অভিমান ও জীবন দর্শন
আনুমানিক পঠন সময় : ৪ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৪১ টি দেশ ব্যাপী ৩৮৪৩৪ জন পড়েছেন।
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যত আবেগ খুঁজে পায়, তার মধ্যে রাগ আর অভিমানের মধ্যে এক মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থাকে। বাস্তবে কিন্তু তা নয়। তাই আজকের বিষয় অভিমান নিয়ে একটু আলোচনা। এই আলোচনার মাঝে পাঠক আবার কোন কিছুর সঙ্গে মিল অনুসন্ধান করবেন না।

 অভিমানী  হৃদয় বড় জেদি কারন সে লজ্জায়, ঘৃণায় অপমানে নিজের অন্তরে শেষ হয়ে যাবে তবু সে কোন অভিযোগ করে না, সেটাই তার অভিমান। যে অভিমান করে সে তর্ক করেনা, মুখে মুখে উত্তর দেয়না, জেতার সুযোগ থাকলেও জেতার কোনো বাসনা থাকে না বরং ইচ্ছে করেই অভিমানে পরাজয়কে করে সঙ্গী।  অন্তরে পবিত্রতা থাকলে তবেই অভিমান করা যায়। প্রকৃত ভালোবাসা অভিমান এর জন্ম দেয়। নিজের অপবিত্রতা আর অপরাধ ঢাকতে যারা ব্যস্ত, তারা কোনদিন আর যাইহোক অভিমান করতে পারেনা। তারা নিজেকে অপরাধমুক্ত করতে হয়ে ওঠে প্রতিদ্বন্দ্বি এবং সেই যুদ্ধে নিজের জয়কে সুনিশ্চিত করেই তবেই হয় ক্ষান্ত। সেখানে অভিমানের অভিনয় থাকতে পারে, তবে অভিমানের ছিটেফোঁটাও লক্ষ্য করা যায় না।

 যার ভালোবাসা যত গভীর তার ভালোবাসার প্রকাশ তত কম, আর তারাই পারে অভিমান করতে। এরা অভিমান করে শত সহস্র মাইল দূরে থাকবে তবু নিজের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। এটাই অভিমান কারন অভিমানের প্রাপ্তি তালিকা যতই বড় হোক চাহিদার পরিমাণ অত্যন্ত নগণ্য। অভিমানী হৃদয় কোমল, পেলব -তা মরমে মরে যাবে তবুও বিস্ফোরণ ঘটে না। অভিমান তো ভালবাসার গভীর থেকে এক সুনিশ্চিত আবদার। তা যদি আপনার জন না বুঝলো, তাহলে সেখানে তেজ, ক্ষোভ বা রাগের বহিঃপ্রকাশ এর কি সার্থকতা থাকে! যারা ভালোবাসার নামে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সদা সচেষ্ট তারা অভিমানের নামে করে প্রতারণা, ভালোবাসার নামে আনে প্রবঞ্চনা, আর সুখের ঠিকানা ভেঙে নির্মাণ করতে চায় এক অহমিকাময় আনন্দধারা। কিন্তু সে আনন্দধারা ক্ষণিকের হয়ে থাকে, কারণ সেখানে অভিমানী হৃদয়ের যেমন অস্তিত্ব নেই তেমন আনন্দযজ্ঞের অপর হোতাও নেই। অভিমান করতে গেলে অধিকার থাকা চায় আর সাথে সাথে সেই অধিকারের প্রতিষ্ঠাও জরুরি। মনে রাখতে হবে অধিকার যেন আবেগের বশে অনধিকারচর্চার নামান্তর না হয়ে দাঁড়ায়। অভিমান আমাদের মানসিক মানচিত্রের সকল সীমানা ভেঙে যেমন এক করে দিতে পারে, তেমন প্রকৃত অভিমানী হৃদয় জানে তার সীমানা কোথায়। শ্রদ্ধা ছাড়া যেমন ভালোবাসা দাঁড়াতে পারেনা, তেমন ভালোবাসার ভিত্তি শক্ত করে এই অভিমান আবার ভালোবাসা প্রগাঢ় না হলে অধিকার তো জন্মায় না সেখানে অভিমানের শিকড় খুঁজে পাওয়াও সম্ভব নয়।

 যে ভালোবাসার সম্পর্কে অভিমান থাকে না সে সম্পর্কে নিশ্চিত স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। সে সম্পর্ক দায়িত্ব-কর্তব্য, চাওয়া-পাওয়া আর দেওয়া-নেওয়া তে সীমাবদ্ধ। অভিমানি হৃদয় ত্যাগ করতে শেখায়, নিজেকে উজাড় করে অন্যকে ভালবাসতে শেখায়। অভিমান করে যে হৃদয় দূরে থাকে বিপদের সময় সে হৃদয় সব উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। তেজী বা রাগী হৃদয় পৃথিবী রসাতলে চলে গেলেও নিজের অহংকারে আবদ্ধ থাকে, সেখানেই ঘটে ভালবাসার অপমৃত্যু। ভালবাসার মানুষের অভিমানে দুজনেই একলা হয়ে যায়। কিন্তু শুধু প্রতীক্ষা করে উল্টোদিকের আহ্বান কখন আসবে আর একটু আলিঙ্গন করে বলবে কিসের এত রাগ আমার উপর? সে হয়তো ভালো করেই জানে যে এটা রাগ নয়, অভিমান। তবুও তারা একে অপরের থেকে দূরে থাকার কারণ হিসেবে অভিমানকে দায়ী না করে অভিযোগ করে রাগের উপরে।

 অভিমানি হৃদয় হালকা ছোঁয়ায় বিগলিত হয়ে যায় কারণ অভিমান তো সেটাই যেটা হওয়ার পর থেকে দূরে গিয়েও কাছে আসার বাসনা, মুখ ফিরিয়ে নিলেও শুধু আড় চোখে বার বার দেখার অজানা নেশা, উপড়ে যাওয়া শিকড়ের গভীরভাবে প্রতিস্থাপন করার এক অদম্য ইচ্ছা।  অভিমানের এই সমীকরণ যদি দুটি হৃদয় বুঝে থাকে, তাহলে সে অভিমান হয়ে ওঠে ভালোবাসার বারান্দা। নইলে নিজের জেদ আর ক্ষোভের মাঝে ভালোবাসা বিলীন হয়ে তৈরি হয় নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী গোল দেওয়ার এক অসম প্রতিযোগিতা।

 অভিমানি হৃদয় মানসিকভাবে দূরে গেলেও চোখের আড়ালে যেতে দেয় না একে অপরকে - সেখানেই অভিমানের জয়জয়কার। দূরত্ব অনেক সময় বরং অভিমানের জন্ম দিয়েছে কিন্তু অভিমান দূরত্ব তৈরি করেনি কোন কালেই। গভীর নৈকট্যের আহ্বান জানায় প্রকৃত অভিমান। অভিমানি হৃদয়ের নিজেকে নিরপরাধী জেনেও তা প্রমাণ করার জন্য কোন তৎপরতা থাকে না, থাকেনা কোন উচ্চবাচ্য। অভিমানে নীরবে চোখের পাতায় অশ্রুরা ভিড় করে, কিন্তু প্রতিবাদে কন্ঠ হয় না সুদৃঢ়।  কারণ অভিমান ভালোবাসার বন্ধনে কোথাও যেন এক বিনি সুতোর মালা দিয়ে আবদ্ধ। মালা থেকে অভিমানে পুষ্প ঝরে পড়ে যায়, তবু সুতো ছিঁড়ে দেয় না। তেমন ভাবে অভিমান করতে গেলে উচ্চমার্গের দর্শন আর ভালোবাসার কোমল মানসিকতা থাকা চায়, নইলে অভিমানের নামে চলে সাময়িক অভিনয়ের খেলা। সেই খেলা প্রকট হলে প্রকৃত ভালোবাসা হয় প্রচ্ছন্ন, আসে শুধু ঘৃণা লজ্জা আর নিজের প্রতি নিজেকে চিনতে না পারার অক্ষমতার অভিমান।

 অভিমানি হৃদয় নিজেকে শেষ করে দেবে তবু কাউকে কোনদিন কোন কটুবাক্য বলে না, কাউকে অকারণে আঘাত দেবে না।  তবে বিন্দু বিন্দু অভিমান যখন একত্রিত হয়ে পুঞ্জীভূত হয় তখন সেই অভিমান আর শুধু অভিমান থাকে না, সে অভিমান রাগে-ক্ষোভে পর্যবসিত হয় আর সেই অভিমান থেকে যখন রাগ বা ক্ষোভ তৈরি হয় তখন সেই রাগ বা ক্ষোভ এর সামনে কেউ দাঁড়ানোর ক্ষমতা রাখে না।

রচনাকাল : ২০/৬/২০২১
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 8  China : 1  Europe : 1  Germany : 1  Hungary : 2  India : 133  Ireland : 8  Japan : 1  Russian Federat : 2  
Saudi Arabia : 8  Ukraine : 1  United States : 110  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Bangladesh : 1  Canada : 8  China : 1  Europe : 1  
Germany : 1  Hungary : 2  India : 133  Ireland : 8  
Japan : 1  Russian Federat : 2  Saudi Arabia : 8  Ukraine : 1  
United States : 110  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
অভিমান ও জীবন দর্শন by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৫৪০৭৭৭
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী