কনক
আনুমানিক পঠন সময় : ৩৮ মিনিট

লেখক : রূপক ঘোষ
দেশ : ভারতবর্ষ , শহর : কলকাতা

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৫০ টি লেখনী ৩১ টি দেশ ব্যাপী ১০৯৩৬ জন পড়েছেন।
Rupak Ghosh
~কনক ~

তখন ঘড়িতে কটাই বা বাজে! বোধহয় সকাল দশটা হবে। নবদ্বীপের হরিতলা গ্রামের “কনকধাম” দোতলা বাড়ির সামনে একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে নেমে এল এক তরুণ আইপিএস অফিসার সৌম্য মুখার্জী। সঙ্গে তিন-চারজন খাকী পোশাকের পুলিশ।

ক্রিং-ক্রিং কলিং বেলের শব্দ।

-কে? দোতলার রান্নাঘর  থেকে চিত্‍কার করে ওঠে অণিমা। - দেখতো কে আবার কলিং বেল বাজাচ্ছে। আমি মাছ কাটছি আমার দুটো হাতই জোড়া।

-দেখছি, বলেই দোতলার সিঁড়ি থেকে নিচে নামতে থাকে অণিমার স্বামী সুজন মুখার্জী। অতি সাদাসিধে আপনভোলা সুজন মুখার্জী নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাসের প্রফেসর। এখন বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। পড়াশুনা নিয়েই থাকেন। বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা খুবই কম। সুজন মুখার্জী  তার স্ত্রীর  অশালীন আচরণ এবং কটু ভাষণের জন্য স্ত্রী কে প্রচণ্ড ভয় পান। দরজা খুলেই পুলিশ দেখে সুজন মুখার্জী ভয় পেয়ে যায়।

-কি ব্যাপার? বাড়িতে পুলিশ কেন?

-কনকদেবী কি এই বাড়িতেই থাকেন? আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চাই।              

-হ্যাঁ, এই বাড়িতেই চিলেকোঠার ঘরে থাকেন। কিন্তু কেন বলুন তো? আমার মাকে কিসের প্রয়োজন আপনাদের?

কথার কোনো উত্তর না দিয়ে সোজা উপরে উঠে যায় সৌম্য। -কেউ যেন উপরে না আসে। অফিসারদের নির্দেশ দেয় সৌম্য।

কেমন যেন হতবাক হয়ে যায় সুজন। মুখ থেকে কোনো কথা সরে না। ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। তুমি তাড়াতাড়ি একবার নিচে এসো।

-কি হল কি? রান্নাঘর থেকে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে অণিমা। একটা সহজ কাজ ও কি করতে পার না?   

এদিকে চুপিসাড়ে চিলেকোঠার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায় সৌম্য। কতদিন পরে আবার এই বাড়িতে এল এই মুহূর্তে ঠিক ঠাহর করতে পারে না সৌম্য। পর্দার আড়াল থেকে সৌম্য ঘরের ভিতর উঁকি মারে। ওইতো ঘরের মধ্যে খাটের উপর শান্ত ভাবে বসে আছে তার আরাধ্য দেবী। সোনার বরণ গায়ের রঙ এই বয়সে ও অটুট। কিন্তু ছোটবেলায় দেখা একরাশ ঘন কালো চুলে ঢাকা সেই স্নেহময়ী মুখের  বদলে ছোট করে কাটা সাদা চুলে সেই মুখটা কে ঠিক মত মেলাতে পারে না সৌম্য। সারা মুখে একটা বিষাদের ছায়া। তবে একটা অদ্ভুত লালিত্য আজও জড়িয়ে রয়েছে সারা শরীরে। দেখলেই মনে ভক্তি জাগে। জুতো খুলে ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করে সৌম্য। পায়ের শব্দে মুখ তুলে চায় কনক। চশমার ভিতর দিয়ে কনক নির্নিমেষ দৃষ্টিতে ক্ষণকাল চেয়ে থাকে সৌম্যের দিকে।

-আমার খোকন না! নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না কনক। কত যুগ পরে খোকন কে আবার এত কাছ থেকে দেখছে।

-চিনতে পেরেছ তাহলে আমায়? সৌম্য ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে। বিস্ময়ে হতবাক  হয়ে যায় কনক। কতক্ষণ এইভাবে কেটে গেল জানা নেই।

-এতগুলো বছর কোথায় ছিলি খোকন? আমি আর তোর মা-বাবা কত খুঁজেছি তোকে; কত থানা-পুলিশ। কিন্তু কোথায় যেন তুই হারিয়ে গেলি।

-যথাসময়ে সব কথা আমি তোমায় বলব। এখন ঠাম্মি তুমি তৈরি হয়ে নাও, আজই আমি তোমায় কোলকাতায় আমার কোয়ার্টারে নিয়ে যাব। তোমার আশীর্বাদে আজ আমি পুলিশ অফিসার হয়েছি। তোমাকে আমি আর একদিনের জন্যও এই বাড়িতে অসম্মানিত হতে দেব না।

কনক বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। খোকনের কথার কি উত্তর দেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তার সেই ছোট্ট হারিয়ে যাওয়া খোকন আজও তাকে ভোলেনি। কান্না চেপে রাখতে পারে না কনক, দুর্বার আবেগে চোখ থেকে ঝরে পড়ে মুক্তোর মত অশ্রুধারা।

কনক সহসা তার অতীতে ফিরে যায়। ছোটবেলার প্রায় মুছে যাওয়া ঝাপসা স্মৃতিগুলো কি ভাবে জানি এতদিন পরে কনকের  জীবনে  আবার উজ্জ্ব্ব্ল হয়ে ধরা দেয়। কতই বা বয়স হবে তার! সে তখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী। স্বরূপগঞ্জে মামার বাড়িতে থেকে বড় হচ্ছে। মামার বাড়ির অবস্থাও তেমন একটা ভাল ছিল না। অভাবের সংসারের মধ্যেই মামা-মামী তাকে স্নেহ দিয়ে তিল তিল করে বড় করে তুলছে। একটু বড় হবার পর  সে জানতে পেরেছিল যে তার জন্মের ঠিক পরেই মা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। শুধু তাই নয়, মায়ের এই অকাল মৃত্যুর জন্য বাবা তাকেই  দায়ী করে একদিন বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। সেদিনের ঘটনা এখনও কনকের মনে পড়ে। অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও বাবার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। মায়ের মুখ তার মনে নেই কিন্তু বাবার মুখটা আজও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে।

 

-ঠাম্মি কি ভাবছো মনে মনে? সৌম্যের ডাকে চিন্তায় ছেদ পড়ে। অতীত থেকে আবার বাস্তবে ফিরে আসে কনক।

-না তেমন কিছু নয়, বলছি এত তাড়াতাড়ি কি করে যাব খোকন? আমার যা কিছু আছে সেগুলো গুছিয়ে নিতেও তো একটু সময় লাগবে। তাই বলছি ছেলেমানুষি না করে দু-এক দিন আমায় একটু ভাবার সময় দে। সত্যি বলতে গেলে এই বাড়ির প্রতিটা জিনিসের সাথে আমার অনেক বাঁধন জড়িয়ে আছে রে! সেই বাঁধন কি এত সহজে ছেঁড়া যায়! তারচেয়ে তুই এই বাড়িতে এসে থাকলেই আমি আনন্দে থাকব।

-তা হয় না। আমি আবার কাল আসব। এই একদিনের মধ্যে তোমার যা নেবার গুছিয়ে নেবে।

-খোকন, মা-বাবার সাথে দেখা করেছিস?

-না।

-কেন?

- মা-বাবার কোনো অস্তিত্ব নেই আমার কাছে। আর যতক্ষণ না আমি বলব ততক্ষণ তুমি আমার পরিচয় ওদের জানাবে না। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করে সৌম্য।

-দাঁড়া খোকন! মা-বাবার সাথে দেখা না করে চলে যেতে নেই। কনক সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে। চিত্‍কার করে ডেকে ওঠে “খোকা”! “খোকা”! ওরে খোকন চলে যাচ্ছে ওকে আটকা তোরা। কনকের কথা ওরা শুনতে পেল কি? কি জানি কেন কনক আজ ভুলে গেছে যে তার চিলেকোঠা থেকে দোতলা নামা নিষেধ। কনক ভুলে গেছে যে এই বাড়িতে বহুদিন হল সুজন কনককে “খোকা” নাম ধরে ডাকতে বারণ করে দিয়েছে। কিন্তু আজ কনক কোন নিষেধ মানবে না। অন্যায় সে করবেই, কেন কি দোষ করেছে সে? টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়িতে হোঁচট খায় ষাটোর্ধ্ব কনক। সৌম্য কোনরকমে ধরে ফেলে ঠাম্মিকে। এদিকে শাশুড়ির চিত্‍কার শুনে অণিমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে।

-ওগো শুনছো? তোমার মা আবার চিত্‍কার করছে। এত লোক মরে তবু এ বুড়ি মরে না কেন কে জানে! সুজন সবই শুনতে পায় কিন্তু প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। মায়ের প্রতি সহানুভূতি থাকলেও সে কিছুতেই মায়ের অন্যায় কে ক্ষমাও করতে পারছে না। আর এক্ষেত্রে অন্তত: অণিমার  কোনো দোষ আছে বলা যায় না।   

 

সৌম্য সব শুনতে পায়। ঠাম্মিকে উপরে তুলে দিয়ে টুপিটা নিচু করে আর  চোখে রোদ-চশমা পরে দোতলায় প্রবেশ করে সৌম্য। পুলিশ অফিসার দেখে দুজনেই থতমত খেয়ে যায়। দুজনের কেউ চিনতে পারে না সৌম্যকে। 

