*জন্মদিন*
১৪ই এপ্রিলে নিজের জন্মদিনে বাড়ি এসেছিল বিক্রম। মা প্রতিবছর পায়না ছোট ছেলেকে জন্মদিনে পায়েস খাওয়াতে। ছেলে কী আর যেমন তেমন ছেলে ! ভারতীয় সেনাবিভাগের বিশেষ বিভাগের মেজর সে। গর্বে বুক ফুলে যায় মায়ের, যখন কেউ ছোটছেলের কথা জিগ্যেস করে। বড় ছেলে বিশাল কোনো দিনই ছোট ভাইয়ের মতো ডাকাবুকো নয়, নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকে সে। তবে বিক্রম ছোট থেকেই দুরন্ত। পাড়ায় কোনো অন্যায় হতে দেখলে সবার আগে ছুটে যেতো প্রতিবাদ করতে। সে হোক না কুকুরকে পাথর মারার প্রতিবাদ, বা মেয়েদের কটূক্তির, বিক্রমকে পাশে পাবেই আর্তজন। পাড়া ছাড়িয়ে আশেপাশের অঞ্চলের লোকেরও চোখের মণি হয়ে উঠেছিল সে।
কিন্তু, কিশোর বেলার ক্লাসমেট নন্দিনী ছাড়া আর কাউকে নিজের চোখের মণি করেনি সে। প্রথম চাকরির লেটার পেয়েই ছুটে গেছিলো তার কাছে। ছোট থেকে সবকিছুর সাক্ষী নন্দিনী কে সেটা দেখিয়ে খুশিতে উদ্বেল বিক্রম নন্দিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেছিল। না, নন্দিনী মুখে মেকি হাসি ধরে রেখেছিল ঠিকই, কিন্তু চোখদুটো জলে ভরে গেছিল। বিক্রম সেদিন প্রথম তার নন্দিনী কে বুকে আগলে আশ্বাস দিয়েছিল সারাজীবন পাশে থাকার। বলেছিল যেমন চাঁদ আর আকাশকে কেউ আলাদা করতে পারেনা, তেমন বিক্রম কেও নন্দিনীর থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।
এরপর কেটে গেছে ৫টা বছর। বিক্রম এখন মেজর হয়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে। নিজের ইচ্ছে মত বাড়ি ফিরতে পারেনা আর। যোগাযোগের মাধ্যম তো চিঠি, মাসান্তে নন্দিনীর জন্য সেটা আসতো একটা করে। ল্যান্ড ফোন আছে, কিন্তু, রোজ তো কথা বলা সম্ভব নয়, তাই সপ্তাহান্তে বান্ধবীর বাড়ি যেত নন্দিনী সঠিক সময়ে। ফোন ও আসতো নিয়মমাফিক ভাবে। এভাবেই চলছিল বিক্রম নন্দিনীর প্রেম কাহিনী, তবে সবটাই লুকিয়ে লুকিয়ে। খুব কাছের কিছু বন্ধু ছাড়া এসব কেউ ই জানতনা। কোনো বাড়িতেও নয়।
দাদা বিশালের বিয়েতে বাড়ি আসতে পারেনি বিক্রম। খুব আফসোস মা কমলের। কিন্তু ছোটছেলের বন্ধু-বান্ধবীদের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেখানে নন্দিনী বলে মেয়েটিকে বেশ লেগেছে ওনার। নিজের দিদিকে ডেকে বলেওছেন যে এই মেয়েটি বিক্রমের জীবনসঙ্গী হলে বেশ মানাবে। অমন গমের মতো গায়ের রং, দীঘল কাজল চোখ, একঢাল কালো চুল, ছিপছিপে চেহারার নন্দিনীকে অপছন্দ হবার ও নয়। তাই দাদার বিয়ের প্রায় দুইমাস পরে সেবার নিজের জন্মদিনে যখন বিক্রম বাড়ি এসেছিল, মা শুধু বলেছিল এবার তার জন্যেও একটা মেয়ে পছন্দ করেছেন, তার ও ভালো লাগবে মনে হয়। বিক্রম বাকি কথা না শুনেই মাকে উত্তর দিয়েছিল যে উনি যেন বিক্রমের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা বা ঐজাতীয় কোনো পদক্ষেপ না নেন, তার আগেই জানিয়ে দিয়েছিল তার নিজের সহপাঠি একজন কে ঠিক করেছে সে জীবন সঙ্গী করার জন্য। সময় মতো তার সাথে আলাপ ও করিয়ে দেবে । এর কদিন পরেই সময় মাফিক ছুটির আগেই ডাক আসে কার্গিল কে বাঁচাবার লড়াইয়ে সামিল হতে। যাওয়ার আগে নন্দিনী কে বলে গিয়েছিল, সামনের ১৪ই জুলাই , নন্দিনীর জন্মদিনের দিন সবাই কে জানাবে নিজেদের সম্পর্কের কথা, কারন মা নাকি অন্য কোন মেয়ে পছন্দ করেছে, তাই আর সময় নষ্ট করা যাবেনা। নিজের হাতের সোনার আংটি খুলে পড়িয়ে দেয় প্রিয়তমাকে। যাওয়ার আগে, নন্দিনীর দোপাট্টা টা নিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দেখল কেমন লাগছে তার নন্দুকে বউএর মতো মাথায় গুঙঘাট ওড়ে ! রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে নন্দিনী সেদিন বিক্রমের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিজেকে বিক্রমের সহধর্মিণী হিসেবে মেনে নিয়েছিল মনে মনে।
এরপরই কার্গিল যুদ্ধ নিয়ে উত্তাল হয়ে যায় ভারত পাকিস্তান। রোজ টিভির পর্দায় চোখ মেলে থাকত নন্দিনী, বিক্রমের পরিবার। নতুন বৌদিকে শুধু বিক্রম জানিয়ে গেছিল নন্দিনীর কথা, আর কেউ জানতনা। নন্দিনীও জানতনা যে বড়বৌদি সব জানে। খবরের কাগজে রোজ হেডলাইন আসত শুধু কার্গিল যুদ্ধের। অসীম শক্তিশালী আর লড়াকু ভারতীয় সেনাদলের কাছে পিছু হঠতে লাগলো শত্রুদল। কোনঠাসা করে দিয়ে নিজেদের জমি ফেরত নিয়ে নিতে পিছপা হয়নি ভারত মাতার ছেলেরা। অনেক সন্তান বলিদান দিয়েছেন, কিন্তু মায়ের অপমানকে সহ্য করা ভারতীয় জওয়ানদের রক্তের ধর্ম নয়। তাদের জন্য বুক ফেটে যেত বিক্রমের মা কমলের। তার ছেলেটাও যে ওখানে পড়ে আছে, খবর কিচ্ছু পাওয়া যাচ্ছেনা। কার্গিলের দ্রাস থেকে আর কি যোগাযোগ হবে ? ৩রা জুলাই জেনারেলের নিজস্ব কডলেস থেকে বাড়িতে একবার কথা বলে বিক্রম। মা, দাদার সাথে কথার পর বৌদিকে চায় ফোনে, তার খবর নিয়ে চুপিচুপি জানায় আসার আগে আংটি পড়ানোর কথা, আর জানায় এবার যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরলেই বিয়ে সেরে ফেলবে, আর দেরি করবেনা। নন্দিনী কে যেন বৌদি খবর দিয়ে দেয় যে বিক্রম সহি সালামৎ আছে।
এরপর আর কোনো খবর পায়নি বিক্রমের পরিবার। চেষ্টা করেও কোনোও যোগাযোগ হয়নি ওখানকার কারোর সাথে।
১৪ই জুলাই এর আগের রাতে, নন্দিনী কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। বারবার মনে পড়তে লাগল বিক্রমের সাথে তার কাটানো মুহূর্তগুলো আর নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলো যে বিক্রম তো কথা না রাখার ছেলে নয়, তাহলে এই যুদ্ধের সময় ও আসবে কিকরে ? যদিও খবরে বলেছে ভারতীয়দের জয় হয়েছে, যুদ্ধ জিতেছে তার