সম্পর্ক ও জীবন দর্শন
আনুমানিক পঠন সময় : ৭ মিনিট

লেখক : সনৎকুমার পুরকাইত
দেশ : India , শহর : ডায়মন্ডহারবার

কিশলয়তে প্রথম আত্মপ্রকাশ - ২০২০ , জুন
প্রকাশিত ৯৭ টি লেখনী ৩৮ টি দেশ ব্যাপী ৩৫১৯৫ জন পড়েছেন।
 আমরা বিশ্ব প্রপঞ্চের মাঝে সবাই যেন সবাইয়ের সাথে কেমন এক বিনি সুতোর মালা দিয়ে বাঁধা আছি। আর সেই বন্ধনের নাম সম্পর্ক, হতে পারে তা ধ্বনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক তা কিন্তু একে অপরের সাথে সম্পর্কের আধার। মিত্রতার মাঝেই যে সম্পর্কের সুর পাওয়া যায় শুধু তা নয়, শ্ত্রুতার মাঝেও সম্পর্কের সুপ্ত বীজ লুকিয়ে থাকে, শুধু অনুকূল পরিবেশের অপেক্ষায় থাকে, আর তা যেদিন উপস্থিত হয় সেদিনই সম্পর্কের বীজ অঙ্কুরোদগম হতে থাকে।

 এই সম্পর্কের মাধুর্য বুঝতে গেলে রেলের ট্রাকের দুটি লাইনের সাথে যে সম্পর্ক থাকে তা বিশ্লেষণ করলেই আমরা বুঝতে পারব, সেখানেই অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের সম্পর্ক যতক্ষন রেলের লাইনের মত সমান্তরাল পথে এগিয়ে যায় তার গন্তব্য অনেক দূর এবং স্থিতিশীল হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে এক্ষেত্রে কিন্তু দুজনের মধ্যে সমান এবং সমান্তরাল দূরত্ব বর্তমান থাকে। এমন একটা দূরত্বে থাকে যে একে অপরকে ছুঁতে পারে না আবার এতটা নৈকট্যে থাকে যে একে অপরকে দেখতে পায়, একে অপরের কথা শুনতে পায়। এতে কি হয় একে অপরকে দেখতে দেখতে কিংবা শুনতে শুনতে মোহ তৈরি হয়, কিন্তু মায়া তৈরি হয় না সামান্য দূরত্বে অবস্থান ও না ছুঁতে পাড়ার কারণে। এখন এই মোহ কেমন বুঝতে হলে আপনি একটি কাঁচের দেওয়ালে চোখ রাখুন যার এদিক থেকে ওদিকে দেখা যায় এবং কাঁচের অপরদিকে একটি পোকা বসে আছে নির্বিকারভাবে। তাই দেখে কাঁচের উল্টোদিকে একটি টিকটিকি ওই পোকাকে ধরবে বলে বসে অপেক্ষা করে। কিন্তু এই সমান ও সমান্তরাল দূরত্বের কারণে সে কোনদিন ওই পোকার কাছে পৌঁছাতে পারবে না। তার এই না পারাটাই হল বাস্তবতা, কিন্তু তার এই অপেক্ষা করে যাওয়াটাই হল মোহ। মোহ যদি না কাটে তাহলে ওটার লোভে ও সারাজীবন শেষ করে দিতে পারে, কারণ সেখানেই জন্ম নেবে লালসা। 

 ঠিক তেমনিভাবে আমাদের চলার পথ যদি রেললাইনের মত সমান ও সমান্তরাল হয়ে থাকে তাহলে আমাদের একের প্রতি অন্যের একটা শ্রদ্ধা কাজ করে। কিন্তু রেলের লাইন যদি কোনসময় এই সমান ও সমান্তরাল দূরত্ব ত্যাগ করে কাছে আসে, তৈরি হয় মোহ, লাইন ভেঙে জুড়ে তৈরি হয় জংশন পয়েন্ট যেগুলো অনেককিছু দিয়ে বন্ধন ধরে রাখতে হয়। আবার যদি এই দূরত্ব কোন কারণে বেড়ে যায়, সেখানে ঘটে রেলের বিপর্যয়। ঠিক তেমনি আমরা যখন নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে কাছে চলে আসি, তখন আমাদের একের প্রতি অন্যের জানা শেষ হয়, শুরু হয় অজানা কাহিনী। 