 -আমি কোলকাতার ভবানীপুর থানা থেকে আসছি। কনকদেবীর অতীত জীবনের কলঙ্কময় কিছু ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার ভার আমাকে দেওয়া হয়েছে। তাই আজ আমি নিজে ওনার সাথে প্রাথমিক ভাবে  কথা বলে ঘটনার কিছুটা অনুমান করে গেলাম। আমার মনে হয় সঠিক তদন্ত ও তথ্য-প্রমাণের জন্য আপনাদের ও সহযোগিতা পাব। প্রয়োজন হলে, আমি আপনাদের দুজনকে এবং অন্য যারা এই ঘটনার সাথে জড়িত আছে বলে মনে করব  তাদেরও থানায় ডেকে পাঠাব সত্যের উদঘাটন করার জন্য। অণিমা মনে মনে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। মিনমিন করে বলে- কিন্তু আমরা তো কোনদিন থানায় অভিযোগ করিনি বরং কেচ্ছা থেকে নিজেদের বাড়ির সম্মান বাঁচানোর জন্য বাড়িতেই সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছি। যতদূর জানি শাশুড়ি ও নিজে থানায় যাননি, বরং নিজের লজ্জা ঢাকার জন্য বাড়িতেই একপ্রকার স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন।

-আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনারা বা আপনাদের মা কেউই থানায় অভিযোগ জানাননি। শুনেছি তার কোনো নিকট আত্মীয় এই ব্যাপারে থানায় অভিযোগ জানিয়েছে। আচ্ছা চলি, নমস্কার। আশা করি ভবিষ্যতে আবার দেখা হবে।

অণিমার মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ে। সুজন নিজেও এই ঘটনার বিন্দু-বিসর্গ জানত না। সুজন যা কিছু জেনেছিল তা তার স্ত্রী অণিমার সৌজন্যে। কাজেই  আজ প্রায় এক দশক পর আজকের এই ঘটনা তাকে খুব অবাক করে তোলে। অণিমা নিজেও ভেবে পায় না কে এতদিন পর থানায় অভিযোগ করেছে।

 

কনক ঘরে গিয়ে সৌম্যর কথা চিন্তা করতে গিয়ে আবার অতীতে ফিরে যায়। মনে পড়ে কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে করে সুনির্মলের হাত ধরে এই বাড়ি আসা। সুনির্মলের মা অনুপমাদেবী  নিজে তাকে পছন্দ করে এই বাড়িতে এনেছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশী সবাই কে ডেকে গর্ব করে বলতেন    আমার বৌয়ের নামটা সত্যিই সার্থক। নামের সাথে গায়ের রঙটা মিলে গেছে। দেখাক দিকি এই পাড়ায় এইরকম আর একটা বউ, আমার বৌয়ের মত- যেমন রূপ তেমন গুণ। শশুরমশাই এইসব শুনে মুচকি মুচকি হাসতেন। আর সে নিজে লজ্জায় বালিশে মুখ ঢাকত। বিয়ের সময় সুনির্মল  ছিল বাইশ বছরের যুবক। নদিয়ার এক গ্রামীণ ব্যাংক এ কাজ করত।

সুনির্মল ছিল বড় বউ ন্যাওটা। সুযোগ পেলেই ওকে আদর করে  অপ্রস্তুত করে দিত। ভরা সুখের সংসার ছিল ওদের -

একদিনের ঘটনা হঠাত্‍ করে মনে পড়ে নিজের মনেই হেসে ওঠে কনক।

সেদিন রবিবার অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। সুনির্মল সোজা রান্নাঘরে -আজ কি রান্না করছ শুনি!

-কি আবার হবে মাছের ঝোল-ভাত।

-রান্না কি হয়ে গেছে?

-হ্যাঁ, প্রায় শেষের মুখে।

-না, আজ এই বৃষ্টিতে খিচুড়ী আর ডিমভাজা রান্না কর।-দারুণ জমবে।

-পাগল নাকি? এই রান্নার কি হবে? আমি আর নতুন করে রান্না করতে পারব না।  

-পারতে তো হবেই। বলেই ওকে কোলে তুলে নিয়ে একটা চুমু খেয়ে নিয়েছিল সুনির্মল।   ।

ছাড়ো বলছি! তোমার কি কোনো লজ্জা নেই। মা-বাবা দেখলে কি হবে বলত।

-ঠিক আছে ছাড়তে পারি, কিন্তু একটা শর্তে- রান্নাটা তোমায় করতে হবে।   

-আমার বয়েই গেছে।  

-ঠিক আছে, আমি নিজে রান্না করব। শুধু তুমি খিচুড়ী করতে কি কি লাগে আর কি ভাবে বানাতে হয় বলে দাও আমি করে নেব।

আমি এই পাগলামি থামাবার জন্য চিত্‍কার করে বলেছিলাম, মা আপনি  একবার রান্নাঘরে এস দেখুন  আপনার  ছেলে কি বায়না শুরু করেছে।

- কি আবার হল বৌমা?

- দেখুন না মা, আপনার ছেলের অদ্ভুত বায়না। যে কোনদিন রান্নাঘরে  পা দেয়নি, কোনদিন রান্না করেনি, সে নাকি আমার কাছ থেকে একবার খিচুড়ী রান্না কি ভাবে করতে হয় শুনেই করে ফেলবে। বলেই হেসে ফেলেছিল ও।

- তুমি তো জানো বৌমা, আমার ছেলে এখন ও ছেলেমানুষ। ঠিক আছে ও যখন নিজে রান্না করবে বলেছে করুক না! আজ তুমি ছুটি পেলে এটাই তো বড় পাওনা। চল আমরা বরং দুজনে মিলে লুডো খেলি।

-চলুন মা।  বলে কনক রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সেদিন।  

কনক চলে যেতেই সুনির্মল একেবারে চুপসে গিয়েছিল। কনক যে সত্যি সত্যিই রান্না না করে চলে যাবে  বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মুখে কনক  যতই না করুক শেষ পর্যন্ত ও ঠিক খিচুড়ী রান্না করবে। এখন উপায়। না সুনির্মল হার মানবে না। খিচুড়ী রান্না করা কি আর এমন কঠিন কাজ ও ঠিক পারবে। মনে জোর এনে সুনির্মল রান্নার কাজে নেমে পড়েছিল সেদিন।

ওদিকে নিজের ও সেদিন লুডো খেলায় মন ছিল না  কারণ  তার স্বামী পড়াশুনায় যতই বিদ্ব্জ্জ্ন হোক, অফিসের কাজে যতই পারদর্শী হোক, এই কাজে যে সে ডাহা ফেল সেটা কনক ভালই জানতো। ওর মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, কি দরকার ছিল নিজের এইভাবে চলে আসার। নাইবা একটু কষ্ট হত। আশা করে ও একটু খিচুড়ী খেতে চেয়েছিল, তার বেশি তো কিছু নয়। না এই কাজটা মোটেও ঠিক করেনি। নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিয়ে উঠেছিল সেদিন। কিন্তু কিছু করার ছিল না সেদিন। মা নিজে যখন লুডো খেলতে বসেছে, তখন  তো আর চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে উঠে যাওয়া যেত না।

অনুপমা তার বৌমার মনের কথা ঠিক পড়তে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল  বৌমার খেলায় মন নেই।  

তবুও না বোঝার ভান করে বলেছিল - বৌমা আজ খোকর সাথে একটা লুকোচুরি খেললে হয় না।

কনক তার মায়ের কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। তাই সে বলেছিল- মা আমি ঠিক আপনার কথার অর্থ বুঝতে পারলাম না।

অনুপমা হেসে ওঠে- তুমি যাও বৌমা, চুপিসাড়ে আমার ঘরে স্টোভ জ্বালিয়ে খিচুড়ীটা রান্না করে নাও, তা না হলে ছেলেটা আমার খেতে পাবে  না। বড় আশা করে ও কথাটা বলেছিল বৌমা।

 কনক যেন সেদিন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। তবুও মা যাতে তার মনের দুর্বলতা ধরতে না পারে সেইজন্য উঠতে উঠতে বলেছিল  – আবার সেই কষ্ট করে রান্না করতে হবে। আমি কি একদিন ও বিশ্রাম পাব না মা?

কনকের কথা শুনে অনুপমার হাসি পেয়েছিল, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে নি। মনের আনন্দে রান্না করতে লেগে গিয়েছিল সে। রান্না করে নিজে যখন নিচে নেমেছিল সুনির্মলের রান্না ও তখন শেষের মুখে।

-যাও তুমি স্নান করে নাও আমি খিচুড়ী নামিয়ে ডিমটা ভেজে নেব। সুনির্মল স্নানে গিয়েছিল। সেদিন সুনির্মলের রান্না করা খিচুড়ীর সামান্য  একটু মুখে দিতেই খিচুড়ির তীব্র ঝালে কেঁদে ফেলেছিল কনক।  তাড়াতাড়ি ওই খিচুড়ী ফেলে দিয়ে  নিজের তৈরি খিচুড়ী সুনির্মলের হাঁড়িতে ঢেলে ডিম ভেজে নিয়েছিল। পাতে বসে সকলেই খিচুড়ীর খুব প্রশংসা করেছিল সেদিন। সুনির্মল বুঝতেই পারেনি প্রকৃত ঘটনা। সুনির্মলের সেদিনের সেই শিশুর মত উচ্ছ্বাস আর উদ্ভাসিত মুখ আজ আবার নতুন করে ধরা দিল কনকের কাছে।

 

কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল কে জানে! কনক ভাবতে বসে। এইতো যেন সেদিনের ঘটনা। খোকন তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে। বড্ড ঠাম্মি ঘেঁষা ছিল ছেলেটা। সুযোগ পেলেই পালিয়ে আসবে আমার ঘরে। এই নিয়ে ওর মায়ের সাথে দিনরাত ঝগড়া চলত খোকনের। আমি অনেক করে বুঝিয়ে ওকে মায়ের কাছে পাঠাতাম। খোকাকে বৌমা নালিশ করলে বলত, থাক না খোকন ওর ঠাম্মির কাছে। খোকন তো আর অন্য কারোর কাছে থাকছে না। ওর যদি ঠাম্মির কাছে থাকতে ভাল লাগে তাতে সমস্যা কোথায়? রাগে গজগজ করতে করতে চলে যেত অণিমা। আমার প্রতি কি যে এত রাগ বৌমার বুঝতে পারতাম না। এমনিতে আমি পারতপক্ষে বৌমার ঘরে যেতাম না, কোনও কাজে বাধা ও দিতাম না তবুও......। মনে পড়ে একদিন আমি আলমারি খুলে আমার লাল রঙের ভেলভেটের বাক্স খুলতে যাচ্ছি দেখি বৌমা আমার ঘরে।