বিক্রম, তবুও এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে তো আর পারবে না সে ! ভোরবেলা উঠে স্নান করে বিক্রমের দেয়া লাল শাড়ি পরে, বিক্রমের মনের মতো করে সাজল নন্দিনী। পূজো দিলো প্রানভরে। প্রতি জন্মদিনে এরকম টা করলেও এই জন্মদিনটা তার কাছে বিশেষ, তারা যে আজন্ম সঙ্গী হবার জন্য প্রস্তুত, সেটা বিক্রম সবাইকে জানাবে। বৌদিও এসে জানিয়ে গেছে এর মধ্যে বিক্রম ফোনে কি জানিয়েছে।
পুজো-আরতি শেষ হয়নি তখনো নন্দিনীর, ভোরের স্নিগ্ধতা খান খান করে গাড়ির হুটর বেজে উঠলো। চমকে যেতেই প্রদীপ আর আরতির থালা হাত ফসকে পড়ে গেল তার। সেই আওয়াজে আরো চমকে উঠলো তার বুক। দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দেখল কনভয় করে পরপর ৪টে গাড়ি ঢুকলো পাড়ায়। সে চেনে এই গাড়ির আদল, জানে তার আসার মানে। মনে মনে সেই সম্ভাবনা মিথ্যে হোক এটাই কামনা করছে সে। হুটর এর আওয়াজে নন্দিনীর মা,বাবা, দাদার ঘুম ভেঙ্গে গেছিল। তারাও বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। পাড়ার আরো সব বাড়ি থেকেই উকি ঝুঁকি দিতে দেখা গেল।
মিনিট পাঁচেকের নিস্তব্ধতা। তারপর ভোরের সৌম্যতার বুকচিরে ভেসে এলো বিক্রমের মা কমল এর গগন বিদারক চিৎকার ! মায়ের বুকফাটা কান্নার রোল ভোরের বাতাস ভারী করে তুলল। সেই আওয়াজ শুনে নন্দিনী কেন, কারোর ই বুঝতে বাকি রইলনা তাদের পাড়ার হীরের টুকরো ছেলের শেষ দেখা এটা !
নন্দিনীর বাবা,দাদা সহ পাড়ার বেশ কিছু লোকজন দৌড়ালেন বিক্রমের বাড়ির দিকে। কয়েকজন মহিলাও আস্তে আস্তে পা বাড়ালেন।
শুধু যার জন্মদিনের ভোর এটা, সে পারলোনা একচুলও নড়তে। চোখের কোনে জল ও এলোনা। মানতেই তো পারছেনা সে, যে বিক্রম কোনোদিন কোনো কথার অমর্যাদা করেনি, সে তার নন্দিনীকে দেয়া এত বড় একটা কথা মিথ্যে করে দিতে পারে কিকরে ?
পাড়ায় গুঞ্জন চলছিল অল্প। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কমবেশি সবাই। প্রত্যেকের চোখের জলই বলে দিচ্ছে বিক্রমের এই পরিণতি মানতে পারছেননা কেউই। নন্দিনী পুজোর থালা আর প্রদীপ আবার সাজাল, আস্তে আস্তে পা বাড়ালো রাস্তার দিকে। তার মা প্রথমে খেয়াল করেননি, রাস্তায় মেয়েকে দেখে দৌড়ে গেলেন। কি করতে চলেছে সে বার বার জিগ্যেস করলেন। উত্তর পেলেন না। সহপাঠীর মৃত্যুতে শোকাহত হয়েছে মেয়ে এটা ভেবেই তার পিছুপিছু গিয়ে পৌঁছালেন বিক্রমের বাড়ির সামনে। গাড়ি ভিতর থেকে তখন সবেমাত্র বের করা হচ্ছে বিক্রমের দেহ।
সঙ্গে আসা সেনাকর্মীদের থেকে জানা গেল বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে ভারত কে জয়ের মুখ দেখিয়ে, নিজের একজন অফিসার কে বাঁচাতে গিয়ে মাথায় গুলি লাগে বিক্রমের। তার ওপর আগে থেকেই কাঁধে ও পায়ে গুলি লেগে রক্ত ক্ষরণ হয়েছিল। বাঁচানো যায়নি তাদের প্রিয় মেজরকে। তবে তাঁর পকেট থেকে মায়ের ও অন্য একটি মেয়ের ছবি পাওয়া গেছে। সেগুলো, তার ইউনিফর্ম আর ভারতীয় পতাকা বিক্রমের মায়ের হাতে তুলে দিতে গিয়ে কর্তব্যরত অফিসারের চোখও ভিজে এলো।
এমন সময় সেখানে এসে দাঁড়ালো নন্দিনী। হাতের আরতির থালা থেকে সিঁদুর নিয়ে টিকা পড়ালো বিক্রমের কপালে, আরতি করলো। ফুলের পাপড়ী ছড়িয়ে দিলো দেহের ওপর। সারা পাড়া তখন স্তব্ধ। পাখিরাও মনে হয় গান গাইতে ভুলে গেছে, বাতাস ও নিঃশব্দে শুধু শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য বইছে।
এর পর কফিনের খুব কাছে গিয়ে অকম্পিত কন্ঠে নন্দিনী বলল, " আজ আমার ২৫তম জন্মদিন, তোমার সাথে আমার হৃদয়ের যে সম্পর্ক আছে সেটা আজ সবাইকে জানাবে বলেছিলে, কিন্তু বাকশক্তিহীন এখন তুমি। তাই অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে আমি ই সেকথা বলছি সবাই কে। শেষবার যাওয়ার আগে তুমি আংটি পড়িয়ে আমাকে বাকদত্তা করে রেখে গিয়েছিলে, আজ পূর্ণতা পাওয়ার দিন সেই সম্পর্কের।"
কথা শেষ করেই বিক্রমের কপালে তার লাগানো সিঁদুরের টিকার ওপর নিজের কপাল রেখে,নিজের মাথাটা নিচের দিকে টেনে নিল নন্দিনী। আকস্মিকতায় কিছু না বুঝলেও, নন্দিনী মাথাটা তোলার পর তার সিঁদুর মাখা সিঁথি দেখে কারোর আর কিচ্ছু বুঝতে বাকি রইলনা। শুধু বিক্রমের বড়বৌদি এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো নন্দিনী কে। তখনও অপলক দৃষ্টি দিয়ে নন্দিনী দেখে যাচ্ছে তার বিক্রমকে। যেন মনে হলো একটু মুচকি হাসলো । কানের পাশে যেন ফিসফিসিয়ে বলল ," আমার সব অসমাপ্ত কাজ এভাবেই সমাপ্ত করো নন্দু!"
মাথায় ঘোমটা টেনে বিক্রমের মা,দাদা,বৌদি আর নিজের মা,বাবা,দাদা কে প্রণাম করে বিক্রমের সাদাকাপড়ে মোড়া শীতল,কঠিন পাদুটোতে মাথা ঠেকিয়ে ধীর পায়ে বিক্রমের বাড়িতে ঢুকে গেল সে।
মেয়ের এ হেন আচরণ দেখেও কোনো কথা বলতে পারলেন না নন্দিনীর মা বাবা। বিক্রমকে যে তারাও নিজের ছেলের মতোই দেখেছেন এতকাল।
এর পর বিক্রমকে নিয়ে অনেক কিছু হল। অনেক সন্মান পেল সে। মরণোত্তর পরমবীর চক্র পেলো। তাকে পাকিস্তানী ফৌজ "শেরশাহ" উপাধি দিলো। ভারতীয় দলে সে কার্গিল সিংহ, কার্গিল নায়ক আরো অনেক উপাধি পেল।
কিন্তু , ২০ বছর কেটে গেছে, আজও প্রতি ১৪ই জুলাই, নিজের জন্মদিনে, ভোর হলেই নন্দিনীর কানে ভেসে আসে হুটর এর শব্দ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজও অপেক্ষায় আছে সে তার বিক্রমের। সে যে কখনোও কথা না রেখে যায়না কোথাও ……
(কার্গিল যুদ্ধে নিহত অমর বীর বিক্রম বাত্রার স্মৃতিতে লেখা, যদিও নাম ছাড়া পুরো ঘটনাই কাল্পনিক)
রচনাকাল : ১৬/৭/২০২০
© কিশলয় এবং অস্মিতা ভাদুরী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।