আশ্চর্য নয় সত্য......অবাক হলেও সত্য ঘটনা
দ্বিতীয় খণ্ড (দশম পরিচ্ছেদ)
তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
কুকুর পা উঁচু করে প্রসাব করে আর প্রসাব করার আগে জায়গাটি শুঁকে নেয়। এই ঘটনাটি আমাদের সবার দেখা। কিন্তু এর পেছনের কারন কি? চলুন খুঁজে দেখি আজ। প্রথমেই জানিয়ে রাখি- এই পোস্টটিতে বৈজ্ঞানিক আলোচনা হতে চলেছে। তাই, অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করে কেউ নিচু মানসিকতার পরিচয় দেবেন না। সব প্রথমেই, আমরা দুটি টার্মের সাথে পরিচিত হব।
ফেরোমন কি?
ফেরোমন বিষয়টা সহজে বোঝার জন্য এটাকে গন্ধ হিসেবে মনে করুন। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দেই – প্রজননকালে স্ত্রী হাতির মুত্রের সাথে এক ধরণের গন্ধ নিঃসৃত হয়। এই গন্ধ শুঁকে পুরুষ হাতি বুঝতে পারে কোন স্ত্রী হাতি মিলনের জন্য প্রস্তুত।
এই গন্ধ প্রাণির বহিঃক্ষরা গ্রন্থি হতে ক্ষরিত হয়। প্রজননের জন্য ব্যবহৃত এই ধরণের গন্ধ কে বলে সেক্স ফেরোমন। ফেরোমন বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। একেক ফেরোমনের একেক ধরণের কাজ। এক প্রজাতির প্রাণির ফেরোমন অন্য প্রজাতির ফেরোমনের কোন মিল নেই। আবার এক প্রজাতির প্রাণির ফেরোমন অন্য প্রজাতির প্রাণী সনাক্ত করতে পারে না।
যেমন- বাঘ যে ফেরোমন নিঃসরণ করে তা সিংহ সনাক্ত করতে পারে না শুধুই বাঘ সনাক্ত করতে পারে। প্রাণির দেহ থেকে ক্ষরিত একটি উল্লেখযোগ্য ফেরোমন হলো মার্কিং ফেরোমন।
মার্কিং ফেরোমন এর মাধ্যমে প্রাণী তার বসবাসের এলাকা মার্ক করে রাখে। এলাকার বাইরে গেলে গন্ধ শুঁকে আবার নিজ এলাকায় ফিরে আসে।
আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, কুকুরকে চোখ বেধে এলাকার বাইরে ফেলে আসলে সে ঠিক পূর্বের জায়গায় ফিরে আসে।
যেমন পিঁপড়েরা খাবারের খোঁজ পেলে ফেরোমন ছাড়ে যার সাহায্যে অন্য পিঁপড়েরা বোঝে কোথায় খাবার আছে এবং তারা লাইন ধরে সেদিকে যেতে থাকে।কুকুর পা উচু করে প্রসাব করে ফেরোমন ছড়ানোর জন্য।
টেরিটরি মার্কিং
বন্যপ্রাণী আধিপত্যবিস্তার করার জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা বেছে নেয়। এই নির্দিষ্ট এলাকায় সে নিজের প্রভাব খাঁটায়।নিজের এলাকায় সে রাজার মত বসবাস করে। তার রাজ্যে বসবাসকারী স্বপ্রজাতিকে প্রজার মত মনে করে। এই এলাকায় অন্য কোন রাজা প্রবেশ করলে জীবনপণ লড়াই করে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়ে দেয়। নিজে হেরে গেলে এলাকা ছাড়া হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী নতুন রাজা হিসেবে স্বীকৃত হয়। ঠিক যেন এলাকার মাস্তানের নিজ এলাকা দখলে রাখার পদ্ধতি। প্রাণিদের দখলে থাকা এ ধরণের এলাকা কে টেরিটরি বলে।টেরিটরি চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াকে টেরিটোরি মার্কিং বলে।
**কুকুর পা উচু করে এক পা তুলে প্রসাব করে কেন?
কুকুর পা তুলে প্রসাব করে বেশ কিছু কারণে এগুলো হলো:-
১। আধিপত্য বিস্তারের এলাকা চিহ্নিত করা
কুকুরের প্রসাবের সাথে মার্কিং ফেরোমন ক্ষরিত হয়। মার্কিং ফেরোমন বেশ গন্ধ যুক্ত। ফেরোমনের এই গন্ধ বৃষ্টি না হলে দীর্ঘদিন টিকে থাকে।মার্কিং ফেরোমনের সাহায্যে কুকুর নিজের এলাকা মার্ক করে রাখে। নিজে এই এলাকার বাইরে গেলে নিজের এলাকা চেনার জন্য মার্কিং ফেরোমনের গন্ধ শুঁকে এবং ফিরে আসে। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন কুকুর চলার পথে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে চলে।আসলে এটি ফেরোমনের গন্ধ শুঁকে নিজ এলাকা খঁজে বের করার প্রচেষ্টা। অন্য এলাকার কুকুর এই টেরিটোরির মধ্যে প্রবেশ করলে গন্ধ শুকে বুঝতে পারে যে, সে অন্য রাজার রাজ্যে প্রবেশ করেছে। এবার পালাতে হবে। কুকুর পা উচু করে প্রসাব করে, মূত্রের মাধ্যমে এলাকা চিহ্নিতকরণের এই ব্যাপারটি ভালুক, নেকড়ে, বাঘ প্রভৃতি প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। তাই কুকুর পা উচু করে প্রসাব করে এটা দেখে কুকুরকে ঘৃণা করা উচিৎ নয়।
শহরাঞ্চলে যেহেতু খাবার পেতে তেমন সমস্যা হয়েনা সেহেতু কুকুরের এক একটা দলের টেরিটরি যথেষ্ট ছোট থাকে। কিন্তু যেখানে খাবারের অভাব সেখানে এক একটা দলের টেরিটরি বেশ বড় হয়ে। যেমন Arctic wolves রা উত্তর মেরুর কাছে থাকে এবং মূলত এদের ক্যানাডাতে পাওয়া যায়। এদের এক একটা দলের টেরিটরি কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। যেমন- মানুষদের বড় বড় দেশ ।
২। পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখা
এক কুকুরের ফেরোমনের গন্ধ শুঁকে অন্য কুকুর তাকে চিনতে পারে। ঠিক মানুষের মত, আপনি যেমন আপনি আপনার কোন বন্ধুর গায়ের গন্ধ শুঁকে নাম বলে দিতে পারেন। কুকুরের অনেক বন্ধু থাকে এই বন্ধু গুলো ফেরোমনের গন্ধ শুঁকে নিজের বন্ধুর এলাকা চিনতে পারে। আবার শত্রু এলাকায় প্রবেশ করে তাড়া খেলে সাহায্যের জন্য বন্ধুর এলাকায় প্রবেশ করে। কোন রাজার অধীন যতগুলো প্রজা কুকুর থাকে সবাই রাজার ফেরোমন চিনতে পারে তাই প্রজা কুকুর রাজার মার্ক করা এলাকা ছেড়ে বাইরে যায় না। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় নির্দিষ্ট এলাকায় নতুন কুকুর প্রবেশ করলে এলাকার কুকুর গুলো একজোট হয়ে অনাহুত কুকুরকে আক্রমণ করে। অনেক সময় এই লড়াই এতই ভয়ংকর হয় যে দেখে মনেহয় মহাভারতের কুরুক্ষেত্র।
৩। প্রজনন সঙ্গী খোঁজা
প্রজননকালে পুরুষ কুকুরের অভাব হলে স্ত্রী কুকুর সঙ্গীর খোঁজে মাইলের পর মাইল ভ্রমণ করে। এই ভ্রমণ পথে স্ত্রী কুকুর পুরুষ কুকুরের ফেরোমনের গন্ধ শুঁকে পথ চলে এবং সঙ্গীকে খুঁজে বের করে। পুরুষ কুকুরও একইভাবে সঙ্গীকে খুঁজে নেয়। তাই কুকুর পা উচু করে প্রসাব করে সেক্স ফেরোমন ছরায়। এখন প্রশ্ন হলো কুকুর সাধারণভাবে প্রসাব করলেই তো পারে, ঠ্যাং উচু করে বিশ্রী ভঙ্গীতে প্রসাব ছিটিয়ে দেয়ার কারণ কি?
খেয়াল করলে দেখবেন যে, কুকুর সাধারণত উলম্ব (vertical) জায়গা যেমনঃ গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি ইত্যাদি জায়গায় প্রসাব করে। কারণ যত উঁচু জায়গায় মুত্র পতিত হবে তত বেশিদূর গন্ধ ছড়াতে পারবে। স্বাভাবিকভাবে প্রসাব করলে তো প্রসাব মাটিতে পরবে ফলে অন্য প্রণির চলাচলের কারণে দ্রুত মিশে যাবে। উচুতে প্রসাব পৌছাতে হলে অবশ্যই পা উচু করে প্রসাব ছড়িয়ে দিতে হবে। তাই কুকুর পা উচু করে প্রসাব করে। উল্লেখ্য কুকুরের এই মূত্রত্যাগের ব্যাপারটি তাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। অনেকেই হয়েতো এই লেখা পড়ে হাসাহাসি করছেন কিন্তু কুকুরদের জন্য এটা মোটেও হাসাহাসির ব্যাপার নয়। কুয়াশা, বৃষ্টির কারণে ফেরোমন ধুয়ে যায় তাই কুকুরকে মাঝে মধ্যেই প্রসাব করে এলাকা চিহ্নিত করতে হয়। স্ত্রী এবং পুরুষ উভয় কুকুর ফেরোমন নিঃসরণ করে তবে পুরুষ কুকুর যেহেতু আধিপত্য বিস্তার করে তাই এরা বেশি মাত্রায় প্রসাব করে।
রচনাকাল : ২৭/৮/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।