মহারাজ…এটি করবেন না…..দয়া করুন..’ 
‘তা বেশ…তবে অগতির শেষ গতি তো আমার গোপাল…তাই এখন তুমিই বলো…আরেঃ…যা চলে…গোপাল কই? সে কি আজ সভায় আসে নি এখনো?’
মন্ত্রী বললেন-‘না মহারাজ…’
‘এই খেলে এখন কচুপোড়া…কি জ্বালাতন রে বাবা…ওঃ…আমি না দেখছি যে এইসব সভাসদদের জ্বালায় এইবার ঠিক পাগল হয়ে যাবো…তা বেশ করেছে আসেনি… এখনই ডাকো তাকে…’ 
মন্ত্রী বললেন-‘প্রহরী..যাও গোপালকে ডেকে নিয়ে এসো এই সভাতে আর এখনি…’
‘যো হুকুম…’ 
এই বলে বল্লম হাতে নিয়ে প্রহরী দৌড় দিলো আর আধ ঘন্টার মধ্যে গোপাল সভাতে এসে হাজির হ’লো… 
‘মহারাজ কি আমাকে ডেকেছেন?’
‘হ্যাঁ…ডেকেছি…আগে তুমি সব কথা শোন দেখি আর তারপরে এই ঘটনা যা হয়েছে তার বিচার করো…আমি তোমাকে এই মামলার প্রধান বিচারক নিযুক্ত করলাম এখনি…মন্ত্রী, তুমি এখনি গোপালকে দেবার জন্য আমার নিয়োগপত্র তৈরী করো আর আমার সই সমেত সীল মোহরের ব্যবস্থা করো…’
তখনি তাই করা হলো আর গোপালকে প্রধান বিচারকের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ একটা মোটা নরম গদির আসনেতে বসিয়ে দেওয়া হলো….গোপাল বসে সবকিছু শুনে একটু হেসে বললো-‘ওঃ…মাত্র এই ব্যাপার শুধু…আর আমি ভাবলুম যে কি না কি হয়েছে….মহারাজ…আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে পারেন…বিচার হয়ে যাবে তবে…’
‘তবেটা আবার কি গোপাল?’
‘আমার যে সেই চাকরটিকে চাই আর সব টাকাটা ও একসাথে চাই…’
‘হুঁ.. বেশ… এই মহিলাদের তবে আমার খাস অতিথিশালায় থাকবার ব্যবস্থা করা হোক আর যখন বিচারকের সব টাকাটাও চাই তখন সেই চাকরকে টাকা সমেত পাঠিয়ে দেবার জন্য নবাবকে এখনি অনুরোধ করে পত্র পাঠানো হোক আর এই মহিলার এক লাখ টাকা ও আনিয়ে নেবার ব্যবস্থা করা হোক কেননা বিচারক সব টাকাটাই একসাথে চাই বলেছেন…কাল সকালে বাকি বিচার হবে…এখন এই সভা ভঙ্গ হলো…’ 
আর তখনি সেই আদেশ পালিত হলো…
নবাবসাহেব মহারাজের পত্র পড়ে দাড়ি চুমরে বললেন-‘এ্যাঃ…কৃষ্ণচন্দ্র দেখছি শেষে গোপালকে বিচারক নিযুক্ত করেছে আর তার নিযুক্তি পত্রের নকল ও পাঠিয়ে দিয়েছে … উঃ…মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তার অতোবড়ো গোটা নদিয়া রাজ্যে আর একটা ভালো কোন লোক পেলো না ছাই.. শেষে একটা ভাঁড়…আর সে কিনা করবে বিচার?…আরে ছোঃ…’
‘কিন্তু তার আর কি করা? কোন উপায়ই তো নেই এখন…বিচারক যেই হোক তার হুকুম বলে কথা…..সেই কথায় আছে না যে হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না তাই এখন সে হুকুম তো মানতেই হবে নইলে কাল তার বিচার করতে বড়ো বয়েই গিয়েছে…ওঃ…’ 
‘কোতোয়াল…তুমি এখনি সব টাকা সমেত সেই নফরকে ধরে আনতে যাও…আর নাজির…তুমি যাও ওই মোহতরমার বাড়ী থেকে এক লাখ টাকা ও বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে এসো আর এই মুহূর্তেই সব টাকাটা বন্দী নফরের সাথে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজধানী কৃষ্ণনগরে পাঠিয়ে দাও…’
‘চঞ্চল…আমি ও কি এই গল্পসভা এখন ভঙ্গ করতে পারি? আমার যে খুব ঘুম পাচ্ছে ভাই…’
‘একদম নয়.. এখন তো আমি ও একজন বিচারক আর আমার সভাভঙ্গের হুকুম 
নেই ..’
‘সে আবার কি? কেন?’
‘কাকু..বিচারকের হুকুম যদি মহারাজ আর গোটা অবিভক্ত বিশাল বাংলার নবাবকে ও পালন করতে হয় তবে আমার হুকুম তুমি মানবে না কেন শুনি? 
‘ওঃ…এ কি এক ছেলে হয়েছে রে বাবা? সাধে কি আর বৌদি পালিয়ে বাঁচে?’
‘তা কি আর তুমি করবে বলো কাকু…যেমন কর্ম তেমন ফল…হিঃ…হিঃ..হিঃ … আরো ছেলেকে অভ্যাস করা ও গল্প শোনবার..’
‘তা বেশ… তবে আমার এই বিচারকের তো একটা বিশেষ আসন ও থাকা চাই.. স্বয়ং মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও গোপালকে দিয়েছিলেন সেই আসন সাদরে… তা আমার এই ছোট্ট বিচারকটির সেই আসনটি কোথায় শুনি? আর আসন না থাকলে তো বিচারককে কেউ মানবেই না…’
‘কে বললো যে এই বিচারকের আসন নেই? সে তো আছেই আর দুনিয়ার সবচেয়ে বড়ো শ্রেষ্ঠ আর মূল্যবান আসনই তো রয়েছে আর সেই আসন ও তুমিই তাকে সাদরে দিয়েছো বিচারকের বহুমূল্য এই উত্তরীয় সমেত…তাই না কাকু..’
‘কই? আসন কোথায়?’
 ‘কেন? আমি কোথায় রয়েছি এখন?’
‘আমার কোলে আর কোথায়?’
‘তবে তুমিই বুঝে নাও কাকু যে ছেলের কাছে তা সে ছেলে ছোটই হোক আর বড়ো…তার মা বাবার কোলই হলো পৃথিবির সর্বশেষ্ঠ আসন …’ 
‘ওঃ…..খেয়েছে…এ আবার কি মুশ্কিল?…তবে তা না হয় হলো চঞ্চল কিন্তু আমি তো তোমার মা বাবা কিছুই নই যে….তার কি হয় শুনি…’ 
‘কে বললো নও…আমাকে মানুষ মানে বড়ো কে করেছে কাকু? আমার মা? হুঁ…তবেই হয়েছি আমি মানুষ আর জানো তো কাকু যে পালন করে সে ও হয় পিতা মানে বাবা…আর পালকপিতা ও পিতাই হয় কাকু কেননা শুধু জন্মেই তো আর একটা বাচ্ছা একদিনেই একজন বড়ো মানুষ হয়ে ওঠে না…তার পেছনে অনেক খাটতে হয়…অনেক কষ্ট করতে হয়..অনেক ত্যাগ ও করতে হয় তবে তাকে বড়ো করে তোলা যায়…প্রথমে তো অন্তত ১৮ বছর সময় লেগেই যায় তার বড় হতে..আর তারপরে ও তো সারা জীবনটাই লাগিয়ে দিতে হয় তাকে রক্ষা করতে…আমি কিন্তু সবই জানি আর বুঝি কাকু?….কি কাকু আমি ঠিক বলছি তো? 
‘ওরে বাবারে…গেছি রে…’
‘বেশ…তুমি যদি নাই মানতে চাও তবে না হয় এখন থেকে আর তোমাকে কাকু না বলে বাবা বলেই ডাকবো…তুমি তখন তো মানতে বাধ্য হবে বাবা?’
