মেন্টাল ক্লিনিক
–---------------------------------
একটা মনখারাপী, একটা দিলখোলা হা হা হু হু,একটা উদাসীন নির্লিপ্ত যার তেমন কোন অর্থ হয় না, একটা বিদঘুটে বিশ্রী পুরনো আধপাকা ফোঁড়ার মতো, আর একটা বেশ মুচমুচে সদ্যভাজা পাপড়ে প্রথম কামড় দেওয়ার মতো হাওয়া বাগানটার এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। এগুলো একে অপরে মিশে, ভাব-ভালোবাসা করে আবার আলাদা হয়ে যায়। প্রাচীরটার গা ঘেঁষে পাতা বেঞ্চিতে কখনও বসে আবার উঠে পড়ে। বাইশ পঁচিশ বছরের যুবক।পকেট থেকে একটি ফটো বের করে আয়নায় মুখ দেখার মতো দেখে। খিলখিল করে হেসে ওঠে। তারপর চোখে চোখ রেখে বিলাপ শুরু করল, "এই বউ, তুই কবে আসবি? তুই সিঁদুর পরিস নি কেন? তুই এলে তোকে মেলায় নিয়ে যাব। নাগরদোলায় চড়াবো। ডিস্কোতে বসাবো। মোরব্বা, জিলিপি খাওয়াবো। বল না বউ, তুই কবে আসবি? আমি তোকে অনেক ভালোবাসবো।"
"আহ! চুপ করে বস না। আবার শুরু করলি।"
"ও মা, তুই যে বলছিলি সুতপাকে খুঁজে এনে দিবি। কাল তো বলছিলি। কিন্তু ও তো এলো না। বল না, মা। সুতপা কবে আসবে।"
বৃদ্ধা মা কোন রকমে পাগল ছেলেটাকে আঁকড়ে ধরে বেঞ্চে বসাল। তিন বছর ধরে এইভাবে এই মানসিক রোগীর ডাক্তারের চেম্বারে ছেলেকে নিয়ম করে নিয়ে আসে।
বিনীতা তার লম্বা বেনুনী দোলাতে দোলাতে পেশেন্ট পার্টিকে স্লিপগুলো ধরিয়ে দিছিল। বিনিতাকে দেখে ছেলেটি আবার বলতে লাগলো, "ও মাসি, তুমি তো বলছিলে, সুতপাকে খুঁজে এনে দেবে। কই ও তো এখনো এলো না। তুমি তো বলছিলে, সুতপা আমার কাছে চলে আসবে। বলো না, মাসি। আসছে না কেন?"
"হ্যাঁ, আসবে তো। আরও ক'দিন ওষুধ খাও। তুমি আগে ভালো হয়ে ওঠ। ও ঠিক আসবে। নাও মাসিমা, স্লিপটা ধর।"
বিনীতা তারপর একটি ডাইরিতে পেশেন্টের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে কেস হিস্ট্রি জেনে নোট ডাউন করে। বিনীতা বলল, আমি নাম ডাকলে তোমরা চলে আসবে, কেমন। তারপর দ্রুত চলে যায় জারুল বনসাইয়ের আড়ালে আর এক পেশেন্ট পার্টি'র কাছে।
সিমেন্টের বেঞ্চে দেদার নাক ডাকছে এক মধ্য বয়স্কা মহিলা। চুল খোলা। পরনের কাপড় আলুথালু। পায়ের একটা আঙ্গুলে পচন ধরেছে ।মাছি ভনভন করছে। এক প্রৌঢ় একটি পোটলা আঁকড়ে পাশে বসে আছে।মাঝে মাঝে হাত দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। বিনীতা প্রৌঢ় ড়কে স্লিপ ধরিয়ে বলল, "কাকা, এরপরই তোমাদের ডাক পড়বে।"
"এখনই?"
"হ্যাঁ।"
"কিন্তু কী করি বলোতো,দেখছো তো ওকে । এখন একে তুলতে পারে কার সাধ্যি?"