আপনি ভেবে দেখুন, সমান্তরাল দূরত্বে থাকার কারণে একে অপরের ভালো কথা শুনেছে, ভালো কথা বলেছে। তাই সেই সম্পর্ক একটা শক্ত বন্ধনের মধ্যে দিয়ে অনেক দূরত্ব অতিক্রম করেছে। কাছে পাওয়া হয় নি, কিন্তু পাশে চিরকাল পেয়েছে। যখন সেই দূরত্ব কমিয়ে একে অপরের কাছে এসেছে, প্রেম ও ভালোবাসার বন্ধন দিয়ে সেই বিবাহ নামক জংশন পয়েন্ট আটকে রাখতে হয়েছে, নতুবা ঘটেছে বিপর্যয়। আমরা মানুষ চিরকাল একে অপরকে কাছে পাবার তাগিদে পরস্পর পরস্পরের কাছে মুখ লুকিয়ে মুখোশ দেখিয়ে অনেকক্ষেত্রে মিথ্যে আর প্রবঞ্চনার বেড়াজালে নিজের লালসা চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠি। সেখানে অন্য সবাইকে মনে হতে পারে শত্রু, কারণ যেনতেন প্রকারেণ তাঁর স্বার্থ 
চরিতার্থ করা জরুরী মনে করেন। বাস্তবতার মাটি ছেড়ে উড়তে চান হাওয়ায়। এভাবেই ঘটে একে অপরের প্রকৃত স্বরূপ জানা। কৌতূহল মিটে গেলে জাগে অনীহা। কিছু কিছু মানুষের নতুনের সন্ধানে ঘটে স্খলন। প্রকৃত সত্য হল এঁরা কেউ কাউকে ভালোবেসে কাছে আসেন নি, আর ভালো-বাসা তৈরির কথাও ছিল না। যেটা ছিল সেটা হল একে অপরকে দিয়ে তাঁর বাসা টা ভালো করে তুলতে চাওয়া।

 অনেকে বলেন সম্পর্কে এসে তাঁর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হয়, কিন্তু একবারের জন্য কেউ ভাবেন না যে তাঁরা একে অপরে স্বাধীন ছিল সমান ও সমান্তরাল দূরত্বে থেকে। কিন্তু পরস্পর পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও ভরসা থেকে হোক আর লোভ ও লালসা থেকে হোক মোহ আর মায়ার জালে জড়িয়ে নিজে থেকেই ঘোষণা করেছিল নিজ স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে কারুর প্রশস্ত কাঁধে মাথা রাখতে, চওড়া বুকে মুখ লুকিয়ে ফাটিয়ে কাঁদতে কিংবা তাঁর ভালোবাসার ছায়ায় খুঁজে পেয়েছিল শক্ত কোন ডালের নিশ্চিন্ত ছায়া। সেদিন থেকে মনের অজান্তে বলেই দিয়েছিলেন আমি তোমাতেই সঁপে দিলাম এ জীবন যৌবন, কিন্তু মোহ কেটে গেলে উন্মুক্ত হয় জ্ঞানচক্ষু। সদর্পে ঘোষণা করেন যে কেউ কাউকে নিয়ন্ত্রন করতে চাইলে কিংবা জবাবদিহি করতে হলে এই সম্পর্ক রাখা সম্ভব হবে না। সেখানেই হয় সম্পর্কের বন্ধন শিথিল। অর্থাৎ রেলের জংশন পয়েন্টের বন্ধন যদি শিথিল হয় তাহলে অপেক্ষা করে এক বড় বিপর্যয়ের। সেটাই ঘটে আসছে আবহমান কাল ধরে। ত্যাগের মাঝেই ঘটে থাকে প্রাপ্তিযোগ। কেউ যদি মনে করে জিদ আর অভিমানকে সঙ্গী করে জীবন দর্শন তৈরি করে জগতজীবকে শিক্ষা দেবে, তাহলে অনন্ত বিশ্বের কাছে তাঁর সেই ভুল হয়ে যাবে ঐতিহাসিক পরিহাস। জীবশিক্ষা তৈরি করতে হলে, নতুন মার্গ দর্শন করাতে হলে ত্যাগ হল শ্রেষ্ঠ পন্থা। তবে জীবন আপনার, আপনার জীবন আপনি পূর্ণ ভোগের অধিকারী। আপনার জীবনকে আপনি নিজেই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেন, কিন্তু সেটা সম্পর্কের বন্ধনে সম্ভব নহে। এই বন্ধন যদি সত্য হয় তা একটুও বিচলিত হতে দেয় না।

 আমাদের নিত্যদিনের চলার পথে নিত্য নতুন কত মানুষ রোজ দেখা হয় ট্রেনে বাসে ট্রামে। কথা হয়, শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। কিন্তু কেউ কারুর কাছে কর্তব্য পালন করতে যেমন দায়বদ্ধ নন, তেমন কেউ কারুর কাছে কোন অধিকার দেখাতে পারেন না। কারণ ওই একটাই, এঁদের সম্পর্কে সমান ও সমান্তরাল দূরত্ব বিদ্যমান। তাই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থাকলেও যখন জিজ্ঞেস করা হয় দাদা কেমন আছেন? বলতে হয় ভালো আছি। ওইখানে ওঁর বেশী ঝোলা খোলা হবে না। তাই ওই সম্পর্কের জটিলতা কোনকালে আসে না। এটাই রেললাইনের দুটি ট্রাকের মধ্যে সমান ও সমান্তরাল দূরত্বে অবস্থান করে অনন্তকাল পাশাপাশি অবস্থান করে বহুদূরের গন্তব্যে চলে যাওয়ার মতো, তবু নিজেদের মধ্যে এক বিনিসুতোর বন্ধন দিয়ে সম্পর্কের মালা যেমন দেখা যায়, তেমন তাঁদের মধ্যে কোনদিন তুমুল অশান্তি লক্ষ্য করা যায় না। এ এক গভীর প্রেমের নিদর্শন। এভাবেই আমরা কাছে থেকেও দূরে চলে যায়। আর একটা বিষয় মনে মনে ভাবুন, আমরা যখন কাছে আসি তখন আমরা কেউ কাউকে আর দেখি না, শুধু অন্তরে অনুভব করি। মনে করুন আপনি কাউকে ভালোবেসে সোহাগ করতে তাঁকে আলিঙ্গন করবেন, সেখানে খেয়াল করবেন আলিঙ্গনকালে মনের অজান্তে আপনারা দুজনেই জানবেন দুজনের চোখ একবার হলেও বুজে আসবে। কারণ তখন একে অপরের হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে বা অনুভব করতে ব্যস্ত থাকে। আর যদি চোখ না বুজে আসে তাহলে বুঝবেন সেখানে দূরত্ব কিছুটা হলেও বিদ্যমান, আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট। সেখানেই লুকিয়ে সম্পর্কের সবথেকে বড় প্রতারণা। নাটকে মুখোশ পরিধান করে অভিনয়সম হয়ে দাঁড়ায় সেই আলিঙ্গন। থাকে না কোন সজীবতা।