‘ওঃ ওঃ ওঃরে বাবা…না না থাক..আমার কাকু ডাকই অনেক ভালো…’
উঃ…কি যে মুশ্কিলে পড়েছি আমি এখন এই ছেলেকে নিয়ে… 
আজ আমি যে খালি হেরেই যাচ্ছি এই ছেলেটার কাছে…যে এই বয়সেই অনেক কিছু জেনে শিখে আর বুঝে ফেলেছে…এখন একে তো বিচারক বলে আমাকে মানতেই হবে কেননা নিজেই তো ছেলেকে দুধ খেতে বলেছি আর নিজেই তাকে এতো করে সাজিয়ে আর উত্তরীয় পরিয়ে নিয়ে কোলে ও তুলেছি …’
ওঃ… কি একখানা ছেলে হয়েছে রে বাবা? আমাকে তো খালি দেখি যে হারিয়েই দিয়ে তবে ছাড়ছে এখন এই বয়সেই…তবে দুঃখ এই যে লোকে শুনলে বলবে যে পুত্র আর শিষ্যের কাছে হারলে ও না কি সেই হার সবচেয়ে বড়ো জয়ের চেয়ে ও বড়ো জয় কেননা তাদের তো বাবা ও গুরুই সবকিছু হাতে ধরে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করেছে…হুঁ…জয় না ছাই…পরাজয় বা হার মানে হার আর জয় মানে হলো জিত…হেরে গেলে তখন আবার কিসের জয় আর তার আবার ভালোটিই বা কি তাই শুনি?…যত্তো সব ছেলে ভূলোনো বাজে আদিখ্যেতার কথা আর কি… 
কিন্তু এখন আমি করি কি? 
ঘুম টুম সব শিকেয় তুলে রেখে আমার এই পরী ছেলের হুকুম তামিল করা ছাড়া পথ নেই আমার আর…এখন এই সব কথা শুনে লোকে বলুক আমাকে ছেলের গোলাম…আর কি?…
তবে তাইতে ও হয়তো এই যাচ্ছেতাই সমাজে কোন দোষই হবে না কেননা শুনেছি যে জোরু কা গোলাম হওয়া না কি মোটেই ভালো কথা নয় তবে ছেলের গোলাম হলে তাকে কেউ কখনো খারাপ বলেছে বলে তো আমি ইতিহাসকালে ও শুনিনি আর সে আমার জানা ও নেই কেননা শুনেছি যে প্রথমতঃ ত্রেতাযুগের স্বয়ং মহারাজ দশরথ ও ছিলেন নিজের বড়োছেলে শ্রীরামচন্দ্রের একেবারে বশ মানে পাক্কা গোলাম আর কি…
এই সেই অযোধ্যারাজ দশরথ যিনি শনি মহারাজের মতন শুধু দৃষ্টিমাত্রেই সবকিছু ভস্ম করে দিতে পারা জবরদস্ত গ্রহরাজকে ও ব্রম্হদেবের কাছ থেকে কোন অমরত্বের বরদান প্রাপ্তি ছাড়াই একলা পরাজিত করেছিলেন আর যিনি গুরুকুলে পড়তে পাঠাবার জন্য ও আট বছরের ছেলে রামকে একমিনিট ও কিছুতেই কাছ ছাড়া করবেন না বলে ছেলের শাস্ত্র শস্ত্র ন্যায়নীতি রাজনীতি সর্বশিক্ষার জন্য সর্বপ্রথম গুরুকুলে পাঠাবার সব নিয়ম ভেঙে নস্যাৎ করে দিয়ে জোরকরে গোটা গুরুকুলকেই নিজের ঘরে তুলে এনেছিলেন… 
আর শেষমেষ তো সীতার বিয়ের আগেই রামের গলায় সীতার জয়মালা দেওয়ার পরেই তার হরণ ও রোধ করেছিলেন কিছুটি না জেনে আর না করেই কেননা সেই খবর লঙ্কাধিপতি ত্রিভুবনজয়ী আর প্রকারান্তরে অমরত্বপ্রাপ্ত রাজা রাবণ যেই শুনেছে আর এও জেনেছে যে রাম মিথিলায় শুধু লক্ষণকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে অমনি সীতাকে বিয়ের আগেই অপহরণ করে নিয়ে এসে সে নিজেই বিয়ে করবে বলে রথ সাজিয়ে নিয়ে বেরিয়ে ও পড়েছিলো তবে তখন সে শুনতে পেলো যে মহারাজ দশরথ চতুরঙ্গ সৈন্য নিয়ে ছেলের বিয়ে দিতে মিথিলায় আসছেন আর অমনি লেজ গুটিয়ে রথ নিয়ে ফেরৎ যেতে যেতে সভয়ে বলেই ফেলেছিলো–‘আরে গেলো যা…এ কি আপদ রে বাবা…আমি ও সব রাজা জনক ফনককে থোড়াই পরোয়া করি তবে…ওঃ….ওরে বাবারে……ওই এক দশরথ যে একাই একশো কেননা সে যুদ্ধে অপরাজেয়…সে অস্ত্রশস্ত্র সব সমেত পরপর দশখানা রথ তৈরী করতে পারে যুদ্ধের সময় মন্ত্রবলে আর ভয়ানক প্রাণঘাতী আর একেবারে ব্রম্হাস্ত্রের মতন অব্যর্থ শব্দভেদী বাণ ও চালাতে পারে যা আমি ও জানি না…হ্যাঃ…আর সেই বাণ মারলে তখন স্বর্গ মর্ত্য পাতাল কোথাও লুকিয়ে ও ছাই ওর হাত থেকে তো আমি পার পাবো না…আর এখন আবার সে চতুরঙ্গ সৈন্য সাজিয়ে নিয়ে আসছে…নাঃ…এখন গিয়ে তবে আর কিছুই করা যাবে না ওই আপদটা না মরলে…হোক গিয়ে তবে এখন সীতার এই ছাইয়ের বিয়ে…আমি ওসব মানলে তো…পরে একদিন গিয়ে ঠিক চুরী করে নিয়ে এসে টপ করে আবার বিয়ে করে ফেলবো ওই সীতাকে…রাম আমার কচু করবে…হ্যাঃ…’ 
আর দ্বিতীয়তঃ দ্বাপরযুগে ছিলেন নন্দরাজা…আর তিনি ও তো শুনেছি যে তাই ছিলেন মানে ছেলে অন্তপ্রাণ কেননা তাঁদের দু’জনেরই যে শ্রীরাম আর শ্রীকৃষ্ণের মতন একটা করে অপরূপ সুন্দর আর অলোকসামান্য ছেলে ছিলো…’ 
‘কাকু..ও কাকু..চুপ করে কি ভাবছো এতো বলো তো?…এখন দয়া করে গল্পটা বলা হোক..’
‘বলছি রে বাবা বলছি…তারপরের দিন যথা সময়ে রাজসভা শুরু হলো তবে গোপালই তখনো আসেনি তাই বিচার কে করে? মহারাজ সমেত সব সভাসদই বসে হাঁ করে অপেক্ষা করতে রইলেন…শেষে মহারাজ বিরক্ত হয়ে আবার সেপাই পাঠালেন আর তখন গোপালকে ও আসতেই হলো…করে কি? তখন দরবারে সবকাজ ফেলে আগে বিচার সভা বসানো হলো… 
মহারাজ বললেন-‘বিচার শুরু হোক…গোপাল…তুমি তো আজ বিচারক…তাই তোমার বিচার এখন শুরু করো…’ 
‘বেশ…সেই নফর মানে চাকরকে আমার সামনে আনা হোক…’
তৎক্ষণাৎ নাজির উঠে গেলেন আর নিজেই লোকটাকে এনে হাজির করলেন.. 
গোপাল তাকে দেখে বললো-‘ওঃ তুমিই সেই বুদ্ধিমান…তা বেশ.. তা ভালো… বুদ্ধি থাকা তো খুব ভালো কথা ভাই তবে সেই বুদ্ধির অপব্যবহার করাটা কিন্তু মোটেই ভালো কাজ নয় বাপু…সৎপথে থাকলে হয়তো কেউ তেমন লাখপতি বা রাজা উজির হয়ে ওঠে না তবে সে বিখ্যাত হয়ে যেতে পারে তা ঠিক জানবে আর খ্যাতিই তো অনন্ত জীবন কেননা আমাদের শ্লোকে তো বলাই আছে যে—চলৎচিত্তং চলৎবিত্তং চলৎজীবন যৌবনং…চলাচল মিদং সর্বে কীর্তির্যস্য সঃ জীবতি…সে যাক…তবে এখন তোমার একটু শিক্ষা হওয়া খুবই দরকার মনে হয়…’ 
‘তা বেশ…এখন একটা বড়ো পাত্রে ওর সামনে পাঁচ লাখ মোহর এনে সাজিয়ে রাখা হোক…’
তৎক্ষণাৎ নাজির চাকরের মতন ছুটে গিয়ে একটা বড়ো থালাতে থলি থেকে চকচকে সোনার মোহর ঢেলে সাজিয়ে রাখলেন….
‘এখন আর কি করতে হবে তাই বলুন আমাকে?…’ নাজির জানতে চাইলেন… 
‘বিশেষ কিছুই নয়…ওই টাকা থেকে মাত্র চল্লিশ হাজার মোহর গুনে গুনে আলাদা করে অন্য একটা থালায় তুলে পাশে রাখতে হবে…তা আপনি কি পারবেন? স্বয়ং নবাবের নাজির মানুষ বলে কথা……না আমিই গুনবো?’
‘অবশ্যই পারবো…কেননা আমার ওপরে নবাব বাদশার হুকুম আছে যে বিচারক যখন যা যা করতে বলবেন সে সব কিছুই আমাকে নিজের হাতে করতে হবে আর কি করে এই অসম্ভব ইন্সাফ করা সম্ভব হলো তার বিবরণ তাঁকে গিয়ে বিশদভাবে জানাতে ও হবে আর তা না হলে তিনি আমাকে শূলে চড়িয়ে দেবেন…’
‘তবে যাতে আপনার শূলবেদনা না হয় তাই করুন আর আমি ততক্ষণ একটু জল যদি পেতাম খেতে…ওঃ যা গরম…’
তখনি মহারাজ বললেন-‘এই কে আছিস? এখনি গিয়ে গোপালের জন্য ঠান্ডা শরবৎ নিয়ে আয় আর পাঙ্খাবরদারকে ও ডেকে আন যাতে সে এসে গোপালকে সমানে এখন হাওয়া করতে থাকে…’
তারপরে নিজের মনেই বলে ফেললেন-‘ওঃ…সে যাই হোক এখন আমার গর্দানটা বাঁচলেই আমি খুশী তবে গোপাল যে কি ভাবে আর কি করতে চাইছে তাইতো ছাতা কিছু বুঝতেই পারছি না আমি শত চেষ্টা করে আর মাথা খাটিয়ে ও…উঃ.. গোপালের বিচার বোঝা ও দেখছি এক অসম্ভব কাজ…সেই দেবাঃ ন জানন্তি কুতো মনুষ্যের…মতন ব্যাপার…ও রে বাবা..’ … 
যা হোক করে মোহর গোনা শেষ করে নাজির গলদঘর্ম হয়ে উঠে দাঁড়ালেন আর তখন গোপাল বললো-‘তা ওহে বাপু তোমার কথাটি আর একবার বলো তো দেখি যা তুমি এই কাজের শর্ত হিসেবে বলেছিলে…’
‘আজ্ঞে…..আমি তো কোনই শর্ত দিই নি…আমি শুধু ওই মালকিনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে এই কাজ শেষ করলে তখন আপনাকে কি দিতে হবে?’ 
‘মানে তুমি কি পাবে তা জানতে চাও নি একবার ও…হুঁ…..এইটাই ছিলো তোমার কথার কৌশল…তা বেশ…এখন মা জননী আপনি বলুন তো এই কথার ঠিক কি উত্তর আপনি দিয়েছিলেন? ’ 
‘কি আর বলি বলো…তখন তো শোকে দুঃখে আমার মাথার ঠিক ছিলো না তাই বলেছিলুম যে আপনি যা চাইবেন আমাকে তাই দেবেন …’ 
‘কি বাপু ? এই কথাই হয়েছিলো তো?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ…’
‘কোন ভূল নেই তো?’