বিনীতা বলল, "কিন্তু নাম পেরিয়ে গেলে আবার যে কখন পড়বে। আজকে পেশেন্টের খুব চাপ। আচ্ছা, দেখা যাক, কী করা যায়। ঠিক আছে কাকা, কাকির ঘুম ভাঙলে আমাকে একবার ডেকো তো।"
তারপর একইভাবে পেশেন্টের খোঁজখবর এবং শারীরিক মানসিক অবস্থা ডাইরিতে নোটডাউন করে।
বাগানটার শেষ সীমানায় একেবারে কোণার দিকে একটি তরুণী একটি মাঝবয়সি লোকের দুই হাত চেপে হাত ধরে আছে। লোকটা হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার বারবার চেষ্টা করছে। " আরে বলছি তো আমি যাব আর আসব। তুমি এখানে বস না। আমি এক্ষুনি আসছি।"
মেয়েটি বলছে, "না, তোমাকে আমি ছাড়বো। না, তুমি আর আসবে না। আগে তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলে। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার খুব ভয় করে।"
মেয়েটি লোকটিকে জাপটে ধরল। লোকটি অস্বস্তিতে পড়ল । বিনীতা কাছে এগিয়ে যেতে মেয়েটি আবার বলল, "ও দিদি, দেখনা আমার স্বামী আমাকে একলা ফেলে চলে যাচ্ছে। ওকে আমি কিছুতেই যেতে দেব না। এই দেখো, আঁচল দিয়ে ওকে এই গিঁট দিলুম।হা হা কী মজা। আর আমাকে ছেড়ে যেতে তুমি পারবে না। বলোনা দিদি, আমি ঠিক করছি কিনা?"
লাঞ্চের আগে রিপ্রেজেন্টটেটিভদের ভিড় বাড়ে এই বিশেষ দিনে । আধ ঘন্টা সময় ওদের জন্য বরাদ্দ। জনাদশেক শুটেট বুটেট লম্বাচওড়া রিপ্রেজেনটেটিভ বাগানের ফাঁকা জায়গাটায় একে অপরের সঙ্গে খোশগল্পে মুশগুল। কোম্পানিতে নিজেদের র্যাংক এন্ড টার্গেট নিয়ে একে অপরকে উল্টেপাল্টে বাজাচ্ছিল।
ইতিমধ্যে প্রথম যুবকটি ওদের কাছে ছুটে এল।
"এই যে,তোমরা আমার সুতপাকে দেখেছো?আমার সুতপা কোথায় বলতে পারো?"
ওদের মধ্যে একজন বাগানের কোণার দিকের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, "ওই তো তোর সুতপা।"
আর একজন ব্যঙ্গ করে বলল, "আসবে আসবে, চিন্তা করো না বাপধন,ঠিক আসবে ।"
ছেলেটি ওর হাত ধরার চেষ্টা করল। রিপ্রেজেন্টটেটিভ দুপা পিছিয়ে ধমক দিয়ে বলল,"ভাগ শালা এখান থেকে,আড় পাগলা কোথাকার ।"
আরেকজন গলা খাটো করে সুর টেনে বলল, "বাপধন, সুতপা ফিরে এলে যে কোম্পানির চলবে না, ডাক্তারের চলবেনা, আমাদেরও চলবে না।তাই তোমার সুতপা কখনোই ফিরে আসবে না।"
সিগারেটের কুণ্ডলি পাকানো ধোঁয়ায় ওদের হা হা দিলখোলা হাসি পাক খেতে লাগলো । হাসতে হাসতে ওদের কাশির দমক ওঠে ।
ডাক্তার সত্তর ছুঁই ছুঁই। কোভিড মহামারির পর থেকে বাইরে আর চেম্বার করেন না। মেদিনীপুরে কিছুটা মফসসল ছোঁয়া নিরিবিলিতে বাগান কাম পুরনো যে বাড়িটা কিনেছেন সেখানেই চেম্বার করেন। এখানে পেশেন্টরা হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারে। ঘুমোতে পারে। হুটোপাটিও করতে পারে। ইকড়ি মিকড়ি, বাঘ ছাগল খেলতে পারে। পাঁচিল ঘেরা আয়তাকার এক চিলতে বাগানটিতে নানা প্রকার ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে। বড় ক'টি গাছও আছে। বাগানের আলো আঁধারি পরিবেশ পেশেন্ট পার্টিও খুশি। ডাক্তার খুব স্ট্রিক্ট ও বেজায় খিটখিটে। চেম্বার থেকে বাইরের দৃষ্টিপথে যেন কোন রোগীর আনাগোনা, উঁকি ঝুঁকি না থাকে। সাইনবোর্ডে কিংবা প্ল্যাকার্ডে লেখা নির্দেশাবলি কোন কাজ দেয়নি। সাত দিনে ছ' দিন চেম্বার । খুব চোস্ত একজন ম্যানেজার, একজন গেটকিপার ও দুজন মহিলা মিলে এই চেম্বারটার দেখভাল করেন। পেশেন্টদের নাম লেখানো, ডেট, টাইম উল্লেখ, বাগানের পরিচর্যা ও পরিষ্কার সবই নিপুন হাতে সম্পন্ন হয়। চেম্বার সকাল ন' টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। মাঝখানে হালকা টিফিন ও লাঞ্চের বিরতি। একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে সবকিছু । ছেলে আমেরিকায় সেটেলড। ভিডিও কনফারেন্সের স্টাফদের নিয়মিতভাবে টিপস দেন ও চেম্বার পরিচালনার বিষয়ে গাইডলাইন তৈরি করেন। বাবাকে বারবার বলেছেন ইন্ডিয়া এখনও ওল্ড সিস্টেমে পড়ে আছে। ক্যাশলেস পেমেন্ট করাতে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। এটা ছেলের কাছে অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। বাবাকে টাকা স্পর্শ করতে নিষেধ করেছেন। তাই তিনি একটি স্টিলের বাক্সে টাকা নেন। মন্দিরে ঠাকুর প্রণামী যেমন নেওয়া হয়। এনি চেঞ্জ নট অ্যালাউড। নির্দিষ্ট দিনে ব্যাংক থেকে একজন কর্মচারী এসে হিসেব করে টাকা নিয়ে যান। তারপর মুহূর্তেই সিংহভাগ ক্যাশলেস ডলার হয়ে যায়।
আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে বিনীতা পেশেন্ট হয়ে এই চেম্বারে এসেছিল। ওর এক দূরসম্পর্কের এক মাসী ওকে নিয়ে এসেছিল। অদ্ভুত সিনড্রোম। গোঁজ হয়ে বসে থাকত।ফ্যাল ফ্যাল করে শূন্যে চেয়ে থাকত।স্নান খাওয়া বন্ধ।পোশাক আশাকের প্রতি ভ্রুক্ষেপ ছিল না ।এক্সট্রিম মেন্টাল শক। এ ধরনের শক কোথা থেকে আসতে পারে ডাক্তারের অজানা ছিল না। মেয়েটার ডাগর ডাগর চোখ জোড়া, লম্বা হিলহিলে চুল। চোখমুখে কেমন একটা মায়া মাখানো ছিল। কত না লালিত্য ভালোবাসা পুষে রেখেছিল ওই দু' চোখে। মাস দুয়েকের চিকিৎসায় বিনীতা সেরে উঠলো।
সেদিন পেশেন্টদের স্লিপ ধরাতে গিয়ে সরলাকে দেখে বিনীতা চমকে ওঠল। প্রথমটা চিনতেই পারেনি।শরীরের সেই বাঁধন আর নেই। সাধারণ একটা শাড়ি অগোছালোভাবে পরিহিত।চুলে অযত্ন। চোখমুখ শুকিয়ে পুজোর বাসি ফুল। চোখের দৃষ্টি মরা মাছের মতো। মনে হয় কত রাত চোখের পাতা জোড়া লাগেনি। যেন স্বজন হারানো শোকে পাথর। ভেতরে অজানিত চাপা দুঃখ গুমরোচ্ছে। বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে ন। বিনীতা নিজেকে আর সামাল দিতে না পেরে সরলার দু বাহু ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, "তোমার কী হয়েছে, কাকিমা? এমনটা কী করে করে হলো?"
সরলা শুধু তার দুর্বল হাত দিয়ে বিনীতার চিবুক স্পর্শ করল আর ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকল ওর দিকে । বিনীতাও সরলার চোখের ভাষায় হারিয়ে যেতে যেতে পৌঁছেগেল তার ফেলে আসা আলো আঁধারে।
–----------------------------------------------------
তিনটে ভাই বোনের মধ্যে বিনীতাই বড়। বাপ মা'র খুব ইচ্ছে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করুক। অভাব অনটনের মধ্যেও ওরা পড়াশোনা শুরু করেছিল। হা' ক্লান্ত সংসারে হাজারও ছিদ্র। দিনকে দিন ছিদ্রগুলো ক্রমশ বড় হতে লাগলো। অস্থি ভেদ করে কঙ্কাল ছুঁয়ে ফেলল। কৃত্রিম অকৃত্রিম মন্দায় পরিযায়ী বিনোদ রোগভোগ নিয়ে হেলে পড়া দেয়ালে পিঠ ঠেকালো। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বিনীতা নেমে পড়ল। প্রতিবেশী তিনুবাবুদের বাড়িতে টুকিটাকি কাজ করত মায়ের সাথে। পারিবারিক পার্বণে ওদের বাড়ির এক আত্মীয়ার নজরে পড়ল বিনিতা। মন্দ নয় তো। বেশ চটপটে। দেখতে শুনতে ভাল। সরলা চাকরিজীবী বিধবা। একমাত্র ছেলে চাকরি না পেয়ে সবে ব্যবসায় হাত পাকিয়েছে।
বিনীতার বাবা-মাকে প্রস্তাব দিল, "মেয়ের মতো থাকবে। আমার ছেলের বাগানের খুব শখ। ঘরভর্তি ইনডোর প্ল্যান্ট।ওগুলোর একটু যত্ন করবে। টুসি (পোষা পাখি) গান শোনায়। তাকে খাওয়াবে, স্নান করাবে।আর আমার বৃদ্ধা মা'র সঙ্গে গল্পসল্প করবে। চাইলে দিব্যি পড়াশোনা করতে পারবে। গল্পের বই পড়বে আমার সঙ্গে। আমার গল্প পড়ার খুব নেশা। আলমারিতে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, সুনীল ঠাসা। ভালো মাইনে পাবে।"
খিড়কির বাঁশ কঞ্চির ছিটেবেড়ায় ঠেকানো থাকলো সবুজ সাথীর সাইকেল। দেহে মরচে জমল। নীল সাদা শালোয়ার জীর্ণ দড়িতে ঝুলতে থাকল। অঞ্জনার সাথে গলায় গলায় ভাব। দু'দিন ছাড়া ছাড়া এলো গেলো। "বিনীতা কবে আসবে, কাকিমা?" প্রতিবারই ওর শালোয়ারটা দুলিয়ে দিয়ে চলে যায়। পিঠের বোনটা মাঝে মধ্যে দিদির জামা পরে। রোদ বৃষ্টিতে পড়ে পড়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।এখন পোকায় কাটছে । মাত্র ক' মাসেই সুগন্ধি, শ্যাম্পু, সাবান, পরিবাটি ঝকঝকে পোশাক আর শহুরে আদব কায়দায় বিনীতা তাক লাগিয়ে দিল সবাইকে। নিয়মিত মাস মাইনে হাতে । বাবার ওষুধ, ছোট ছোট ভাইবোনের পুজো পার্বণের আহ্লাদ, মায়ের পরনের কাপড় জুটলো । পড়শী চোখ টাটালো।
"দিদি এবারের পুজোয় আমাদের তোর ওখানে নিয়ে যাবি?
"দিদি আমাকে একটা রিমোট কনট্রোল গাড়ি কিনে দিবি?"
"বিনিরে,তোর বাবার জন্য একটা পুরনো বড় ফোন কিনে দিবি?"
মাঝে মাঝে মায়ের বুকের ভেতরটা হাপুশ হুপুশ করতো। "কী ডাগর হয়েছে মেয়েটা! বড্ড ভয় করে।
সরলা মর্নিংওয়াকে যেত নিয়মিত। বিনীতাও সঙ্গে যেত। পথ চলতি লোকেরা বলতে লাগলো, "এটি আপনার মেয়ে বুঝি?"
" হ্যাঁ, এটা আমার মেয়ে।" এক ঝলক তাজা বাতাস বিনীতার চোখে মুখে ঝাপটা দিত।
"আচ্ছা বিনি, তুই আজকাল খুব সিরিয়াল দেখিস। আগের মতো কাজে মন নেই। টুসি (ময়না পাখি) তোর, নামে খালি অভিযোগ করে।"
"আর দিদা?"
"দিদা, জন্মে কারো নামে কোন অভিযোগ করে না। আজ টুসি তিনবার বিনি বিনি করেছে, কেনো রে?"
"কাকিমা, তুমি কোনটা অভিযোগ, বুঝতে পার?"
"বুঝবো না?তোকে কী আমি বুঝি না? তুই কিছু না বললেও আমি তোর মনের কথা বুঝি। এখন তুই আমাকে গল্প পড়ে শোনাস না। তুই আমার কাছে আর বসিস না। আচ্ছা বিনি বলতো, রবিঠাকুরের পোস্টমাস্টার গল্পে রতনকে তোর কেমন লাগে?"
বিনীতা হঠাৎ চুপ করে গেল। বুকের মধ্যে ওঠা উথাল পাতাল ঢেউ কোনরকমে চেপেছিল।এমন প্রশ্ন কেন? তাহলে কি—-? হঠাৎ ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে জ্বাল বন্ধ করলে যেমন হয়।
–----------------------------------------------------------
আজকাল বিনীতা ঝিমিয়ে থাকে। চোখের নিচে কালি। চালধোয়া জলের মতো চোখমুখ ফ্যাকাসে। শুধু নীরবে কাজ করে চলে। সরলার সামনে আসতে চায় না। গতকাল বেসিনে ওয়াক ওয়াক করছিল।সরলা ভেবেছিল, হয়ত অম্বল হয়েছে। পরদিন সরলা অফিস থেকে ঘরে ফিরেছে সবে।খুব অবসন্ন। টুসি বলতে শুরু করলো, "দাদা বিনি, দাদা বিনি, দাদা বিনি"। তিন তিনবার এই ডাক শুনে সরলার মাথায় রক্ত উঠে গেল। গতকাল রাধা (ঠিকে ঝি) আকারে ইঙ্গিতে যা বলেছিল,তা বুজতে বাকি নেই সরলার। সরলা রুক্ষস্বরে বিনিকে ডাক দেয়। বিনীতা সামনে এসে দাঁড়ায়। ভয়ে দরদর করে ঘামছে। ওর চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে সরলা স্তম্ভিত হয়ে যায়।
কিছুক্ষণ পরে বলে, "তুই আমার এত বড় সর্বনাশ করতে পারলি?"
এখনই আপদ বিদায় করা দরকার। সরলা বিনীতাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে যায়। "এই তোর প্রতিদান? বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাস? আমারই ভুল, ছোটলোকদের লাই দিতে নেই। মাথায় ওঠে। এখনই দূর হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।"
বেচারী ভয়ে হকচকিয়ে গেছে। শুধু কেঁদে মরছে। সরলা ছেলেকে ডেকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না। বিনীতা হঠাৎ ওঠা এক ঘূর্ণি বাতাসে পাক খেতে খেতে দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেল। টুসির 'বিনি বিনি' ডাকটা বাড়িময় অনুরণিত হল।
শয়তানের চোখ দুটো ওর পিছু নেয়। "পেটের ওই পাপটা খালাস করে ফেল। নাহলে নিজে খালাস হয়ে যাবি।"
কোন মুখে মায়ের কাছে ফিরে যাবে। রাতের আঁধারে অনেকটা পথ পেরিয়ে বিনীতা পৌঁছেছিল ওই মাসির কাছে। মাসির আছে পুরুষালি দুই বাহু ও দুচোখে ছাইচাপা আগুন। বিনীতাকে অভয় দিয়ে আগলে রাখল। বলল, "চল ওটাকে নষ্ট করে ফেলি। এ সমাজ তোকে ঠাঁই দেবে না।"
বিনীতার দৃষ্টি ফিরে আসে সরলার ভাষাহীন চোখদুটোয়। সরলা সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে, " মা'রে, আমাকে তোর কাছে ঠাঁই দিবি? নিজের পেটের ছেলে এতবড় অমানুষ, লম্পট হবে ভাবতে পারিনি। আমারই ভুলের মাশুল আমাকে দিতে হচ্ছে । তোরও ক্ষতি আমি করেছি। তোর জীবনটাকে নষ্ট করেছি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে' মা। তোর মা'কে কথা দিয়েছিয়াম।,তোকে ভালো রাখব। কথা রাখতে পারিনি। এই পোড়া চোখে ঘুম আসে না।মনের জ্বালা শরীরের জ্বালা থেকে অনেক বেশি। শয়তানটা বাড়িটাকে নোংরামির আখড়া বানিয়েছে। মেয়েরা ওর কাছে শুধু সস্তার পুতুল।ব্যবহার করার পর ছুঁড়ে ফেলে ডাস্টবিনে । এসব সহ্য হয় না।"
বিনীতাও কাঁদতে থাকে। তারপর সামলে নেয়।সরলাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার জন্য ঝুঁকে পড়ে। সরলা ওকে বুকে টেনে নেয়। "ওখানে না বিনি, আমার বুকে আয়।"
রচনাকাল : ১/১২/২০২৩
© কিশলয় এবং অভিজিৎ জানা কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।