জীবন দিয়ে গেয়ে গেল .........জীবনের জয়গান
সফল হলো ..................ভারতের নারীর সংগ্রাম
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
মেয়েদের স্তন ঢেকে রাখা ছিল অভদ্রতা। স্তনসহ নারীবক্ষ উন্মুক্ত রাখাই ছিল ভারতের কেরালা রাজ্যে উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং অভিজাতদের কাছে ভদ্রতা। কেরালা এখন ভারতে অনেক এগিয়ে থাকা রাজ্য । অথচ সেখানেই ছিল একদিন এই নিষ্ঠুর নিয়ম। যুগে যুগে শাসকশ্রেণি নানাভাবে করারোপ করে জনগণকে শোষণ-নির্যাতন করেছে। একসময় ছিল জমিদারের পাইক-পেয়াদাদের কর আদায়ের নির্মম অত্যাচার। অবিভক্ত ভারতবর্ষের এরকম অনেক কাহিনী এখনও আমরা ইতিহাসে পড়ি। জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনী মীর মশাররফ হোসেন তুলে ধরেছিলেন ‘জমিদার দর্পণ ‘ নাটকে । নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র লেখেন ‘নীল দর্পণ’ নাটক। এসবই ইতিহাসের অংশ। এরকম আরও ইতিহাস আমাদের জানা আছে। কেরালা এখন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। সেখানে একসময় মেয়েদের স্তনের উপর কর ধার্য করা হয়েছিল। মেয়েদের স্তন আবৃত রাখলে দিতে হত কর। স্তন ছোট-বড় অনুযায়ী সেই কর নির্ধারিত হতো। নাঙ্গেলি নামক এক তরুণী কর দিতে অস্বীকৃত হয়ে নিজের স্তন কেটে কর আদায়কারী সরকারের কর্মচারির হাতে তুলে দেন। এভাবে জীবনের বিনিময়ে এক সময় বন্ধ হয় এই নিষ্ঠুর করপ্রথা।
২১৫ বছর আগে কেরালা রাজ্যের একটা অংশ ছিল ত্রাভানকোর। সেখানকার রাজা ছিলেন ত্রিভাঙ্কুর। তার আমলে পুরুষরা গোঁফ রাখতে চাইলেও কর দিতে হত। আর নিম্নবর্গের হিন্দু-নারীদের স্তনসহ বুক ঢাকলে দিতে হতো স্তনকর। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হত – ‘ মুলাককারাম। ‘ নিম্নবর্ণের মানুষকে অসম্মানিত করতেই তখন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। আর নিম্নবর্ণের মানুষের আয় ছিল কম তাই তাদের পক্ষে এই কর দেওয়া সম্ভব ছিল না। এজন্য নিম্নমবর্ণের নারীরা উন্মুক্ত বক্ষেই চলাফেরা করত। আইনটি ছিল এরকম-ব্রাহ্মণ এবং খ্রিস্টান ব্যতীত হিন্দুধর্মের অন্য কোনো নারী তার স্তন আবৃত রাখতে পারবে না। নারীদের স্তন রাখতে হবে অনাবৃত, উন্মুক্ত। আবৃত করতে হলে বা স্তন ঢেকে রাখতে চাইলে দিতে হবে স্তনশুল্ক। আবার এই শুল্কের পরিমাণ নির্ভর করবে স্তনের আকারের উপর। যার স্তন যতবড় তার শুল্ক ততো বেশি। এই স্তনশুল্কের মোটা অংশ চলে যেত পদ্মনাভ মন্দিরে। গিনেস বুকের তথ্য অনুযায়ী, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী মন্দির! ৩৫ বছর বয়সী কৃষ্ণবর্ণের অতীব সুন্দরী এক তরুণীকে প্রায়ই কাজের জন্য বাইরে যেতে হতো। তবে সে সবসময় তার স্তন ঢেকে রাখত। হঠাৎ একদিন সে শুল্ক সংগ্রাহকের নজরে পড়ে। শুল্ক সংগ্রাহকরা তার কাছে স্তনশুল্ক দাবী করে। অস্বীকৃতি জানিয়ে সে বলে, ‘ স্তন আমার, তাকে আবৃত রাখব, নাকি অনাবৃত রাখব তা ঠিক করার তুমি কে ! আমি শুল্ক দেব না।’ এরপর প্রতিদিন শুল্ক সংগ্রাহকরা তার বাড়িতে এসে তাকে শুল্ক দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে । দিনে দিনে বাড়তে থাকে করের বোঝাও। অবশেষে একদিন কর দিতে রাজী হয় সে। শুল্ক সংগ্রাহকদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে চলে যায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে ফেলে তার স্তন দুটি! তারপর নিজের স্তনদ্বয়কে কলাপাতার আবরণে মুড়িয়ে শুল্ক সংগ্রাহকের হাতে শুল্কস্বরূপ তুলে দেয় । সে বলে, ‘ যে জিনিসের জন্য আমাকে অতিরিক্ত শুল্ক গুনতে হয়, সেই জিনিসই আমি রাখবো না।’ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় শুল্ক সংগ্রাহকসহ পাড়াপ্রতিবেশী সবাই। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মেয়েটির মৃত্যু হয়। পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। কয়েকদিন পর রাজা ত্রিভাঙ্গুর স্তনশুল্কসহ সকল প্রকার অবৈধ শুল্ক বাতিল করতে বাধ্য হয়।
নিজের অজান্তেই মেয়েটি ১৮৫৯ সালে ভারতে সংগঠিত কাপড় দাঙ্গার বীজ বপন করে যায়। নিজের জীবনের বিনিময়ে অগণিত অসহায় নারীকে রক্ষা করে নাঙ্গেলি। সেও পারতো বাকি সব নারীদের মতো স্তনশুল্ক মেনে নিতে। শুল্ক দেওয়ার মতো সক্ষমতাও তার ছিল। কিন্তু পৃথিবীতে কেউ কেউ বুকে আগুন নিয়ে জন্মায়। কোনো অন্যায় তাদের সামনে আসলেও তা তাদের বুকে স্থান পায় না, বুকের আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায় সব অন্যায়। কাহিনী এখানেই শেষ নয়…নাঙ্গেলির শরীর তখনও চিতায় দাউদাউ করে জ্বলছে! হঠাৎ একটা লোক দৌড়ে এসে সেই চিতার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে! লোকটা নাঙ্গেলির স্বামী। ভারতের ইতিহাসে, স্ত্রীর সঙ্গে সহমরণে যাওয়া কোনো পুরুষের এটাই প্রথম এবং শেষ ঘটনা। ইতিহাসে এই প্রেমিক পুরুষের নাম খোদাই করা নেই। কিন্তু প্রতিবাদের যে আগুন নাঙেলি জ্বালিয়ে দিয়েছিলো ভারতীয় নারীদের মনে আজও তা জ্বলজ্বল করছে। কেরালার স্তনকরের উল্লেখ করেছেন একজন ইংরেজ লেখক স্যামুয়ের ম্যাটিয়ার তার ‘ নেটিভ লাইফ ইন ট্রাভানকোর ‘ ( Native Life of Travancore -Samuel Mateer F.L.S ) বইতে। এই বইতে তিনি স্তনকরসহ আরো ১১০ ধরণের করের কথা উল্লেখ করেছেন। খ্রিস্টান এবং ব্রাহ্মণ নারীরাই শুধু সে সময় নীল রঙের একধরণের জ্যাকেটের মতো ব্লাউজ দিয়ে নিজেদের স্তন ঢেকে রাখতে পারত। নিপীড়নমূলক এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তখন অনেকবার বিদ্রোহ হয়। এই সিরিজ বিদ্রোহগুলোকে বলা হয়, ‘ চান্নার রিভোল্ট। ‘ এসব বিদ্রোহে খ্রিস্টান গির্জা এবং উচ্চবর্ণের হিন্দুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এরপর থেকে নিম্নবর্গের হিন্দু নারীরা প্রকাশ্যে ব্লাউজ পরতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত মাদ্রাজের ব্রিটিশ গভর্নরের হস্তক্ষেপে দুই দফা আদেশ জারির মাধ্যমে এই প্রথা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
রচনাকাল : ২৪/৯/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।