 আবার প্রেম ভালোবাসার সম্পর্কের মাঝে অশান্তি কলহ হলে দেখবেন খুব নিকটে দুজনে অবস্থান করছেন দুজনে, একে অপরের কথা স্বাভাবিক গলায় শুনতে পাবেন। মানে একটু আগে হয়তো তাঁরা একে অপরের সাথে কথা বলছিলেন, পাশের চেয়ারে বসে কেউ তাঁদের কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাঁরা শুনছিলেন। কিন্তু যখন মনোমালিন্য হল, একে অপরের সাথে জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করল, তার কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল খুব জোরে চিৎকার করে গালাগালি করতে লাগলো। প্রশ্ন হল এই কলহের সময় আমরা চিৎকার করি কেন? কারণ আমাদের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বৃদ্ধি না পেলেও মানসিক দূরত্ব বেড়ে গেছে। একে অপরের জন্য নিজের মনের মণিকোঠায় সেই স্থানে আর তাঁকে কেউ বসিয়ে রাখেন নি। তাই তাঁদের মন থেকে জোরপূর্বক চিৎকার করে নিজের কথা শোনাতে বা প্রতিষ্ঠিত করতে উন্মত্ত হয়ে পড়ে তাঁরা। 

 এভাবেই চলে সম্পর্কের টানাপোড়েনের রসায়ন। আর সেই রসায়নে রস প্রদান করতে প্রবেশ করে কিছু তৃতীয় শ্রেণীর ব্যক্তি। কারণ তাঁরা যোগ্য প্রশাসকের মত বিভাজন নীতি চালিয়ে বানরের পিঠে ভাগ করে লুটে খাওয়ার আনন্দ পান। আসলে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাবে তাঁর প্রাপ্য ভাগের পিঠেটুকুও তাঁর বাড়িতে জোটে না ক্ষেত্রবিশেষে। তাই এখানে সেখানে অযাচিতভাবে প্রবেশ করে মানুষের জীবনকে করে বিধ্বস্ত। নিজের জীবনে এঁরা স্বেচ্ছায় মর্যাদা পান নি, এঁরা মনে প্রাণে শান্তিও পান না খুব একটা। মনের অশান্তি দূর করতে নিজেকে অনেক সময় হারিয়ে ফেলেন সংগঠিত ভাবে। যারা দীর্ঘ সম্পর্কের শিকড় উপড়ে ফেলে এই হালকা হাওয়ায় উড়ে আসা নতুন কোন বীজের প্রতি আসক্তি দেখায় তাঁদের সম্পর্কে শুরু হয় জটিলতা, আর যারা সাময়িক অশান্তির পাল্লায় পড়ে দীর্ঘদিনের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করেন না, অন্যের কথায় নিজের কাছের মানুষের সাথে সম্পর্কের জাল ছিন্ন করেন না। তাঁদের সেই সম্পর্কের গভীরতা এত প্রাবল্য পায় যে পরবর্তীকালে তুফান হয়ে গেলেও সেই সম্পর্কের গাছ আর উৎপাটন হতে দেখা যায় না। এটাই হল সম্পর্কের জীবন দর্শন।

রচনাকাল : ২০/৬/২০২১
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।

শেয়ার করুন    whatsapp fb-messanger fb-messanger



যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  Germany : 1  India : 21  Saudi Arabia : 4  Ukraine : 1  United States : 39  
যেখান থেকে লেখাটি পড়া হয়েছে -


Canada : 1  Germany : 1  India : 21  Saudi Arabia : 4  
Ukraine : 1  United States : 39  
© কিশলয় এবং সনৎকুমার পুরকাইত কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সম্পর্ক ও জীবন দর্শন by Sanat Kumar Purkait is licensed under a Creative Commons Attribution-NonCommercial-NoDerivs 3.0 Unported License Based on a work at this website.

অতিথি সংখ্যা : ১০৩৭৭৩৩২
  • প্রকাশিত অন্যান্য লেখনী