অন্ধের ষষ্ঠী
আনুমানিক পঠন সময় : ৩০ মিনিট

লেখিকা : রিনা দাস
দেশ : India , শহর : Kalkata

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২১ , জুলাই
প্রকাশিত ১৭ টি লেখনী ১৯ টি দেশ ব্যাপী ১৫৯২ জন পড়েছেন।
বিষাদে অবগাহন (ছোট গল্প)
_______
ঝিরিঝিরি হিমেল হাওয়া বইছে। ঘরের দক্ষিণা কোনে‌র জানালাটা খুলে কনা উপন্যাস পড়তে বসেছে। আগেই কি যেন বিড়বিড় করে বইয়়ের কভারে গন্ধটা নিয়ে বকছে ।বিদ্যুৎ টা চলে গেলে হাত পাখার হাতটা ভারী হাওয়ায় বইয়ের মোটা কভারে বাতাস করছিল। জানালার ধারে বকুল গাছটায় বকুল ফুলের মুকুলে ভরপুর। ভোর হতে না হতেই কে কোথা থেকে বকুল কুড়িয়ে নিয়ে যায় কনা টের‌ই পায় না। পেটের দায়ে প্রমিও মম খুব ভোরে সে ফুল নিয়ে চলে যায়। কখনো কলাগাছের কিংবা মান কচু গাছের বড় পাতা ছাইয়ে রাখে।। ফুলে যেন মাটিতে লেগে নষ্ট না হয়। বকুল ফুলের গন্ধতো পুরো জায়গায় মিষ্টি সুবাস নিয়ে আসে। গাছটির দু'পাশে ঘোর জঙ্গল মোহল বললো ভুল হবেনা। সারি সারি গাছ মাটিতে ঘাসগুলো বিশাল বিশাল। মশা সে যেন ইনজেকশন দিচ্ছে। এ সত্ত্বেও মিষ্টি সুবাসে কার মন স্থির থাকে। মা মিনা কনাকে ডাকছে ঘরের কাজে সহযোগিতা করার জন্য। হাতে হাতে কিছু কাজ এগিয়ে দিলে কার না ভালো লাগে। বরং বিশ্রাম হয় সুবিধা-অসুবিধা তো আছেই। বই পড়তে কি সব সময় ভালো লাগে। এত পড়াশোনা থাকে। কি জানি বাপু আমরাও তো অত পড়াশুনে জানা লোক নই। আমার হয়েছে মরণদশা দিনে রাতে এত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি শরীর  তো নয় এ যেন কল কারখানার মেশিন চলছে। কনা মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে বলে আমি পারবো না দেখছো না আমি বই পড়ছি। মিনা কি ওতো জানে সে কি পড়াশোনা করে। কনা দেবদাস উপন্যাস নিয়ে বসেছে। বইটি খুলে লেখক ও সম্পাদকীয় পড়তে বসেছে সে সময় পিন্টুর গলার আওয়াজ পেল। কনা তড়িঘড়ি বইটি বুকশেলফ এ রেখে মায়ের কাছে ছুটল। কি করতে হবে বল গে। মিনা গম্ভীরভাবে বললো ছাগলটারে পাতা পেরে দেগে আর গরু গুলো রে গুর নালী ও জল পাটাতনে চাড়িতে খেতে দে। কনা অন্যমনস্ক ভাবে যাচ্ছে গরু যদি শিং দিয়ে একটিবার তেড়ে আসে তোর রক্ষা নেই। মেয়ে গাভীকে জল দিতে গিয়ে যদি বাছুর দুধ খেয়ে ফেলে তো আজ আর ঘরে ভাত কি জুটবে না। বেধড়ক পিটুনি খেতে হবে। আত্মভোলা মনে কনা ফের টিভি দেখতে বসেছে। ক্রিকেট খেলা হচ্ছে বাংলাদেশ বনাম ইন্ডিয়া। টানটান উত্তেজনা দু'বাংলার মানুষের আবেগের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস 30 বলে 50 রান সংগ্রহ ভারত জিতে যাবে।ব্যাট করতে নেমেছে মহেন্দ্র সিং ধোনি স্পিনার সাকিব আল হাসান। ধোনির ব্যাট তখন তুঙ্গে চার ছক্কায় বাউন্ডারি হাঁকিয়ে। মা চিৎকার করে চলছে কি রে হলো জল দিলি। কনার শ্বাসরুদ্ধ ম্যাচে সব ভুলে ক্রিকেট দেখায় মশগুল। এবার মিনা লাঠি নিয়ে পাকড়াও করল কনা ভয়ে পালিয়ে ভোঁদৌড়। একবার যদি শম্ভু জানতে পারে মেয়ে কথা না শুনে খেলা দেখতে বসেছে পিটুনিতে রক্ষে নেই। মাকে শান্ত করার জন্য কনা দৌড়ে গাছে উঠে পরল কাঁঠাল গাছের পাতা পেড়ে ছাগল দুটো রে দিল। ওদিকে মিনা বকা শুরু করে দিল কনা ধীরে পায়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল। ভারি অন্যায় হয়েছে আর করব নে। কনা শান্ত হয়ে গরুকে খড় খেতে দিল। আকাশ ভারী কালো মেঘে ঢেকেছে। বৃষ্টি নামবে বলে কনা ঘরেই ছিল ,ঝিরিঝিরি পড়তে আরম্ভ করলো। কনা খেতে বৃষ্টিতে ভিজতে গেছে। মিনা কণাকে ডাকলো ঘরে নেই ওই বাদর মেয়ে আবার বেরিয়েছে। ঘরে ফিরুক ওর আজ করবোগে। কনা ভেবেছিল আজ ওর দাদা (পিন্টু) ও শম্ভু বাবা নেই বেশ আনন্দে বর্ষা উপভোগ করবে। বিজলী চমকাচ্ছে বিল্টু ও আশু কাদায় দৌড়াচ্ছে সাথে কনা ‌ও তাল মিলিয়ে। বৃষ্টিতে কাদের গাছে ফল আছে সে নজর তাদের আছে। সেবার বাতাবি লেবু পেড়ে লঙ্কা ,লবণ, চিনি দিয়ে মেখে বেশ মজা করে খেয়েছে। চুরি করে খাওয়ার মজাটাই আলাদা। বৃষ্টিতে মাটির ভ্যাপসা স্যাঁতস্যাঁতে ভাবটা কনার বেশ লাগে। বিল্টু ও আশু ডিজে স্নান করে যে যার মতো ঘরে গেল। কনা বাড়ীতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই বুঝতে পারবে বলে বাড়ির পিছন দিকটার কথা চিন্তা করতে লাগল। কিন্তু রাস্তাটা মোটেও সুবিধার ছিল না। বর্ষাকাল হলে ঘাস বেয়ে জোঁক, কেঁচো উঠে আসে। একে তো মা রেগে অগ্নি শর্মা হয় আছেন ওদিকে এদিকে বাঁশঝাড়ের রাস্তার পিচ্ছিল জোঁক, কেঁচোর উৎপাত। পেছন দরজা লাগানো থাকলেও ডিঙিয়ে উঠতে হবে। ভয়ে ভয়ে দরজা ডিঙিয়ে কলতলায় ভালো করে স্নান সেরে নিল। চুপি চুপি বারান্দায় পা টিপে টিপে ফেলতে লাগলো। পাশের বাড়ি রেডিওর আওয়াজটা কানে পৌঁছাচ্ছে। এন্ড্রকিশোর নুকুল বিশ্বাস গান গাইছে। উঁকি দিয়ে দেখল বৃষ্টির আওয়াজে মা শুয়ে পড়েছে। পোশাক পরিবর্তন করে খেতে রান্না ঘরে প্রবেশ করবে ঠিক সে সময় মা লাঠি নিয়ে ক'ঘাত বসিয়ে দিল। কতদিন নিষেধ করেছি ওদের সাথে পাড়ায় ওরকম ভিজতে নেই। ঢিঙ্গি মেয়ে এত বল মানে লাগেনা। পাড়াগাঁয়ের হইচই পড়ে যাবে রটনা ঘটনায়। কনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। মিনা একমনে মেয়েকে শাসিয়ে যাচ্ছে পাঁড়া গায়ে ওতো বন্ধু টন্দুর কোন আধিখ্যেতা নেই। ওরা পুরুষ তুমি নারী। ওদের হাজার গায়ে কাদা লাগলেও কেউ কিচ্ছুটি বলবে না। তোমার গায়ে একটা মশা মাছি বসলেই সবাই ছিঃ ছি করবে। কনা মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখে বেশি কিছু বলল না নয়তো আরো ক৺ঘা খেতে হবে। সুজুকি দিয়ে চলছে পিসি মাকে থামিয়ে দিল অনেক হয়েছে এবার থাম। কনা চোখের বন্যা ক্রমশ সামলিয়ে চুপচাপ ঘরের কোণে বসে পরলো। যেন সটান মায়ের জোরে ছুটি নিয়েছে। মিনা কিছুক্ষণ বকাঝকা করে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছে। এতক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। পাশের বাড়ি  সুনয়না কি যেন নিতে এসেছে। খাবার থালায় দিয়ে কনা কে ডাকলো।