‘আজ্ঞে না..’
‘তা বেশ কথা …এই কথাগুলো কলমবন্দী মানে নথিতে লেখা হোক…’ 
তৎক্ষণাৎ কলমনবিস তাই করলো… 
তখন গোপাল বললো-‘বাপু হে আমার তো বিচার করে এই মনে হলো যে তুমি মালকিনকে যে এক লাখ টাকা দিয়েছিলে তা তুমি কিন্তু খুব সরল মনে আর উদারভাবে অনেক বেশিই দিয়ে ফেলেছিলে কেননা সব টাকাই তো ডুবে গিয়েছিলো আর তুমি দিন রাত খেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই সব টাকা পাইপয়সা অবধি সমস্তই উদ্ধার করে এনেছো..আমি রাতে সব হিসেব দেখে নিয়ে তবেই কিন্তু এই কথা বলছি…আর জানো তো যে ডুবন্তধন আর গুপ্তধন যে উদ্ধার করে সে সব তারই হয় ন্যায় নীতি অনুসারে…অবশ্য রাজনীতি তা বলে না কেন না সেই মতে সব টাকাই হয় রাজার …কি? ঠিক বলছি তো আমি?’
‘অবশ্যই হুজুর…
’হুঁ.. তাই সব টাকাটা আমি আনিয়ে নিয়ে আবার ঠিকমতন দুটি ভাগে ভাগ করিয়েছি একটা ছোট ভাগে চল্লিশ হাজার আর অন্য বড়ো ভাগেতে আছে চার লক্ষ ষাট হাজার…যাতে ইন্সাফ মানে ন্যায় বিচার করা সম্ভব হয় আর কি…তবে মধ্যে আবার তোমাদের ওই যে একটা বাজে শর্তের ঝামেলা আছে তো…...তাই ইচ্ছে থাকলে ও বড়ো ভাগটা তুলে আমি তোমার হাতে দিয়ে দিতে তো পারছি না ভাই আর তাই তোমাকে একটা শেষ প্রশ্ন আমাকে করতেই হচ্ছে…তুমি বেশ ভেবে চিন্তে ঠান্ডা মাথায় উত্তর দিও কিন্তু ভাই…’
এই বলে গোপাল থেমে গেলো আর গোটা বিচার সভা সেই শেষ প্রশ্নটা শোনবার জন্যে উদ্গ্রীব হয়ে তখন একেবারে উঠে দাঁড়ালো…সূচিপতন স্তব্ধতা… 
দু’মিনিট পরে গোপাল দৃঢ়স্বরে বললো-‘বলো এখন মাণিকচাঁদ যে এই দু’টো ভাগের মধ্যে তুমি কি চাও? বলে ফেলো…
‘ওঃ হরি…..এতো সব ভনিতা করে শেষে এই প্রশ্ন…আ গেলো যা…এতে আর ভাববোই বা কি আর চিন্তাই বা করবার কি আছে? আমি বড়ো ভাগটাই চাই…’
‘ঠিক করে ভেবে বলছো তো? এখন ও সময় আছে…তুমি আবার বলো..’
‘আরে যাঃ…বললাম তো ওই বড়ো ভাগটাই আমি চাই…চাই…চাই…’
‘বেশ তবে এই কথাটা ও কলমবন্দী করা হোক আমার শেষ প্রশ্নটার সঙ্গে…’
তাই লেখা হ’লো আর তখন গোপাল বিচারকের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আর দু’হাত তুলে বললো-‘আপনারা সবাই দয়া করে বসুন আর এক মিনিট আর কলমনবিস তুমি লেখো এই বার আমার বিচারের রায়…’ 
‘যে হেতু এখানে টাকার দুটো ভাগ করে রাখা আছে আর যে হেতু শর্ত ছিলো যে মাণিকচাঁদ যা চাইবে তাই সে দেবে মানে মালকিনকে তাই দিতে হবে আর যে হেতু সে আমার শেষ ও অতি সরল প্রশ্নের উত্তরে বার বার সে বড় ভাগটাই চেয়েছে… ……….এখানে মনে রাখতে হবে যে কোন ভাগটা তুমি নিতে চাও এই প্রশ্ন কিন্তু একবার ও করাই হয়নি…তাই আমার বিচারে যে হেতু বড়ো ভাগটাই মাণিকচাঁদ চেয়েছে তাই সেটাই আমাকে শর্তানুযায়ী বাধ্য হয়েই এই মা জননীকে দিয়ে দেবার আদেশ দিতে হচ্ছে আর দ্বিতীয় ছোট ভাগটা ইচ্ছে হলে এখন মাণিকচাঁদ চাইলে নিতেই পারে আর সে না নিলে তখন রাজনীতির অনুসারে মালিকহীন এই ভাগটা নবাব বাহাদূরের প্রাপ্য হবে…’
‘অ্যাঁ…’
‘অ্যাঁ নয় হ্যাঁ…’ 
‘মহারাজ এই বিচারসভা এখন শেষ হলো…তাই এখন আমাকে আসতে আজ্ঞা দিন দয়া করে…ওফ…তবে এই গরমে ঠান্ডা শরবৎ আর পাখার হাওয়ার জন্যে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহারাজ…’
গোপালের বিচারের এই রায় শুনে সভার প্রত্যেকটি মানুষ এমনকি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও নাজির সমেত সবাই একেবারে নির্বাক হয়ে গেলেন…
আমি ও থামলুম…
চঞ্চল এক মনে এতোক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এক মনে এই গল্প শুনছিলো টান টান হয়ে তবে এইবার গোপাল ভাঁড়ের বিচারের এই অভিনব রায় শুনে সে খিল খিল করে জলতরঙ্গ সুরে হেসে উঠলো… 
‘হিঃ হিঃ হিঃ হিঃ…কি মজা…কি মজা…এইবার ঠিক ইন্সাফ হয়েছে …ইন্সাফ হয়েছে…আর তাও একেবারে শর্তমতনই…’
তারপরে চঞ্চল বেশ গম্ভীর হয়ে বললো-‘ওঃ…সত্যি কাকু…এই না হলে সে আর কিসের গোপাল ভাঁড় আর তার বিচার মানে ইন্সাফ?…আর হ্যাঁ…এখন আমার বিচারের রায় ও তো দিতেই হবে…তবে তাই দিই… 
‘যে হেতু আমার কাকু আমার দেওয়া শর্তমতন গোপাল ভাঁড়ের কথার মারপ্যাঁচের  বিশেষ সুন্দর এক গল্প বলতে পেরেছে আর যে হেতু সেই গল্পটা আমি মোটেই জানতাম না মানে আমার অজানা ছিলো তাই কাকুকে এই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো.. এখন কাকু তার পুরষ্কার সময়মতো অবশ্যই পাবে.. তবে কাকু এখন তার ছেলেকে ইচ্ছে করলে ছেড়ে দিতে পারে আর নয়তো ঘুম পেয়ে থাকলে কাকু ছেলেকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ঝুপ করে শুয়ে পড়তে ও পারে …হিঃ…হিঃ…হিঃ…হিঃ…’
   ********************************************************
০৯৪৫২০০৩২৯০ 
bhattacharyagc@redifmail.com



রচনাকাল : ১৭/২/২০২১
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 2  Canada : 35  China : 4  Hungary : 3  India : 175  Ireland : 3  Malaysia : 1  Russian Federat : 5  Saudi Arabia : 8  Sweden : 3  
Ukraine : 2  United Kingdom : 2  United States : 233  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 2  Canada : 35  China : 4  Hungary : 3  
India : 175  Ireland : 3  Malaysia : 1  Russian Federat : 5  
Saudi Arabia : 8  Sweden : 3  Ukraine : 2  United Kingdom : 2  
United States : 233  
© কিশলয় এবং জি.সি.ভট্টাচার্য কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
আদিখ্যেতা by GCBhattacharya is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৬২৮৫০০
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী