মহান মে দিবস ও আন্তর্জাতিক শ্রম দিবস
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
‘‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য / ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, / চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য /কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া। /চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ, / গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে, /তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য /জীবনকে চায় ভালবাসতে।’’----
বর্তমান এই কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার এই পঙক্তিগুলো যেন কানে বেজে ওঠে। সারা পৃথিবী আজ ভয়ঙ্কর এক সমস্যার মুখোমুখি, মানুষ আজ ঘরবন্দি, এক অতি ক্ষুদ্র অণুজীবের কারণে। সারা দেশ আজ স্তব্ধ, রাস্তাঘাট শুনশান, ব্যবসা বন্ধ, কর্মহীন মানুষ; সারা দেশ জুড়ে চলছে লকডাউন। এর মাঝেই আজ সেই বিশেষ দিন, যে দিনটা প্রত্যেক বছর পালিত হয় শুধুই শ্রমিকদের দিন হিসেবে। তাঁদের সারা বছর কাটে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে। একটি দিন সেই কাজ থেকে ছুটির দিন। এই সময়ে অবশ্য প্রতিদিনই তাঁদের কাছে কর্মহীন, বেকার হয়ে ঘরে বসে থাকার দিন। আজ বিশ্ব শ্রমিক দিবস বা মে দিবস।
প্রতি বছর সারা বিশ্বে এই দিনটি পালিত হয় প্রতীকী দিন হিসেবে। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষদের দিন হিসেবে। মে দিবস হাজার হাজার শ্রমিকের পথ চলা মিছিলের কথা, একই পতাকা তলে দাঁড়িয়ে আপোষহীন সংগ্রামের কথা। মে দিবস দুনিয়ার সব শ্রমিকদের এক হওয়ার দিন। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের কাছে জাগরণের গান, সংগ্রামের ঐক্য ও গভীর প্রেরণা।
মে দিবস আসলে শোষণমুক্তির অঙ্গীকার, ধনকুবেরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার শপথ নেওয়ার দিন। কীভাবে এই দিনটি পরিণত হলো এই মে দিবস হিসাবে সে ইতিহাস কমবেশি সকলেরই জানা, ইতিহাসের পাতায় চোখ ফেরালেই আমরা জানতে পারি শ্রমজীবী মানুষদের সেই আন্দোলনের কথা।
মেহনতি মানুষদের এই আন্দোলনের পথ কখনও মসৃণ ছিল না। ছিল নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে মোড়া। জুলুম, অত্যাচার, প্রতিরোধ, ধর্মঘট, মিছিল, সংগ্রামের কাহিনি রয়েছে এই দিনটার পিছনে।
১৮৮১ সালে নভেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আমেরিকান ফেডারেশ অব লেবার’। ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর সেখানে চতুর্থ সম্মেলনে গৃহীত হয় এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, বলা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সব শ্রমজীবী মানুষ আট ঘণ্টার বেশি কোনওভাবেই কাজ করবে না। ওই দিনটিতে তাই পাঁচ লক্ষ শ্রমিক প্রত্যক্ষভাবে ধর্মঘটে যোগ দেন। শাসকদল এই ঐক্যবদ্ধ বিশাল শ্রমিক সমাবেশ ও ধর্মঘট দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।
৩ মে ম্যাককর্মিক হার্ভাস্টার কারখানায় নির্মম পুলিশি আক্রমণ চলে, তাতে প্রাণ হারান ৬ জন নিরীহ শ্রমিক। সেই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর পরের দিন অর্থাৎ ৪মে হে মার্কেট স্কোয়্যারে আয়োজিত হয় এক বিশাল প্রতিবাদ সভা। পুলিশ এই সভায় গুলি চালালে শহিদের রক্তে রাঙা হয় হাতের পতাকা। গ্রেফতার করা হয় চারজন শ্রমিক নেতাকে। বিচারের নামে শুরু হয় প্রহসন, জারি করা হয় ফাঁসির আদেশ।
দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে এই নৃশংস বর্বরতার খবর পৌঁছয় দুনিয়ার সব মেহনতি শ্রমজীবি মানুষের কানে। ১৮৮৯ সালে জুলাই মাসে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রথম দিনের অধিবেশনেই সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয় যে ১৮৯০ সালে ১ মে থেকে প্রতি বছর শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক সংহতি, সৌভ্রাতৃত্ব ও সংগ্রামের দিন হিসেবে এই দিনটি পালিত হবে। এভাবেই ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক মে দিবস ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক মে দিবসে পরিণত হল।
আজ এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের লড়াই সবচেয়ে কঠিন। এই লড়াই জীবনে বেঁচে থাকার লড়াই। এই আর্থিক বিপর্যয়ের মুহূর্তে ইতিমধ্যেই কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমজীবী মানুষ। পরিসংখ্যান বলছে করোনা পরবর্তী সময়ে কয়েক কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। তাদের জীবনে নেমে আসবে ভয়ঙ্কর কালো দিন।
করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় বিগত বছরগুলিতে কাজ হারিয়ে দলে দলে গাঁয়ের মাটিতে ফিরে এসেছে বহু শ্রমিক। তাদের সেই অসহায় ছবি প্রতিনিয়ত ভেসে উঠেছিল সংবাদ মাধ্যমের পর্দায়। অনেকে আবার ফিরতে না পেরে আটকে ছিল বিভিন্ন রাজ্যে। কোনও রকমে সামান্য সাহায্যে তাদের মুখে জুটছিলো আহার, সেটাও অনিশ্চিত, কারোর কারোর হয়তো সেটাও জুটেনি নিয়মিত।
একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে। আসবে আবার নতুন সকাল, কিন্তু এই শ্রমিকদের জীবনে যে আঁধার নেমে এসেছে সেটা তারা কাটিয়ে উঠবে কীভাবে! তাঁদের জীবন থেকে যদি কলকারখানা, হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ চলে যায়, তাহলে মে দিবস পালনের ওই মুষ্টিবদ্ধ হাত আর কখনও উপরে উঠবে না।
আসুন, আমরা সকলেই আজ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, কৃষক, শ্রমিক, দুনিয়ার মজদুর সকলের পাশে এসে দাঁড়াই। তবেই এই মেহনতী মানুষের দল আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন। সমাজ দাঁড়াতে পারবে। আমরা পালন করতে পারব মে দিবস। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে উঠবে। শ্রমদিবসের লড়াইও সার্থক হবে। দুনিয়ার মজদুর এক হবে। সফল হবে মেহনতী মানুষের সংগ্রাম।
রচনাকাল : ৩০/৪/২০২২
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।