কনা চুপচাপ খেতে বসলো। সুনয়না জিজ্ঞেস করল কিগো মুখ ভার কেন আবার কোন গোল বাঁধা ও নি তো! কনা মাথা নাড়ালো। বেশি কিছু না বলে সুনয়না মই নিয়ে চলে গেল। গেল বছর মইটা নিয়ে ভেঙে ফেলেছে এবার যদি তাই করে তো শম্ভুর রাগের ঘটা দেখিনি বুঝতে পারবে। মিনা বলতো সাবধানে কাজ করে দিয়ে যাবে সময় মতো নয়তো রেগে চিৎকার করবে। কনা খেতে বসে মনে মনে ফন্দি আঁটছে কি করে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেয়া যায়। আজ বাবা ও দাদা রাত হবে বিয়ের পাকা কথা বলতে গেছে রঞ্জনা'র। মিনা মন্দিরে পূজো সেরে বসে আছে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। কনা কালো পাঞ্জাবি টে পরে সামনে দাঁড়ালো মিনা চিৎকার করতে লাগলো। কনা তড়িঘড়ি কাপড় খুলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বলল চিৎকার করছো কেন? ওদিকে ভূত। কই না তো ভূত নেই তো মিনা কালো পাঞ্জাবি টা দেখতে পেয়ে কনার কানটি ধরে নিল আবার বদমাশি হচ্ছে। আমাকে ভয় দেখানো হচ্ছে কনা ছেড়ে আলগা হলে দৌড়ে পালিয়ে বসে ,আমাকে মেরে ছিলে কেন? আমার কষ্ট হয় না বুঝি। মিনা তখন মেয়েকে মেয়েদের দুঃখের কথা বোঝাতে থাকে। এত সহজ নয় গো মেয়েদের জীবন মেয়েদের সামনে-পিছনে ভেবে পা ফেলতে হয় নয়তো পদে পদে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। রাত ঘনিয়ে এলে কনা বালিশ কাঁথা নিয়ে শুয়ে পড়ে। আজ আর পড়তে বসবো না মোটেও ভাল লাগছে না বলে ঘুমিয়ে পড়ল ।ভোরে ওঠে বই পড়তে বসল কিন্তু মাথায় ভুতের বেগে বকুল ফুল তোলার কথা মনে পরতেই ছুটে গেল। মা কনা উঠে দেখে মেয়ে নেই পেছন পেছন বকুল তলায় গিয়ে দেখে সে দলবেঁধে বকুল ফুল তুলে নিচ্ছে। ফের মালা গেঁথে বিক্রি করল এত সুন্দর সুবাসে যে কেউ কিনে নিতে রাজি হতো। মা বারণ করেছে ছেলেদের কাছে মালা বিক্রি না করতে তাই সে শিক্ষিকার কাছে বিক্রি করেছে। মালা ভারী সুন্দর এজন্য কত মায়া স্নেহ দিয়ে গেঁথে কনা বিক্রি করছে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনায়ে এল হাঁস মোরগগুলো বাড়ি ফিরল। কাক পাখিগুলো ঘরে ফিরছে আঁধার ঘনায়ে। কনা সিটি দিয়ে বাড়ি ফিরছে। মা আবার রেগে আগুন। তোরে না বলেছি মেয়েদের ওসব করতে নেই। কনা পিটুনি ও বকার ভয়ে নিরুত্তরে ঘরে ফিরল।


[[[২]]]
গ্রামের প্রচলিত প্রথার বৈশাখে নানা দেবদেবীকে পূজা অর্চনা করা হয়ে থাকে। মনঃবাসনা পূরণের জন্য কেউ কেউ শুভচনীর বাস্তূ পুজা করে কেউ পান-সুপারি ফল ছড়া সাজিয়ে পঞ্চ কন্যাকুমারী দিয়ে উপসে এপূজা করে। আলাদা করে একটা পানির উপর সুপারি দিয়ে লোকজনের সম্মুখ থেকে বৃদ্ধ দেখে এই নৈবেদ্য দিয়ে গিয়ে আড়ালে রাখতে হয়। ছোট মাঝারি কেউ এসবে হাত দেবেনা। অনেকের ধারণা এ খেলে কথা পেটে চেপে রাখতে পারেনা গোপন কথা ফাঁস করে দেয়। গতবছর বন্যায় আমন ধান ডুবে গিয়েছে। ধানের পুরো মাঠ প্রান্তরে থৈ থৈ জল। টানা 15 দিন থেকে জল বের হতে না পেরে পুরো মাঠে সকলের চাষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিলাবৃষ্টিতে ধান মাটিতে কাদায় মিশে গেছে। কনা দেখেছিল পেটের দায়ে অনেক মা বোন সে ধান তুলে নিয়ে ঢেঁকিতে ৺ছেটে চাল করে বের করে খেয়েছে। সেসব অতীত মনে হলে এখনো চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। পেটের খিদে কচু শাক ,শাক আলু সেদ্ধ, কাঁঠাল সেদ্ধ, গমের ভাত করে খেয়ে দিন যাপন করত। সেসময় ভাত ছিল ধনী লোকের খাবার রুটি আটা গরিব লোকের আহার। আশু একি পাড়ায় বেড়ে উঠেছে। পড়াশুনোয় বেশ ভালো। বাবা মা ক্ষেতমজুরে কখনো-সখনো ভ্যান গাড়ি চালায়। দুটো ছেলে মেয়ে কি করে তাদের পড়াশোনা করাবে। মেয়েটারে বিয়ে দিতে হবে সে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা হয়। কনা, আশু বিল্টু হাসু সবাই একযোগে বন্ধু। কারো একটু অবস্থা ভাল কারো একটু খারাপ মধ্যবিত্ত পরিবারে যা ভাল তাই ওই ভালো-মন্দ বললে খারাপ কিছু নয়কো। একসাথে ওঠাবসা খোশ গল্প কখনো ক্রিকেট খেলা, কখনো ফুটবল ,ব্যাডমিন্টন, ছোট গুলো দাড়ি বান্ধা, গোল্লাছুট কানামাছি, দৌড় সবমিলিয়ে পাড়াগাঁয়ে হয়। শৈশবকালে দুরন্তপনায় ভরপুর। বেসুরো গলায় গান ও চলে মনের প্রশান্তির জন্য। পাট খেতে পাটগুলো ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, লাল শাক গুলো ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। মেয়ে মোড়গকে হাঁসের ডিম গুলো তাপ দিচ্ছে বেশ এক মাসের মধ্যে বেরিয়ে এলো। সদ্যজাত হাঁসের বাচ্চাগুলি দেখতে ঠিক পাখির ছানার মতো মনে হচ্ছে। কনার শখ হা সুদের মোরগের তাপ দিয়ে হাঁসের ছানা  পোষ্য করবে। মনের আনন্দে নিয়ে এলো মা রেগে অগ্নিশর্মা। একি হবে সদ্য জন্মানো। গিয়ে ফিরিয়ে দাও কনা হতভম্ব হয়ে ফিরিয়ে দিলেন। বাবা দাদার ভয় তো আছেই। রবি যেন পাটে বসতে চলেছে পাখিগুলো যে যার আলয়ে ফিরেছে। কনা পড়তে বসল। কিছুক্ষণ পড়ার পর খিদে পেয়েছে বলে উঠলে মিনা দু'টো নারিকেলের নাড়ু ও তিলের মোয়া নিয়ে হাজির। শম্ভু বাজারে গিয়েছে মেয়ের জন্য গরম গজা, লজেন্স নিয়ে আদুরে ডেকে উঠলো। ও বুড়ি কোথায় গেলি। আয় দেখি, কনার বাবার হাত গজা দেখে প্যাকেট খুলে গরম গজা সপাট কটা খেয়ে নিল। ততঃক্ষণে শম্ভু হাত-পা ধুয়ে বাইরে পাঞ্জাবি ধুতি খুলে ঘরের ধুতি গেঞ্জি পরে নিল। মিনা হাতে ধরিয়ে দিল চা,কাপের ডিস দু'টো বিস্কুট। গভীর চিন্তায় মগ্ন। কনা গায়ে হাত দিয়ে বলল ও বাবা কি হলো গো গম্ভীর হলে যে! আকাশ থম মেরে আছে এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে বলে। তামাক পাতা বাইরে শুকতে দেয়া আছে। রোজকার মতো কনক আজও সকালে এসে তামাক পাতা পাট শুকোতে দিয়েছিল। কিন্তু গুটিকয়েক রেখেছে বাকি ভিজাটা বাইরে আছে। বাইরে হাওয়া দিচ্ছে ধুলোবালির ভয়ে মিনা ঘরের বারান্দায় জানালাটা বন্ধ করে দিল। গতকাল তারকনাথের মেয়ে বিয়ে ঠিক করে এল বেশ কমিষ্ঠ ছেলে দেখতে-শুনতেও আছে। গরিব লোকের মেয়ে নিয়ে হাজার চিন্তে মাথায়। ঠিক সময়ে বিয়ে দিতে না পারলে আইবুড়ো রাখতে হবে। পরে জৈষ্ঠ মাসেই ধুমধাম করে পাড়া জানিয়ে বিয়ে দেবে। রেডিওটা ছেড়ে দিল কনা। সংবাদ শুনছে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে আরো এক মৃত তরুনীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার। গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। এত নিষ্ঠুর গো এরা। মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে গুলি করল কেন? পুলিশ ও বিএসএফ অনুমান করছে সীমানা পেরিয়ে কাঁটাতার কে স্পর্শ করেছে বলে বিএসএফ গুলি চালিয়েছে। এই হত্যাকান্ডের বিচার চাই বলে রব উঠেছে। ওদিকে বিএসএফ-এর জবাবদিহিতা দিতে হবে বলে খবরের কাগজে উঠে এসেছে। প্রত্যেক বছর বাংলাদেশ-ভারত মিলন মেলা চড়কের দিনে খুলে দেয় ওই সময়ে দু'পারের আত্মীয়-স্বজন দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে। নরেশ পিংকুর ছোট বোন ওই মেলায় তো ভারতে গিয়েছে আজ কত বছর হলো দেখা নেই। বিকেল পাঁচটায় আবার বন্ধ করে দেয়। কত লোক তাদের প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাত করবে বলে প্রতীক্ষা করে। শম্ভুর পিসতো বোন সেই যে গেছে তারার খবর নেই কি বেঁচে আছে কি মরে গেছে। দেশে থাকলে কি হত দেশভাগের পড়ে গেছে তার আর কোন খোঁজ মিলল না। স্বাধীন দেশে কিছু পৈশাচিক নরপশু থাবায় সবাই আতঙ্কে থাকে। বিত্তবান মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত কে সব সময় চাপিয়ে রাখে। রাজত্ব যেন ওদের ওই ওরা যা বলবে সাধারণ তাই মেনে নিতে হবে। মোড়লের মতো আদেশ করবে। দরদ নেই মায়া-মমতা শিকেয় তোলা। সকালে মাঝেই টেংরা আর জ্যান্ত কই নিয়ে গেছে। মিনা জ্যান্ত কই কালো জিরে দিয়ে পাতলা ঝোল করেছে। ভ্যাপসা গরম পড়েছে মোটেও স্বস্তি নেই। এ বেলা বৃষ্টি হলে খাটুনির শরীরে জিরিয়ে নিয়ে যায়। ভাত পেল্টে বেড়ে মিনা শম্ভু কে ডাকতে গেছে ।কি গো কোথায় গেলে এসো বেলা সাড়ে ন'টা বাজে খেয়ে শুয়ে পড়ো। বারান্দায় চেয়ার টেবিল পাতা আছে এঁটো ধরে তাই মিনা ছেলেমেয়েদেরও ননদের সাথে স্বামী শম্ভু কে খেতে দিল। শম্ভু হাত ধুয়ে দিয়ে বসে পড়ল। গরম ভাত আর সাথে দু'পদ আছে মাছ তো আছেই। অল্প দিও গরমে মোটেও খেতে ইচ্ছেটি করছে না। মিনার হাতের রান্না মাঝেমধ্যে খারাপ হলে ডাকপিট দিতে ছাড়েনা কেউ। মাঝেমধ্যে এত চাপ পড়ে যে তরকারিতে নুন দিতে ভুলে যায়। গত সপ্তাহে রমলার জামাইকে খাওয়াবে বলেছিল পায়েস রেঁধে ছে কাজু কিসমিস দিতেই ভুলে গেছে। ভাগ্যিস গুড় কিংবা বাতাসা দিতে ভুল করেনি। সে নিয়ে সকলে যে হাসাহাসি করছিল একের পর এক দায়িত্বে কারো মাথায় এতটা ঠিক থাকে বাপু। খাসির মাংসে তো নুন কম দিয়েছিল। নবান্নে পুরোহিত এনে পুজো দেওয়ার প্রথা রীতি পালনে একটু কমতি ছিল না। সেবার এত সখের আট-দশটা পোষ্য ছাগল অকালে মরে গিয়েছে। মিনা একটু কষ্টই পেয়েছে। পোষ্যদের চোখে জল ছটফটিয়ে চিৎকার করতে করতে মারা গেছে। তার আগের বছর ভূপালের বউ সন্তান জন্ম দিয়ে সাত দিনের মাথায় গত হয়েছেন। ওতো মা মারা যাওয়া সাতদিনের কন্যা সন্তানটিকে তো বড়দি তরু নিয়ে লালন-পালন করে বড় করে তুলেছে। এই গ্রামে অমঙ্গল ঢুকেছে। শাপ পড়েছে সবাই বলে। পাড়াগাঁয়ের ছেলেমেয়ে অকালে মারা যাচ্ছে। পাশে লালটুর বড় বউ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। পাগলার ছোট ছেলেটা খেলতে গিয়ে পড়ে মরে গেল। অভিশাপে নরকের আস্তানা হয়েছে। চারিদিক থেকে খারাপ সংবাদ ছাড়া ভালো সংবাদের নামটি নেই। তনিমার বয়স হয়েছে ভাল পাত্র জুটছে না। ভাই শিশির দের কে নিয়ে তো চিন্তার অন্ত নেই। শম্ভু সকাল সকাল উঠে ফসলের মাঠ দেখতে গেছে। দুপুর হতে না হতেই হাটের বেলা পড়ে যাবে। সপ্তাহে দু'দিন হাট বসে। দূরদূরান্ত থেকে বহু লোক হাট করতে আসে। বেশ সস্তা দামে অনেক জিনিস পাওয়া যায়। সব খেতের সবজি চাষের মাছ ,পান সুপারি, ছাগল, গরু, মোরগ, পায়রা, যাবতীয় প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যায়। শম্ভু হাটে যাবে মিনা বাজার বলে দিল যাবার পথে আবার বাকি ক'টা চিৎকার করে বলে দিল। শম্ভু চলল পেছোন তরুণীকে নিয়ে ভারী ব্যাগটা বইতে পারবে নে। বাজার পৌঁছানোর আগেই রাস্তায় মাছ দেখলো দাম জিজ্ঞেস করল বেশ কম আছে টাকি আর মৌলরা। ছোট মাছ বেশ খেতে। ডাক্তাররা তো ওই ছোট মাছ খেতে বলে।ক'গাছা পান কিনলো পান ওয়ালর কাছ থেকে। মসলা তো এক মসলার দোকানদারের কাছ থেকে নেবে। কাঁচা সবজি কিছু শুকনো খাবার কিনে তরণীর হাতে পাঠিয়ে দিল। এতে গিন্নি সকাল সকাল সব গুছিয়ে নিতে পারবে। শম্ভু নিয়মিত এক ডাক্তারের দোকানে কিছু সময় পার করে। কিছু ধর্মীয় লোকো ওআসে। কিছু আলোচনা হয় এতে বেশ হালকা হওয়া যায় ।আলোচনা শেষে যে যার মতো বিদায় নেয়। পাড়াগাঁয়ের লোকের মাথামোটা বিশেষ সামান্য কিছুতেই বৈদ্ধি ওঝা ডাকে। কি যেন তনিমার হয়েছে বৈদ্য ডেকে হাজির। সে নাকি বলেছে একে বিয়ে দিতে পারবে না কি করে রেখেছে। শিশির অনেক বলে কয়ে ধৈর্য ধরে ছেলে দেখতে শুরু করেছে। অবশেষে সুপাত্রে বোনকে পাত্রস্থ হতে পেরেছে।