ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল ....... জীবনের জয়গান
সফল হলো ..................ভারতের রক্তাক্ত সংগ্রাম
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ক্ষুদিরাম বসু
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তৎকালীন লর্ড কিংসফোর্ডকে হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ক্ষুদিরামের (১৮৮৯-১৯০৮) ফাঁসি কার্যকর করে। ক্ষুদিরামকে যখন ফাঁসি দেয়া হয় তখন আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ একই রাষ্ট্র ছিল। ফলে বাঙালি তথা বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা অংশ ক্ষুদিরামের ফাঁসি।
ক্ষুদিরাম এক মৃত্যুহীন প্রাণ। তাঁর ফাঁসির কয়েকমাস পর আলিপুর বোমা মামলায় কারারুদ্ধ তরুণ বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত জেলের মধ্যেই গুলি করে হত্যা করেন বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে । নরেন গোঁসাই রাজসাক্ষী হয়ে বিপ্লবীদের গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিল ইংরেজদের কাছে।
বিচারে ফাঁসির হুকুম হয় কানাইলালের। বিচারক কানাইলালকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ জেলের মধ্যে তুমি রিভলবার পেলে কী করে?
কানাইলাল দৃঢ়কন্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, ক্ষুদিরামের আত্মা আমাকে দিয়ে গেছে ‘।
কানাইলাল দত্তের জন্ম ৩১ আগস্ট ১৮৮৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের চন্দননগর। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলি জেলার খরসরাই গ্রামে। তাঁর পিতা চুনিলাল দত্ত ছিলেন বোম্বাইয়ে বিট্টিশ সরকারের নৌবিভাগের একজন হিসাবরক্ষক। মায়ের নাম ব্রজেশ্বরী দেবী।
কানাইলাল শৈশবে বোম্বাইয়ের গিরগাঁও এরিয়ান এডুকেশন সোসাইটি স্কুলে এবং পরবর্তী সময়ে চন্দননগর ডুপ্লে বিদ্যামন্দিরে (বর্তমান কানাইলাল বিদ্যামন্দির) লেখাপড়া করেন। ১৯০৮ সালে হুগলি মহসীন কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও বিপ্লব ও রাজদ্রোহিতার অভিযোগে কারারুদ্ধ হওয়ায় ইংরেজ সরকার তাকে ডিগ্রি প্রদানে বাধা দেয়, কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সে বাধা উপেক্ষা করে তাকে ডিগ্রি প্রদান করে।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল প্রশিক্ষকের। দেশের জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সেদিনের যে ভূমিকা ছিল তা ইতিহাসে খুব কম আছে। কানাইলালও বিপ্লবী আন্দোলনে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠেন চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায়ের কাছে । তাঁর দ্বারাই কানাইলাল বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষা নেন এবং অস্ত্রচালনা শেখেন । চন্দননগরে নিজের প্রচেষ্টায় অনেকগুলি বিপ্লবী সমিতি গড়ে তোলেন কানাইলাল। তিনি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় চাকরিচ্যুত বাঙালি কেরাণীদের জন্য গড়ে তোলেন স্বদেশী সাহায্যভাণ্ডার। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সাথে ছাত্রাবস্থাতেই তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল । কিংসফোর্ডকে হত্যা করার জন্য তিনি প্রথমে মনোনীত হয়েছিলেন।
কিংসফোর্ড হত্যার চেষ্টায় কানাইলালের পরিবর্তে পরে প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে ক্ষুদিরাম বসু মজফরপুর যান। কানাইলাল তখন বারীন ঘোষের দলের সঙ্গে কলকাতায় বোমা তৈরির কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯০৮ সালের ২ মে তিনি উত্তর কলকাতার ১৫ নম্বর গোপীমোহন দত্ত লেন থেকে মানিকতলা বোমা মামলায় অস্ত্র আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।
কানাইলাল দত্ত
কানাইলাল দত্ত জেলের ভেতর রাজসাক্ষী নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ওরফে নরেন গোঁসাইকে হত্যা করতে মনস্থির করেন। এইসময় নরেন গোঁসাইকে পুলিশ কড়া নিরাপত্তায় জেলে রেখেছিল। বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কানাইলালকে একটি রিভলবার যোগাড় করে দেন। অসুস্থতার অজুহাতে হাসপাতালে ভর্তি হন কানাইলাল। কারণ বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাই ছিলেন সেখানে। জেলের অপর বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সহযোগিতায় জেলের ভেতরেই ৩১ আগস্ট ১৯০৮ সালে কানাইলাল হত্যা করেন নরেন গোঁসাইকে। বিচারে তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। তিনি দণ্ডরোধের জন্যে উচ্চতর আদালতে আপিল করার দৃঢ় বিরোধিতা করেছিলেন, তাই তাঁর পক্ষে কেউ আবেদন করেনি।
১০ নভেম্বর, ১৯০৮ তারিখে কানাইলালের ফাঁসি কার্যকর করে ব্রিটিশ। তাঁর সহযোদ্ধা অপর বিপ্লবী সত্যেন বসুও ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হন।
শৈশব থেকেই কানাইলালের শারীরিক অসুস্থতা কিছু বেশিই ছিল। কিন্তু ফাঁসির আগে তার ওজন বেড়ে হয়েছিল প্রায় ষোলো পাউন্ড এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। এ প্রসঙ্গে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তার “নির্ব্বাসিতের আত্মকথা” গ্রন্থে লিখেছেন –
“জীবনে অনেক সাধুসন্ন্যাসী দেখিয়াছি ; কানাইএর মত আমন প্ৰশান্ত মুখচ্ছবি আর বড় একটা দেখি নাই। সে মুখে চিন্তার রেখা নাই, বিষাদের ছায়া নাই, চাঞ্চল্যের লেশ মাত্র নাই – প্ৰফুল্ল কমলের মত তাহা যেন আপনার আনন্দে আপনি ফুটিয়া রহিয়াছে। চিত্ৰকূটে ঘুরিবার সময় এক সাধুর কাছে শুনিয়াছিলাম যে, জীবন ও মৃত্যু যাহার কাছে তুল্যমূল্য হইয়া গিয়াছে সেই পরমহংস। কানাইকে দেখিয়া সেই কথা মনে পড়িয়া গেল। জগতে যাহা সনাতন, যাহা সত্য, তাহাই যেন কোন শুভ মুহূৰ্ত্তে আসিয়া তাহার কাছে ধরা দিয়াছে।–আর এই জেল, প্রহরী, ফাঁসিকাঠ, সবটাই মিথ্যা, সবটাই স্বপ্ন ! প্রহরীর নিকট শুনিলাম ফাঁসির আদেশ শুনিবার পর তাহার ওজন ১৬ পাউণ্ড বাড়িয়া গিয়াছে!! ঘুরিয়া ফিরিয়া শুধু এই কথাই মনে হইতে লাগিল যে, চিত্তবৃত্তিনিরোধের এমন পথও আছে যাহা পতঞ্জলিও বাহির করিয়া যান নাই। ভগবানও অনন্ত, আর মানুষের মধ্যে তাঁহার লীলাও অনন্ত !
তাহার পর একদিন প্ৰভাতে কানাইলালের ফাঁসি হইয়া গেল। ইংরাজশাসিত ভারতে তাহার স্থান হইল না। না হইবারই কথা ! কিন্তু ফাঁসির সময় তাহার নির্ভীক, প্ৰশান্ত ও হাস্যময় মুখশ্ৰী দেখিয়া জেলের কর্তৃপক্ষরা বেশ একটু ভ্যাবাচাকা হইয়া গেলেন। একজন ইউরোপীয় প্রহরী আসিয়া চুপি চুপি বারীনকে জিজ্ঞাসা করিল— “তােমাদের হাতে এ রকম ছেলে আর কতগুলি আছে?” যে উন্মত্ত জনসঙ্ঘ কালীঘাটের শ্মশানে কানাইলালের চিতার উপর পুষ্প, বর্ষণ করিতে ছুটিয়া আসিল, তাহারাই প্রমাণ করিয়া দিল যে, কানাইলাল মরিয়াও মরে নাই।”
ক্ষুদিরাম বসুর পরে তিনিই ফাঁসিমঞ্চে প্রাণ উৎসর্গ করা প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী শহিদ। তার কর্ম ও বীরোচিত মৃত্যু সমগ্র জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে।
রচনাকাল : ২৩/৯/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।