চির মিলন
রূপক ঘোষ
শিউলিবনার অজ পড়শি গ্রাম ছাতনার বালিখুন থেকে মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তি হয়েছিল মঙ্গল সোরেন।সালটা ১৯৭৬। শিউলিবনা হল বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে ছোট্ট এক আদিবাসী গ্রাম। আজ থেকে দু’শ বছর আগে যেখানে একসময় শাল-পিয়ালের ঘন জঙ্গল ভেদ করে সূর্যের আলোও প্রবেশ করতে পারত না ঠিক ভাবে। বন্য জীবজন্তুরা ঘুরে বেড়াত একসময়। সেই পিছিয়ে পড়া আদিবাসী গ্রামের মঙ্গল সোরেন ছিল ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমার ব্যাচ মেট। প্রথম যেদিন ওর সাথে আমার দেখা হয় সেদিন প্রথম দর্শনেই ওর প্রতি কেন জানি না আমার একটা মমতা জন্মেছিল। কিন্তু আকৃষ্ট হবার মত কোনও নিদর্শনই ওর ছিল না। গায়ের রঙ বেশ কালো, লম্বা ছিপছিপে পেটানো চেহারা, মাথায় কোঁকড়ানো একরাশ চুল। ব্যাস ওই পর্যন্ত, এর বেশি কিছু নয়। তবে হ্যাঁ, ওর সারামুখে ছিল এক অপার সারল্য আর চোখে ছিল অসীম গভীরতা। কিন্তু আমার সাথে আভিজাত্যে অনেক ফারাক। কারণ আমি ছিলাম ভবানীপুরের এক নামজাদা পরিবারের ছেলে। আমার বাবা হলেন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রফেসর আর আমার মা একজন প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সক।
প্রথম প্রথম কলেজের কারোর সাথেই ঠিক মত মিশতে পারত না মঙ্গল। সবসময় শামুকের খোলসের মত নিজেকে গুটিয়ে রাখত। লাজুক স্বভাবের ছেলেটির কাছ থেকে ওর পরিচয় পেতেই এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছিল। প্রথম দিন শুধু ওর নামটুকু জানতে পেরেছিলাম এই যা। ধীরে ধীরে আমার সাথে মঙ্গলের সখ্যতা গড়ে উঠল। অসম্ভব মেধাবী ছেলেটি তার ব্যবহার, সততা এবং পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে অচিরেই কলেজের সবার নজর কেড়ে নিয়েছিল। এর পর আস্তে আস্তে মঙ্গলের কাছ থেকে ওদের পরিবার, ওদের সমাজের সংস্কৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছিলাম। একদিন দেখি সন্ধ্যেবেলায় আলো না জ্বালিয়ে চুপটি করে ঘরের মধ্যে বসে আছে মঙ্গল। এরকম আনমনা আমি ওকে আগে কোনদিন দেখিনি। চুপিসাড়ে আমি ওর পিঠে হাত রাখলাম। মুখ ঘোরাতে দেখি ওর চোখটা ছলছল করছে। আমি কোমল স্বরে বললাম- কি হয়েছে তোর মঙ্গল? বাড়িতে কি কোনও দুসংবাদ আছে।
-না,না, বলে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে মঙ্গল।
-কথা ঘোরানোর চেষ্টা করিস না। তুই আমার কাছে ধরা পড়ে গেছিস। তোর মত সাদাসিধে ছেলে মিথ্যে বলতে পারে না।
-এই কথা ফুলিও বলত।
-কে ফুলি?
আমি চেপে ধরি মঙ্গলকে। অগত্যা সব সত্যি প্রকাশ পায় আমার কাছে।
মঙ্গল বলতে শুরু করে- তুই তো জানিস আমরা আদিবাসী। থাকার মধ্যে আমি, আমার বাবা ও মা। অভাবের সংসার আমাদের। দু’বেলা দুমুঠো অন্ন যোগাতেই প্রাণান্তকর অবস্থা। আমার বাবা আমাদের গ্রামের দিনু মোড়লের বাড়িতে খাতা লেখার কাজ করে আর আমার মা ওই বাড়িতে রান্নার কাজ করে। দিনু জ্যাঠা আদিবাসী নয়। ওনার পদবী মাইতি। দিনু জ্যাঠার একটাই মেয়ে ফুল্লরা। বয়সে আমার থেকে চার বছরের ছোট। বয়সের তুলনায় খুব পাকা। বড় মেয়েদের মত গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলে। ছোটবেলা থেকেই আমার খেলার সাথী ফুল্লরা। ওর যত আবদার আমার কাছে। দিনু জ্যাঠা ও কোনদিন মানা করেনি আমাকে ওর সাথে মিশতে।
-সে তো বুঝলাম। কিন্তু এটা বুঝলাম না, “এই কথা ফুলিও বলত” এটা বললি কেন?
- পুরো ঘটনা না বললে বুঝবি কি করে? আগে আমায় শেষ করতে দে।
-আচ্ছা, বল।
- আমার বাবার সাধ্য ছিল না আমাকে পড়ানোর। দিনু জ্যাঠাই আমার পড়ার খরচ চালাত। পড়াশুনার অবসরে আমরা সারদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেরাতাম। পুকুরে দাপাদাপি, অন্যের বাগান থেকে ফল চুরি কোনকিছুই বাদ যেত না। আর মোড়লের মেয়ের সাথে থাকার সুবাদে আমাকেও গ্রামের অন্য কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। এইভাবে কবে যে ফুল্লরা বড় হয়ে গেল বুঝতেই পারিনি। বুঝতে পারলাম যেদিন ‘খেরওয়াল তুকৌ’ উপলক্ষে শিউলিবনায় ওকে নিয়ে মেলায় গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স ষোলো আর ওর বয়স বড়জোর এগারো-বারো হবে।
-খেরওয়াল তুকৌ কি?
-আদিবাসী ও লোক সংস্কৃতিকে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রতি বছরের শেষ দিন থেকে দু’দিন ব্যাপী মেলার আয়োজন হয়। মেলাতে বাহা ও দাঁশাই নাচের প্রতিযোগিতার আসর বসে। শেষ দিন আদিবাসীদের বিয়ের আসর বসে। এই মেলায় পুরুষ তার জীবন সঙ্গিনীকে খুঁজে নেয়। অবশ্য যদি মেয়েটা মত দেয় তবেই।
-ভারি মজার ব্যাপার তো।
-হ্যাঁ। তা ঠিক। যাইহোক, মেলা শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছি, কারণ আমি খেয়াল করিনি কখন অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি করে বাড়ি যাব বলে সোজা রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরেছি।
হঠাত্ ফুলি মানে ফুল্লরা চিত্কার করে বলে- মঙ্গল দাদা আমার পিঠে বোধহয় কিছু কামড়েছে খুব জ্বালা করছে। আমিও অতশত না বুঝে তাড়াতাড়ি করে পিঠের শাড়ি সরিয়ে দেখতে গেলাম কি কামড়েছে। ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে ফুল্লরা আমায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল- ছি: তোমার লজ্জা করে না মেয়েদের গায়ে হাত দিতে! এই তোমার চরিত্র! এইজন্য তুমি জঙ্গলের রাস্তা ধরেছ? আমি বাড়িতে গিয়েই বাবাকে তোমার কুকীর্তির সব কথা বলব। আমি তো বিস্ময়ে অবাক। মুখ দিয়ে কোনও কথা সরছে না। কি বলছে কি ফুলি! আমি শুধু বলার চেষ্টা করলাম- ফুলি বিশ্বাস কর আমার মনে কোনও খারাপ উদ্দেশ্যে ছিল না। আমি শুধু......
এবার ফুল্লরা আমায় অবাক করে দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ল। তুমি খুব সাদাসিধে মঙ্গল দাদা। এইজন্যই তোমাকে আমি ভালবাসি। তুমি এতদিন আমার সাথে ঘুরছ, অথচ আমার মনের কথা কিছুই বুঝতে পারনি। দেখ আমার পিঠ, বলেই পিঠের দিকে শাড়িটা সরিয়ে দিয়ে আমায় কাছে টেনে নেয়।আমি সভয়ে সরে যেতে চাইলে, ফুলি আমায় চেপে ধরে রাখে।
এবার আমার মঙ্গলের কথা বোধগম্য হল।
মঙ্গল আবার বলতে শুরু করে- তুই বিশ্বাস কর আমার সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গিয়েছিল সেদিন। এতদিন ধরে আমি ওর সাথে মেলামেশা করছি ঠিকই, কিন্তু আমার মনে একবারের জন্যও এই চিন্তা আসেনি। সম্ভবত মেয়েরা অল্প বয়েসেই অনেক কিছু বুঝতে শিখে যায়। আমি সেদিন ওর মুখের দিকে ভাল করে চাইতে পারছিলাম না। কেমন একটা অপরাধ বোধ কাজ করছিল আমার মনে। দিনু জ্যাঠা আমাদের কত সাহায্য করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা! এছাড়া গরীব পরিবার আমরা, তার পরে আদিবাসী। কোথায় আমরা আর কোথায় ওরা! কি নেই ওদের? ওই গ্রামে দিনু জ্যাঠারই শুধুমাত্র দোতলা বাড়ি। এছাড়া পুকুর-জমি-সম্পত্তি তো আছেই। কাজেই এই চিন্তা করা শুধু অস্বাভাবিক নয় পাগলামো ও বটে! কিন্তু ফুল্লরা স্বাভাবিক! যেন দু’পরিবারের মধ্যে সব কথা হয়ে আছে। চুপচাপ খানিকটা যাবার পর ফুল্লরা বলে আচ্ছা মঙ্গল দাদা তুমি তো মেলায় দেখলে মরদগুলো কেমন তাদের নিজেদের জন্য বউ পছন্দ করে নিল। তোমার আমাকে বউ করতে পছন্দ হয় না? আমি ফুলিকে প্রশয় না দিয়ে ধমক দিয়ে বললাম ফুলি তুই এখন অনেক ছোট। এইসব কথা এখন চিন্তা করতে নেই। এখন মন দিয়ে পড়াশুনা কর, দেখবি তোর জন্য খুব সুন্দর শিক্ষিত বড়লোক পাত্র জুটবে। এই কথা শোনার পর ফুল্লরা সেদিন ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। সারা রাস্তা আর কথা বলেনি আমার সাথে। পরের দিন দেখলাম ফুলির মুখটা থমথমে। আমার সাথে কথা বলতে চাইছে না, যেন আমায় চেনেই না। আমিও কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে গেলাম। এখন আমার কি করা উচিত কিছুতেই মাথায় ঢুকছিল না। এইভাবে এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমিও কেমন যেন ফুলিকে পাবার আশায় পাগল হয়ে উঠলাম। এরপর একদিন ফুলিকে দেখতে পেলাম শাল বনের ভিতর দিয়ে পুকুরে যাচ্ছে স্নান করতে। আমি পিছন থেকে ডাকলাম ‘ফুলি’। ফুলি ঘুরে তাকিয়েই আবার নিজের মত চলতে শুরু করল। কেমন যেন জেদ চেপে গেল আমার। দৌড়ে গিয়ে ফুলির হাতটা চেপে ধরলাম। ফুলি আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে গেলে আমি জোর করে ওকে আমার বুকে টেনে নিলাম। ফুলি প্রথমে বাধা দিলেও পরে আমার কাছে সম্পুর্ণ রূপে আত্মসমর্পণ করল। ওই দিন থেকে কি যে হল আমাদের তোকে বোঝাতে পারব না। প্রায় প্রতিদিন আমরা লুকিয়ে পুকুরের ধারে বসে নতুন জীবনের স্বপ্ন আঁকতাম। কত কথা! কত গল্প! দিন কেটে চলে। আমি একাদশ শ্রেণীতে বাঁকুড়া জেলার মধ্যে প্রথম হলাম। সেদিন ফুলির যে কি আনন্দ তোকে বোঝাতে পারব না। আমায় আদর করে বলল, মঙ্গল দাদা তোমায় আরও পড়াশুনা করে মানুষের মত মানুষ হতে হবে। পড়াশুনা শেষ করে তুমি খুব ভাল চাকরি নিয়ে আমার বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমার ফুলিকে নিয়ে যাবে। দেখবে বাবা তখন না করতে পারবে না। আমি মনে মনে শপথ নিলাম আমাকে বড় হতেই হবে। এদিকে কি ভাবে জানি না আমাদের দুজনের এই সম্পর্কের কথা দিনু জ্যাঠা জেনে গেল। দিনু জ্যাঠা আমাকে একটাই কথা বলল তুমি এক সপ্তাহের মধ্যে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে এবং কোনদিন ফুল্লরার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। এর অন্যথা হলে পরিণাম ভাল হবে না। জ্যেঠিমা কিন্তু আমাকে খুব ভালবাসত এবং স্নেহ করত। জ্যেঠিমা আমাদের সম্পর্কটা মন থেকে মেনে নিয়েছিল। এবার আমার চিন্তা হল আমি কোথায় যাব? পড়াশুনা করার জন্য কি ভাবে টাকার যোগাড় করব? পড়াশুনাই যদি করতে না পরি তাহলে ফুলির আশা পূরণ করব কি ভাবে!এদিকে জয়েন্ট এনট্রান্স এ আমি সফল হয়েছি কিন্তু ভর্তি হবার টাকা নেই। ভর্তির সময় যখন প্রায় পেরিয়ে যাবার মুখে ঠিক তখনই এক রাতে আমার দরজায় করাঘাতের শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি বাইরে মুখে কাপড় ঢেকে ফুলি। ফুলি চট করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। দেখি ওর হাতে একটা বাক্স।
-কি আছে বাক্সে?
ফুলি বলে, বেশি কথা বলার সময় নেই। এই সোনার গয়নাগুলো মা দিয়েছে তার ভাবি জামাইকে লেখা-পড়া শিখে মানুষ হবার জন্য। আমি চললাম। কেউ দেখে ফেললে বিপদের শেষ থাকবে না। আর জানবে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকব যতদিন না তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফুলি দৌড়ে চলে গেল।
একনাগড়ে কথা বলে মঙ্গল কিছুটা দম নেয়।
-তারপর?
-সেই চলে আসা। তারপর থেকে এই চার বছর ফুলির সাথে কোনও যোগযোগ নেই। ফোন করে ওর সাথে কথা বলতেও পারিনি,কারণ তাতে ও বাড়িতে ঠিক ধরা পড়ে যাবে। চিঠি লিখব সে উপায় ও নেই। আমার ঠিকানা ও ফুলির জানা নেই। তাই আমি নীরবে ওর কথা ভেবে শুধু ভাল রেজাল্ট করতে চেয়েছি। তুই তো জানিস আমার একটা ভাল মাইনের চাকরির সুযোগ এসেছে। কিন্তু কি হবে আমার এই চাকরির? আমি তো জানিই না ও এখন কেমন আছে! বেঁচে আছে কিনা! ওকে গিয়ে দেখতে পাব কিনা!
-এভাবে বলছিস কেন? কি হয়েছে তোর ফুল্লরার ?
-পড়ে দেখ সব বুঝতে পারবি। বলেই মঙ্গল একটা চিঠি আমার হাতে তুলে দিল।
চার-পাঁচ লাইনের চিঠি। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি করে ভয়ে ভয়ে লেখা। কারণ চিঠির অক্ষর গুলো কেঁপে কেঁপে গেছে। আমি চিঠিটা পড়লাম।
‘মঙ্গল দাদা তুমি তাড়াতাড়ি এস। বাবা আমার বিয়ে জোর করে অন্য জায়গায় ঠিক করেছে। প্রতিবাদ করে লাভ হয়নি। বোধহয় আমাকে বাঁচতে দেবে না। তোমার সাথে কি শেষবারের মত একবার দেখা হবে?’
তোমার ফুলি।
আমি বললাম –চিঠিতে কিন্তু কোনও তারিখ নেই। তাই বোঝা যাচ্ছে না কবে লিখেছে। খামের উপর পোস্ট-অফিসের তারিখটা দেখেছিস?
-না, খামটা খুঁজে পাইনি। শুধু এই চিঠিটা বিছানার উপর পড়েছিল।
-চিঠিটা তোর ঘরে দিল কে?
-কে দেবে আবার? নিশ্চয় ওয়ার্ড বয় দিয়ে গেছে। চিঠিটা খুলে পড়েছে তারপর দিয়েছে।
- কি করবি ভেবেছিস কিছু?
-আমি কাল সকালেই ফ্লাইট ধরে চলে যাব। তারপর ওর বাবার মুখোমুখি দাঁড়াব। বলব আমি এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। আপনার মেয়ের ভার আমি নিতে পারব। আর আমি নিশ্চিত জ্যেঠিমা ও আমায় সমর্থন করবে।
-কিন্তু তোদের সমাজ কি মেনে নেবে এই ভালোবাসার বিয়ে?
-হয়তো প্রথমে মানবে না। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমাদের দুজনের ভালোবাসার কাছে ওদের সকলকেই হার মানতে হবে। বরং তুই পারলে কাল আমার সাথে চল, আমি একটু সাহস পাব।
-কাল আমার একটা ইন্টারভিউ আছে। তাই আমি কাল যেতে পারব না। তবে কথা দিচ্ছি ইন্টারভিউ দিয়ে আমি পরের দিনই তোদের গ্রামে যাব।
-ঠিক আছে। ওই কথা রইল।
পরের দিনই মঙ্গল কোলকাতার ফ্লাইট ধরে কোলকাতা থেকে যখন ছাতনার বালিখুন এসে উপস্থিত হল তখন সন্ধ্যে ছ’টা হবে। শালবনের রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে দ্রুত হাঁটা লাগায় মঙ্গল।
-মঙ্গল দাদা,
মঙ্গল চমকে তাকায়। দূর থেকে ছুটতে ছুটতে আসছে ফুলি। পরনে সেই বাসন্তী রঙের তাঁতের শাড়ি গাছ কোমর করে বাঁধা।
-কি ব্যাপার তুই সন্ধ্যে বেলায় এখানে কি করছিস?
-আমি তোমার আসার অপেক্ষাতেই এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার মন বলছিল তুমি আজ আসবে তাই বাড়ি থেকে চুপ করে বেরিয়ে এসেছি। তুমি এখন এখানে থাক না বলে আমার উপর নজরদারী একটু কম।
-চার বছর পর আজ তোকে দেখলাম ফুলি। তুই তো এখন অনেক বড় হয়ে গেছিস। তারপর বল ওই চিঠি লিখেছিস কেন? কি হয়েছে খুলে বল আমায়।
-বলব বলেই তো তোমার সাথে এখানে লুকিয়ে দেখা করতে এসেছি। তবে এখানে কথা বলা উচিত হবে না। তার চেয়ে চল আমরা জঙ্গলের ভিতর পুকুর ধারে বসে কথা বলি। এই সন্ধ্যের সময় ওদিকে এখন কেউ আসবে না।
-আচ্ছা চল।বল এবার কি হয়েছে?
-আগে বলো সেই যে তুমি চলে গেলে, একবারের জন্য ও এলে না কেন? আমার এখানে কি ভাবে দিন কাটছে সেটা চিন্তা করেছ কোনদিন? তোমরা ছেলেরা বড় স্বার্থপর!
-আমার কি আসতে মন চায়নি ফুলি? কিন্তু আমি এলে তোর যদি বিপদ হয় সেই ভয়ে আসিনি। তবে তোর কথা আমি রেখেছি। আমি খুব বড় চাকরি পেয়েছি দিল্লিতে। এবার আমাদের বিয়ে কেউ আটকাতে পারবে না। আমি তোকে নিয়ে দিল্লি চলে যাব। ওখানেই ঘর বাঁধব আমরা। সাথে মা-বাবাকে ও নিয়ে যাব।
ফুল্লরার মুখে মলিন হাসি ফুটে ওঠে। অন্ধকারে মঙ্গল দেখতে পায় না।
-তুমি যা ভাল বুঝবে তাই করবে। আমি কি তোমার কাজে কোনদিন বাধা দিয়েছি? কিন্তু তার আগে বাবাকে মানাতে হবে। বাবা জেদ ধরে বসে আছে, তার পছন্দের ছেলেকেই আমায় বিয়ে করতে হবে। আমিও ওই ছেলেকে বিয়ে করব না বলে দিয়েছি। এরজন্য কম অত্যাচার করেছে আমাকে! তবুও আমায় রাজি করাতে পারেনি। আমি বলেছি আমার প্রাণ থাকতে তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করব না।
- ঠিক আছে আমি আজই বাড়িতে মা-বাবার সাথে কথা বলে কাল তোদের বাড়ি যাব। দেখি কি করে তোকে অন্য জায়গায় বিয়ে দেয়! এখন চল রাত হয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরতে হবে।
-তুমি যাও মঙ্গল দাদা। আমার একটা কাজ আছে, সেটা সেরে বাড়ি যাব।
-এত রাতে আবার কি কাজ? যে কাজই থাক, কাল করবি। এখন আমার সাথে চল।
-তুমি ভয় পেও না। আমার কোনও ক্ষতি হবে না। আমি ঠিক লুকিয়ে বাড়ি চলে যাব।
অগত্যা আমি বাড়ির দিকে পা বাড়াই। বাড়িতে আমাকে দেখে মা-বাবার মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
-তুই হঠাত্ চলে এলি? কি হয়েছে তোর? কোনও বিপদ হয়নি তো?
-বিপদ হবে কেন? চাকরির খবর দেবার জন্য এসেছি। আমি চাকরি পেয়ে গেছি। এবার আমি তোমাদের আমার কাছে নিয়ে রাখব। আর শোনো কাল তোমরা দিনু জ্যাঠার কাছে ফুলির সাথে আমার বিয়ের কথা পারবে। আমিও থাকব তোমাদের সাথে, দেখি দিনু জ্যাঠা কি করে আমায় না বলে। আসার সময় ফুলির সাথেও এই ব্যাপারে আমার কথা হয়েছে। আমি আসব বলে রাস্তায় আমার সাথে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করছিল ও।
-কি বলছিস কি তুই? মঙ্গলের মা আর্তনাদ করে ওঠে।
-অবাক হচ্ছ কেন? আমি কি মিথ্যা বলছি? ফুলির চিঠি না পেলে আমি জানতেই তো পারতাম না এখানে এতকিছু ঘটে গেছে!
- না, না, এটা হতে পারে না। কি করে সম্ভব এটা ?
- সেটা তুমি ঠিক বলেছ মা। আমি নিজেই তো বিশ্বাস করতে পারিনি, যে ফুলি আমায় চিঠি লিখবে। বিশ্বাস না হয় নিজে পড়ে দেখ না চিঠি! শুধু কি তাই ফুলি আবার আমার আসার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল।
-চিঠিটা কবে লিখেছে?
হবে হয়তো চার-পাঁচ দিন আগে।
-না! অসম্ভব! এটা হতে পারে না।
-কি আবোল-তাবোল বলছ তখন থেকে বলতো?
-আমি ঠিকই বলছি মঙ্গল। আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে বাবার অত্যাচারে ফুলি জলে ডুব দিয়ে আত্মঘাতী হয়েছে!
-না!...........
-আমি ঠিক বলছি মঙ্গল। ফুলি তোকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে না বলায় দিনু মোড়ল জোর করে মেয়েকে ঘরে বন্দী করে অত্যাচার করত। আমরা এবং গ্রামের সবাই দিনু মোড়লকে অনেক বুঝিয়েছি। শোনেনি কারোর কথা। ফুলিও অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে। তারপর যেদিন বিয়ের দিন এল, ঠিক তার আগের রাতে ফুল্লরা ওর মায়ের সাহায্যে ঘর থেকে পালিয়ে যায়। ওর মা ভেবেছিল ফুল্লরা তোর কাছে পালিয়ে যাচ্ছে। তাই সরল বিশ্বাসে দিনু মোড়লের ঘর থেকে চাবি চুরি করে লুকিয়ে ঘর খুলে দিয়েছিল।
-আমি একবর্ণ বিশ্বাস করি না তোমাদের কথা। তোমরা সবাই আমায় ভুল বলছ যাতে আমি ফুলিকে বিয়ে না করি। এটা দিনু জ্যাঠার চক্রান্ত। আমি এখানে থাকব না। আজই আমি ফুলিকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যাব। দেখি তোমরা কি করে আমাদের বিয়ে আটকাও!
এই বলে ঝড়ের বেগে মঙ্গল বেরিয়ে পড়ে।
-মঙ্গলের মা চিত্কার করে ওঠে -মঙ্গল শোন!এত রাতে কোথায় ও যাস না বাবা!
কিন্তু মঙ্গল এক নিমেষে হারিয়ে যায়। মঙ্গল উন্মাদের মত ছুটছে। অন্ধকার রাস্তায় হোঁচট খেয়ে বারবার পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। ফুলিকে ওর বাড়িতে যাবার আগেই যে ভাবে হোক আটকাতে হবে। ওইতো পুকুরের ধার দিয়ে অবসন্ন ভাবে হেঁটে আসছে ফুলি না? তবে কি ফুলিও জেনে গেছে এই চক্রান্তের কথা! তাই কি ফুলি তখন বাড়ি না গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল? ও কি ধরেই নিয়েছিল যে আমি ঠিক ফিরে আসব ওকে নিয়ে যেতে?
-ফুলি আমি ফিরে এসেছি তোর কাছে। আমি তোকে আজই এখান থেকে নিয়ে যাব। কেউ কিছু করতে পারবে না আমাদের। সবাই আমাদের বিয়েটা আটকাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি কিছুতেই ওদের সফল হতে দেব না। তুই চিন্তা করিস না।
-তবে তাই হোক মঙ্গল দাদা। এস, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমি আর এই কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আমি আজ বড় ক্লান্ত। হাত বাড়াও মঙ্গল দাদা যাতে আমাদের আর কেউ কোনদিন আলাদা করতে না পারে।
মঙ্গল একছুটে গিয়ে ফুলির হাতটা সজোরে চেপে ধরে।
-এবার চল মঙ্গল দাদা। ফুলি মঙ্গল কে নিয়ে পুকুরের দিকে পা বাড়ায়।
এদিকে মঙ্গলের বাবা-মার আর্ত-চিত্কারে সকলেই ছুটে এসে মঙ্গলের খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু খোঁজ মেলে না। ভোর হয়েছে। পুকুরের জলে শান্ত ভাবে ঘুমিয়ে আছে মঙ্গল সোরেন। শিউলিবনা গ্রামের সবাই আজ ভেঙে পড়েছে মঙ্গলকে একবার শেষ দেখা দেখতে। কি অদ্ভুত নিয়তি! এক সপ্তাহ আগে পুকুরের ঠিক যেখানে ফুল্লরার মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল, ঠিক সেখানেই মঙ্গলের মৃতদেহ ভেসে উঠেছে। মঙ্গল সোরেন তার মৃত্যু দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে ভালোবাসার হার হয় না। ভালোবাসা কে দমিয়ে রাখা যায় না। তাই ভালোবাসার যুদ্ধে আজ সেই জয়ী হয়েছে। ফুলিকে তার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। হেরে গেছে বরং সেই মানুষগুলো যারা শুধু জাত-পাতের হিসাব আর পৃথিবীটাকে টাকার তুলা-দণ্ডে বিচার করে।
ইন্টারভিউ দিয়ে ওই দিন যখন আমি গ্রামে পৌঁছই, তখনই এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কথা জানতে পারি। আমার আর একদণ্ড গ্রামে থাকতে ইচ্ছা করছিল না। আজ আমি বড় একা, বড় নি:সঙ্গ। মঙ্গলের এই অকাল মৃত্যু কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। ঈশ্বরের কি নির্মম পরিহাস! শেষ বারের মত মঙ্গলকে চোখের জলে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম আমি। ফিরে আসতে আসতে শুধু একটাই কথা বারবার মনে হচ্ছিল, একেই কি বলে শাশ্বত প্রেম? তাই কি মৃত্যুর পরেও চিরদিনের জন্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে অটুট রয়ে গেল দু’জনের মিলন?
--*---
রচনাকাল : ১২/১০/২০২১
© কিশলয় এবং রূপক ঘোষ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।