স্বাধীন ভারত ও স্বাধীনতার সংগ্রাম (দ্বিতীয় পর্ব)
তথ্য সংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেই সংগ্রামের বহু নায়ককেই মনে রাখেনি ইতিহাস। যেরকম বিশ্বের ইতিহাস থেকেও হারিয়ে গিয়েছেন বহু নায়ক-নায়িকা। তাতে অবশ্য তাঁদের কিছু এসে যায়নি। কারণ ইতিহাসের পাতায় নাম তোলা নয়, তাঁদের এক ও একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারতরকে ইংরেজ কবল থেকে মুক্ত করা। আরও এক স্বাধীনতা দিবসের আগে স্মরণ করা হল এরকমই বিস্মৃতপ্রায় কিছু ব্যক্তিত্বকে।
মাতঙ্গিনী হাজরা
মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ভারত ছাড় আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। মেদিনীপুরে তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি মিছিল চলাকালীন ব্রিটিশ পুলিশের গুলি এসে লাগে তাঁর দেহে। তবু তিনি চলা থামাননি। হাতে তেরঙ্গা, মুখে বন্দেমাতরম স্লোগান নিয়ে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও তিনি সেইদিন এগিয়ে গিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নিয়ে।
বেগম হজরত মহল
৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন বেগম হজরত মহল। আওয়াধের নবাবকে ইংরেজরা নির্বাসিত করলে তিনি আওয়াধের ক্ষমতা হাতে তুলে নেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়াধবাসী ইংরেজ সাসিত লখনউ শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। পরে অবশ্য তাঁকে পিছু হঠতে হয়। শেষ পর্যন্ত বেগম হজরত আশ্রয় নিতে বাধ্য হন নেপালে। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
সেনাপতি বাপাত
স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলার মর্যাদা পেয়েছিলেন এই গান্ধীবাদী নেতা। মুলসি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে সেনাপতি বলে ডাকা হত। ইংরেজ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা ও ভাঙচুর চালানর অভিযোগ আনে। এই অভিযোগ ওঠার পর তিনি নিজেই আত্মসমর্পন করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। কারণ সত্যাগ্রহী হিসেবে হিংসার পথ নেওয়া তাঁর উচিত হয়নি বলে মনে করেছিলেন সেনাপতি বাপাত। দীর্ঘদিন জেলে কাটাতে হয় তাঁকে।
অরুণা আসাফ আলি
মহাত্মা গান্ধীর সহযোদ্ধা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। কিন্তু সেভাবে কোনওদিনই প্রচারে ছিলেন না। ১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় বম্বের গোয়ালিয়া ট্যাঙ্ক ময়দানে বারতের জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা তুলেছিলেন এই বীরাঙ্গনা।
পত্তি শ্রীরামুলু
গান্ধীর একনিষ্ঠ সমর্থক ও ভক্ত বলা যায় তাঁকে। গান্ধীর মানবতার আদর্শকে সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। দেশ ও মানবতার প্রতি তাঁর এই নিষ্ঠা ও কর্তব্যবোধ দেকে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং গান্ধী। একবার শ্রীরামুলু সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, 'আমার যদি শুধুমাত্র শ্রীরামুলুর মতো আর ১১ জন সমর্থক থাকত, তবে এক বছরেই স্বাদীনতা অর্জন করতে পারতাম।'
ভিকাজি কামা
ভারতের অনেক শহরেই কামার নামে সড়ক বা ভবন রয়েছে। তাই তাঁর নামটি অনেকেই জানেন, কিন্তু যেটা জানা নেই তা হল তিনি কে, এবং তিনি কি করেছিলেন। স্বাধীনতার লড়াই শুধু ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের বিরুদ্ধে নয়, কামা বুঝেছিলেন প্রকৃত স্বাধীন হতে গেলে দূর করতে হবে লিঙ্গ বৈষম্যও। তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার লড়াইও তিনি চালিয়ে গিয়েছেন সারা জীবন ধরে। এমনকী মৃত্যুর পর তাঁর যাবতীয় সঞ্চয় তিনি দান করা যান মেয়েদের জন্য তৈরি এক অনাথ আশ্রমে। ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কনফারেন্সে তিনি স্বাধীন ভারতের পতাকাও উত্তোলন করেছিলেন।
তারা রানী শ্রীবাস্তব
স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিওয়ান থানার সামনে এক ব্রিটিশরাজ বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন তারা রানী শ্রীবাস্তব। ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে বিদ্ধ হন তাঁর স্বামী। কিন্তু তাতে দমে যাননি তারা রাণী। স্বামীর ক্ষতে ব্যান্ডেজ বেঁধে বাকিদের সঙ্গে এগিয়ে যান মিছিলে। মিছিল থেকে ফিরে দেখেছিলেন স্বামীর মৃত্য়ুর হয়েছে। কিন্তু সেই মৃত্যু তাঁকে স্বাধীনতার জন্য আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তোলে। শেষ পর্যন্ত সংগ্রামের পথেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। শেষ অবধি তাঁর হাতে উঁচু করে ধরা ছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা।
রচনাকাল : ১৩/৮/২০২১
© কিশলয় এবং লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।