তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্রl সম্ভবত মার্চ মাসের মাঝামাঝিl একদিন স্কুলে গিয়ে দেখি কিছু নতুন শিক্ষক - শিক্ষিকা এসেছেন l পরে শুনলাম, তাঁরা বি. এড এর ট্রেনিং এর জন্য এসেছিলেন l
যথারীতি ওনাদের মধ্যেই একজন ম্যাডাম, আমাদের ক্লাসে এসেছিলেন প্রথমবার l বাংলার ম্যাডাম ছিলেন উনি l নাম, সায়ন্তি বারিকl
প্রথম দিন ক্লাসে অদ্ভুতভাবে অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন আমাদের কাছ থেকে l খুবই জ্বালাতন করেছিলাম ওইদিন ওনাকে (নতুন শিক্ষক -শিক্ষিকা এলে , যেভাবে জ্বালাতন করা হয় আর কি ) l ভেবেছিলাম হয়তো আমাদের ওপর খুবই রাগ করবেন , প্রধানশিক্ষক মহাশয়ের কাছেও নালিশ জানাতে পারেন আমাদের বিরুদ্ধে l
কিন্তু ক্লাস যখন শেষ হলো, ওনার মুখে সেই হাসিটাই বিদ্যমান ছিল, যেমনটা ক্লাসে ঢোকার মুহূর্তে ছিলেন l তখন বুঝলাম অতোটাও রাগ করেন নি তিনি l নিশ্চিন্ত হলাম , নালিশটা প্রধানশিক্ষক মহাশয় অবধি যাবে না l যদিও পরের সমস্ত স্যার ম্যামকে একইরকমভাবে জ্বালাতন করায় খুবই বিরক্ত হয়েছিলেন , আবার অনেকে নালিশও জানিয়েছিলেন , আমাদের ক্লাসে , ক্লাস নিতে পারবেন না কেউ l
হ্যাঁ, স্কুলের সবথেকে খারাপ রেকর্ড ছিলো আমাদের ব্যাচের, ব্যবহারের দিক থেকে l
তা প্রতিদিনই আমরা অন্তত ওনার ক্লাসে খুবই বিরক্ত করতাম , ম্যাডাম খুব একটা বিরক্ত হতেন না l মাঝে মাঝে একটু ধমক দিতেন l ক্লাস খুবই ভালো নিতেন তিনি , ওই বিরক্ত করার মাঝেই l হয়তো উনি আমাদের ওই জ্বালাতন করারই মাঝে , আমাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা খুঁজে পেয়েছিলেন l যখন ক্লাস নিতেন হয়তো অনেকেই পড়া শুনতো না , তবুও এতো জ্বালাতনের মাঝেও ক্লাস নিতেন l শুনিনি কক্ষনো আমাদের সম্পর্কে নালিশ জানিয়েছেন l আমাদের সাথে দিদির মতো ব্যবহার করতেন l
দিনের পর দিন কেটে গেলো প্রথম ইউনিট পরীক্ষা হয়ে গেলো, এলো গরমের ছুটির সময় l ছুটির আগের দিন অনেক বি -এড এর শিক্ষক -শিক্ষিকার মুখে শুনেছিলাম, তাঁরা নাকি আমাদের জ্বালাতন থেকে বেঁচে যাবে l কিন্তু ম্যাডামের মুখেই শুনেছিলাম, আমাদের নাকি তিনি মিস করবেন l যাওয়ার দিন ক্লাসের সকলকে চকোলেট খাইয়েছিলেন l এটা ভেবে খুশি হয়েছিলাম , কেউ তো আমাদের মিস করবে !
তারপর একটানা ছুটি l লক্ষ্য করলাম , বাকি স্যার -ম্যামদের কথা তেমন মনে না পড়লেও ওই ম্যাডামের কথা খুব মনে পড়ছে , মিস করতাম ওনাকে খুব l অনেক সময় মেসেঞ্জারে খবরা খবর নিতাম l
তারপর অনেকদিন পর স্কুল খুললো, আবার জ্বালাতন শুরু করলাম তাঁকে l তখন আমাদের ক্লাসের নাম সত্যিই খুব খারাপ হয়ে পড়েছিলো l নাইন , এ -সেকশনকে সবাই খুব নিন্দা করতো l তবুও তিনি কিছু বলতেন না l ক্লাস নিতে নিতে কখন তিনি প্রায় সকলেরই প্রিয় শিক্ষিকা হয়ে উঠলেন, তা বোঝাই গেলো না l এরকম খারাপ একটা ক্লাসকে অবশেষে সামলাতে পেরেছিলেন তিনি l আমাকে প্রজেক্ট সহ আরও কটা কাজে অনেক সাহায্য করেছিলেন উনি l
বার্ষিক পরীক্ষার প্রথমদিন ছিলো কম্পিউটার l ওইদিনই আমাদের স্কুলে ওনাদের অন্তিমদিন ছিলো, ট্রেনিং এর অন্তিম দিন l পরীক্ষার পরে শেষবারের মতো দেখা করলাম ওনাদের সকলের সাথে l বাড়ি ফিরেও একটু কষ্ট হচ্ছিলো , সাহায্য পেয়েছিলাম ওনার থেকে অনেক কাজে , অনেকটা স্নেহও পেয়েছিলাম l
যাই হোক, ওনার ছাত্র আমি এখন l অনেক কিছু শিখেছি ওনার কাছ থেকে l ওনার কাছ থেকেই নিজের কাজকে ভালোবাসতে শিখেছি l অনেক সমস্যায় খুব সাহায্য করেন উনি l ওনাকে আমি নিজের আদর্শ বলেই মানি l উনি নিজের ছাত্রদের ভাইয়ের মতো মনে করেন l
ভবিষ্যতে যদি শিক্ষক হই তবে ওনার মতো ভালো হওয়ার চেষ্টা করবো, ছাত্র-ছাত্রীদের ভাইয়ের মতো স্নেহ করতে চেষ্টা করবো l ঠিক উনি যেমনভাবে আমাদের স্নেহ করেন l
রচনাকাল : ৩০/৮/২০২০
© কিশলয় এবং সৌম্যদীপ দত্ত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।