শ্রী শ্রী গণেশ চতুর্থী ও গণেশপূজা
তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
আজ শ্রী শ্রী গণেশ চতুর্থী ও শ্রী গণেশ পূজা। সকলকে জানাই শ্রী শ্রী গণেশচতুর্থীর আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। দেবাদিদেব মহাদেব এবং দেবী গৌরীর পুত্র শ্রী গণেশ। গণেশ সিদ্ধিদাতা অর্থাৎ সাফল্য প্রদানকারী দেবতা। হিন্দু শাস্ত্রমতে সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি এবং বুদ্ধিদাতা তিনি।
সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্মের সময় দেবী দুর্গা সকলের সঙ্গে শনিদেবকেও নিমন্ত্রণ করেন তাঁর পুত্রের মুখ দেখে আশীর্বাদ করার জন্য। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শনিদেব গৌরী-পুত্রকে দর্শন করেন। শনিদেব দর্শন করার সঙ্গে সঙ্গে গণেশের মস্তক ভস্মীভূত হয়। এই অবস্থায় ভগবান বিষ্ণুর প্রচেষ্টায় হাতির মাথা দিয়ে গণেশের পুনর্জীবন দান করা হয়। ক্রুদ্ধ দুর্গা চিন্তিত হয়ে পড়েন এরূপ দর্শনের কারণে গণেশ দেবতা রূপে পূজিত হবেন কি না এই চিন্তায়। অবশেষে সমস্ত দেবতাদের আশীর্বাদে শ্রী গজানন সিদ্ধি লাভের দেবতার স্থান পান। এই কারণে সমস্ত শুভকর্মে, এমনকি সমস্ত পূজার শুরুতে সিদ্ধিদাতার পূজা বিধি। সিদ্ধিদাতার আশীর্বাদে সমস্ত কর্মে সাফল্য আসে।
স্কন্দপুরাণ মতে ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথি সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্মতিথি। এই দিনে শ্রীগজানন আশীর্বাদ দানের উদ্দেশ্যে মর্তে আগমন করেন। ভক্তিভরে উপাসনা করলে সিদ্ধিদাতা গণেশের আশীর্বাদ মেলে।
ভগবান গণেশ শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক এবং বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা রূপে পূজিত হন। পৌরাণিক তত্ত্ব অনুসারে ভগবান গণেশ কেবল প্রতিবন্ধকতা দূর করার দেবতা নন তিনি একজন শিক্ষকও। তার উপাখ্যানগুলি হিন্দু পুরাণের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যা মানুষকে জীবন মহান শিক্ষা প্রদান করে। গণেশ প্রদত্ত পাঁচটি শিক্ষা অবশ্যই মনে রাখা উচিত:
১. কর্তব্যের ঊর্দ্ধে আর কিছু নাই
লোকবিশ্বাস অনুসারে, বলা হয় মাতা পার্বতী নিজ হস্তে মূর্তি খোদাই করে শ্রী গণেশকে সৃষ্টি করেছিলেন। মহাদেবের অনুপস্থিতিতে সেই মূর্তিতে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। একদিন মাতা পার্বতী স্নান করার সময় দরজা পাহারা দিতে বলেছিলেন এবং গণেশও মায়ের নির্দেশমত দরজা পাহারা দিচ্ছিলেন এমন সময়ই পিতা মহাদেব এসে পার্বতীর স্নান ঘরে প্রবেশের ইচ্ছা প্রকাশ করায় ভগবান গণেশ তা অস্বীকার করেন। ঘটনাটি পিতা ও পুত্রের মধ্যে মারামারিতে পরিণত হয় এবং গণেশের শিরশ্ছেদ করে শেষ হয়। পরবর্তীকালে একটি হাতির মস্তক দেন করে গণেশের পুনরুত্থান করেন।
ঘটনাটি এই শিক্ষা প্রদান করে যে এমনকি দেবতারাও তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্য, এবং কর্তব্যপরায়ণ হওয়ার চেয়ে বড় কোন গুণ নেই, বিশেষ করে পিতামাতার প্রতি। ভগবান শিবের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালভাবে অবগত থাকা সত্ত্বেও ভগবান গণেশ তাঁর কর্তব্যের প্রতি অটল ছিলেন।
২. পিতা-মাতার চেয়ে বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ আর কেহ নয়
একবার ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতী তাদের দুই পুত্র কার্তিক এবং গণেশকে একটি অলৌকিক জ্ঞানের ফল প্রদান করেছিলেন, কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল একজনই পবিত্র ফল পেতে পারেন। কে ফলের অধিক প্রাপ্য তা নির্ধারণ করার জন্য, ভগবান শিব তাদেরকে তিনবার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে বলেছিলেন, এবং যিনি প্রথমে শেষ করতে পারবেন তিনি ফল দিয়ে ধন্য হবেন। বড় ছেলে, ভগবান কার্তিক, দৌড় জয় করতে , ময়ূরকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলেন, তবে ভগবান গণেশ ভাবতে লাগলেন যে তিনি কীভাবে তার ইঁদুর-গাড়িতে চড়ে জয়ী হতে পারেন?
পৃথিবীকে তিনবার প্রদক্ষিণ করার পর, কার্তিক ভাই গণেশকে খুঁজতে বাড়িতে ফিরে আসেন। যদিও দৌড়ে গণেশই জয়লাভ করেছিলেন কিন্তু পৃথিবীর পরিবর্তে তিনি ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন-যাঁরা তাঁর চোখে তাঁর পৃথিবী ছিলেন। তিনি জ্ঞানের ফলের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন, এবং জ্ঞানের প্রভু হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন।
ঘটনাটি এই শিক্ষাই প্রদান করেন পৃথিবীতে সকলের কাছে এমন কি ভগবানের কাছে পিতা মাতার চেয়ে বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ আর কিছুই হতে পারে না।
৩. ক্ষমাই হল শ্রেষ্ঠ গুণ
একদিন খাবার এবং মিষ্টির প্রেমিক, ভগবান গণেশ হৃদয়গ্রাহী খাবার খেয়ে বাড়ি ফিরছিলেন, হঠাৎই তিনি হোঁচট খেয়ে পেটে গড়িয়ে পড়ায় চাঁদ এটিকে উপরে থেকে দেখে একটি নিষ্ঠুর হাসিতে ফেটে পড়ে এবং গণেশকে বিদ্রুপ করে যা ভগবান গণেশকে এতটাই বিরক্ত করেছিল যে তিনি তাকে অভিশাপ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভগবান গণেশ চাঁদকে আকাশ থেকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন এরপর চাঁদ ক্ষমা চাওয়ায় উদার ভগবান গণেশ তাঁর অনুরোধে সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু তিনি অভিশাপ প্রত্যাহার করতে পারেননি, তাই তিনি আকাশ থেকে চাঁদের অন্তর্ধানের সময়কে একদিন কমিয়ে এনেছিলেন।
ভগবান গণেশের এই কাহিনী ব্যাখ্যা দেয় যে কিভাবে রাগ কাটিয়ে ওঠার শক্তি আমাদেরকে উন্নত মানুষ করে তোলে।
৪. জীবনের প্রতিটি কাজ সম্পূর্ণ করা উচিত
পৌরাণিক তথ্য অনুসারে বেদ ঋষি মহাভারত লিখতে চেয়েছিলেন এবং তিনি ভগবানকে গণেশকে তা অনুরোধ করেছিলেন তিনি যেমন বর্ণনা করবেন তেমনটা লিখে দেওয়ার জন্য। ভগবান গণেশ ও একটি শর্তে রাজি হয়েছিলেন। বেদ ঋষি বিনা বিরতিতে শ্লোকগুলি পড়া শেষ করবেন এবং ভগবান গণেশ বিরতি না নিয়ে লিখবেন। সেইমতো দুজন মানবজাতির কাছে পরিচিত একটি মহাকাব্য লিখতেও বসেছিলেন, কিন্তু ভগবান গণেশের কলম লিখতে লিখতে ভেঙে যায় তখন ভগবান গণেশ তাঁর একটি দাঁত ভেঙে দিয়েছিলেন কিন্তু মহাকাব্য রচনা চালিয়ে গেছিলেন।
একটি কাজ শেষ করার জন্য ভগবান গণেশ তার দাঁত উৎসর্গ করেছিলেন। ভগবান গণেশের এই শিক্ষা গ্রহণ করলে মানুষ সাফল্যের পথে চালিত করবে।
৫. সর্বদা আত্মসম্মানের কথা মাথায় রাখা উচিত
একদিন সকল দেবতারা ভগবান গণেশকে স্বর্গলোকে এক ফেলে ভগবান বিষ্ণু ও মাতা লক্ষ্মীর বিবাহের অনুষ্ঠানে চলে গেছিলেন। ভগবান গণেশকে প্রতারিত করা হয়েছিল, কারণ অন্যান্য দেবতারা তাঁর শারীরিক চেহারা এবং ব্যাপক খাদ্যাভ্যাসের জন্য বিব্রত ছিলেন। সত্য জানার পর, ভগবান গণেশ প্রতিশোধ নিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। গণেশ তার ইঁদুর-বাহন, গজাসুরকে পাঠিয়েছিলেন সেই রাস্তাগুলি খনন করার জন্য যা দেবী লক্ষ্মীর বাসভবনের দিকে নিয়ে যায়। ফলে দেবতারা আর এগিয়ে যেতে বাঁধা পান, এবং সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান। একজন কৃষক ঐসময় রাস্তা পার হচ্ছিলেন এবং পরিস্থিতি বুঝে দেবতাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং ভগবান গণেশের নাম জপ করার পর প্রথম প্রচেষ্টায় রাস্তায় আটকে থাকা গাড়িটি বের করে আনেন। এরপর ঐ কৃষক ব্যাখ্যা করেছিলেন যে কীভাবে কেবল ভগবান গণেশের নামই তার মধ্যে গাড়ী উঠানোর শক্তি জুগিয়েছে, যেহেতু তিনি বাধা দূরকারী। এর ফলে দেবতারা বুঝতে পেরেছিলেন যে তাঁর শারীরিক চেহারার চেয়ে সত্তার ও মূল্য আছে এবং তারা ভগবান গণেশের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।
ভগবান গণেশের এই কাহিনী এই শিক্ষা প্রদান করে যে কখনওই কারোর কাছে নিজের ক্ষমতা বা চেহারাকে ছোটো হতে দেওয়া উচিত নয়।
রচনাকাল : ১০/৯/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।