-কি আছে মা ওই লাল বাক্সে? আমি একটু দেখব সোনার গয়নাগুলো? ওগুলো নিশ্চয় আপনার? পুরানো দিনের গয়নাগুলো খুব ভারী হয় না মা? আমার কিন্তু পুরানো দিনের গয়নার খুব সখ।  

 সেই প্রথম আমি মুখের উপর বলেছিলাম না বৌমা ওগুলো দেখে তোমার কাজ নেই। বলেই তাড়াতাড়ি আমি বাক্স বন্ধ করে আলমারিতে রেখে চাবি দিয়ে দিয়েছিলাম। গজগজ করতে করতে সেদিন চলে গিয়েছিল অণিমা। এই ঘটনার জন্য ও যে মনে মনে আমার প্রতি এত রাগ পুষে রেখেছিল তা জানতাম না। জানতে পারলাম ঠিক তিন চার মাস পর। ঠাকুর ঘরে পুজো দিচ্ছি, দেখি বড় খোকা আর বৌমা আমার ঘরে। চোখ মেলে দেখি   খোকার মুখটা রাগে থমথম করছে। তবুও শান্তভাবে বলেছিলাম কিরে হঠাত্‍ করে আমার ঘরে, কিছু বলবি আমায়?

-কোনো কিছু বলার মুখ আছে তোমার? নষ্টা চরিত্র তোমার!

-খোকা! এ তুই কাকে কি বলছিস? কি করেছি আমি?

-তোমার মুখ দেখলে ঘেন্না হয় আমার। ছি:! তোমার পেটে পেটে এত? লজ্জা করে না তোমার? বয়স তো কম হল না। এই বয়সেও এত নিচে নামতে পারলে? আজ থেকে তুমি আর আমায়  খোকা বলে ডাকবে না। কাল থেকে তুমি চিলেকোঠার ঘরে থাকবে। দোতলায় নামার চেষ্টা করবে না। নিচে নামলে জানবে তোমার খোকন মারা যাবে।

-খোকা! একি বলছিস তুই? কান্নায় ভেঙে পড়ে কনক।

অণিমাকে নিয়ে ঘরে চলে যায় সুজন। অণিমার মুখে ক্রূর হাসি ফুটে ওঠে।  পরক্ষনেই খোকন ঠাম্মির ঘরে প্রবেশ করে। ঠাম্মিকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছিয়ে দেয়।

-কেঁদনা ঠাম্মি, আমি সব ঘটনা জানি। তুমি কোনও দোষ করনি। মা আমার সাদাসিধে বাবাকে ভুল বুঝিয়ে তোমার প্রতি প্রতিশোধ নিয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি, একদিন আসবে যেদিন বাবা নিজের ভুল বুঝে আবার তোমায় কাছে টেনে নেবে। এখন ছোট বলে আমার কথা বাবা মানতে  চায়নি।

-খোকন! চিত্‍কার করে ওঠে অণিমা। -ঠাম্মির ঘর থেকে চলে এস এক্ষুনি। আজ থেকে তোমার ঠাম্মির ঘরে যাওয়া বারণ। দু-একদিনের মধ্যেই বাবা তোমায় বোর্ডিং এ রেখে আসবে। এখানে থাকলে তুমি কোনদিনই মানুষ হতে পারবে না।

কান্নায় ভেঙে পড়ে খোকন। কয়েক দিনের মধ্যেই খোকন কে দার্জিলিং এর একটা নামী স্কুলে ভর্তি করে দেয় সুজন। কিন্তু এরই মধ্যে এল এক চরম

দু:সংবাদ। বোর্ডিং এ পাওয়া যাচ্ছে না খোকনকে। চারিদিক তোলপাড় করে খোঁজা হল। থানায় খবর দেওয়া থেকে শুরু করে টেলিভিসনে  নিরুদ্দেশের বিজ্ঞাপণ কোনো কিছুই বাদ গেল না। কিন্তু কোথায় কি ভাবে যেন উবে গেল ছেলেটা।    

  

 সহসা ভাবনায় ছেদ ঘটে কনকের। নিচে পুলিশের গাড়ি এসে থামল। দুপদাপ করে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। আজ কি আবার সৌম্য এসেছে তার কাছে? কি হল আবার কে জানে? কিছুক্ষণ পর একজন পুলিশ এসে তাকে ধরে ধরে দোতলার বারান্দায় নিয়ে আসে। খোকা আর বৌমার সাথে কি সব কথা বলছে একজন পুলিশ অফিসার ঠিক বুঝতে পারে না কনক। তবে বৌমাকে খুব উত্তেজিত বলে মনে হল কনকের। অবশেষে বৌমা ও বড় খোকার উদ্দেশ্যে পুলিশ অফিসার বলে আগামীকাল ঠিক ১১টার সময় আপনারা নবদ্বীপ পুলিশ স্টেশনে  আসবেন। ওখানেই আপনাদের নামে যে অভিযোগ উঠেছে তার একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। যদি ওখানেই সব সমস্যা মিটে যায় তো ভালো, নতুবা এই অভিযোগটা কোর্টে উঠবে। আর কোর্ট যাকেই  দোষী সাব্যস্ত করবে আইন অনুযায়ী সেই শাস্তিই তার প্রাপ্য। আমার দিকে চেয়ে পুলিশ অফিসার বলে আপনাকে আগামীকাল আমাদের গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। কোনও চিন্তা করবেন না, ভয় পাবার কিছু নেই।

 

পরের দিন যথারীতি কনককে পুলিশ জিপে করে থানায় নিয়ে আসে। কনক দেখে থানায় বসে আছে খোকা ও বৌমা। বৌমার সারা মুখে কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব। একটু পরেই থানায় প্রবেশ করে এক পুলিশ অফিসার।   

-দেখুন আপনাদের এক এক করে আমি কিছু প্রশ্ন করব। তারপর আপনাদের মুখোমুখি বসিয়েও কিছু প্রশ্ন করব। আশা করি আপনারা সত্যি কথা বলবেন। আর এই পুরো বয়ানটাই আমরা রেকর্ড করব ভবিষ্যতের কথা ভেবে। সুজন বাবু আপনাকে দিয়েই প্রথম শুরু করা যাক। দয়া করে আপনারা বাকি দুজন পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন। দরকার পড়লে আপনাদের ডাকব।

জেরা শুরু হয়।

-আপনার পুরো নাম?

-সুজন মুখার্জী।

-কি করেন আপনি?

-আমি নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক।

-তা আপনার মায়ের প্রতি অভিযোগটা কি একটু খোলসা করে বলবেন।

সুজন মুখার্জী অধোবদনে বসে থাকে।

-দেখুন, চুপ করে থাকলে হবে না। সত্যের খাতিরে আপনি যা দেখেছেন তাই বলবেন।

- সবটা আমি নিজে দেখিনি। কিছু ঘটনা আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি।

- ঠিক আছে, আপনি আগে বলুন আপনি আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে ঠিক  কি শুনেছেন।

সুজন বলতে শুরু করে। -আজ থেকে প্রায় এগারো-বারো বছর আগের ঘটনা। তখন আমার ছেলে অর্ঘ ক্লাস এইটে পড়ে। ও ছিল আমার মায়ের বড় ন্যাওটা। সুযোগ পেলেই ছলছুতো করে মায়ের ঘরে চলে যেত। পড়াশুনাটা শুধু নিজের ঘরে করত। এছাড়া আর বাকি সবই প্রায় ওর ঠাম্মির কাছে। এমনকি সেই ছোটবেলা থেকেই খাওয়া-শোওয়া সবই ঠাম্মির কাছে।এই নিয়ে আমার স্ত্রী অণিমা প্রায়শ: আমার কাছে নালিশ জানাত। প্রথম প্রথম আমি আমার স্ত্রীর কথায় গুরুত্ব দিতাম না, বরং হেসে উড়িয়ে দিতাম। বলতাম ভালই তো হয়েছে। তোমার খাটনি দূর হয়ে গেছে। আর ও যদি ওর ঠাম্মির কাছে থাকতে চায় তাতে আপত্তি কোথায়? এই নিয়ে অনেক অশান্তি হয়েছিল আমাদের মধ্যে। এর মাসখানেক পর অণিমা আমাকে বলল জানো আমাদের খোকন কেন ঠাম্মির কাছ থেকে আসতে চায় না! আমি নিজে দেখেছি তোমার মা ওকে রোজ সকালে কি যেন  হাতে দেয়। আমার চোখে পড়লে তোমার মা আড়াল করে নেয়। আমার মনে হয় বশীকরণের কোনও ওষুধ। প্রথমে আমি ওর কথা বিশ্বাস করিনি। তাই আমি নিজে খোকনকে ডেকে চুপিসাড়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। কিন্তু খোকন মানে আমাদের ছেলে সৌম্য ও কিছু নয় বলে এড়িয়ে গিয়েছিল। আর এর ফলেই আমার স্ত্রীর কথা  বিশ্বাস করতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

-তা বেশ। এবার আপনি বলুনতো এই ঘটনা ঘটার আগে আপনার সাথে আপনার মায়ের সম্পর্ক কিরূপ ছিল?

-আমার মা হচ্ছে ভালোবাসার প্রতীক। সেই ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্ট করে আমায় মানুষ করেছে। আমি যখন রাত জেগে পড়তাম, তখন আমার মা ও বাড়ির সব কাজ সেরে রাতে আমার পাশে বসে থাকত। আমি বারণ করলেও শুনত না। কত সময় দেখেছি ক্লান্তিতে মায়ের চোখ বুজে আসছে তবুও ঠিক জেগে থাকবে। আমার মনে আছে একবার বিএ ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমার খুব জ্বর হয়েছিল, মাথার অসহ্য যন্ত্রনার জন্য চোখ মেলে পড়তে পারছিলাম না। তখন মা নিজে আমার খাতা থেকে পড়ে আমাকে শুনিয়েছিল আর আমি শুনে উত্তরগুলো ঝালিয়ে নিয়েছিলাম। মায়ের জন্যই সেবার আমি পরীক্ষা দিতে পেরেছিলাম।

- বেশ  এবার বলুন আর কি শুনেছেন আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে?

