শিক্ষক বলতে এখনকার মতো নিরামিষ প্রানী না ভেবে, জাদরেল প্রানীর কথাই বেশি মনে পড়ে আমার। যাদের দাক্ষিণ্যে শরীরের আর্যাবর্ত থেকে দাক্ষিণাত্যে প্রভাব পড়তো মৌসুমী বায়ুর মতো।
সামান্য ট্যাঁফু করলেই রাম-শ্যাম-যদুদের বংশধরদের নাম মনে করে চিমটি খেতে হতো বলে বলে। তাও, আবার চরম রোমান্টিক মুডে। কি চারিত্রিক বৈপরীত্য! এ যেন ঠান্ডা মাথায় খুন! নাম ডাকার সময় ক্লাস সেভেনে শাস্তি হল কথা বলার জন্য। চুলের মুঠি ধরে দুলিয়ে দুলিয়ে মার। সাথে গান করছেন, "ফুলে ফুলে ঢোলে ঢোলে.. "!!!
কান দুটি মনে হচ্ছে বাষ্পচালিত রেল ইজ্ঞিন। ক্লাস সিক্সে জীবন বিজ্ঞান ক্লাসে দ্বিতীয় চ্যাপ্টার কলা। চাপা হাসি সবার সেই নামের বিভিন্ন সূত্র মনে করে। স্যার এসে বললেন, " বুঝেছি! কক্সিসটা বড্ড বেড়ে গেছে। মানুষকে পড়াতে এসে এখন বাঁদরের পড়াতে হবে! " বেশ কিছু বছর পর নচি দার গান, "যারে যা যা ভুলে" গানটি শুনে আজও হাসি পায়। সংস্কৃতের স্যার ছিলেন ভারী মজার মানুষ! শব্দরূপ, ধাতুরূপ এর মাধ্যমে শাস্তি দিতেন সুর করে করে। যেমন, কারোকে বেঞ্চের ওপর দাঁড়াতে বলছেন কান ধরে, " নর-নরৌ-নরাঃ। /বেঞ্চের ওপর, কান ধরে দাঁড়া।" অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে কেউ পাল্টা দিল, "সাধু-সাধুভ্যাম-সাধুভ্য। /আর কতক্ষণ দাঁড়াবো।" স্যারের জবাব, "ফলম-ফলে-ফলানি। /এখনও সময় হয়নি। " বোঝো ঠেলা!
বাংলার দিদিমণি ক্লাস নিচ্ছেন। পেছন বেঞ্চে বসে ছেলেরা ডাইনোসরদের গল্প জুড়েছে। দিদিমণি বেত উঠিয়ে ডাকছেন। বেতের নির্দেশ ডানদিকে, চোখ বাম দিকে। সবাই মারাত্মক কনফিউজড! আবিষ্কার করল সেই ক্লাসের আর্কিমিডিস! " ইউরেকা! দিদিমণি ট্যারা! " পুরস্কার জুটল কুড়িটি বেতের বাড়ি। প্লবতার সূত্রে কোন বরফটুকরো বোধহয় এমন আন্দোলিত হয় নি।
ভূগোলের স্যার, রিডিং পড়তে দিয়ে ভাতঘুম সারতো। কোন বিচ্ছু ছেলে ওমনি ডেকে উঠতো, "জাগতে রহো।" ধরফড়িয়ে উঠতেন! গোটা ক্লাসে হাসির রোল ফেঁটে পড়তো।
হেড স্যার, খাস বাঙাল। কথা না শুনলেই, বেতের বাড়ি পড়তো যেখানে-সেখানে। সাথে ওনার বিখ্যাত ডায়লগ, " মাইরা, পিঠের সাম তুইল্যা দিমু। ঘুঘু দেখসো,ব্যাটা! ঘুঘুর ফাঁদ দেখো নাই! " হাত-পা জ্বললেও নির্লজ্জের মতো দাঁত বের করা হাসিটাও ছিল ছেলেদের মধ্যে।
ইংরেজি স্যারের নাম দেওয়া হয়েছিল "বস ইন্ডিকাস!" তাঁর গলকম্বলের মতো থুতনির নীচে ফ্যাটের আধিক্য ও বসে বসে মৌরী চিবোনোর জন্য। ধরা পড়লে, ইতিহাসের মেগাস্থিনিস বাঁচিয়ে দিত শাস্তির হাত থেকে।
তবে, যাইহোক ছাত্রবেলার জীবন ও এমন সব শিক্ষকদের সান্নিধ্যে থেকে জীবনের রসবোধ যেমন বেড়েছে, তেমনি গড়ে উঠেছে জীবন বোধ। তাঁরা আজ তারা হয়ে গেছেন। হয়তো সেখানে গিয়েও মজা করছেন। এমন শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার যারা শুধু পড়ানোর ডিউটি পালন করেননি, জীবনের জীবনীশক্তিটুকু দিয়ে গড়ে গেছেন প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন-দর্শন। ওনাদের প্রত্যেককে আমার সশ্রদ্ধ প্রনাম।
রচনাকাল : ২/৯/২০২০
© কিশলয় এবং প্রসেনজিৎ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।