কনার খুব বেশি বয়স নয় বড়জোর নয় কি দশ হবে। দুরন্তপনায় সে যে মেয়ে তার খেয়ালি নেই। একবার তো পাড়ায় মেয়েছেলে উভয়ের ডাংগুলি খেলে হাত পায়ে আশুর  চোট লেগেছে। আশু খুব ভালো জন্য মোটেও নালিশ করে নি। উঠতি বয়সে যে কোন বাধা মানে না। বেনু দাদু গত মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে কনা দেখতে গিয়েছিল চিড়ে খেতে চেয়েছিল মিনা চিরে গুড় নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। সুস্থ থাকাতে তো শম্ভু বেনু খুব ভাব ছিল। ক্ষ্যাপা কীর্তন বিভিন্ন সঙ্গে কীর্তন করে বেশ কাটিয়ে দিতে ।সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে কনা বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বেনু খুব তৃপ্তি সহিত চিড়েগুঁড়ো খেয়ে নেয়। তার পরের সপ্তাহে বেনু ইহলোক থেকে পরলোকে পাড়ি জমায় ।কনা মুখে জল দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই দেহে আর সাড় রইল না। বেশ ভালো মানুষ ছিলেন খুব স্নেহ করতেন ।কনা তো দু'দিন রাতে স্বপ্ন দেখেছিল এসে পিড়ি পেতে বসে ছিল। বলেছিল ও দাদুভাই তোর আমার কথা মনে পড়ে না ।জোর কনা বলে পড়বে না কেন কত গল্প করতেম। ঘুম ভাঙ্গতেই কণা চিৎকার করে ওঠে ।মিনা এগিয়ে আসে কি হল তোর চিৎকার করে করছিস কেন? কনা মাকে ভয় জড়িয়ে ধরে। পুনরায় জিজ্ঞেস করলে বেনু দাদু আসার কথা বলে মা তখন কনাকে বলে আত্মাটা চারপাশে ঘোরাফেরা করে শ্রাদ্ধশান্তি হলে ও ঠিক হয়ে যাবে। আত্মাটা ইচ্ছে প্রকাশ করে জন্য লোক ভয় পায় সে কোনো ক্ষতি করবে না। কনা জিজ্ঞেস করল মা আত্মা কি গো? মিনা কথা না বাড়িয়ে বলে ও তোর বুঝে লাভ নেই।
        
     

[[[[৩]]]]
গ্রামের পরিবেশটা বড্ড শান্ত পাশে রত্নাই নদী। নদীর দু'ধারে ধানের শীষে শীতকালে বেশ জাঁকিয়ে কুয়াশা পরে। শিশিরের বিন্দু স্বচ্ছ দেখে মনে হবে চোখের জলে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। গরমকালে নদীর ধারে বালীর উত্তপ্তে হাঁটার জো নেই। ধান ক্ষেতের মাঝখানে মাকড়সার জালে শিশির বিন্দু অপলক মায়াবী হরিণী লাগেও বটে। সকালবেলায় কৃষক লাঙ্গল, ফলা, বলদ নিয়ে জমি খননে বের হয়। আশু মাঝেমধ্যে দুপুরে মায়ের জন্য পান্তাভাত, কাঁচালঙ্কা, লবণ নিয়ে খেতে নিয়ে আসে। শীতকাল হলে এ অবশ্য দিতে হয় না মোটে চিরে, মুড়ি চিবিয়ে কাটিয়ে দেয় ।শীতকালের বেলা দ্রুত গড়িয়ে যায়। কনার ভীষণ শখ শ্রমিকদের সাথে গিয়ে পান্তা খাবে। এই নিয়ে আশু, বিল্টু দের সাথে চুপি চুপি গিয়েছিল কনার তো ভারী আনন্দই লেগেছে। কেউ বলে দিলে রক্ষা নেই ।মা তো আছেই দাদা ও বাবাকে কে বোঝাবে। নদীর ধারে এক ঝিলে সবাই পাট জাগ দেয়। সে ও দেখতেও চুপি চুপি বাইসাইকেলে আশু ও বিল্টুর সাথে সে দেখতে এসেছে। সে 'বার তো দাদার নজরে পড়েছে ঘরে এসে বোনকে ক'ঘাত উত্তম-মধ্যম এ প্রহর করল। তা সত্ত্বেও যেন কিছুতেই মন বসে না পড়াশোনা একঘেয়েমি লাগে ।পড়াশুনা সে যে খারাপ রেজাল্ট করে সেও নয়।অন্যান্যদের তুলনায় বেশ মেধাবী তবে পরীক্ষার আগে কিছুদিন খুব মনোযোগী। শম্ভূ ত আগে ভাবতো অত পড়াশোনা করে কাজ নেই। ঘোর শ্বশুর বাড়িতে রান্নাবান্না ছাড়া আর কি বা কপালে জুটবে। যতদিন চলে যায় দিন পরিবর্তন হতে থাকে। পাড়াগাঁয়ের লোকের সমালোচনা ছাড়া কি বা আছে। আজ ওর মেয়ে কি করলো কাল ওর মেয়ে কি করলো সেটাই মুখ্য বিষয় ।কনা শীতের সকালে দাদার সাথে দৌড় করছে হঠাৎ থেমে খেতে নজর পড়ল কত মায়াবী শস্যে ভরে গেছে। প্রান্তর থেকে প্রান্তরে সবুজে সবুজে যেন সবুজের সমারোহে নিজেকে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। রাখাল গরুর পাল নিয়ে মাঠে তাদের খাদ্যের যোগান দিয়ে যাচ্ছে। মালতিও কাননী কনার থেকে ক'বছরের বড় ওরা ইস্কুলে যায় আর ঘরে ফিরে লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের মত ঘরের কাজ এগিয়ে দেয়। এনিয়ে মিনার কম ক্ষোভ উগরে পড়েনি ।আমার যত জ্বালা কেউ একটু কুটো অবধী নেড়ে দেবেনা সময় হলে সব চাই। গেরস্থ ঘরে কি কম কাজ থাকে সকাল থেকে শুরু করে রাত অব্দি। কনা সকালে টগর ,বেলি, শিউলি ফুল তুলে মাকে দিয়ে দিত। মা মনোযোগ দিয়ে পুজো করে মনে মনে প্রার্থনা করে ছেলেটারে জ্ঞান-গরিমায় শিক্ষিত করো ঠাকুর। কনার যেন ভালো কিছু হয় গো ঠাকুর। তুমি ছাড়া আর কে বা আছে আমাদের। শম্ভু ও ঠাকুরের ভক্ত সকালে সকালে আহ্নিক সেরে তারপর খুঁটিনাটি কাজে মন দেয়। মাঝে মাঝে গ্রাম্য সালিশের ও ডাকে বিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ বলে সবাই ভাবে। শম্ভু যতটা সহজ সরল খোলামনের ততটাও মেজাজ চড়া মানুষ। অন্যায় কে প্রশ্রয় দিতে মোটো ও রাজি নয় তা বলে সর্বদা কর্কশ ও ঠিক নয়। অনেকেই পেছনে সমালোচনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সম্মুখে কিছু 'টি বলেনে। ন্যায় অন্যায় সব‌ সম্মুখে পক্ষপাতহীন বিচার করাটা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে পড়ে। শিল্পা তো একবার শাশুড়িকে অন্যায় কথা বলে অপমান করতে শুরু করেছে। বড় ভাসুর বলে শ্রদ্ধা না দেখিয়ে যা তা অপমান করতে শুরু করলে শম্ভু লাঠি নিয়ে তেড়ে মারতে গিয়েছিল। কনা ও পিন্টু দৌড়ে থামিয়ে দিয়েছে। কনা ভয়ে শম্ভুকে কম কথা বলে। যদিও সন্তান স্নেহে সে ছিল ভালোবাসার এক জ্বলন্ত পিতার উদাহরণ। রোদ-বৃষ্টি খরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। অভাব সে কিছুতেই গ্রামের পিছু ছাড়ছে না। শম্ভু দুঃখীর কষ্ট দেখে মোটেও ঠিক থাকতে পারেন না। শশীকে নিজের জমিতে আশ্রয় দিয়ে দুই ভাইকে ঘরে থাকার জমি দিয়েছে। বেনুর চার ছেলেমেয়েকে শম্ভু আশ্রয় দিয়েছিল। তার ও দু'ভাই শশী ও মাধব। ধীরে ধীরে গ্রামে খুঁটি পুঁতে বসেছে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে শম্ভুকে গলিয়েছে। আবার চায়ের দোকানে শলাপরামর্শ জিজ্ঞেস করত। বেশ কিছুদিন পর শম্ভুর নামে উল্টো নিন্দে রটানোর কথা আলোচনা করছে। পেছনদিকে যে পিন্টু ছিল শশী খেয়াল করেননি মোটেও। যাকে বলে যার নুন খাচ্ছে তাকে খুন করতে প্রস্তুত হচ্ছে ।পিন্টু বুদ্ধিমান ছেলে ছিল বলে ক'দিন পরে কথা প্রসঙ্গে শশীকে জিজ্ঞেস করছিল বাবার নামে কি বাজে কথা বলছ। আমি সব শুনেছি ।শশী তো হতভম্ব লজ্জায় অপমানে নিজের ভুল স্বীকার করে নিল। কনার বড় বোন চাপা অনেক আগেই বিয়ে হয়েছে। ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে ঠিকই কিন্তু বরটা খুব বেশি শিক্ষিত নয়। যাহোক সংসার ভালো হলে কার বেশি আপত্তি থাকতে পারে। বেশ ঘটা করে বিয়ে হয়েছে ।বড় মেয়ে বলে শম্ভুর উপঢৌকনে কোন কমতি ছিল না। দামি গহনা সাজিয়ে-গুছিয়ে বিয়ে হয়েছিল। চাপা দেখতে সুন্দরী ছিল বলে খুব বেশি পড়াশোনা করতে পারেনি। মধ্যবিত্ত ঘরের সে তো প্রস্তাবে স্বস্তি ছিলনা। দোরগোড়ার এতো প্রস্তাব কাল সে। চায়ের কাপে চুমু দেওয়া অব্দি কালিদা এসে হাজির ও শম্ভু দা কি গো তোমার চাপাকে বিয়ে দেবে নাকি গো। সুন্দর পাত্র আছে ।সুকৌশলে বুঝিয়ে কালিকে কিছুকাল থামিয়ে রেখেছে ঠিক বছর ঘুরতে ফের হাজির। শম্ভু যেন বিপাকে পিন্টু তো সরাসরি না করে দিয়েছে বিষাদের রেখা শম্ভুর কপালে। অস্থির মনে ভাবতে থাকে কথাটা মন্দ নয়। তাই পরিবারের সকলের অনুমতি নিয়েই স্থির করে ফেলেছিল সুপাত্রে কন্যা পাত্রস্থ করতে পারাটা পিতা-মাতা হিসেবে খুব গর্বের ও সম্মানের ও বটে। কনা তখন বেশ ছোট ছিল বিয়ের বিষয়ে তেমন কিছু বোধ ছিল না। কনা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে সপাট জবাব গ্রামের কে কি বলল সে তার ধার ধারে না। শিক্ষার আলো নারী জীবনে যে কতটা গুরুত্বের তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে শিখেছে। অন্যায় কথা বলছিল বিল্টু দা মেয়ে মানুষের পড়াশোনা করে লাভ কি বরং হাতি পোষা আর মেয়েদের ঘরে রাখা একই ব্যাপার। কনা সেদিন ছোট ছিল কিছু বলেনি কিন্তু অপমানজনক কথা যে বলছিল তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। কাঁচা রাস্তার দু'ধারে কাশফুল বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সারি সারি বাজার হেঁটে বাজার যেতে কিছুটা সময় লাগে। সেদিন কি যেন ঘরে ছিলনা কনা বাইসাইকেল নিয়ে আনতে গিয়েছে সে নিয়েও মিনাকে কথা শুনাতে ছাড়ে নি।আশুর পড়াশোনার পয়সা মাঝেমধ্যে টান পড়তো শম্ভুর কাছে বকেয়া করতে আশুর মা এসেছিল। ছনের ঘরে মাটির দেয়ালে থেকে আশুকে পড়াশোনা করে যেন গরিবের আকাশ কুসুম কল্পনা মাঝেমধ্যে মনে হয়। কষ্টে দুর্দশায় দু-একটা টিউশন করাতে আশু কিন্তু সে কি আর বললে পাড়াগাঁয়ে কে গুনবে ওত টাকা। কম মাইনে দিয়ে গৃহশিক্ষককে রেখে অনেকেই বাঁচে। কি যেন ভাবতে-ভাবতে আশু দু-এক পা খেলার মাঠের দিকে যাচ্ছে। বিষন্ন মনে প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে। নীল আকাশটা আজ ভারী অদ্ভুত গভীরে আত্মপ্রকাশ করছে ।পিন্টু কি এক কাজে মাঠের ধারে শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ বাদে দুটো বন্ধু এলো তারা বেশ মাঠে বসে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করে। অভাব-অনটনে যাদের পথ চলা তাদের কাছে সুখ হচ্ছে আকাশ পাতাল এর বিস্তর ফারাক। সন্ধ্যার দিকে ধীরে ধীরে শম্ভু সেই ডাক্তারখানায় বারান্দায় বসে দু 'এক কাপ চা চক্রে হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার রক্তিম বাবু সাথে ভালো-মন্দ আলাপ চারিতা হয়। শম্ভু বেশ রুচিশীল মানুষের একজন চায়ের কাপ গরম জলে ধুয়ে তারপর দোকানদার চা দিতন। বন্ধু দত্ত আসত মাঝে মধ্যে সেকালে মোবাইল মানে শুধু বড় লোকের হাতে। কল আসতেই বেশ ক'টা মিনিটে টাকা কাটতো। সংক্ষেপে দু-চার কথা বলে ছেড়ে দিতে হতো এভাবে কেটে গেল বেশ কয়েক বছর আশু,কনা,বিল্টু, মম ও অন্যান্য সঙ্গীরা বড় হল। আশু খেলাধুলা খুব একটা পেত না কিন্তু বন্ধুদের দলে পড়লে যা হয় তাই খেলতো। আমগাছটা ও কাঁঠাল গাছ টায় বেশ বেস্ট ধরেছে। কনা লম্ফঝম্প করে আম কাঁঠাল, লিচু গাছে উঠে পেরে আনতো। শিশির দেখতে পেয়ে বকাঝকা মেয়েদের গেছো বাদর হতে নেই। নেমে আয় ভরদুপুরে ভূত গাছ থেকে ফেলে দেবে। ঝিরঝির হাওয়া বাতাস মনটা তবু বিষাদে ঘেরা। কিছু বাদেই সুতপার দাদা মারা গেছে। ক্যান্সার কারণে অকালে চলে গেল, শ্মশান ঘাটে যাওয়ার প্রস্তুত হচ্ছিল সে অঝোরে বৃষ্টি। নির্দিষ্ট আগে স্থানে শ্মশান না হবার ফলে বাঁশের চাঁদোয়া করে মৃতদেহ সৎকার করা হয়। প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল পাড়াগাঁয়ের সকলে সহযোগিতা করে ত্রিপল টানিয়ে সৎকারের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। দুটি ছেলে মেয়ে রেখে চলে গেল ,অল্প বয়সে বিধবা চক্ষু চড়ক গাছে পরিণত। শোকে পাথর কিছুদিন থাকার পর বউ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়িতে চলে গেলেন। দুঃখীর কপালে দুঃখী জোটে কে জানিত এসব দেখতে হবে সুতপার বাবা তার একবছর পরেই চলে গেলেন। পর পর ধাক্কা সামলিয়ে উঠতে হলো সুতপা'দের পরিবার। শম্ভু খুব ধার্মিক ছিলেন অপরাধীকে ক্ষমা করতেন খুব সহজে মানুষ যখন অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে ।বিবেক জাগ্রত না হয় কেউ চাপিয়ে বিবেক জাগ্রত করতে পারেনা। এতকিছুর পরও সম্ভব কিছু লোককে বসে বোঝাত কিন্তু কথায় আছে না চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী মন থেকে গ্রহণ করতে না পারলে ঠিক কি আর ধর্মের টান আসে। একে একে  কিছুদিন কেটে যাবার পালা ,বৈদিক পুরোহিত সুস্থ-সবল ছিলেন বটে খবর পেল সে গত হয়েছেন। বিষাদের ছায়া নেমে পড়লো শম্ভু চিন্তা করতে লাগলো আমারও যাবার পালা ঘনিয়ে এলো বুঝি।।



[[[[৪]]]]