-মায়ের কাছে শুনেছিলাম আমাদের বাড়িতে আমার ঠাকুরদার আমলে অনেক ভারী ভারী সোনার গহনা ছিল। যদিও কোনদিনও দেখার তাগিদ আমর ছিল না। কারণ গহনার প্রতি কোনোদিনই  আমার বিন্দুমাত্র  লোভ ছিল না। কিন্তু অণিমা আমায় বলেছিল যে মায়ের ঘরে আলমারির মধ্যে একটা লাল ভেলভেটের বাক্স দেখেছে যার মধ্যে অনেক সোনার গহনা আছে। আর আমার স্ত্রী  দেখতে চাওয়ায় মা নাকি  তাড়াতাড়ি বাক্স চাবি দিয়ে আলমারিতে বন্ধ করে দিয়েছে। আমার গহনার প্রতি লোভ নেই কিন্তু খারাপ লাগে এই ভেবে যে মা কেন বিশ্বাস করে গহনা দেখাতে চাইল না? আমি কি ওই গহনা নিয়ে নেব? তবে বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর থেকেই এই ঘটনা.......

-দাঁড়ান,দাঁড়ান!  নিরুদ্দেশ মানে?

- আসলে আমার বাবা চাকরি থেকে অবসর নেবার পর পুরোপুরি  ধর্মে-কর্মে মন দেন। তিনি  বলতেন এখন বুঝতে পারছি জীবনে সংসার ধর্ম করার মধ্যে কোনও আনন্দ নেই। আনন্দ আছে পরার্থে সেবা করার। তাই তিনি ভারত সেবাশ্রম সংঘে নিজেকে নিয়োজিত করেন। মা-আমি অনেক করে বাবাকে বুঝিয়েছিলাম কিন্তু বাবা নিজের জেদ ছাড়েননি। মাকে বলতেন আমি তোমার জন্য ব্যাঙ্কে টাকা রেখে দিয়েছি।ওই টাকার উপর সম্পূর্ণ অধিকার তোমার। তুমি ঠিক করবে ভবিষ্যতে ওই টাকা কি করবে।যদি তোমার ছেলে তোমায় কোনদিন না দেখে তাহলে  ওই জমা টাকার যে সুদ হবে তাই দিয়ে তুমি তোমার  ভরণ-পোষণ  ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে। আর এখন তোমার ছেলে কলেজের অধ্যাপক, ভাল অর্থ রোজগার করে। আমি জানি ও ঠিক তোমাকে দেখবে। তোমার ছেলের প্রতি সেই বিশ্বাস আমার আছে।

এই বলে গভীর একটা দীর্ঘ-নিশ্বাস ফেলে সুজন।

-তারপর?

-সৌম্য তখন ফাইভে পড়ে। তখন থেকেই বাবা পাকাপাকি ভাবে ওখানে থাকতে শুরু করে। মাসে এক দুবার করে ঘুরে যেতেন। তারপর হঠাতই বাড়িতে আসা একেবারে বন্ধ করে দিলেন। আমি নিজে মাকে নিয়ে কলকাতার ভারত সেবাশ্রমে খোঁজ নিই। কিন্তু ওখানকার সেক্রেটারি বাবার সম্বন্ধে কোনও খোঁজ দিতে পারেননি। তিনি শুধু এটুকুই জানাতে পেরেছিলেন যে আমার বাবা আজ প্রায় চার মাস হল কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছেন আর যাবার কারণ জানিয়ে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে গেছেন।

-সেই চিঠি আপনি দেখেছেন?

-হ্যাঁ, আমি দেখেছি।

-কি লেখা ছিল সে চিঠিতে?

- চিঠিতে দুটো লাইন লেখা ছিল।

-সেই চিঠি কি আপনার কাছে এখন আছে?

-হ্যাঁ, যদি আপনাদের কাজে কাজে লাগে সেই জন্য এনেছি।

-দেখি সেই চিঠি।

চিঠিটা হাতে দেয় সুজন।

অফিসার চিঠিটা পড়ে।

“কনক” আমি আরও বৃহত্তর মানবজাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার জন্য অচেনা পথে যাত্রা করলাম। ছেলেকে নিয়ে ভাল থেকো। আমার খোঁজ করার চেষ্টা করো না।

-ইতি সুনির্মল

-এরপর থেকে আপনার মায়ের মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখেছেন?

-তারপর থেকেই মা আমার ছেলেকে আরও নিজের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তখন সৌম্য ক্লাস ফাইভে পড়ে। শুধু তাই নয় সংসার থেকে নিজেকে একেবারে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তার কাছে তখন একমাত্র সম্বল আমার ছেলে আর ঠাকুর ঘর।

-আপনার মা কে আপনার স্ত্রীর সাথে  কোনদিন খারাপ ব্যবহার করতে দেখেছেন?

 

-না, মা নিজের ঘর থেকে পারতপক্ষে বেরতেন না। আর আমার স্ত্রীর সাথে সেরকম কথাবার্তা ও হতো না।

-এর অর্থ দাঁড়ায়, যে আপনার স্ত্রীর সাথে আপনার মা কোনদিনই খারাপ ব্যবহার করেননি তাইতো?

-হ্যাঁ, তাইতো মনে হয়।

-আচ্ছা সুজনবাবু আপনার কি ধারণা আপনার ছেলের নিখোঁজ হবার পিছনে আপনার মায়ের কোনও ভূমিকা আছে?

-এ আপনি কি বলছেন? মা এই কাজ কেন করবেন? আপনি জানেন না আমার মা আমার ছেলেকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসেন!

-না, তাতো ঠিক! কিন্তু.....

-কোনও কিন্তু নয় অফিসার।

-আচ্ছা এই প্রসঙ্গ থাক। পরের  প্রসঙ্গে আসা যাক। আমি যতদূর শুনেছি আপনি আপনার মাকে চিলেকোঠার ঘরে নির্বাসিত করেছেন। এমন কি নিজের নাম ধরে ডাকতেও বারণ করেছেন। এর কারণ কি শুধু এইজন্য নাকি অন্য কারণও আছে?

-এটা আমাদের ঘরের মান-সম্মানের প্রশ্ন। তাই আমি এই প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দেব না।

-তা বললে কি করে হবে সুজনবাবু? যিনি আপনাদের বিরুদ্ধে থানায় ডায়রী করেছেন তিনি তো আর অনেক কিছু আমাদের জানিয়েছেন। কাজেই আপনি না বলতে চাইলেও এটা এখন আর আপনাদের ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।

-আপনি যা জানেন নিশ্চিন্তে বলুন। আমি কথা দিচ্ছি, যদি আপনাদের সমস্যা এই থানাতেই সমাধান হয়ে যায় তাহলে এই গোপন কথা আর কেউ কোনদিন জানতে পারবে না। যদি কোর্টে যেতে হয় তাহলে অন্য ব্যাপার।

 

     সুজন ভাবার জন্য একটু সময় নেয়। ঘটনাটা কি ভাবে বলবে ঠিক ভেবে পায় না। মায়ের এই কলঙ্কের কথা অফিসার কে বলতে তার শিক্ষিত রুচিতে বাধে। অগত্যা বাধ্য হয় বলতে।

-বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর থেকেই মা নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছিল। আমাদের কোনও সাতে-পাঁচে থাকত না। শুধু ঠাকুরঘর  আর আমার ছেলে। এর ঠিক কয়েক বছর পর তখন আমার ছেলে  ক্লাস এইটে পড়ে। একদিন আমার স্ত্রী আমায় মায়ের সম্পর্কে একটা ভয়ংকর খবর জানায়। প্রথমে আমি বিশ্বাসই করিনি, উল্টে আমি আমার স্ত্রীকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছিলাম। ছি:ছি:! এত নীচ মনোবৃত্তি তোমার! প্রমাণ দিতে পারবে তুমি? যদি না পার, তবে জানবে তোমার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করব আমি। তখন আমার স্ত্রী আমায় এর প্রমাণ দেবে বলে অঙ্গীকার করে।

-কি গোপন কথা?

একটু চুপ করে থেকে- আমাদেরই প্রতিবেশী নরেন মল্লিকের সাথে মায়ের  অবৈধ সম্পর্ক আছে! উনি নাকি মাঝে মধ্যেই রাত করে মায়ের ঘরে আসেন, আবার কিছুক্ষণ পরেই চলে যান।

-এটা হয়ে থাকলে তো আপনার স্ত্রীকে দোষ দেওয়া যায় না। তা আপনি স্বচক্ষে  ঘটনাটা দেখেছিলেন?

- হ্যাঁ, একদিন রাতে আমার স্ত্রী আমায় চুপিসাড়ে মায়ের ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। তাই জানালা দিয়ে আমি ভিতরে চোখ রেখেছিলাম। বিশ্বাস করুন এইভাবে ঘরে উঁকি দিতে আমার লজ্জা করছিল আর রুচিতে বাধছিল। তবুও....

-না, এতে আপনার দোষ কোথায়? যাইহোক কি দেখলেন ভিতরে?

-কাঁচের ভিতর থেকে অল্প আলো আসছিল। তাতেই দেখতে পেলাম মা নিচে বসে আছে আর মায়ের  একেবারে কাছেই বসে আছে নরেনবাবু।

-কি কথাবার্তা হচ্ছিল শুনতে পেয়েছিলেন?

-না, দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় কিছু শুনতে পাইনি।

- নরেনবাবুকে চিনতে পেরেছিলেন?

-না, নরেনবাবু জানালার দিকে পিছন ফিরে বসেছিল। তবে বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি।

-বেশ বেশ! তা এরপর আপনি আর আপনার স্ত্রী কি করলেন? দরজায় আঘাত করে ভিতরে ঢুকলেন নাকি চিত্‍কার করে পাড়ার লোক ডাকলেন?

-ছি:!নিজের ঘরের কলঙ্ক বাইরে জানতে দিতে আছে?

-তা আপনি পরের দিন মাকে এই ঘটনার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেছিলেন?

- ছেলে হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করতে আমার রুচিতে বেধেছিল। আমি শুধু বলেছিলাম তুমি অতি নীচ কাজ করেছ। তাই কাল থেকে তুমি চিলেকোঠার ঘরে থাকবে। দোতলাতে নামবে না আর আমার নাম তুমি মুখে নেবে না। এই বলে আমি আমার ছেলের দিব্যি দিয়েছিলাম। কারণ আমি জানি ছেলের দিব্যি দিলে মা নিচে নামবে না।

-আপনি যখন এই কথা বললেন তখন আপনার মা এর কারণ জানতে চায়নি?

-না, মা শুধু ‘খোকা’! একি বলছিস তুই? কি করেছি আমি? বলেই নির্বাক হয়ে গিয়েছিল। শূণ্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

-ঠিক আছে, আপনি এখন পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। এরপর আবার আপনাদের সকলকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করব।

বেল বাজিয়ে অফিসার অণিমাদেবী কে আসতে বলে। সুজনবাবুর স্ত্রীকে প্রথম দর্শনেই খুব চালাক বলে মনে হল অফিসারের।

-বসুন।

-আপনার নাম?

-আমার নাম তো আপনি জানেন। আবার কেন জিজ্ঞাসা করছেন?

-যা বলছি  ঠিক তার উত্তর দিন। বেশি স্মার্ট হবার চেষ্টা করবেন না।

বিরক্তি সহকারে -অণিমা মুখার্জী।

-আপনার পরিবারে আর কে কে আছেন?

-আমার স্বামী,আর ওই যত নষ্টের শাশুড়ি।

-ভদ্রভাবে কথা বলুন। এটা থানা, আপনার বাড়ি নয়। শাশুড়িকে সম্মান করতে শিখুন। এরপর থেকে এইভাবে কথা বললে হাজতে চালান করে দেব। কথাটা মনে রাখবেন। এখন থেকে আমি যা যা জিজ্ঞাসা করব  তার ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন, চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। নিশ্চয় জানা আছে ‘পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা’। এবার বলুন আপনার শাশুড়ি আপনার সাথে কিরকম ব্যবহার করে?

-ব্যবহার! উঠতে বসতে খিটখিট করে। নিজের থেকে কিছু করার স্বাধীনতা নেই। সবেতেই নজরদারী।

- এটা কি আপনার বিয়ের ঠিক পরপর থেকে শুরু হয়েছিল?

-না, একদম প্রথমে নয়। আমার ছেলে কোলে আসার পর থেকেই খিটখিট শুরু হয়েছিল।

-আপনার ছেলেকে আপনার শাশুড়ি ভালবাসত?

-একদমই নয়, আমার যখন খুব কাজের চাপ থাকত, তখন আমি শাশুড়িকে ছেলেকে ধরতে বললে বিরক্তি সহকারে ধরত। আমি বলতাম মা ওতো আপনার নাতি হয়। ওকে একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখলে আমার হাতের কাজগুলো সারতে পারি।

-হুম,তা আপনার সাথে আপনার শাশুড়ির ঝগড়া হত?

-ঝগড়া! রাতদিন আমাকে মুখ শোনাচ্ছে। আমি চুপ করে থাকি বলে ঝগড়া করার সুযোগ পায় না।

-আচ্ছা, আমি শুনেছি আপনার শশুর একেবারে মাটির মানুষ ছিলেন।  একথা কী সত্যি?

-একদম ঠিক শুনেছেন।

-আপনার শশুর কি নিরুদ্দেশ হবার আগে আপনাদের সম্পত্তি ভাগ করে দিয়ে গেছেন?

-না, ভাগ করে দেবেন কি ভাবে? শাশুড়িই হতে দেয়নি।শশুরের যাবতীয় টাকা-পয়সা, যত সোনা-দানা, সবই শাশুড়ির হেফাজতে। এমনকি এই বাড়িও শুনেছি শাশুড়ির নামে। দলিল দেখার সুযোগ হয়নি কখন।আর আমার স্বামীও বড্ড সাদাসিধে,বললেও মায়ের  কাছে জানতে চায়নি কিছু।

-আপনাদের সংসারে শাশুড়ি কোনও আর্থিক সাহায্য করে।

-শশুর চলে যাবার পর কয়েক মাস করেছে, তারপর থেকে বন্ধ।

-গহনা বা সোনা-দানা যা আছে আপনাকে দিয়েছে?

-হ্যাঁ, তা কিছু আমায় দিয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক গহনা নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। আমি নিজে দেখেছি মাঝে-মধ্যেই শাশুড়ি আলমারির থেকে  লাল ভেলভেটের গহনার বড় বাক্স খুলে দেখছে। আমি দেখতে চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে চাবি দিয়ে আলমারিতে তুলে রাখত।

-ওই আলমারিতে আর কি আছে?

-এমনিতে এমন কিছু নেই। আছে নিজের কয়েকটা শাড়ি আর টুকিটাকি জিনিস।

-হুম, আমি শুনেছি যে আপনার ছেলে সৌম্যকে শাশুড়ি খুব ভালোবাসতেন, এটা কি সত্যি?

-সত্যি না ছাই। আমার কাছ থেকে ছেলেকে পর করে দেবার জন্য ওকে আমার নামে নিন্দা-মন্দ করত।

-তা একথা আপনি জানলেন কি করে?

-কেন খোকন আমায় বলেছিল।

 বলেই ছেলের শোকে কেঁদে ফেলে অণিমা। কিছুক্ষণ উভয়েই চুপ।

-আমার শেষ প্রশ্ন হল আপনি আপনার শাশুড়ির কেচ্ছার ব্যাপারটা জানতে পারলেন কি ভাবে?

ক্রূর হাসি হেসে ওঠে অণিমা।

-দেখুন আমরা মেয়েমানুষ, আমাদের চোখকে ফাঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। আপনারা পুরুষমানুষ তাই  বুঝতে পারেন না। আমি বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম যে শশুর নিরুদ্দেশ হবার কয়েক বছর পর  থেকেই শাশুড়িকে আবার চনমনে দেখাচ্ছে। আমি ও তক্কে-তক্কে ছিলাম। তারপর একদিন দেখি শাশুড়ি রাতের বেলায় চুপিচুপি নিজের ঘর থেকে  বেরিয়ে সদর দরজার দিকে যাচ্ছে। দেখেই আমার কেমন যেন সন্দেহ হল, আমিও পা  টিপেটিপে অনুসরণ করলাম। ওমা! যা ভেবেছি ঠিক তাই।  ওই নষ্টা বুড়ি ......

আমার চোখে চোখ পড়তেই নিজেকে সামলে নেয়।  

-না, মানে আমার শাশুড়ি চুপ করে দরজা খুলে দিল। আর ও মাগো! দেখি দরজা খুলে ঘরে ঢুকছে আমাদের নরেন মল্লিক। লজ্জায় আমি তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম।

-আপনি এই ঘটনা আপনার স্বামীকে বলেননি?

-না, আমি ভাবলাম আরও কিছুদিন দেখি তারপর বামাল সমেত প্রমাণ দেব।

-এরপর আর কোনদিন এসেছিল ওই নরেন মল্লিক?

-আসবে না আবার! এর কয়েক মাস পর আবার সেই ঘটনা। সেদিনই আমি আমার স্বামীকে নিজে নিয়ে গিয়ে সব দেখালাম।

-আচ্ছা আপনি নরেন মল্লিককে কেন চেপে ধরলেন না?

-জানেন, প্রথমে ভেবেছিলাম নরেন মল্লিককে হাতেনাতে ধরে একটা হেস্তনেস্ত করব। কিন্তু লোক লজ্জার ভয়ে কিছু করতে সাহস হয়নি।

-নরেন মল্লিকের পাড়াতে সুনাম আছে?

-মোটেও না। কান পাতলেই নরেন মল্লিকের নামে নানা কথা শোনা যায়।

-ঠিক আছে। আপনি পাশের ঘরে বসুন, দরকার পড়লেই আবার ডাকব।

এরপর অফিসার কনকদেবীকে ডাকলেন।

-আপনি কি জানেন আপনার নামে যে অভিযোগগুলো এতদিন আপনার ছেলে ও বৌমা করেছিল তার বিরুদ্ধে আমাদের থানায় এফ.আই.আর. করা হয়েছে?

- না বাবা, আমি জানব কি করে? আর এতদিন পর এইসব করে কি লাভ বাবা? আমার অনেক বয়স হয়ে গেছে, আর নতুন করে জীবনে আমার কিছু পাবার নেই।

-তা বললে কি করে হবে মা?

-তুমি আমাকে মা বলে ডাকলে বাবা! কতদিন এই ডাকটা আমি শুনিনি।   ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন বাবা।

-এবার আপনাকে আমি যে যে প্রশ্ন করব আপনি তার ঠিকঠিক  উত্তর দিলে আপনার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো বিচার করতে সুবিধা হবে। আশা করি আপনি আমায় সহযোগিতা করবেন।

-বল কি জানতে চাও?

-আপনার কাছে একটা লাল বাক্স আছে, যেটা আপনার বৌমা অনেকবার দেখতে চেয়েছিল কিন্তু আপনি দেখতে দেননি। এই অভিযোগ কি সত্যি?

-হ্যাঁ, সত্যি।

-কিন্তু কেন দেখতে দেননি আমায় বলবেন?

- না, এটা আমি বলব না।

-আচ্ছা, আমায় বলতে হবে না, কিন্তু বৌমাকে বলেননি কেন?

-বলার অসুবিধা আছে।

-আচ্ছা, আপনি নাকি যতদিন সৌম্য আপনার কাছে ছিল, ততদিন তার    হাতে রোজ কিছু একটা দিতেন?

- হ্যাঁ, ঠিক বলেছে।

- কি দিতেন? কোনও ওষুধ?

-না।

-তাহলে কি?

-আমি বলতে পারব না।

-দেখুন, সব কিছু প্রশ্নের উত্তরে যদি আপনি ‘না’ বলেন, তাহলে কেসটার মীমাংসা করব কি করে?

-আমি তো তোমায় আগেই বলেছি, ওরা আমার নামে যা যা অভিযোগ এনেছে তার বিরুদ্ধে আমার কোনও বক্তব্য নেই। সবই সত্যি।  

-তাহলে এখানে এসে আপনার লাভ কি?

-আমি তো আসতে চাইনি, তোমরাই আমায় নিয়ে এসেছ।

-একটা কথা আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার নামে অভিযোগ যে, এক-দুদিন পাড়ার নরেন মল্লিক কাউকে কিছু না জানিয়ে আপনার ঘরে রাতে এসেছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার কিছু বলার আছে?

-না, বলার নেই। আমার ঘরে সত্যিই লোক এসেছিল।

অফিসার এই কথা শুনে অবাক হয়ে যায়। তাহলে তো অভিযোগ মিথ্যে নয়। কারণ উনি নিজের মুখেই এই কথা মেনে নিচ্ছেন। অফিসারের মন থেকে কনকদেবীর উপর  যে শ্রদ্ধা ছিল তা উধাও হয়ে যায়।

-আপনি আসুন। প্রয়োজনে ডাকব।

কনক ধীরে ধীরে পাশের ঘরে প্রবেশ করে।

ঠিক এই সময় সৌম্য পাঞ্জাবীর ছদ্মবেশে অফিসারের ঘরে ঢোকে। স্যারের ছদ্মবেশ দেখে অফিসার অবাক হয়ে যায়। অফিসার সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।

-আরে আপনি বসুন। এখন আপনি অফিসের চেয়ারে বসে আপনার কর্তব্য পালন করছেন।যাইহোক, এদিকের পরিস্থিতি কি, জেরা করে কিছু বুঝতে পারলেন?

-হ্যাঁ, স্যার কিছুটা বুঝেছি। সব পক্ষের কথা শুনে মনে হল কনকদেবীর ছেলে ও বৌমা যা বলেছে তার অনেকটাই সত্যি। কনকদেবী নিজমুখে অভিযোগ স্বীকার করেছেন।

-ঠিক আছে। এখন আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। ওনাদের তিনজন কে একসাথে ডাকুন। আর আমি নিজে আরও দুজন সাক্ষীকে নিয়ে এসেছি। ওনাদের আমি আলাদা ঘরে বসিয়েছি। আমার মনে হয় অফিসার, এই মামলার ক্ষেত্রে ওনাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। হ্যাঁ, আর আমি না বলা পর্যন্ত আমার পরিচয় দেবেন না।

 

     অফিসার তিনজন কে ঘরে ডাকে। সেখানে সৌম্য ও উপস্থিত থাকে।

সৌম্যের দিকে কনক অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বড্ড চেনা চেনা লাগে তার। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারে না।

-ওনাকে ভয় পাবার কিছু নেই। উনি পাঞ্জাবি হলেও কলকাতায় বহুদিন থাকার সূত্রে বাংলা বলতে ও বুঝতে পারে। উনি এখন আপনাদের কিছু প্রশ্ন করবেন। সত্যি উত্তর দেবেন।

সৌম্য শুরু করে-হামি আপনাদের কথা বহুত শুনেছি। আপনাদের কেস ফাইল ভি দেখেছি। তাই সচ সচ বাত বলবেন। নহী তো মুশকিল মে পড়ে  যাবেন। অচ্ছা, অণিমাদেবী পহলে আপনি বোলেন। আপনি বলছেন কি কনকদেবী আপনার সাথে খরাব ব্যবহার করেন লেকিন আপনার হাজব্যান্ড বোলছেন কি ওনার মা কিসি কি সাথ খরাব ব্যবহার কোরে না। কোনটা সচ আছে?

-না আগে করত না এটা ঠিক, কিন্তু ওনার স্বামী নিরুদ্দেশ হবার পর থেকেই খারাপ ব্যবহার করতেন।

-অচ্ছা ও ছোড় দিজিয়ে। আপনি বলছেন কি আপনার শাশুড়ি হরদিন আপনার লড়কাকে এক  দবাই দিতো জিসকে কারণ আপকা লড়কা অলগ হো গয়া।

-ঠিক তাই।

-ও দবাই আপনি খুদ দেখেছেন? কোই প্রুফ আছে?

-না, আমার ছেলের কাছ থেকে জেনেছি। আমার ছেলে নিরুদ্দেশ না হলে আপনি ওর কাছ থেকেই সত্যি জানতে পারতেন।

-সচ বাত।

- আমি সব সত্যি কথাই বলি। ওইতো শাশুড়ি এখানেই আছেন ওনাকে জিজ্ঞেস করুন আমায় ভেলভেটের লাল বাক্স কোনদিন দেখতে দিয়েছে কিনা?

-নহী,নহী,  আপনি সচ বোলছেন। আমি  বিশওয়াস করছি।

 

-অচ্ছা, আপনি এখন বোলেন  নরেন মল্লিক কেমন আদমি আছে?

-একদম ভাল নয় স্যার। মেয়েদের প্রতি একটা দুর্বলতা আছে। তার উপর  নেশা করে। চরিত্র একদম ভাল নয়।

-উমর কতো আছে?

-তা চল্লিশ-বিয়াল্লিশ হবে।

-এত কম উমর আদমির কনকদেবীর সাথে কি বাত থাকতে পারে?

- তা আমি কি করে বলব স্যার।

-আপনার শ্বশুরের ঘর ছোড়নে কা কোই কারণ?

-শুনেছি অবসরের পর উনি ধর্মে মন দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমার শাশুড়ির সাথে ওনার বনিবনা না হওয়ায় বাড়ি ছেড়েছিলেন।

হুম।– এবার বোলেন ওই রাতে নরেনবাবু জব আপকা ঘর আসেন আপ দূর সে ঠিক পেহচান গয়ে থে?

-চিনব না আবার! ওকে খুব ভাল করে চিনি।

-বেশ বেশ। নরেনবাবু উস ঘর পে কিতনা সময় থে?

-আমি তো সারাক্ষণ ছিলাম না, তবে আন্দাজে মনে হয় এক-দু ঘণ্টা পর চলে গেছিল।

-ঠিক হ্যায়।

-এবার প্রোফেসর সাব আপনি বোলেন অভি ভি আপনি আপনার মাকে অবিশওয়াস কোরেন?

-এক এক সময় মনে হয় আমি যা দেখেছি বা শুনেছি সব ভুল, আবার কখন মনে হয় হতেও পারে।

-আপ পহলে  নরেনবাবু কো পেহচানতে থে? কেমোন আদমি আছে?

-হ্যাঁ,চিনতাম। শুনেছি চরিত্র ভাল নয়।

-আপ অভী ভি সোচ কে বোলেন উসি দিন ঘরে নরেনবাবু থে?

-পিছন ফিরে ছিল, তাই মুখ দেখতে পাইনি। তবে মনে হয় নরেনবাবু।

- ঠিক হ্যায়।

-অভী মাইজি, আপনি বোলেন আপকি বহু জো বাত বলেছে ও ঠিক হ্যায় কি নহী?

-আমার কিছু বলার নেই। আমি সব মেনে নিচ্ছি। থানা থেকে যা শাস্তি দেবে আমি মেনে নেব।

-ইসকা মতলব আপনি কুছ বোলবেন না। ঠিক হ্যায়।

 

     সৌম্য অফিসারের কানে কানে কিছু একটা বলল। অফিসার থানার এক কনস্টেবল কে পাশের ঘর থেকে একজন সাক্ষিকে নিয়ে আসতে বলল। একটু পরেই ঘরে ঢুকল নরেন মল্লিক। নরেন কে দেখেই অণিমা চমকে উঠল। সৌম্য দেখল তার মায়ের মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেছে। সব দেখে সৌম্য মুচকি মুচকি হাসে।

-আইয়ে নরেনবাবু।

-আমায় থানায় কেন জোর করে ধরে আনা হয়েছে বলবেন? আমার এদের সঙ্গে সম্পর্ক কি?

-সমঝ জায়েঙ্গে। আপনি এদের পেহচনতে থে?

-হ্যাঁ, একই পাড়ার তাই চিনি।

-অণিমাদেবী অউর প্রোফেসর সাব বোলছেন কি আপনি রাত করে চুপকে চুপকে কনকদেবীর ঘরে ঘুসেছিলেন।

-না স্যার, ওরা মিথ্যা কথা বলছে। আমি কোনদিন ওদের বাড়ি যায়নি স্যার, বিশ্বাস করুন। আর উনি আমার কাছে সাক্ষাত্‍ দেবী। আমি স্বীকার করছি যে আমার একটু চরিত্রের দোষ আছে। তা বলে এত বড় মিথ্যা!

অণিমা চিত্‍কার করে বলে ওঠে। -না স্যার, বিশ্বাস করুন নরেন মল্লিক দুদিন রাতে আমার শাশুড়ির ঘরে এসেছিল। আমার স্বামী ও দেখেছে।

-না আমি মুখ দেখতে পাইনি। তুমি বলেছ উনি নরেনবাবু সেই কথা বিশ্বাস করে আমি বলেছি। সুজন বলে ওঠে।

-ঠিক আছে। আপলোগ ঝগড়া মত কিজিয়ে।

-দুসরা আদমিকে বুলাও।

একমুখ দাড়ি নিয়ে ঘরে যে প্রবেশ করল, তাকে দেখে কনক বাদে বাকি সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। এই অবস্থার মুখোমুখি যে দাঁড়াতে হবে অণিমা ভাবতেই পারেনি। এক লহমায় এতদিনের সব জারিজুরি যেন শেষ হয়ে গেল।

-আইয়ে।

-ঘরে যিনি প্রবেশ করলেন তিনি আর কেউ নন সুনির্মল মুখার্জী।

-এনাকে আপলোগ চিনতে পারছেন? ইয়ে সুনির্মল মুখার্জী। কনকদেবী কে পতি আছে।

সুজন বাবাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরে। সবার মাঝেই ডেকে ওঠে বাবা! এদিকে অণিমা একটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে। এবার কি সব চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাবে?

-সুনির্মলবাবু আপকা লড়কা অউর বহু বোলছে কি আজ সে প্রায় দশ-বারো সাল পহলে আপকি বিবি কে ঘর মে দো-বার রাত কো নরেন মল্লিক আয়া অউর আপকা গায়েব হোনে কা কারণ ভি আপকী বিবি থী। আপকো কুছ কহনা হ্যায়?

-না, তুমি কিছু বলবে না। কনক চিত্‍কার করে কেঁদে ওঠে। 

-না কনক, আমাকে বলতে বাধা দিও না। আমি জানতাম না যে আমার ভুলের জন্য তোমাকে আজ দশ-বারো বছর কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে। তাই আমাকে সব বলতে হবে।

কনকের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

-আপ বোলিয়ে। 

-হুজুর, সে আজ অনেক বছর আগের ঘটনা। আমার নাতির বয়স তখন দশ-এগারো বছর হবে।প্রায় আমি দেখতাম নরেন মল্লিক আমার পুত্রবধুর সাথে লুকিয়ে চুরিয়ে কথা বলছে। এটা আমার পছন্দ হয়নি। আর এই লজ্জার ঘটনার কথাও আমি কাউকে বলতে পারিনি। বাধ্য হয়ে আমি একদিন নরেন মল্লিক কে বললাম তুমি আমার বাড়িতে কোনদিন আসবে না আর আমার বৌমার সাথে কথাও বলবে না। এরপর আবার একই ঘটনা ঘটলে আমি তোমার স্ত্রীকে সব জানাতে বাধ্য হব। নরেন মল্লিক আমায় হুমকি দেয় যে এর পরিণাম ভাল হবে না। এর ফল ভুগতে হবে। এরপর বেশ কয়েক মাস নরেন মল্লিক কে আমাদের বাড়ির ত্রি-সীমানায় আসতে দেখিনি। একদিন আমি আমার নাতি কে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরতে রাত নটা বেজে গিয়েছিল। আমি জানি ওর মা ওকে বকবে তাই নিজে ওকে সঙ্গে করে দোতলায় ওর ঘরে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি, দেখি সিঁড়ির এক কোণে নরেনের সাথে আবার কথা বলছে বৌমা। আমার নাতির ও চোখে পড়ে ঘটনাটা। ও ছোট ছিল বলে পুরোটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু একটা খারাপ কিছু অনুমান করেছিল। কারণ তারপর থেকেই ও ওর মায়ের কাছে থাকতে চাইত না। সুযোগ পেলেই আমাদের ঘরে চলে আসত। আমি নাতিকে সেদিনের ঘটনা কাউকে বলতে বারণ করে দিয়েছিলাম। কাজেই এই ঘটনা আমি আর আমার নাতি ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। আজ যদি আমার নাতি থাকত তাহলে আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস করতে সুবিধা হত। এরপর একদিন বৌমা প্রতিশোধ নেবার জন্য এবং বাড়ি থেকে আমায় তাড়াবার জন্য আমার প্রতি এক জঘন্য আচরণ করে। যদিও সে ঘটনা আমি আপনাদের বলতে পারব না। আর আপনারা ওই ঘটনা কল্পনা ও করতে পারবেন না। তবে এটুকু বলতে পারি যে  সেই কারণের জন্যই আমি ঘর ছাড়তে বাধ্য হই। বিশ্বাস করুন আমি যা বলছি সব ধ্রুব সত্যি। আমার সামনেই বৌমা বসে আছে, মনে হয় ও এখন স্বীকার করতে বাধ্য হবে।

-না উনি মিথ্যা বলছেন। আমার নামে কলঙ্ক দেবার জন্য এইসব মনগড়া কথা বলছেন। অণিমা চিত্‍কার করে ওঠে।

- চুপ হো জাইয়ে। সৌম্য ধমক দেয়।

-ক্যায়া নরেনবাবু কৌন ঠিক বোলছে? সচ বোলিয়ে নহী তো জেল হো জায়েগা।

নরেন মল্লিক ভয়ে মাথা নিচু করে সব  অপরাধ স্বীকার করে নেয়।

–স্যার সুনির্মলবাবু সত্যি কথাই বলছেন। আমি কনকদেবীর ঘরে কোনদিন যাইনি। বরং আমার সম্পর্ক ছিল ওনার বৌমার সাথে।   

-অভী বাকি কথা বোলেন সুনির্মলবাবু ।

-আমি ভারত সেবাশ্রম সংঘে প্রায় চার মাস থাকার পর নতুন করে ভারতবর্ষ কে চেনার জন্য অজানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ি। আর আমি একটা চিঠি লিখে রেখে যাই এইজন্য যে এখানে আসার পর আমার চিঠি পেয়ে কেউ যেন আমায় না খোঁজে। আমার মন জুড়ে তখন ভারতবর্ষ কে জানার বাসনা  আর লক্ষ্য মানব জাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। এইভাবে প্রায় দু-বছর সারা ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে ঘুরেছি, ভারতবাসী কে জেনেছি। বহু সাধকের সান্নিধ্যে এসেছি। কিন্তু দু-বছর পর আমার মনে হল আমি যদি নিজের স্ত্রীকেই শান্তি দিতে না পারি তাহলে সমগ্র ভারতবাসীর দুর্দশা দূর করে শান্তির বাণী শোনাবো কি করে? তাই একদিন আমি রাতে আমার স্ত্রীর কাছে আসি। তাকে আমার এতদিনের উপলব্ধির কথা বলি।আমি ওকে আমার সঙ্গে থেকে মানব জাতির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার কথা বলি। কনক  ভাবার জন্য সময় চায়। এরপর আমি কয়েক মাস পর আবার আসি কনকের কাছে। কনক আমার সাথে যেতে রাজি হয়। ঠিক হয় এক সপ্তাহ পর ও আমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এক সপ্তাহ পর কনক আর আসেনি। না আসার কারণ এখন বুঝতে পারছি। আমার বৌমা, কনকের সাথেও একই ভাবে আবার নোংরা খেলায় মেতেছে। আমি নিশ্চিত বৌমা সেদিন আমায় দেখে চিনতে পেরেছিল, কিন্তু আমার স্ত্রীকে ছেলের সামনে ছোট করার জন্য নরেনের নাম নিয়েছিল। ছি: বৌমা ছি:!

-ঠিক আছে আপ বয়ঠিয়ে। অব হামি বলি পরের বাত।

এই বলেই এক ঝটকায় নিজের ছদ্মবেশ খুলে ফেলে সৌম্য। ঘরের উপস্থিত সকলেই অবাক হয়ে যায়। একটা পিন পড়লে বোধহয় শব্দ শোনা যাবে। অণিমা মাথা নিচু করে বসে থাকে।

সৌম্য বলতে শুরু করে- আমি এখন যেটা বলব সেটা একটা গল্পের মত শোনাবে। ছোটবেলা থেকে আমি ঠাম্মির স্নেহেই বড় হয়েছি। একটু জ্ঞান হতে বুঝলাম  আমার মা  নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত। বাবা ছিল অতি সাদাসিধে আপনভোলা মানুষ। কারোর সাতে-পাঁচে থাকত না। তাই বাবাকে কবজা করতে মায়ের কোনদিনই অসুবিধা হয়নি। আমি কোনও সময় মায়ের নামে বলতে গেলেও বাবা শুনতে বা বুঝতে চাইত না। আর ওই যে ঠাম্মির নামে অভিযোগ, ঠাম্মি নাকি আমাকে প্রতিদিন ওষুধ দিত সেটা ছিল আমার সুরক্ষার জন্য প্রতিদিন আমার হাতে দশ-কুড়ি টাকা তুলে দেওয়া। যখন যা পেত আর কি! আমি সেই টাকা ঠাম্মির কথামত ঠাকুর ঘরে একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখতাম। মা-বাবা কাউকে কোনদিন বলিনি।

এখন বাকি রইল লাল ভেলভেটের বাক্সের ইতিহাস। এই ইতিহাস বড় করুন।

-খোকন ওই কথাটা আর বলিস না বাবা। ঠাম্মি আর্তনাদ করে ওঠে।

-না, ঠাম্মি। আজ তোমার কোনও কথা আমি শুনব না। আমায় সব বলতেই হবে। আজ দীর্ঘ দশ-বারো বছর ধরে  যে কলঙ্কের বোঝা  তুমি একা ওই কালনাগিনী মহিলার জন্য বয়ে বেড়াচ্ছ, যার জন্য তোমার সুখের সংসার ছারখার হয়ে গেছে, যার জন্য তুমি তোমার নাতি, স্বামী হারিয়েছ তাকে কঠোর শাস্তি পেতেই হবে।

-সৌম্য! অণিমা চিত্‍কার করে কেঁদে ওঠে।

-চুপ!সৌম্য গর্জে ওঠে। -তুমি আমায় কোনদিন নাম ধরে ডাকবে না। আমার মাথার দিব্যি রইল। যদি তোমার বিন্দুমাত্র বিবেক এখনও অবশিষ্ট থাকে তবে নিজের মুখে সব কুকীর্তির কথা স্বীকার কর।  ঠাম্মি,আমি একটা অন্যায় করেছি। তোমায় না বলে তোমার আলমারি থেকে বাক্সটা আমি নিয়ে এসেছি। তুমি আমায় ক্ষমা করো।

 

সৌম্য নিজের কাছ থেকে লাল ভেলভেটের বাক্সটা টেবিলের উপর রাখে। থানার সমস্ত পুলিশ এবং উপস্থিত বাকি সকলের দৃষ্টি পড়ে বাক্সটার উপর। সৌম্য চাবি দিয়ে তালা খুলে মুল্যবান সামগ্রী বার করে। সুদৃশ বাক্সের ভিতর গহনার বদলে আছে কাঁচা হাতের লেখা খানকতক চিঠি, গুটিকয়েক সাজার জিনিস আর কয়েকটা ফটো। এই ঘটনায় সকলেই অবাক হয়ে যায়। লজ্জায় কনক তখন মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে। সকলেই সৌম্যকে এর কারণ জানতে চায়।

সৌম্য বলে -এই কারণের ব্যাখ্যা আমার ঠাম্মি দেবে। প্লীজ ঠাম্মি, আজ অন্তত: সকলের সামনে সত্যি কথাটা বল। আমি আজ তোমায় আবার আমার আরাধ্য দেবী রূপে দেখতে চাই।

কনক মাথা নিচু করে বলতে শুরু করে- আমার খোকন ছোট থেকেই আমার ন্যাওটা। যদিও তার কারণ আমার বৌমা নিজেই। বৌমা আমার খোকনের চাওয়া-পাওয়া কে আমল দিত না। মায়ের স্নেহ থেকে খোকন  বঞ্চিত ছিল। বৌমা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকত। তাই খোকন আমার কাছেই আদর খুঁজতে চাইত। ওর যত আবদার ছিল আমার কাছেই। এই চিঠিগুলো যেগুলো দেখছেন সেগুলো সব ওর হাতের লেখা।  মায়ের উপর অভিমান করে চিঠি। আর কিছু চিঠি আছে যার মধ্যে লেখা আছে বড় হয়ে আমার জন্য ও কি কি করবে। একটা চিঠি আমি আপনাদের পড়ে শোনালেই বুঝতে পারবেন মায়ের উপর কি পরিমাণ  অভিমান ওর মনে  জমা হয়েছিল। যে চিঠিটা আমি পড়ছি সেটা ও যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখনকার লেখা। খোকন  যেরকম লিখেছিল সেরকমই পড়ে শোনাচ্ছি।

 

     কনক চিঠিটা পড়তে শুরু করে। -থমমি মা আমায় চুমু করেনি ঘুম পারায় নি ভালো বাসেনি তুমি ভালো মা পচা দুশতু।                    

আসলে ও লিখতে চেয়েছে “ঠাম্মি, মা আমায় চুমু খায় নি। ঘুম পাড়ায়নি। ওকে ভালোবাসে না। তুমি ভালো। মা পচা, দুষ্টু।

বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে ফেলে কনক। আর একটা চিঠি পড়ে শোনায় কনক।

-এই চিঠিটা ওর দশ বছর বয়েসে লেখা। ঠাম্মি, আমার  মা পাজী। দাদু মাকে বকেছে। আমি বড় হয়ে মাকে বকবো। আজ থেকে তুমি আমার ঠাম্মি আবার তুমিই আমার মা হবে। হবে না?-ইতি খোকন         

বুঝতেই পারছেন কত দু:খে ওই চিঠি খোকন লিখেছে। আসলে এই চিঠিগুলো আমার কাছে সোনার চাইতেও দামী। আর ওই সাজার জিনিসগুলো দেখছেন  অর্ধেক ক্রিমের কৌটো, অর্ধেক বোরোলীন, একটা গোটা লিপস্টিক। এইসব ও মায়ের সাজার জিনিস থেকে লুকিয়ে এনে আমায় দিয়েছে সাজার জন্য। আর বাকি রইল ফটো। ওর ছেলেবেলার ফটো। অ্যালবাম থেকে পুরানো ফেলে দেওয়া ছেঁড়া,বিবর্ণ ফটো। আমার কাছে এইসব পরম সম্পদ। খোকনের মা যখন আমার কাছ থেকে জোর করে খোকনকে দূরে সরিয়ে নিতে চাইত  তখন ওই বাক্স ছিল আমার কাছে  একমাত্র যক্ষের ধন। হ্যাঁ, এটা ঠিক বহুবার আমার বৌমা বাক্স দেখতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা ছিল ওর মধ্যে কি সোনার গহনা আছে তা জানার।  আমি দিইনি। কারণ আমার মনে ভয় ছিল, হিংসার বশবর্তী হয়ে এই অমূল্য সম্পদ ও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দেবে। কারণ বৌমার কাছে মূল্যবোধের কোনও দাম নেই।

একনাগাড়ে কথা বলে কনক একটু দম নেয়। দীর্ঘ এক দশকের মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমান, দু:খ প্রকাশ করতে পেরে কনক যেন কিছুটা শান্তি অনুভব করে।

সৌম্য আবার শুরু করে- ঠাম্মির কথার সূত্র ধরে বলি এই বাড়ি এবং যাবতীয় সম্পত্তি ঠাম্মি বাবার নামে দানপত্র করে দিয়েছে।আর সোনার গহনা যা ছিল সব ওই পাপিষ্ঠা মহিলাকে আগেই দিয়ে দিয়েছিল। ঠাম্মির কাছে থাকার মধ্যে আছে শুধু ব্যাঙ্কের থেকে প্রতি মাসে পাওয়া সামান্য সুদের টাকা। এবার আসি আমার কথায়। কোথায় ছিলাম আমি এত বছর? বাবা যখন আমায় দার্জিলিং এর স্কুল বোর্ডিং এ ভর্তি করে দিলেন তখন থেকেই আমার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।কারণ আমি দেখেছি আমার ঠাম্মিকে মিথ্যা অভিযোগে নির্বাসিত করা হল। ওই নোংরা মহিলার জন্য আমার আরাধ্য দেবীকে কলঙ্কিনী তকমা পেতে হল। বাবা পর্যন্ত আমার কথা বিশ্বাস করল না।আমায় এখান থেকে পালিয়ে নিজের মত করে মানুষ হতে হবে। ওদের টাকায় আমি মানুষ হতে চাইনি। তাই আমার ঠাম্মির দেওয়া জমানো টাকা নিয়ে সিমলা পালিয়ে গেলাম। এরপর আরও অনেক কথা। আমি আর বিস্তারিত বলতে চাই না।শুধু এটুকু জেনে রাখুন অনেক ঘাত-প্র্তিঘাতের মধ্য দিয়ে আমি সিমলাতেই  এক বাঙালি পরিবারে আশ্রয় পাই। ওনারা আমায় লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তোলেন। আমি চেয়েছিলাম পুলিশ অফিসার হতে যাতে এই কলঙ্কিনী মহিলাকে নিজের হাতে শাস্তি দিতে পারি। আজ আমার আশা পূর্ণ হয়েছে। সমস্ত প্রমাণের ভিডিও রেকর্ড হয়েছে। তাই আমার মনে হয় এইসব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ওই মহিলা কোর্টে যথাযথ শাস্তি পাবে। চল দাদু, চল ঠাম্মি আমার বাড়ি চল। ওই বাড়িতে আর তোমায় যেতে দেব না। থাকুক বাবা ওই যমপুরিতে।

সুজন ডুকরে কেঁদে ওঠে। সৌম্য, কথা শোন তুই আমায় ছেড়ে যাস না। মা-বাবাকে নিয়ে আবার আমরা একসাথে থাকব। তোর মা  মিথ্যা বলার জন্য শাস্তি পাবেই। সেটা অবশ্যই তার প্রাপ্য।

-না বাবা তা আর হয় না। তুমি তোমার মত করে নি:সঙ্গতা ভোগ কর। তখন বুঝতে পারবে ঠাম্মি কি সাজা এতদিন ভোগ করেছে। কারোর কাছে কোনও প্রতিবাদ জানায়নি।

-খোকন একটা কথা আজ আমার রাখবি। আমি আজ পর্যন্ত কোনদিন তোর কাছে কিছু চাইনি, আজ ভিক্ষা চাইছি।

-এ তুমি কি বলছ ঠাম্মি? তুমি আমার কাছে ভিক্ষা চাইবে। তার চাইতে আমার মরণ ভালো। বল তুমি কি চাও?

- আগে বল আমার কথা রাখবি? তবেই বলব।

-কথা দিলাম।

-তোর মাকে নিয়ে আর কোর্ট-পুলিশ করিস না। এমনিতেই তোর মা অনেক শাস্তি পেয়ে গেছে। নিজের ছেলেকে কাছে পেয়েও ধরে রাখতে পারল না। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? শুধু কি তাই নিজের স্বামীর কাছেও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। বৌমা এখন একেবারে নি:স্ব। ওকে ওই বাড়িতে গিয়ে আমৃত্যু একাই সারা জীবন কাটাতে হবে। আমিও  তোর কাছে এখন ফিরে যাব না। আমি তোর বাবাকে নিয়ে শেষ বয়সে সারা ভারতবর্ষকে চিনতে চাই। তবে হ্যাঁ, তোর বিয়ের সময় আমরা দুজনে যেখানেই থাকি ঠিক আসব, কথা দিলাম। তোর সাথে আমার যোগাযোগ ঠিক থাকবে। এখন আমি বাড়ি গিয়ে নিজের কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস ও জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়ে আজই বেরিয়ে পড়ব। আর হ্যাঁ, ওই লাল বাক্সটা আমি চুরি  করে নিয়ে যাচ্ছি। যখনই তোর কথা মনে পড়বে তখনই খুলে বুড়ো-বুড়ি মিলে দেখব। আমার শেষ ইচ্ছাকে বাধা দিস না বাবা।

ঠাম্মির শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানায় সৌম্য। থানা থেকে কেসটা তুলে নিয়ে  সৌম্য কোলকাতার দিকে রওনা হয়।  

                     ---*---
রচনাকাল : ১৯/১০/২০২১
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 3  Bulgaria : 1  Canada : 2  China : 71  Germany : 2  Hungary : 3  India : 266  Ireland : 2  Malaysia : 1  Russian Federat : 11  
Saudi Arabia : 4  Ukraine : 2  United States : 131  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 3  Bulgaria : 1  Canada : 2  China : 71  
Germany : 2  Hungary : 3  India : 266  Ireland : 2  
Malaysia : 1  Russian Federat : 11  Saudi Arabia : 4  Ukraine : 2  
United States : 131  
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
কনক by Rupak Ghosh is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৬২৬৩৬
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী