দুটো পা, এগোচ্ছে না, পিছচ্ছে। খালি পিছচ্ছে। গাছ সিপাই, আকাশ ঘুড়ি, উসখুসে হাওয়া মিঠাই পেয়ে বসছে ওদের। বেলা আর অবেলার গল্প জুড়ে ছোটবেলা পা ছড়িয়ে বসে আছে। আমার মাঝ বয়সী রোদ, খেলা করতে ফিরে গেছে আস্কারা পেন পেন্সিলে, ছড়াতে ছবিতে। আমার হাতেখড়ি হচ্ছে, কুচকুচে স্লেটের অমন মুখ ভার করা কালো, বাঁকাট্যাঁরা সাদা দাগে, দুধে দাঁত হাসছে। চক্কোত্তি পুরোহিত আমার খড়ি হাত ধরে ঘোরাচ্ছে আর বলছে – অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া, আর মা আমার – “এসো পড়াই, কিছু করে দেখাই” কোল পেতে মার্জিন টানছে আমার “ রুল” টানা খাতায় – এরপরে কত কি লেখা হবে ওতে – সহজ বাঙলা ব্যাকরণ, স্মার্ট ইংলিশ, কৌমুদী, “ দাঁত কপাটি” গণিত, আমাদের পরিবেশ, গুহা মানব থেকে ভাইসরয়... সাল তারিখের হাল হকিকত – যুগের পরে যুগ, অন্ত মধ্য আদি। ছোটবেলার সেই বিশ্বাস – আমার মা সব জানে। যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। আর ওই তো, বাবা ফিরছে অফিস থেকে। আয় ব্যায়, ঘাম দেয়। রোজকার রোজগার আরও চায় আর বাবা হাসিমুখে খেটে যায়। ফি বিকালে সাইকেলের রডে বসে কলোনির রাস্তা ছেড়ে সোজজা কালী পাহাড়ের মাঠে। তারপরে আমি বাবার হাত ছেড়ে দলছুট মেঘের সাথে। আমার বায়না আকাশ চায়। বাবা ডেকে নেয়। তবে আকাশে নয়, টলটলে জলে আমি বাবার আদরের নৌকা, আমাকে নিয়ে বাবা ভেসে যায়। ভেসে যেতে যেতেই আমাকে শেখায় সততা, পরিশ্রম আর অধ্যবসায়। বাবার হাতে ভালোবাসা, কখনো “ বল বল” রসগোল্লা, কখনো শুকতারা, আনন্দমেলা। ঢাকে কাঠি পড়লেই কু ঝিক ঝিক রেলগাড়ি – যেদিকে দুচোখ যায়।
খেয়াল নেই কতক্ষণ ধরে ভাবছি এসব। খেয়াল হল ধুপ ধোঁয়ায় শাঁখ বাজতে। শীতের সন্ধ্যা ঝুপ করেই নামে। নাঃ এবার যেন একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। রোদ পিঠ দুপুরের আঁচ কতক্ষণই বা থাকে। সময়ের সাথে সাথে পরিবেশ, পরিস্থিতি বদলায়। টিক টিক, টিক টিক আহ্নিক বার্ষিক। দশচক্রে ভগবান ভূত হয় তো ঋতুচক্রে প্রকৃতি অদ্ভুত। জল হাওয়া, আলো ছায়া, মনের জানলা খুলে দেয়। সেই জানলায় আলগা হয়ে কিছুতেই বলতে পারি না – শেখার কোন শেষ নাই, শেখার চেষ্টা বৃথা তাই। ওরা সবাই আমায় শেখায় – অন্ধকার রাত পেরলেই ভোর ঠিকানার আলো, জল থৈ থৈ বর্ষা কেটে শরত আকাশ ভালো। নিজের মনেই একটু হেসে ছাদের এক কোন ছেড়ে উড়ো মনের সুতো গুটবো বলে উঠেই পড়লাম এবার। টাইম লাইন আইন অমান্য করে টেনে নিয়ে গেছিল অনেকটা। ফিরে আসতে সময় লাগবে।
“ বাবা, সন্ধ্যে হয়ে গেছে, পড়াতে বসবে না?” ছেলের ডাকে ঘরে ফেরার ডাক... সাড়া দিতেই হবে। এমন বাধ্য আমিও ছিলাম। সিঁড়ি ধরে ছেলের পিছু পিছুই হুড়মুড়িয়ে নামছে আমার বারো তেরো। সেই খাকি প্যান্ট সাদা জামা, ঘণ্টা গুনে বই হৈ হৈ, টিফিন মানে ইচ্ছে ডানা। স্যার মানে রাশভারি,কখন সখন মুচকি হাসি। এক থালাতেই আদর শাসন, জানার বহর, মনকে বোঝা, এটা করো - ওটা করোনা, কমা দাঁড়ি। তবু অনেকজনের মধ্যে থেকেও একজন যেন অন্যরকম, ইংলিশ স্যার পড়া পড়ায় নিয়ম ছাড়া আব্বুলিশ। আমার সঙ্গে কি যেন একটা ছিল স্যারের। কেমন যেন নিজের মতো, হাতে ধরে শিখিয়ে দেওয়া – ভয় পাবিনা, আমি আছি। শরীর খারাপ, ক্লাস কামাই, স্যার আছে। ভুল ত্রুটি ওঠা বসা চোখে চোখে। বইমেলা, নাটক, ডিবেট, আমি আছি, স্যারের ডাকে। অল্প আঁচে কাছে টেনে নরম মাটি স্যারই নিলেন গড়ে পিঠে। বাবার মতোই একটা মানুষ, আমার পাশে, তেপান্তরের খোলা মাঠে।
“ বাবা, আজ কি পড়াবে? ল্যাংগুয়েজ?”
ছেলের ডাকে আবার খোঁজ পড়েছে আমার। শেখা আর শেখানোর সাপ সিঁড়ি হাত ধরাধরি করে দান চালবে এবার। আজকাল এমন প্রায়ই হয়, পুরনো সব শেখার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় চলতে ফিরতে, উঠতে বসতে।
“ বাবা, কাল তো শিক্ষক দিবস। আমাকে তুমি একটা কোলাজ বানিয়ে দেবে? গ্রেট টিচার্সদের?”
আমার আনমন বলল, ছেলেও একদিন বুঝবে, টিচার্সরা ছবিতে নয় বরং আমরা তাঁদের ছায়াতে...
রচনাকাল : ৩১/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সৌরীন্দ্র বেজ ( সৌরীন) কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।