নদীর পাড়ে খোলা হাওয়ায় চুল এলিয়ে সখিনা পরি প্রকৃতির রূপ অবলোকন করছে অন্ধকার রাতে চাঁদনীর আলোয় এক অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে বটে। দূরদূরান্ত থেকে মেয়েরা বাইসাইকেল নিয়ে পড়তে আসে সাথে বন্ধুরাও বটে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুন্দর পল্লীগীতি করে ,হিন্দু মুসলিম কোন একক ভেদে স্কুল নয় সর্বজনীনভাবে। একই সাথে শপথবাক্য ,জাতীয় সংগীত এসেম্বলি প্যারেড থেকে শুরু করে তারপর উপস্থিতির হাজিরে নিয়ে শিক্ষক একে একে নাম উচ্চারিত করেন। প্রধান শিক্ষক ভারি রাগী ছিলেন এসেম্বলি সমাবেশের পর কোন শিক্ষক কিংবা ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত হলেই বকুনির অন্তনেই। রিপন নামে ছাত্রটি নির্ধারিত স্কুলের পোশাক না পরতে ও এসেম্বলি না করতে বেত দিয়ে শাস্তি দিলেন। অনিয়মের শাসনে বাড়ন্ত এক চুলও ছাড়তে রাজি নয় ।যেকোন সংগীত মন দিয়ে সুরে গাইলেন অপূর্ব লাগে। কনা মনে মনে ইচ্ছে পোষণ করলো যদি গাইতে পারতেম। তবে ছয় সাত ক্রশ মাইল ডিঙিয়ে কে দেখতে যাবে। সপ্তাহে একদিন মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্যের অতিরিক্ত সাধ। ছোটখাটো সবগুলো বিসর্জন দিতে না পারলে জীবনে বড় কিছু আশা করা যায় না ।ওপারে লতা, আশা, সন্ধ্যা এপারে সাবিনা, রুনা লায়লা, বেবি নাজনিন কি অপূর্ব কন্ঠে যে কোন মুহূর্তে মুগ্ধতা নিয়ে আসে ওরাওতো মেয়ে মানুষ ওরা পারল কি করে। ওদের কি কোনো বাধা-বিপত্তি আসেনি না ঠিকই এসেছে ওরা সাধনা করেছে। সমাজ কেন উন্নত হয় না ওসব দোষ যাতনা- লাঞ্ছনা আজকাল মধ্যবিত্ত গরিব ঘরে। কনা  প্রশ্ন করে আপন-মনে শিক্ষার আলো কি জগতে নিষ্কলুষ করতে পারেনে? এই ভেদ নারী পুরুষ? সমতা নয় কেন ?পরিবারের ছেলেদের এত যত্ন করে কেন ?মেয়েরা কি পারেনা যোগ্য ও সমাজের নেতৃত্বে? কনা কলেজে পরে বুঝতে শিখেছে আশু ও কলেজে। একটা সময় হয়তো বিবেক বোধ জাগ্রত হয়। কোন পন্থা সহজ কোন পন্থা ভুল কি বেঠিক তা জানতে পারে। কন্যাকে নিয়ে পরিবারের চিন্তার অন্ত নেই ,বেখেয়ালি মেয়েটা না কোন দিন বিপদে পরে। পাড়া গাঁয়ে ঢেড়া পেটানো লোকের তো অভাব নেই। হিসেব মিলল বটে কিছু ক্ষতিপূরণ অপূর্ণ থেকে গেল। প্রত্যেক বছর আমন নয়তো ইরিতে ,হয় বন্যা নয়তো খরা ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে ।এসবের যোগান দিতে এক ফসল থেকে আরেক ফসলের প্রতীক্ষায় ছাড়া কোন উপায় নেই। দিন যত যাচ্ছে সবকিছু দাম হাতের নাগালের বাইরে ফসল তোলা শেষ হিসেবেও লাভ লস কিছু নেই। খাওয়া-দাওয়া পড়া বেঁচে থাকায় ওই। বাড়তি আকাঙ্ক্ষা করাটা বৃথা বর্গা দিয়ে লাভের কিছু হয় না যা খরচা করে ফসল ফলায় ওতে বর্গাচাষীদের ও বিশেষ কিছু লাভ হয় না। যাদের অনেক বিঘে জমি আছে এসব তাদের জন্য ঠিক আছে। শম্ভু ক'বার বর্গা দিয়েছিল মৌসুমে যা পায় তাই লাভ ।সংসার বেড়ে গেলে বাড়তি খরচা ও যোগ হয় বটে। আমন ধানে সেবার প্রচুর ফলন হয়েছে সে ধান খেয়ে ও বেশকিছু হাটে বিক্রি করে দিয়েছে। চারদিকে নারিকেল ,সুপারি গাছে ভরপুর মাঠ। বড় আম গাছে পান গাছ লাগিয়ে দিয়েছে। দেখতে কেমন অদ্ভুত সুন্দর লাগে। দমকা ঝড়ো হাওয়ায় আম গাছটার ডালপালা ভেঙে যাবার ভীষণ ভয় ।এ ঝরে ছোটরা দলবেঁধে পাকা আম কুড়াতে আসে। কর্মচা গাছে কর্মচা দেখতে ভারী সুন্দর কিন্তু ভীষণ টকও আঠাঁলো। পাকা জলপাইগুলো ঝরে নিচে পড়ে আছে। কালো জাম গাছটা ভীষণ লম্বা কারও ধারে নেই পেড়ে জাম খাবে। নিচে যা পড়ে তাই দলবেঁধে কুড়িয়ে নেয়। সব গাছগুলোর মধ্যে মিষ্টি ফল ছিল লিচু। সব সময় লিচু সকলের নজরের ,রবি আজতো পাটেও বসেছে। দখিনা হাওয়া জোরকদমে গাছের শিউলি গুলো রাতের দিকে নিচে পড়ে ওদিকে ঝড়ের বেগে পাকা লিচু গুলো নিচে পড়ে ফেটে যাচ্ছে ,কনা মাঝেমধ্যে জানালার দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। ইচ্ছে করছে লিচু নিয়ে আসতে কিন্তু শম্ভু পিন্টু ঘরে রাত বেরোতে খোলা চুলে মেয়ে মানুষ যাওয়া বারণ। মিনা দেখতে পেলে তো লাঠিপেটায় পিঠ লাল করে দেবে। রাতের অন্ধকারে যেন গ্রাম নয় ঘোর কোন অরণ্য প্রবেশ বলে মনে হবে। আস বিশেষ কাজে বাইরে গেছে রাত তখন দশটা দশ বাজে। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক আওয়াজ। আশু ভয়ে টিপে টিপে ফেলছে এ যেন ঘর অরণ্যে বাঘের ভয়।ঘুনঘুটে অন্ধকার চারিদিকেই ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে বর্ষাকাল ও ছিল। পাশেই খাল ছিল ব্যাঙ ডাকছে ঘোতঘোৎ। নিস্তব্ধ পুরো পাড়া ,দূর থেকে মনে হচ্ছে কনাদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। রাত জেগে থাকা পুরনো অভ্যেস রাত বারোটা একটা অব্দি পিন্টু ও কনা বই পড়ে, পিন্টু ও কনার ভোর চারটে ওঠার অভ্যেস। জোৎস্না রাত ছিল রাত তখন এগারোটা কি বারোটা হবে কনা সেবার প্রচুর ঘুম পেয়েছিল তাই জানালার পর্দাটা দিয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে। এলাম ঘড়ি টা পাশেই ছিল হঠাৎ ঘরের মধ্যে লাইটের আলো চোখে পড়াতে চোর বলে চিৎকার করে চোর পালিয়ে যায় তখন থেকে সবাই সজাগ থাকে। শিশির দের বাড়িতে সুদান দীর্ঘদিন ধরে কাজ করতো । গেরস্থ বাড়িতে মাসকা মাস থেকেই যেত। বন্যা খরা নেই সারা বারো মাস তেল নাকড়ি সব ধরনের কাজে সহযোগিতা পেতে। বিশ্বস্ত লোক তো দেখা মেলা ও দায়ভার পুজো এবার কাছাকাছি সুদানের জন্য শার্ট প্যান্ট আর হাতে কিছু পয়সা দিয়ে বাড়িতে পুজো করতে পাঠিয়ে দিল। এবার দুর্গা পুজোয় সকলের আনন্দের সীমা নেই নতুন নতুন পরিকল্পনা সকলের মধ্যে কনা আরতী প্রতিযোগিতার পরিকল্পনা ছোটদের জন্য দিনের বেলায় দৌড় প্রতিযোগিতা, আর একটু বড়দের জন্য মেধা প্রতিযোগিতা, রনি, বিল্টু ,আশু মম সবাই উদগ্রীব। মেয়েদের পোশাকে শাড়ি ছেলেদের ধুতি পাঞ্জাবি সবাই অঞ্জলি দেওয়ার পর ভুল বুঝে ব্যস্ত তারপর যে যার মত ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। পুজো মানে নারিকেলের নাড়ু, মোয়া, খই, মুড়কি চিরে ,সন্দেশ মেলা বসলে গরম জিলাপি মচমচে বাহ বেশ খেতে কনা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বেরোয় দিনে। ধীরে ধীরে কনা বেড়ে উঠেছে আশেপাশে গালমন্দ বুঝতে পারে বেশ আদরে বেড়ে উঠেছে । শম্ভু কোথাও গেলে কনার জন্য ভালোবাসার কিছু না কিছু নিয়ে আসতো। একবার সকলে মিলে কান্তজীর মন্দিরে ঘুরতে যাবে বলে পরিকল্পনা করলো পড়াশোনার জন্য কনা গেল না কিন্তু বাড়ির সকলে ঘুরে এসেছিল। কোন আর আফসোস হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু ছোটখাটো কিছু ত্যাগ না করলে বড় কিছু আশা কখনো সফল হয় না ।শম্ভু এসে গল্প করেছে মন্দিরের গাঁথুনি একেকটি ইটের একেটা দেবী, প্রত্যেকটা ইটে হাতের শৈল্পিক তৈরি দেবদেবীর মূর্তি যেন সদ্য প্রকাশিত। কারিগরি নিখুঁত কাজ যেন মনকে ভিশন আপ্লুত ও শ্রদ্ধা ভক্তি অর্পণ করে দীর্ঘদিন ধরে শম্ভু বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতো কখনো মীনাকে সাথে নিয়ে ,কখনো বন্ধুদের সাথে। ধর্মীয় বই পড়া পত্রিকাতে সংবাদ পড়া শুধু নিজের মধ্যেই গচ্ছিত রাখেনি ভালো-মন্দ গুলো কিছু প্রিয় ব্যক্তির নিকট আনন্দ ভাগ করে নিত ।শম্ভু লোককে ডেকে চা পান খাইয়ে মাঝেমধ্যে বই পড়ে শোনাতো মিনাকে বলতো একটুখানি চা নিয়ে এসো আঁধার ঘনিয়ে এলো, জীবনের কিছু সময় না বলা কথা বিলুপ্তই রয়ে গেল। ঘোর অমানিশা যেন দূর কিনারে ডাক দিয়ে যাচ্ছে, হৈ-হুল্লোড় আনন্দ-ফুর্তির সময় কেটে গেল। শম্ভু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল সংসারে বিষাদের ছায়া নেমে এলো, ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু হলো দৈববাণীর মতো স্বপ্ন আদেশ যেন কর্ণকুহরে প্রবেশ করতে লাগলো। পূর্ব কোনের দিকটা রবি আজ নিস্তব্ধ কি যেন অশনিসংকেত বেজে উঠল ,শম্ভু তার প্রিয় সহপাঠী বন্ধু কে হারালো মনের ভিতরটা হু হু করে উঠলো! মৃত্যু যে জীবনের পরম সত্য সত্যকে মেনে নিতে হবে জন্ম যেমন সত্য তেমনি মৃত্যু বেড়াজালের প্রকোষ্ঠে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আত্ম উপলব্ধি করতে শেখায়। হরিশ ছিল ছোট ভাইদের রাজমিস্ত্রি হঠাৎ ওনার স্ত্রী গত হবার দুঃসংবাদ এল !চিত্ত বড় চঞ্চল হতে লাগলো মৃত্যুকে কে রোধ  করিতে পারে এ যে পোষ্য নয়! মিনা মনকে শক্ত করতে লাগলেন কনা ও পিন্টুকে শান্ত ভাবে বোঝাতে লাগলেন। পিন্টু গত কয়েক বছর থেকে বাইরে থেকে পড়াশোনা করে সংসারে বেশি দিন পরে থাকলে তো আর বেশ উন্নতি হবে নে, শিক্ষা দীক্ষায় মানুষ হতে না পারলে ঠিক মূর্খের বাসই হবে। মিনা কাজের লোককে দিয়ে ধীরে ধীরে কাজ করাতে লাগলেন। শম্ভুর অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। ছেলেমেয়েদের যথাযথ ব্যবস্থা করে যেতে না পাওয়া অবধি মনে বেশ অসন্তোষই বহন করতে লাগলো। সর্ব তার নামে সমর্পন করলেন স্রষ্টা যে কাউকে অভক্ত কিংবা শোচনীয় রাখেন না সর্ব দায়িত্বভার পালন করার জন্য আলাদা শক্তি প্রদান করেন দুরন্তপনা ধীরে ধীরে আরো কমতে লাগলো শম্ভুর মেজাজ ধীরে ধীরে বদরাগী হতে লাগলো, শারীরিক যন্ত্রণা যে কতটা কষ্ট দেয় যার হয় সেই বুঝতে পারে! যুক্তিতর্ক ধর্মীয় আলোচনা এখন যেন তার কিচ্ছু ভালো লাগেনা নিভৃতে চোখের জল সংবরণ করা ছাড়া আর কি বা করার আছে। শুরুতেই চিকিৎসা চালু ছিল ,কিছুতে রোগ নির্ণয় সম্ভব হলো না পরিশেষে মাস ছ'য়েক পরে দুরারোগ্য ব্যাধি ধীরে ধীরে কেমন ঘিরে ধরলো! বড় বড় ডাক্তার দেখিও মোটেও কাজ হচ্ছিল না এ ব্যাধি যে মরণের আঁতুড়ঘর শম্ভু ধীরে ধীরে বুঝতে সক্ষম ।আনন্দগুলো বিষাদে পরিণত হল শারীরিক অবস্থা দিনতর নিস্তেজ হয়ে পরছে। চোখে জোনাকির ফুলকি লাগছে, চিত্ত স্হির রাখার উপায় নেই বুঝতে পারছে সকল বন্ধু যখন পৃথিবী কে বিদায় জানাচ্ছে সেও শীঘ্রই বিদায় নেবে ।ধীরে ধীরে নোট করতে লাগল অবর্তমানে কার্যকলাপ ,বুঝিয়ে দিতে লাগল বিমর্ষ অন্ধকারে। আঁধার ঘনিয়ে আসছে হৃদযন্ত্র কোন কাজ করছে না মনের অবসাদ ঘিরে ক্রমে নিম্নগতিতে নিয়ে যেতে লাগল।



[[[]]]৫][[[]]
আকাশে ঘন কুয়াশার স্তর পরতে থাকলো। নীল আকাশটা ধোঁয়া ধোঁয়া আবছাকার স্তর হতে থাকলো। রক্ত জমাট ই যেরূপ ঠিক তদ্রূপ। সদ্য কেউ কোন স্তরকে ঘা দিলে বাষ্পাকারে বেরিয়ে আসবে ।পিন্টুর উচ্চশিক্ষালাভের আর কিছুদিন বাকি উচ্চ শিক্ষার পথে পদার্পণ। ঋতুর ভূমিকা ও দায়িত্ব পালন করে চলছে বরাবরের মত। চিন্তার ভাঁজ রেখা কপালে দিয়ে গন্ডদেশ শুষ্কে প্রায়। নিজেরও পড়াশোনার অর্ধসমাপ্ত জীবন-জীবিকার শ্রমিক দিয়ে মিনার সহ বুদ্ধির পরখ ধাপে ধাপে। তুফান নেমে আগ্রাসিন। এক মুহূর্তে যেন স্বস্তি নেই তবুও ভবিতব্য মেনে এগিয়ে চলায় উত্তম। মন্থর গতিতে ভাবনারে স্তরটা ভারী হতে লাগলো উপরে যিনি পথ চালনা করেন তিনি ধৈর্য দেবেন বৈকি !পুরনো বন্ধু গিরিধারী দূর থেকে ট্রেনে চেপে দেখতে এসেছে। শরীরের খবরা-খবর নিল ,অন্তরঙ্গতায় অতীত ভবিষ্যৎ বর্তমান ক্ষনে দুলিতেছে যমালয়ে যেতে হবে ভবপারের তরীতে বিন্দুমাত্র ইহজগতের করি যাবেনে ।যতসব ভাবনা ঠাকুর তুমি দেখে রেখো ।প্রমার মনে অস্বস্তির ভাঁজ ।মে প্রেমা অ-আ স্বরবর্ন থেকে ব্যঞ্জনবর্ণ হাতে ধরে শিখিয়েছে সে কিনা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে যাচ্ছে! পিন্টু বাবাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করল শম্ভু রাজি হল না যা হবার তা তো হবেই বিধির লিখন খন্ডাতে পারে কে? কথায় আছে জন্মদিনে কর্মের লেখা ভাগে ভাগে দেবে দেখা অযৌক্তিক প্রচেষ্টার হয়রানির শিকার না হওয়ায় ই  ভালো পথ্য যোগে যেমন সারা নেই। মিনাকে পাশে রেখে না-ফেরার দেশে কোন এক ঊষায় পরপারে পাড়ি জমালেন! আঁধার যেন থম বিস্মিত! পাখি কাক যেন গানের সুর পেল না হাজার হাজার লোকের আনাগোনা অকৃত্রিম ভালোবাসা যে শম্ভু সকলকে আগলিয়ে রাখতাম সে আজ কোথায়? মিনা, কনা, ঋতু, পিন্টু, চম্পা আজ বাকহারা! গ্রামের অভিভাবক তথা পরিবারের অভিভাবক অসার দেহতন্ত্র! তবুও মনে প্রশান্তি মহান আদর্শ পরিবার তথা গ্রামে কিংবা সমাজে স্থাপন করে গেছেন। কনার হাজারটা প্রশ্ন আজ স্তব্ধ কেন !এমন হয় শোকসন্তপ্ত পরিবার আবার এগিয়ে চলল ধীরে ধীরে ।পথভ্রষ্ট বিভিন্ন মাধ্যমে ছাতা দিয়ে আগলে রেখেছে, ঋতু বেশ বুদ্ধিমতী,বিষাদের শান্ত মাথায় চলে ।দু'ধারে গাছের সারি সারি মাঠ ফাঁকা ফাঁকা বকুল গাছটা কেটে ফেলেছে ।চম্পাফুল সবাই যে আনন্দে গ্রহন করতে সেও বিক্রি করে দিয়েছে এখন ক'টা জবা, বেলি ,কুন্দ লতা এই সম্বল শিউলি আগের মতোই নিয়ম করে ঝরে পড়ে নদীটি আপন-মনে চলছে তার গতিপথ ও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। জোড়া শালিক দেখতে পাওয়া দুর্লভ ।বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে বেশকিছু ঘরবাড়ি ধ্বংসের মুখে পতিত ।ভিটেমাটি ছেড়ে তারা বেশ অসহায় ওপ্রকৃতিও যে বিরূপ ! এ ভাঙ্গনে কে রুখবে । বাঁধ সেতো উধ্ব 'মূল্যের যোগান।তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিরুপায় লোক গুলো প্রশাসনের আওতায়। তাদের দুঃখ কে কে বুঝিতে পারে? হায়রে নিয়তি নদীর বাঁধ ভাঙ্গা সে তো নিতান্ত গোঙানি শামিল। সেবার তো উচ্ছ্বাসে দুর্ভেদ্য জয়ের প্রত্যয়ে কিছু উঠন্তি ছেলে নৌকা যোগে তিস্তাতে স্নান করতে গিয়ে পাঁচজনের মধ্যে দুজনেই নিখোঁজ ।এত প্রত্যেক বছরই কিছু উঠন্তি তরুণ নিজের ইচ্ছা মৃত্যু ডেকে আনে। একমাত্র তিস্তা সেতু সেওতো মালামাল বহনে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ,তিস্তার কাছাকাছি কিছু পল্লী ও বন্যা কবলিত।আশুর পারিবারিক অবস্থা ঠিক বিষাদেই। সেইজে তলানীতে কি করে উঠে দাঁড়াবে তার কোন উত্তরণের উপায় জানা নেই তার আগে যারা ছোট্ট ছিল ধীরে ধীরে বেড়ে উঠলো ।আশু ও কনা সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছে উচ্চ শিক্ষায় আর ওধাপ বাকি আছে। ওদিকে পিন্টু চাকরি পেয়েছে ঠিকই কিন্তু মাইনে হয়নি। মিনা দেবী মেয়েকে বলে যদি খুব ভোরে ওঠে, উত্তরের দিকে  তাকানো যায় তবে পাহাড় দেখা যাবে। কি সুন্দর দেখতে কল্পকাহিনীর মত দেখবি।কনা সেই লোভে খুব ভোরে তাকাল কিন্তু পাহাড় দেখতে পেল না মিনা বলে আকাশটা বেশ মেঘলা আজ আর হবেনা ।ঋতুর ঠিক একটা বন্দোবস্ত করে চলে যাবার ইচ্ছে ছিল সম্ভব কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। প্রকৃতির নিয়মে সেও একদিন অসমাপ্ত পরিবারে নিজ পরিবারে প্রস্থান করলো সূ।র্য উদয় হতে শুরু করল মীনা দেবীর স্বস্তি ফিরে পেল ।বেশ ক'বছর কেটে গেল আশুর কোন বন্দোবস্ত হলো না। হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন ঘন আঁধারে ঢেকে গেল। নিয়ম কি বিষাদে অগ্নিতে আহুতি দেয়। দুরন্ত বেগে স্থম্ভিত হলো, রেললাইনের পাটাতন বসে পড়লো সে লাইনে আর ট্রেন চলল না! নিমজ্জিত পাড়াগাঁয়ে আলো প্রবেশ তবুও যেন মলিন সূর্যটাকে ক্রমশ গ্রাস করছে রাহু, কেতু বলয় রেখায় কি যেন বিষাদে অবতীর্ণ ।উচ্চমাধ্যমিক মেয়েটি অর্থাৎ দপ্তরের মেয়েটিকি প্রাণবন্ত হঠাৎ একদিন না ফেরার দেশে পাড়ি জমালো! এভাবেই যেন একে একে সকলকে বিদায় নিতে হবে কে জানত আলুর  ইচ্ছে অনিচ্ছার সব স্বপ্ন গঙ্গা জলে পতিত হলো। দুরন্তপনা সকলেরই ধীরে ধীরে মন্থর হল সহপাঠীরা একে অপরকে ছেড়ে বেশ কিছুদিন নিজের জীবন জীবিকার খোঁজে বহু দূর দূরান্ত পাড়ি দিল ।হঠাৎ অগ্নিদহনে আশু তার মাকে হারালো! কনা আজও মঙ্গলময় ইচ্ছেই পড়ে রইল জলাধার ছোটখাটো জঙ্গল গুলো ধীরে ধীরে বিলীন হলো পুকুর খননে বেশ তোড়জোর চারিধারে। ক'কোশ দূরে ঝিলে কত জানা প্রজাতির মাছ যা মনের আনন্দ ও বটে। এত কিছুর পরও কি যেন শূন্যতা! খোলামেলা হৈ-হুল্লোড় আনন্দগুলো বিলীন। বিষাদ জেগেছে অন্তরে জীবন-জীবিকা দিন অন্তর কঠিনতর হচ্ছে। টিফিনে যখন এক টাকার ঝাল মুড়ি খেয়ে উদরপূর্তি করতে হতো আজ সে দুটাকার ঝাল মুড়ি খেয়ে নয় পাঁচ কিংবা দলে শুরু করতে হয়েছে। গ্রামীণ নকশিকাঁথা বুননে আজ ধ্বংস পর্যবেশিত কনা গভীর মনে রেখাপাত একি শূন্যতা। ক্রমশ প্রকৃতি আধুনিক জীবনকে আধুনিকীকরণ করেছে বটে। পল্লীতে আজ আলো তবে মনের আলো বিলিন কোন অগ্নিগর্ভে ।আশু বিল্টু জীবন-জীবিকায় দুরন্ত ছুটছে। জীবনকে বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত এজে টিকে থাকার মহা সংগ্রাম ও বটে অভুক্ত পেটের দায়ে নিতান্ত দরজায় কড়া নাড়ছে ।একরাশ হতাশা আর বৈরী প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নীল আকাশে কনা প্রহর গুনছে। এ প্রতীক্ষার অবসান কবে? প্রশ্ন এখন নির্বাক হতভম্ব এ শঙ্কায় ছাতা তো তিনি ধরবেন। বর্ষাকালে আজ ব্যাঙ গুলো বিলুপ্ত টুক টাক উই'পোকার ঝিঁ ঝিঁ ডাক কর্ণকুহরে প্রবেশ করে সব প্রশ্ন আজ সমাপন ওই তিনি আছেন।
রচনাকাল : ৯/৭/২০২১
© কিশলয় এবং রিনা দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 3  Germany : 1  Hungary : 3  India : 48  Ireland : 6  Saudi Arabia : 2  Turkey : 1  Ukraine : 2  United States : 55  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 3  Germany : 1  Hungary : 3  
India : 48  Ireland : 6  Saudi Arabia : 2  Turkey : 1  
Ukraine : 2  United States : 55  
© কিশলয় এবং রিনা দাস কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
অন্ধের ষষ্ঠী by Rina das is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৪৮৪৩৩৭
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী